গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা করতে করণীয়
Published: 24th, February 2025 GMT
অনেক দিন থেকে আমরা শুনে আসছি—গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়নে গ্রামীণ অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সন্দেহ নেই। কিন্তু দীর্ঘদিন থেকে বিরাজমান অর্থনৈতিক সংকট ও বন্যার প্রাদুর্ভাবে অর্থনীতির এ গুরুত্বপূর্ণ খাতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে কৃষি এবং কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পের (সিএমএসএমই) উদ্যোক্তারা বিপাকে পড়েছেন।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও সুদের হার, ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট প্রভৃতি কারণে এ খাতে অর্থায়ন–সংকটও তীব্র হয়ে উঠেছে। ঋণ প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় ঘুরে দাঁড়াতেও হিমশিম খাচ্ছেন গ্রামীণ উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশের গ্রামীণ এলাকায় ব্যাংক খাতের মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণস্থিতি কমেছে প্রায় ১ দশমিক ১২ শতাংশ। এ অবস্থা থেকে গ্রামীণ শিল্পকে বাঁচাতে হলে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে হবে। তেমনি সরকারের প্রণোদনাও বাড়ানো প্রয়োজন।
আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে এসেছে। প্রথম প্রান্তিকে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল দশমিক ১৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে জিডিপিতে এ খাতের অবদান ছিল দশমিক ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ বন্যা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় কৃষির অবদান কমেছে।
ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, গ্রামীণ এলাকা থেকে গৃহীত ঋণ ওই সব এলাকায়ই বিতরণ করা গেলে অবস্থার উন্নতি হতে পারে। স্থবিরতা কাটাতে হলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণ বাড়াতে হবেদেশের সিএমএসএমই উদ্যোগের বড় একটি অংশ কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়ন ছাড়াই নিজেদের চেষ্টায় গড়ে উঠেছে। কিন্তু গত বছর দুই দফা বন্যায় দেশের প্রায় অর্ধেক জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এ উদ্যোগগুলোয় বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিএমএসএমই খাত। বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে দেশের বিস্তীর্ণ জনপদের কৃষি, ফল-ফসল ও প্রাণিসম্পদ ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে পারছেন না সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তারা। আবার ব্যাংকঋণ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় এ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে গেছে। সচল থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোও দৈনন্দিন পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে। যে কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকা ও ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির জন্য বর্তমানে সহজ অর্থায়ন সুবিধা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন সময় সরকারের দিক থেকে অর্থায়ন বাড়ানো ও সহজ করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবে অনেক সিএমএসএমই উদ্যোগ অর্থায়ন–সুবিধার বাইরে রয়ে গেছে—বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তারা।
পরিসংখ্যান বলছে যে দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশই হচ্ছে সিএমএসএমই খাতের মাধ্যমে। ছোট আকারের কৃষি উদ্যোগ কিংবা পশুপালন খামার, ছোট আকারের উৎপাদনমুখী শিল্প কিংবা সেবা খাতের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের অসংখ্য উদ্যোক্তা নিজেদের স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি আরও অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। এসব উদ্যোক্তার কেউ কেউ ব্যবসায়িক সাফল্যের মাধ্যমে নিজেদের আরও বড় পরিসরে বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমানে প্রচলিত সিএমএসএমই উদ্যোগের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠান স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে। সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নে খাতটির পুরো সম্ভাবনা কাজে লাগানো প্রয়োজন। এ জন্য খাতটির উন্নয়নে দরকার পর্যাপ্ত অর্থায়ন–সুবিধা নিশ্চিত ও তরুণ জনগোষ্ঠীকে সিএমএসএমই উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিতকরণ। তা ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে নীতি সহায়তা এ খাতের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে ইদানীং দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠিত এজেন্ট ও উপশাখা ব্যাংকিং সেবার সম্পূর্ণ সুফল যেন প্রান্তিক উদ্যোক্তারাই পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। বাস্তবে দেখা গেছে, এজেন্ট ও উপশাখা ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামে ঋণপ্রবাহ না বেড়ে উল্টো গ্রামের পুঁজি ব্যাংক খাতে যুক্ত হয়েছে আমানত হিসেবে। সেসব টাকা ঋণ আকারে পেয়েছে শহরাঞ্চলের বিভিন্ন বড় ব্যবসায়ী, যাঁদের সিংহভাগই ঋণখেলাপি। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, গ্রামীণ এলাকা থেকে গৃহীত ঋণ ওই সব এলাকায়ই বিতরণ করা গেলে অবস্থার উন্নতি হতে পারে। স্থবিরতা কাটাতে হলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণ বাড়াতে হবে।
এ উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর উৎপাদন কার্যক্রমে ফিরতে না পারা কৃষক ও খামারিদের জন্য বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করাও প্রয়োজন। সর্বশেষ বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম ফেনী। বন্যায় এখানকার পোলট্রি ও ডেইরি খাতের অন্তত পাঁচ হাজার উদ্যোক্তা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। পত্রিকান্তরে জানা গেছে, বন্যার পর থেকে এখন পর্যন্ত এসব ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রণোদনা, স্বল্প সুদে ঋণদানসহ নানা দাবিতে বেশ কয়েকবার সংবাদ সম্মেলন ও স্মারকলিপি দিলেও এখনো কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়নি। যে কারণে মাংস, ডিম ও দুধের সংকট ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে। সন্দেহ নেই, রাষ্ট্রীয় কোনো উদ্যোগ ছাড়া খাদ্য উৎপাদনে জড়িত গ্রামীণ অর্থনীতির বড় এ খাতকে রক্ষা করা দুঃসাধ্য কাজ। সরকারি প্রণোদনা এ খাতে স্বস্তি বয়ে আনতে পারে। দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা হারানো গতি ফিরে পেতে পারে।
কোভিডকালে আমরা দেখেছি, প্রায় চাঙা গ্রামীণ অর্থনীতি আমাদের পুরো দেশের জন্য একটি শক্তিশালী নিরাপত্তাব্যূহ রচনায় সহায়তা করেছে। অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্সেরও বৃহৎ অংশের সুবিধাভোগীরা গ্রামবাসী। ক্ষুদ্রঋণের উপকারভোগীদেরও বিরাট অংশের বাস গ্রামে। গ্রামই আসলে বাংলাদেশের প্রাণ। তাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও নীতিমালা প্রণয়নেও গ্রামের প্রাধিকার থাকা অনস্বীকার্য ।
● মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র অবদ ন বন য য় ব তরণ ব যবস সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ভূমিকম্প হলে যা করবেন
পরপর দুটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে মিয়ানমারে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস এর তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৭। উৎপত্তিস্থলের ২০ কিলোমিটার দূরে ৬ দশমিক ৪ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প হয়েছে। এর উৎপত্তিস্থল মিয়ানমারের মান্দালয় যা বাংলাদেশে থেকে ৫৯৭ কিলোমিটার দূরে। এতে শুধু মিয়ানমার নয়, এর প্রভাব অনুভূত হয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ডসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে।
ভূমিকম্পের জন্য বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে, এমন মত বিশেষজ্ঞদের। আবহাওয়াবিদদের ভাষ্য, ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া খুব জটিল বিষয়। কোনো নির্দিষ্ট ভূমিকম্পকে সরাসরি নির্ণয় করা যায় না। ভূমিকম্পবিষয়ক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য সরকারের সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।
আবার ব্যক্তিপর্যায়েও ভূমিকম্পের সময় কিছু করণীয় আছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ভূমিকম্পের সময় করণীয় নিয়ে একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এটি দেওয়া আছে।
নিচে করণীয়গুলো তুলে ধরা হলো:
ভূকম্পন অনুভূত হলে আতঙ্কিত হবেন না। ভূকম্পনের সময় বিছানায় থাকলে বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত কোনো আসবাবের নিচে আশ্রয় নিন। রান্নাঘরে থাকলে গ্যাসের চুলা বন্ধ করে দ্রুত বেরিয়ে আসুন। বিম, কলাম ও পিলার ঘেঁষে আশ্রয় নিন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালে স্কুলব্যাগ মাথায় দিয়ে শক্ত বেঞ্চ অথবা শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নিন। ঘরের বাইরে থাকলে গাছ, উঁচু বাড়ি, বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দূরে খোলাস্থানে আশ্রয় নিন। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, হাসপাতাল, মার্কেট ও সিনেমা হলে থাকলে বের হওয়ার জন্য দরজার সামনে ভিড় কিংবা ধাক্কাধাক্কি না করে দুহাতে মাথা ঢেকে বসে পড়ুন। ভাঙা দেয়ালের নিচে চাপা পড়লে বেশি নড়াচড়ার চেষ্টা করবেন না। কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখুন, যাতে ধুলাবালু শ্বাসনালিতে না ঢোকে। একবার কম্পন হওয়ার পর আবারও কম্পন হতে পারে। তাই সুযোগ বুঝে বের হয়ে খালি জায়গায় আশ্রয় নিন। ওপর তলায় থাকলে কম্পন বা ঝাঁকুনি না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে; তাড়াহুড়ো করে লাফ দিয়ে বা লিফট ব্যবহার করে নামা থেকে বিরত থাকুন। কম্পন বা ঝাঁকুনি থামলে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ুন এবং খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিন। গাড়িতে থাকলে পদচারী–সেতু, উড়ালসড়ক, গাছ ও বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দূরে গাড়ি থামান। ভূকম্পন না থামা পর্যন্ত গাড়ির ভেতরে থাকুন। ব্যাটারিচালিত রেডিও, টর্চলাইট, পানি এবং প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম বাড়িতে রাখুন। বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করুন।