এই ৭ আচরণ বা অভ্যাস আপনাকে অনেকের মধ্যে আলাদা করবেই
Published: 24th, February 2025 GMT
১. অন্যের কথার মধ্যে নাক না গলানো
মনে হতে পারে, এ আর এমন কী কঠিন কাজ! কারও কথার মধ্যে বাধা না দিলেই তো হয়। কিন্তু আপাত সহজ এই কাজটাই বেশির ভাগ লোকের পক্ষে করা বেশ কঠিন। আলাপ চলার সময় অনেকে বুঝতেই পারেন না, কখন তাঁরা অন্যের কথার মধ্যে নাক গলাচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা এটা প্রায়ই করেন। কাজটা হয়তো তাঁরা সচেতনভাবে করেন না, কিন্তু করেন। মূলত তাঁরা অন্যের কথায় নাক গলানো বা বাধা দেন একধরনের অনিরাপত্তা বোধ থেকে। আমরা আদতে মনোযোগ চাই। নিজের উপিস্থিতি জানান দিতে চাই। চাই অন্যেরা আমাকে দেখুক, শুনুক, আমি আছি। যখনই এর অভাব ঘটে, তখনই আমাদের মধ্যে একধরনের অনিরাপত্তাবোধ তৈরি হয়। ফলে অন্য কেউ যখন কথা বলে, তখন মনোযোগ নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিতেই আমরা অনিচ্ছাকৃতভাবে আলাপে বাধা দিয়ে ফেলি। নিজে কথা বলে উঠি।
এ ধরনের আচরণ আমাদের প্রতি অন্যের শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট করে। এ জন্য অন্যকে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। নিজে বেশি না বলে অন্যকে বরং জায়গা দিতে হবে। অন্যের কথা শুনতে হবে, যেটা বড় নেতারাও করেন।
মনে রাখতে হবে, নিজের কথাও বলতে হবে, তবে এতে অত তাড়াহুড়ার প্রয়োজন নেই। অন্যকে কথা বলার এই সুযোগদান আপনাকে অনেকের মধ্যে দিন দিন আলাদা করেই তুলবে।
২.গড়পড়তা না হয়ে বিশেষ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন
কোনো একটি বিশেষ বিষয়ে দক্ষ হয়ে ওঠা খুব একটা সহজ নয়। আপনার আশপাশে দেখবেন, অনেকেই প্রায় সব বিষয়েই জানেন বা পারেন, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে? দেখবেন, তাতে অনেকেই বিশেষজ্ঞ নন। তাঁরা গড়পড়তা। তাঁদের চেয়ে আলাদা হতে হলে আপনাকে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠতে হবে।
কোনো বিশেষ বিষয়ে দক্ষ হয়ে ওঠার মানে এটাও যে আপনি অন্যদের চেয়ে অধ্যবসায়ী ও সংকল্পবদ্ধ। আপনি হতে পারেন শিক্ষক, প্রশিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, অভিনেতা, ব্যাংকার, সাংবাদিক কিংবা যেকোনো পেশাজীবী। তবে আপনার বিশেষত্ব কী? আপনি কি সবার চেয়ে আলাদা? কিংবা যিনি আলাদা, তিনি কেন বাকি সবার মতো নন? খেয়াল করে দেখবেন, সব অভিনেতাই সেলিব্রেটি হন না, সব খেলোয়াড়ও চ্যাম্পিয়ন নন। তাই আপনার চারপাশের লোকদের মধ্যে কোনো বিশেষ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করুন। সেটাই আপনাকে আলাদা করবে সহজে।
আরও পড়ুনমুখের আকার দেখে কি আপনার ব্যক্তিত্ব বলে দেওয়া সম্ভব২৩ ডিসেম্বর ২০২৪৩. উপস্থিতিতেই নজর কাড়ুনযেকোনো স্থানে আপনার উপস্থিতি আলাদা করে বুঝিয়ে দিন। সামান্য ব্যতিক্রমী হলেও কিছু করুন। এর মানে এই নয় যে আপনি মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য হাস্যকর, অদ্ভুত কোনো আচরণ করবেন, অথবা অদ্ভুত ধরনের পোশাক পরবেন। তাই এমন কিছু করুন বা পরুন, যাতে ভিড়ের মধ্যে আপনার উপস্থিতি আলাদাভাবে নজর কাড়ে।
আলাদা করে মানুষের নজর কাড়তে গিয়ে অনেক সময় কেউ কেউ হাসির পাত্রে পরিণত হন। সেদিকটায় খেয়াল রাখতে হবে। হয়তো আপনি সাদামাটা পোশাকই পরলেন, কিন্তু টাই হলো আলাদা। হাতঘড়ি, ব্রেসলেট অথবা পায়ের মোজা দুটি কিছুটা ব্যতিক্রমী হলো।
মানুষের মনোযোগ আকর্ষণে আপনি হয়তো কথায় কথায় অট্টহাসি দিলেন না, কিন্তু ঠোঁটের কোণে লেগে রইল স্মিত মিষ্টি হাসি। সারাক্ষণ ভাঁড়ামো করলেন না, কিন্তু পরিচয় দিলেন পরিমিত রসবোধের।
মনে রাখবেন, আপনার নজরকাড়া উপস্থিতির কারণেই আপনাকে আলাদা করে মনে রাখবে অনেক মানুষ।
৪. সমালোচনায় সর্বংসহা হোনবেশির ভাগ মানুষই সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। সামান্যতেই আহত বোধ করেন। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে আলাদা হতে গেলে আপনাকে সমালোচনায় সর্বংসহা হতে হবে, মানুষের আক্রমণে থাকতে হবে অবিচল।
মানুষ বুঝে না বুঝে আপনার সমালোচনা করতে পারে। কিন্তু আপনাকে তা ঠান্ডা মাথায় মোকাবিলা করতে হবে। যে সমালোচনা যৌক্তিক, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের দুর্বলতা শুধরে ফেলুন। আর অযৌক্তিক সমালোচনা এড়িয়ে যান সযত্নে।
সব সমালোচনা হাসি মুখে সামাল দিতে পারলে মানুষ দিন শেষে আপনার হাসিমাখা মুখটাই মনে রাখবে। আর সমালোচনায় বিরক্ত হলে, মানুষ আপনার বিরক্তিভাবটাই মনে রাখবে, এর পেছনের কারণ নয়। সমালোচনা সহ্য করার এই গুণ আপনার আরও আকর্ষণীয় করে তুলবে।
৫. এমন কিছু শেয়ার করুন, যা করতে বুকের পাটা লাগেকিছু মানুষ নিজের দুর্বল দিক তুলে ধরেও মানুষের প্রশংসায় ভাসেন। কেন? কারণ, তাঁরা এমন কিছু শেয়ার করেন, যা করতে বুকের পাটা লাগে। কিছু দুর্বল দিক শেয়ার করলে মানুষ দৃশ্যত আপনার ভেতরে খুঁত খুঁজে পাবে ঠিকই, কিন্তু এটা আপনাকে সামাজিকভাবে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলবে।
ধরুন, আপনি একসময় চরম দরিদ্র ছিলেন। কিন্তু এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। আপনার দারিদ্র্য তুলে ধরলে কেউ কেউ হয়তো এটাকে আপনার দুর্বলতা ভেবে ভুল করবে, কিন্তু বেশির ভাগের কাছেই আপনি সংগ্রামী এবং লড়াকু হিসেবে প্রশংসিত হবেন।
দুর্বল দিক তুলে ধরার ক্ষেত্রে একটা বিষয় মনে রাখতে পারেন, বিষয়টা যেন আপনার হেরে যাওয়া মনোভাবের পরিচায়ক না হয়। বরং তা যেন অন্যদের জন্য হয়ে ওঠে প্রেরণাদায়ী। এমন আপাত দুর্বল দিক আপনাকে অন্যের সামনে সবল করেই উপস্থাপন করবে।
আরও পড়ুনছবিতে প্রথমে কী দেখতে পাচ্ছেন? জেনে নিন আপনি মানুষ হিসেবে কেমন২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫৬. শরীর যেখানে, মনও সেখানেমাঝেমধ্যে খেয়াল করবেন, কিছু মানুষ কোনো অনুষ্ঠানে একত্র হলেও তাঁদের মন সেখানে নেই। তাঁদের শরীর এক স্থানে তো মন আরেক জায়গায়। ফলে তাঁরা মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন, হাসছেন, মিশছেন বটে, আদতে কিছুই করছেন না। তাঁদের মন যেন ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোন্খানে।’
কোনো মিলনমেলায় আপনি ‘ওখানে’ই থাকুন। অর্থাৎ আপনার শরীর যেখানে, মনটাকেও সেখানেই রাখুন। আপনার সামনের মানুষটাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিন। তাঁর কথাই সবচেয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনুন।
আপনার এই মনোযোগ মানুষকে আপনার প্রতি আরও মনোযোগী করবে। আপনার শরীর-মনের এই যৌথ উপস্থিতি আপনাকে অন্যের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণই করবে।
৭. বেশি ভালো ভালো নয়কথায় বলে, বেশি ভালো ভালো নয়। এটা মাথায় রাখুন। সব সময় অতিরিক্ত ভালোমানুষি দেখাবেন না। মাঝেমধ্যে ‘খারাপ’ হোন! ভাবছেন, এ কেমন সুপরামর্শ? শুনুন, সব সময় খারাপ আচরণ করা, আর মাঝেমধ্যে রুদ্রমূর্তি ধারণ করা এক নয়।
অনেক মানুষ সাত চড়েও রা করেন না। ফলে বাকিরা তাঁকে বোকা হিসেবেই চিহ্নিত করে। একটানা এই ভালোমানুষী তাঁর সম্পর্কে মানুষের প্রত্যাশাও বাড়িয়ে দেয়। ফলে কোনো সময় প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সামান্য ফারাকও অন্যরা মেনে নিতে চান না। আবার একটানা ভালো আচরণ মানুষের ভেতরে একঘেয়েমি তৈরি করে, অন্যরাও তাঁকে একঘেঁয়ে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে।
তাই মাঝেমধ্যে সামান্য ‘দুষ্টু’ হওয়ায় তেমন ক্ষতি নেই। এতে সম্পর্কে বৈচিত্র্য আসে। একঘেঁয়েমি কাটে। মানুষও আপনাকে নির্বোধ ভাবায় ক্ষান্তি দেবে। আপনাকে যে চাইলেই ‘ব্যবহার’ করা যায় না, সেটাও লোকজনকে বুঝতে দিতে হবে। আর জানেনই তো, যাকে চাইলেই পাওয়া যায়, অর্থাৎ যার সরবরাহ বেশি, তার চাহিদাও কম।
সুতরাং নিজেকে আলাদা করে তুলে ধরতে মাঝেমধ্যে কম ভদ্র, দুষ্টুমিষ্টি আচরণ করুন। এতে মানুষ আপনাকে আরও ভালোইবাসবে।
সূত্র: মিডিয়াম
আরও পড়ুনজীবনের সবচেয়ে বড় ভুল কোনটি?১৪ এপ্রিল ২০২৪উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ র বল দ ক উপস থ ত মন য গ আপন র এমন ক ন আপন আপন ক ই আপন
এছাড়াও পড়ুন:
হাসিনার পতনের পর নতুন রাজনৈতিক দল গঠন কতটা কঠিন
বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন যে প্রকৃতপক্ষেই কঠিন বা আপাত-অসম্ভব এক বাস্তবতা, সে বিষয় আবারও উঠে এল যোগাযোগ পেশাজীবী ও শিক্ষক খান মো. রবিউল আলমের প্রকাশিত লেখায়। ‘হাসিনার পতনে গ্রামেগঞ্জে প্রভাব ও আওয়ামী কর্মীদের ভাবনা কী’ শীর্ষক ওই লেখায় তিনি দেশের গ্রামাঞ্চলের নির্জলা বাস্তবতাই তুলে ধরেছেন।
খান মো. রবিউল আলমের লেখার মূল বক্তব্য হলো, বাংলাদেশের মানুষ এখনো দ্বিদলীয় বা বড়জোর তৃতীয় দলের বাইরে যে কিছু ভাবতে পারে না, এর নানা কারণ আছে। সেই কারণগুলো দেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবন থেকে তুলে এনেছেন তিনি। সে জন্য তাঁর বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য।
খান মো. রবিউল আলমের লেখা থেকে উদ্ধৃত করা যাক, ‘স্থানীয় জনগণ নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টায় জনগণ বিএনপিকে আগামী দিনের প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করছে। গ্রামীণ রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঠামোয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে জনগণ বিশেষ কিছু ভাবছে না। কারণ, জনগণের রাজনৈতিক আচরণের অভ্যস্ততা কেবল ভোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; জীবন-জীবিকা, সামাজিক নিরাপত্তা, প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা মাড়িয়ে এর শিকড় অনেক গভীরে। জনগণের ক্ষমতাপ্রিয়তা বা ক্ষমতাসখ্যের তীব্র অনুভূতি প্রচলিত রাজনীতির একটি বিশেষ দিক, যার ভিত্তি হলো রাজনৈতিক দলকেন্দ্রিক এক বিশেষ সুবিধাবাদী ব্যবস্থা। মতাদর্শের চেয়ে অনেক বেশি অনুগামী ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে।’
বিষয়টি হলো, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় ৮৫ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতনির্ভর। অর্থাৎ দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। তাঁরা নানাভাবে কমাই-রোজগার করছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের জীবনে রাষ্ট্রের ভূমিকা খুবই সীমিত। সম্প্রতি সরকারের এক জরিপেও উঠে এসেছে, দেশে গত ১০ বছরে অনানুষ্ঠানিক খাতের আকার বেড়েছে, যদিও এই সময় জিডিপিও বেড়েছে কয়েক গুণ। ঠিক সেখানেই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা সামনে চলে আসে। বিশেষ করে বড় বড় শহরের শ্রমজীবী মানুষের জীবন এই নেতাদের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। গ্রামাঞ্চলেও তার ব্যতিক্রম হয় না। উপবৃত্তি, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির মতো বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় আসতে গ্রামের মানুষদের রাজনৈতিক নেতার দ্বারস্থ হতে হয়। সেই সঙ্গে জমিজমার বিবাদ, সালিশ, বিচার—এমন কোনো বিষয় নেই, যার সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সম্পৃক্ততা নেই।
রাজনৈতিক অর্থনীতির এই অমোঘ নিয়ম থেকে কারও নিস্তার নেই। শহরাঞ্চলে এই মানুষের বস্তিতে থাকা, বিভিন্ন ধরনের নাগরিক সেবা লাভ, এমনকি রুটিরুজির সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীরা এমনভাবে জড়িত যে এই ব্যবস্থায় অন্য কারও পক্ষে প্রবেশ করা একপ্রকার অসম্ভব। যদিও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নানাভাবে সেই চেষ্টা করছে বলে প্রতীয়মান হয়।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, জুলাই-আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনে দেশে যে পরিবর্তন এসেছে, শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে তা যতই ফ্যাসিবাদের পতন বা নতুন বন্দোবস্তের সূচনা মনে হোক না কেন, গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে বিষয়টি নিছক ক্ষমতারই পটপরিবর্তন। লেখক বলছেন, ‘একটি পর্যবেক্ষণ হলো, গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা ঢাকার বাইরে নেওয়া সম্ভব হয়নি। শেখ হাসিনার সরকারের পতন ও ভারতে পালিয়ে যাওয়া স্থানীয় জনগণ গণ-অভ্যুত্থানের মুখে একটি সরকারের পতন হিসেবেই দেখছে। গণ-অভ্যুত্থানের মর্মবাণী ঢাকার ফ্রেমে আটকে আছে। এটা মর্মান্তিক ব্যাপার। “রাজনৈতিক বন্দোবস্ত” বা “নতুন বয়ান” কিংবা “অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ” বিনির্মাণের স্বপ্ন মাঠঘাটে নেই।’
লেখকের এই পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে নির্মম বাস্তবতাই উঠে আসে। এই গণ–অভ্যুত্থান যে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক চেতনা বা প্রচারণার ভিত্তিতে হয়নি, বরং সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সাবেক সরকারের নির্মম দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অভূতপূর্ব ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে সেই বাস্তবতার প্রতিভাত হয়।
তা–ও না হয় হলো, এরপর যে বিজয়ীদের আচরণ ও কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তার প্রতিফলন ঘটবে, সেটাই তেমন একটা হয়নি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে বিজয়ীদের আচরণের সঙ্গে সাবেক সরকারের আচরণের বিশেষ তফাত দেখা যাচ্ছে না।
এই বিষয়ও লেখকের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, ‘বিজয়ীদের ঔদ্ধত্য বাড়ছে। উদ্ধত আচরণ জনবিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। বিজয়ী কতটা উন্নত, তা বোঝা যায় বিজিতের প্রতি সে কেমন আচরণ করে তা দিয়ে। বিজয়ের স্বাদ বিজিতদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া কাজের কথা হতে পারে না। বিজয় উদ্যাপনের চেয়ে তার মর্মকে বাস্তবে রূপ দেওয়া জরুরি কাজ। ভেঙে যাওয়া সম্পর্কগুলো, সমাজের গভীর ক্ষতগুলো সারিয়ে তোলা দরকার। সুসম্পর্কের গভীর নেতিবাচক অভিঘাত নিয়ে কোনো সমাজ বেশিদূর এগোতে পারে না।’
লেখকের এই পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে এক গভীর সত্যের উদ্ভাস ঘটে। সেটা হলো, বাংলাদেশের মানুষ ক্ষমতার বাড়াবাড়ি বা ঔদ্ধত্য পছন্দ করে না। আওয়ামী লীগের পতনের অন্যতম কারণ ছিল গ্রামাঞ্চলে দলটির নেতা–কর্মীদের টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাজনিত দুর্বিনীত ঔদ্ধত্য। সেই ঔদ্ধত্য মানুষ কখনোই ভালোভাবে নেয়নি। যখন সময়-সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, এক ধাক্কায় মানুষ সেই দলকে ফেলে দিয়েছে।
এবারই প্রথম নয়, ২০০৭ সালের এক–এগারো সৃষ্টি হওয়ার পেছনেও তৎকালীন বিএনপির নেতা–কর্মীদের চরম ঔদ্ধত্য বড় কারণ ছিল। এক–এগারো হওয়ার পর মানুষ খুশিই হয়েছিল। বড় বড় দুর্নীতিবাজ নেতা-মন্ত্রীকে গ্রেপ্তারের পর মানুষের মধ্যে উল্লাস দেখা গেছে। রাজনৈতিক যোগাযোগে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আবারও সেই বারবার বলা হওয়া সেই ক্লিশে কথাটিই বলতে হয়—ইতিহাসের শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। এই ফাঁদে আমরা সবাই কমবেশি পড়ছি।
আইয়ব খানের মৌলিক গণতন্ত্র ও সুবিধাভোগী-সুবিধাদাতার সম্পর্ক১৯৫৮ সালে ক্ষমতা দখলের পর আইয়ুব খান মনে করেন, পশ্চিমা ধাচের সংসদীয় গণতন্ত্র পাকিস্তানের জন্য অনুপযুক্ত। রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করেন এবং ১৯৬০ সালে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে নতুন ব্যবস্থা চালু করেন। এই ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল কর্তৃত্ববাদী শাসনের সঙ্গে কিছু গণতান্ত্রিক রীতিনীতির মিশ্রণ ঘটানো।
এ ব্যবস্থার অধীন নির্বাচিত মৌলিক গণতন্ত্রীরা কেবল স্থানীয় সরকারের কার্যক্রমই সম্পাদন করতেন না, বরং তাঁরা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নির্বাচকমণ্ডলীর ভূমিকাও পালন করতেন। ১৯৬০ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এই মৌলিক গণতন্ত্রীরাই আইয়ুব খানকে নির্বাচিত করেন।
বিষয়টি হলো, আমাদের মতো কমজোরি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা না থাকায় প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট বা সুবিধাদাতা-সুবিধাভোগী সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র এই প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করে।
স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা (যেমন ভূস্বামী, মাতবর) মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত হন। ফলে তাঁরা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা (যেমন লাইসেন্স, ঋণ, সরকারি চাকরি) লাভ করতেন এবং বিনিময়ে সরকারের প্রতি তাঁদের সমর্থন বজায় রাখতেন। দেশে সেই যে সুবিধাদাতা-সুবিধাভোগীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সেই কাঠামো থেকে আমরা এখনো বের হতে পারিনি। স্বাধীনতার পর মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং একাংশে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা এখনো জারি আছে। দীর্ঘদিনের চর্চা ও রীতিনীতির মধ্য দিয়ে এই ব্যবস্থার মূল অনেক গভীরে চলে গেছে।
ক্ষমতা হারানো ভীতিকরএ ব্যবস্থার অনিবার্য ফল হলো, ক্ষমতা হারানো একধরনের ভীতিকর বিষয়। লেখকের বিবরণে বিষয়টি উঠে এসেছে, ‘ক্ষমতাহীনতার তিক্ত স্বাদ এবং অসহায়ত্ব তাঁদের পেয়ে বসেছে। পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের দুয়ারীবাজারের এক আওয়ামী লীগ সমর্থক জানান, অনেক মামলা তাঁর। এতে তাঁর সমস্যা নেই। সমস্যা হলো ব্যবসা শেষ হয়ে গেছে। আর অর্থনীতি শেষ হয়ে গেলে মানুষের দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। অর্থনীতি ও রাজনীতি কীভাবে মিলেমিশে গেছে, তার চমৎকার ব্যাখ্যা দিলেন তিনি।’
এমনকি নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ক্ষমতা হারানোর পর জীবন বাঁচাতে বিরোধী দলের কর্মীকে সরকারি দলে যোগ দিতে হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, নিজ দলের বড় নেতার কোপানলে পড়ে দলীয় কর্মীদের বাড়িঘর হারিয়ে দেশত্যাগ করতে হয়েছে—এমন ঘটনাও দেখেছি। অর্থাৎ স্থানীয় রাজনীতি সব সময় আদর্শ বা দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে হয় না, বরং স্থানীয়, গোষ্ঠী ও ব্যক্তিস্বার্থ এর মধ্যে জড়াজড়ি করে থাকে। একটি থেকে আরেকটি বিচ্ছিন্ন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক-অর্থনীতির আলোকে বলা যায়, এ পরিস্থিতির উত্তরণে সুশাসন এবং সবার জন্য কমবেশি সম–অধিকার নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
এবার বিশেষ বাস্তবতা ছিল; গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু আগেও আমরা দেখেছি, সরকার পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজিত বা বিরোধী দলগুলোর ওপর নির্মম নির্যাতনের খড়গ নেমে এসেছে। গত ১৫ বছরে বিপুলসংখ্যক বিরোধীদলীয় কর্মীকে ক্রসফায়ারে হত্যা ও গুম করা হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডের বড় একটা নজির হলো, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর চালানো মর্মান্তিক গ্রেনেড হামলা। সেই হামলায় শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী হতাহত হন। সবচেয়ে বড় কথা, ওই ঘটনার মধ্য দিয়ে দ্বিদলীয় ব্যবস্থার অবসান ঘটে। গত ১৫ বছরে যা ঘটেছে, তা মূলত ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়া—এ কথা বললে নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না।
যাহোক, লেখকের পর্যবেক্ষণ কেবল একটি এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এটি পূর্ণাঙ্গ জরিপ বা গবেষণা নয়। যদিও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলা যায়, এ বাস্তবতা বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলের। এ বাস্তবতা স্বীকার করেই নতুন রাজনৈতিক দলকে কাজ করতে হবে।
প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক