বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও অন্যান্য সদর্থক পরিবর্তন আনার বিষয়ে বিস্তর লেখালেখি ও আলোচনা হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাবকে এর জন্য প্রথমত দায়ী করা যায়। রাজনীতিতে মেধাবী, দক্ষ, সর্বোপরি ভালো মানুষের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব।

ছাত্রজনতার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র-সংস্কারের যে পটভূমি তৈরি হয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে নির্মোহ-সৃষ্টিশীল চিন্তাসমূহের সমন্বয়ে রাষ্ট্র মেরামতের একটি বাস্তবায়নযোগ্য রূপরেখা প্রণয়নের কাজ চলছে। সে-প্রচেষ্টায় কিঞ্চিৎ অংশগ্রহণের অভিপ্রায়ে এই লেখার অবতারণা। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা, প্রতিবন্ধকতাবিহীন কার্যকর গণতন্ত্র চর্চা এবং জবাবদিহি ও অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্র পরিচালনার প্রশ্নে এখানে কয়েকটি প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলো।

একটি দেশের রাজনীতির উপর সে-দেশের ভালোমন্দ অনেকাংশে নির্ভর করে। সৎ-যোগ্যদের রাজনীতিতে আসতে হবে; ভালোরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকলে তা ক্রমশ অযোগ্যদের দখলে চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। রাজনৈতিক সংস্কারের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে একটি গ্রহণীয় রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠিত হোক। সদর্থক সংস্কারের পথ ধরে কাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীল রাষ্ট্র ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাক—এটিই জনগণের একান্ত প্রত্যাশা।

তিনশ আসনে সরাসরি নির্বাচন বহাল রেখে মিশ্র পদ্ধতির সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন
পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আলোচিত-পর্যালোচিত হচ্ছে। বিশ্বের অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ পদ্ধতি বিভিন্ন ফরমেটে প্রচলিত রয়েছে। বেশিরভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করণে এটি একটি কার্যকর পদ্ধতি। আমাদের দেশে বিদ্যমান ৩০০ আসনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার পদ্ধতি অক্ষুণ্ণ রেখে, এসব আসনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্য মনোনীত/নির্বাচিত হতে পারেন।

আসনসংখ্যার অনুপাতে নারী আসনসংখ্যা বণ্টিত হওয়ার বিদ্যমান পদ্ধতির পরিবর্তে সারাদেশে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে এ বণ্টন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে। এককক্ষ/দ্বিকক্ষ পার্লামেন্টের বিতর্ক ছাড়াই বর্তমান ব্যবস্থায় ৫০টি আসন বাড়ালেই এর বাস্তবায়ন সম্ভব। এ ব্যবস্থায় সারাদেশে ১% ভোটপ্রাপ্ত দলেরও সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যায়। সদস্য বণ্টনে অর্ধেক নারী সদস্যভুক্তির বিধান করে এই ১০০ আসনের শতকরা ৫০ ভাগ নারীদের জন্য সংরক্ষণ করা যায়।

দীর্ঘ সময় ধরে জাসদের পক্ষ থেকে ৫০০ আসনের সংসদের কথা বলা হয়; পর্যালোচনা-সাপেক্ষে পরবর্তীকালে প্রাপ্ত ভোটের শতকরা অনুপাতে আসনসংখ্যা ২০০টিতেও উন্নীত করা যেতে পারে। ৩০০ আসনের নির্বাচনি ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রেখে রাজনৈতিক দলগুলো প্রাজ্ঞ, মেধাবী পেশাজীবী ও মনোনয়ন-বঞ্চিত উপযুক্ত প্রতিনিধিদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে অর্জিত আসনে মনোনীত করতে পারে। অপরদিকে শতকরা ন্যূনতম ১ ভাগ ভোটপ্রাপ্ত সব রাজনৈতিক দলের সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়, যা অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একধাপ উত্তরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে মর্যাদা ও অবস্থান দিয়ে শাসন-প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা

বাংলাদেশের মতো গণতন্ত্রকামী জনবহুল দেশের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে এদেশের উন্নয়ন ও বিনিয়োগ বহুলাংশে বাধাগ্রস্ত হয়ে আসছে। বহুকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য আমাদের দেশের উপযোগী কার্যকর মৌলিক ভাবনা ও তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত না থাকায় নির্বাচনি এলাকাসমূহে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকে।

সামান্য ভোটে পরাজিত প্রার্থী বা তাঁর সমর্থকদের পক্ষে অনেকসময় জানমাল রক্ষা করা এবং এলাকায় অবস্থান করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই একক দখলদারিত্বের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ৩০০ সংসদীয় নির্বাচনি আসনের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে যদি আইনগতভাবে একটি অবস্থান ও মর্যাদা দিয়ে শাসন-প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা যায়, তবে তা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের জন্য এবং ঐ প্রার্থীর সুরক্ষায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

এক্ষেত্রে প্রতি আসনের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে যদি উপজেলা চেয়ারম্যানের সমান মর্যাদা, ঐ আসনের বাজেট/বরাদ্দের একটি অংশ (এক-পঞ্চমাংশ) প্রদান করা যায়, তবে তা অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র চর্চা, স্থিতিশীলতা ও সুশাসনের জন্য  একটি মাইলফলক হতে পারে। বিজয়ী এবং নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর মোট প্রাপ্ত ভোট বিবেচনায় নিলে তা প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন ব্যবস্থায় রূপ নেয়।

প্রতিদ্বন্দ্বী ৩০০ প্রার্থীর জন্য গাড়ি, ভাতা, বরাদ্দ ইত্যাদি মিলিয়ে যে খরচ হবে, স্থিতিশীল পরিবেশ প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়ন ও বিনিয়োগের তুলনায় তা যৎসামান্য। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সম্মানিত ছায়া সংসদ-সদস্য বা সহযোগী সংসদ-সদস্য বলেও অভিহিত করা যায়। সর্বোপরি দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার স্বার্থে এটি একটি সুদূরপ্রসারী কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। রাষ্ট্রের স্বার্থে রাজনৈতিক পক্ষসমূহ ও সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে পারেন।

অনলাইন গণভোটের ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ

নিরপেক্ষ ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তিবিদদের সহযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে গণভোট গ্রহণের কার্যক্রম কিছু জাতীয় সংকট নিরসনে সহায়ক হতে পারে। প্রতিবার নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠন প্রশ্নে জাতি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এ সংকট থেকে বের হয়ে আসার জন্য রাজনৈতিক দল ও সংশ্লিষ্টদের নির্মোহ ভাবনা ও তার বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে হয়তো একটি সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব। তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রের ভোটার/নাগরিকদের নিবন্ধনকৃত মোবাইলে একটি ইউনিক পাসওয়ার্ড প্রদান করে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সপ্তাহব্যাপী/নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী অনলাইন গণভোটের আয়োজন করা যায়। ইচ্ছুক নাগরিক/ভোটারগণ ভোটার আইডি ও একটি ইউনিক পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে তার মোবাইলের মাধ্যমে একবারমাত্র মতামত দিতে বা ৩টি নাম প্রস্তাব করতে পারেন।

এই মতামত বা সম্মতিই হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বা নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের গণভিত্তি। অনলাইন গণভোটে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের নির্দিষ্ট সংখ্যকের/১০০ জনের তালিকা করে তাঁদের মধ্য থেকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে বা লটারির মাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের উপদেষ্টা, নির্বাচন কমিশনের সদস্য, অন্যান্য সাংবিধানিক পদ ও নির্বাচনকালীন গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োগ দেওযা যেতে পারে। স্বচ্ছ, বিশ্বাসযোগ্য ও প্রশ্নাতীতভাবে এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া (গণভোট, বাছাই ও নিয়োগ) সম্পন্ন হতে হবে। খোলা মন নিয়ে রাজনৈতিক পক্ষসমূহ নির্বাচনের পূর্বে সংকট ও অনিশ্চয়তা পরিহারে এরকম একটি আইনি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেন। পাইলটিং, প্রাকটিস ও পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে যাকে আরও পরিশীলিত ও কার্যকর করে তোলা সম্ভব।

রাষ্ট্র মেরামত বা রাজনৈতিক সংস্কারের পরিবেশ সবসময় পাওয়া যায় না বা তৈরি হয় না। জুলাই বিপ্লবের প্রত্যাশানুযায়ী বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে যেসব ভাবনা ইতোমধ্যে সকলমহলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে সেগুলোকে আইনি ভিত্তি দিয়ে দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়া, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি বিষয়ে একধরনের ঐকমত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। এছাড়া শতকরা ৫১ ভাগ ভোটারের উপস্থিতি না থাকলে পুনরায় নির্বাচনের বিধান রাখা, ভোট প্রক্রিয়ায় জড়িতদের পক্ষপাতিত্ব, কারচুপিসহ ভোটাধিকার হরণের যে-কোনো কার্যক্রমে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন; যাতে নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সবাই নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে বাধ্য হয়।

একটি দেশের রাজনীতির উপর সে-দেশের ভালোমন্দ অনেকাংশে নির্ভর করে। সৎ-যোগ্যদের রাজনীতিতে আসতে হবে; ভালোরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকলে তা ক্রমশ অযোগ্যদের দখলে চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। রাজনৈতিক সংস্কারের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে একটি গ্রহণীয় রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠিত হোক। সদর্থক সংস্কারের পথ ধরে কাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীল রাষ্ট্র ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাক—এটিই জনগণের একান্ত প্রত্যাশা।

কাজী জুলফিকার আলী বিশেষজ্ঞ, সংস্কার ও গবেষণা অনুবিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন র ব চনক ল ন ব যবস থ য় র র জন ত পর য ল চ র অন প ত ক র যকর র জন য সরক র আসন র সদস য গণভ ট গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

সময়সীমা বাড়ানো ও শর্ত শিথিল বাস্তবসম্মত

গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি বহুপক্ষীয় মত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এর অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনপ্রক্রিয়া। বর্তমানে প্রচলিত নির্বাচনসংক্রান্ত আইন ও ২০০৮ সালের নিবন্ধন বিধিমালার অন্তর্নিহিত কঠোরতা সদ্য গঠিত কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নিবন্ধনের সব শর্ত পূরণ করাকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। রক্তস্নাত গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ নীতির হাত ধরে যখন নতুন নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত হচ্ছে, সে মুহূর্তে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে যে সময়সীমা নির্ধারণ করতে দেখা গেছে, তা বাস্তবতার নিরিখে অসংগত, অপর্যাপ্ত এবং নবীন রাজনৈতিক শক্তিগুলোর জন্য কার্যত একপ্রকার নিষেধাজ্ঞারই নামান্তর।

এমন প্রেক্ষাপটে সদ্যোজাত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ আ-আম জনতা পার্টি (বিএজেপি) এবং নতুনধারা বাংলাদেশ (এনডিবি) নিবন্ধনের সময়সীমা বৃদ্ধিসংক্রান্ত যে দাবি তুলেছে, তা বিবেচনা করতে হবে রাজনৈতিক ন্যায়বোধ ও গণতান্ত্রিক ভারসাম্যের নিরিখে।

নির্বাচন কমিশন গত ১০ মার্চ এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনের জন্য আবেদন আহ্বান করে, যার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত। অর্থাৎ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরবর্তী ৪০ দিনকে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের মতো একটি জটিল ও বিস্তৃত প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অথচ প্রায় এক দশক ধরে এ নিবন্ধনপদ্ধতি অকার্যকর ছিল। উপরন্তু এ সময়ের মধ্যেই দেশের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর ও টানা সরকারি ছুটি পড়ে যাওয়ায় প্রশাসনিক গতিশীলতা ও কার্যসম্পাদন চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে।

এ বাস্তবতা বিবেচনায় রাজনৈতিক দলগুলো যে নিবন্ধনের সময়সীমা ন্যূনপক্ষে তিন মাস বাড়ানোর আবেদন জানিয়েছে, সেটি নিছক একটি সুবিধার আরজি নয়; বরং তা বর্তমান বাস্তবতার গভীর উপলব্ধি থেকে উৎসারিত এক গণতান্ত্রিক দাবিমাত্র। নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে এ আবেদনকে আন্তরিকতা ও যুক্তিনিষ্ঠতার সঙ্গে গ্রহণ করা এবং দ্রুত সময়সীমা বৃদ্ধির ঘোষণা প্রদান করা।

উল্লেখ্য, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ইতিমধ্যে নিবন্ধনের কড়াকড়ি শর্তাবলি শিথিল করার পরামর্শ দিয়েছে। কমিশনের মতে, নিবন্ধনের পূর্বশর্ত হিসেবে দেশের ১০০টি থানা বা ৪০টি জেলার স্বীকৃত কার্যালয়, নির্ধারিত হারে নারী প্রতিনিধিত্ব, পাঁচ বছরে একবার করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ ইত্যাদি শর্ত আজকের বাস্তবতায় অনেকটাই ভারসাম্যহীন ও নবীন দলবিরোধী। এ অবস্থায় একদিকে যখন শর্ত পূরণের কাঠামোগত সংস্কারের প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন, তখন অপর দিকে নিবন্ধনের আবেদন আহ্বান এবং এর জন্য কড়াকড়ি সময়সীমা নির্ধারণ একপ্রকার নীতিগত অসংগতি হিসেবেই প্রতিভাত হয়।

রাজনৈতিক পরিসরকে সুসংবদ্ধ ও বহুমাত্রিক করার জন্য কেবল বৃহৎ ও পুরোনো দলগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে নবাগত দলগুলোর সামনে দেয়াল তুলে রাখলে তা গণতান্ত্রিক বিকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। বরং একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের উচিত, রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের প্রক্রিয়াকে সময় ও শর্ত—উভয় ক্ষেত্রেই আরও সহনীয়, বাস্তবসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমুখী করা।

আমরা আশা করি, নির্বাচন কমিশন অবিলম্বে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের সময়সীমা বৃদ্ধি করবে এবং সেই সঙ্গে শর্ত শিথিলসংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো গ্রহণের প্রক্রিয়া দ্রুততর করবে। গণতন্ত্রের শক্তি বহুমতের স্বীকৃতি ও প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির বিস্তারে নিহিত—এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নাগরিকের ভোটাধিকার প্রয়োগের পরিবেশ তৈরি করা, রাজনৈতিক দলের হাত-পা বেঁধে দিয়ে তরঙ্গসংকুল নদীতে সাঁতার কাটতে বাধ্য করা নয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়কে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে: আলী রীয়াজ 
  • সময়সীমা বাড়ানো ও শর্ত শিথিল বাস্তবসম্মত
  • বাম বিকল্প রাজনৈতিক ধারা গড়ে তোলার আহ্বান
  • ‘আমাদের রাজনীতিতে ভুল ছিল বলেই চব্বিশ ঘটেছে’
  • ‘গণমাধ্যম কর্মীদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে’
  • সরকারের সঙ্গে মতপার্থক্য স্পষ্ট হতে শুরু করেছে: মান্না 
  • নির্বাচনের বিকল্প সংস্কার কেন, প্রশ্ন রিজভীর
  • রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের মতপার্থক্য স্পষ্ট হতে শুরু করেছে: মান্না
  • সংস্কার কেন ভোটাধিকার আর গণতন্ত্রের বিকল্প হবে: প্রশ্ন রিজভীর
  • প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠিতে যা বলল বিএনপি