বসতভিটার ধসে পড়া মাটিতে কাদার প্রলেপ দিয়ে মেরামতের চেষ্টা করছিলেন রহিমা বেগম। পাশে দুজন শিশু মাটিভর্তি ঝুড়ি এগিয়ে দিচ্ছিল তাঁকে। কাছাকাছি পৌঁছাতেই ঘরের সামনে অচেনা মানুষ দেখে এগিয়ে আসেন রহিমা বেগম। প্রতিবেদককে বললেন, ‘আমাগের গুচ্ছগ্রামের মানুষেরে দেখতি আইছেন ভাই? সাহেবরা আইসে শুধু ঘুইরে যায় আর আশ্বাস দেয়, কাজের কাজ কিচ্ছু হয় না। আমাগের ঘরের চাইতে গ্রামের মানুষের গরুর ঘর অনেক ভালো।’

কাদামাখা হাতের আঙুলের ইশারায় রহিমা বেগম ভাঙাচোরা ঘর দেখিয়ে বললেন, ‘জায়গাজমি না থাকায় মানুষির আনাছিকানাছি বাস করতাম। সরকারি ঘর পাইয়ে মনে করিলাম একটু ভালোভাবে থাকতি পারবানে। কিন্তু তা আর হইল না। যাবার কোনো জায়গা না থাকায় কষ্ট করি এখনো গুচ্ছগ্রামে পড়ি আছি। কষ্ট সহ্যি করতি না পারি অনেক লোক চলি গেছে। আমরা যারা আছি তাগের দিকি কেউ খেয়াল করে না।’

৯ ফেব্রুয়ারি সকালে খুলনার কয়রা উপজেলার মঠবাড়ি গ্রামের কয়রা নদীর চরে নির্মিত গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পে গিয়ে কথা হয় বাসিন্দা রহিমা বেগমের সঙ্গে। রহিমা বেগমের মতো এমন দুরবস্থা খুলনার কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ নদ ও কয়রা নদীর চরে নির্মিত তিনটি গুচ্ছগ্রামের আট শতাধিক বাসিন্দা। 

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বসতভিটা হারানো ৪৫০ পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরে খুলনার কয়রা উপজেলায় গড়ে তোলা হয় তিনটি গুচ্ছগ্রাম। গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প-২–এর আওতায় গোবরা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের চর ভরাট করে ২২০টি, মঠবাড়ি গ্রামের কয়রা নদীর চর ভরাট করে ১৭০টি এবং শেওড়াপাড়া গ্রামের কপোতাক্ষ নদের চর ভরাট করে নির্মাণ করা হয় ৬০টি ঘর। প্রকল্পের জায়গা ভরাট, ঘর নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ, চুলা নির্মাণ, নলকূপ স্থাপন, পুকুরঘাট নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে সাড়ে সাত কোটি টাকার বেশি খরচ হয়।

তিনটি গুচ্ছগ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, নদীর চরে নির্মাণ করা গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের সমস্যা একই ধরনের। একটিতেও নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা। সব কটির নলকূপ নষ্ট। বিদ্যুতের খুঁটি ও তার থাকলেও অধিকাংশ ঘরে নেই বিদ্যুতের সংযোগ। জোয়ারের পানিতে ডুবে অধিকাংশ ঘরের মেঝে ও বারান্দার মাটি সরে গেছে। মরিচা ধরে টিনের বেড়া ক্ষয়ে ফাঁকা হয়ে আছে। নেই যোগাযোগের রাস্তা। পানি জমে আছে কিছু ঘরের সামনে। এত সংকট নিয়ে সেখানে থাকতে চান না উপকারভোগীরা। এরই মধ্যে অনেকে চলে যাওয়ায় ফাঁকা পড়ে আছে শতাধিক ঘর।

সম্প্রতি কয়রার শেওড়াপাড়া গ্রামের কপোতাক্ষ নদের চরে নির্মিত গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের সামনে পৌঁছাতেই ছুটে আসেন বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ। নানা ধরনের সমস্যার কথা তুলে ধরেন তাঁরা।

এই সময় শেওড়াপাড়া গ্রামের গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা পারভীন বেগম বলেন, ‘এই ভাঙা ঘরে দুই ছেলেমেয়ে আর প্রতিবন্ধী স্বামীকে নিয়ে  কষ্টে বাস করতিছি। নিজির গতর খাটায়ে আয় করে খাবার জোগাড় করতি হয়। অসুখ–বিসুখ লাইগেই আছে। টাকার অভাবে চিকিৎসাও করাতি পারিনে। আমাগের তিন কুলি কেই নেই। যাবারও জাগা নাই।’

গুচ্ছগ্রামগুলোর ঘর সংস্কার করার বিষয়ে কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাস বলেন, ‘আমি নিজেও দেখেছি, গুচ্ছগ্রামের ঘরগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। মানুষ থাকার মতো পরিবেশ নেই। তবে ঘরগুলো সংস্কারের জন্য এ মুহূর্তে কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। আমার হাতে বরাদ্দ থাকলে অন্তত মেঝেটা পাকা করে দিতাম। আমি ঘরগুলো মেরামত বা পুনর্নির্মাণের জন্য জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করব। একটি প্রাক্কলন তৈরি করে সেখানে পাঠাব। আশা করি, খুব দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হবে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: উপজ ল র কয়র

এছাড়াও পড়ুন:

বিলীন হওয়ার পথে চার গ্রামের একমাত্র বিদ্যালয়টি

যমুনা নদীর ভাঙনে বিলীন হওয়ার পথে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চর ডাকাতিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ভাঙতে ভাঙতে নদী এখন বিদ্যালয়ের ভবনের কাছে চলে এসেছে। দুই দিন ধরে বৃষ্টি হওয়ার কারণে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ায় বিদ্যালয়ের একমাত্র পাকা ভবনটি এখন যেকোনো সময় বিলীন হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সোমবার সকালে স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েক মাস ধরে ভাঙন চললেও ২৮ মার্চ থেকে ভাঙন ব্যাপক আকার ধারণ করে। নদীর ভাঙনে বিদ্যালয়টির আশপাশে অর্ধশত বসতঘর ও বিস্তীর্ণ জনপথ বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের ঝুঁকি থাকায় বিদ্যালয়টির আশপাশের লোকজন বসতভিটা ভেঙে নিয়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন।

চর ডাকাতিয়াপাড়া এলাকার কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী শোয়েব হোসেন বলেন, চর ডাকাতিয়াপাড়া, মাগুরিহাট, ফারাজিপাড়া ও কিসের মোড় গ্রামের একমাত্র সরকারি বিদ্যালয়টি এটি। চারটি গ্রামের শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়টিতে পড়ালেখা করে। ভাঙন বিদ্যালয়ের পাকা ভবন থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে আছে। বৃষ্টি হওয়ার পর থেকে ভাঙন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। কিছুক্ষণ পর পর নদীর পাড় বিশাল আকার ধরে পানিতে ভেঙে পড়ছে। তাই ভয় ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে নদীপারের তিন শতাধিক পরিবার।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার ভাষ্য, দীর্ঘদিন ধরে উপজেলার খোলাবাড়ি থেকে চরডাকাতিয়া হয়ে বড়খাল পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন চলছে। ওই অংশের মধ্যে খোলাবাড়ি, হাজারী, মাগুরিহাট, চর মাগুরিহাট, খানপাড়া, মাঝিপাড়া, ডাকাতিয়া গুচ্ছগ্রাম, চরডাকাতিয়া ও চর ডাকাতিয়াপাড়ার গ্রামের কয়েক হাজার বসতভিটা ও শত শত একর ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। মাঝেমধ্যে কয়েকটি স্থানে পাউবো শুধু তীব্র ভাঙনের সময় কিছু জিও ব্যাগ ফেলেছে। কিন্তু স্থায়ীভাবে ভাঙনরোধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ওই সব গ্রামের অবশিষ্ট বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

চর ডাকাতিয়াপাড়া বাসিন্দা হামিদুল হকের বসতবাড়ি গত বুধবার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। তিনি এখন ওই এলাকার এক আত্মীয়য়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলেন, সব কৃষিজমি অনেক আগেই নদীর মধ্যে গেছে। শুধু বাড়ির ভিটাটুকুই ছিল। তা–ও নদী হয়ে গেল। নদীভাঙনে সব শেষ। এখন থাকার জায়গাও নেই। অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৩ সালে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হয়। ২০১৫ সালে বিদ্যালয়ে একটি শহীদ মিয়ারসহ সুন্দর একটি পাকা ভবন নির্মাণ হয়। ভবনে অফিসসহ চারটি কক্ষ আছে। বিদ্যালয়ে ১০২ শিক্ষার্থী পড়ে। নদীভাঙনের আগে বিদ্যালয়ের প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী ছিল। বিদ্যালয়ে পাঠদান করেন ৬ জন শিক্ষক।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফাতেমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, নদীর ভাঙন বিদ্যালয় থেকে অনেক দূরেই ছিল। কয়েক মাস ধরে ভাঙতে ভাঙতে একদম বিদ্যালয়ের কাছে চলে আসে। বিদ্যালয়ের আশপাশে বহু বসতবাড়ি ছিল। সেসব বসতবাড়িও বিলীন হয়েছে। ভাঙন এখন বিদ্যালয়ের ভবনের একদম কাছে। মনে হচ্ছে না বিদ্যালয়টি ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের জামালপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান বলেন, ইতিমধ্যে ওই এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। ভাঙনরোধে ইতিমধ্যে ওই এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলার কাজ চলছে। বিদ্যালয়ের ভবনটি রক্ষায় সেখানেও জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে, যাতে বিদ্যালয়টি রক্ষা পায়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিলীন হওয়ার পথে চার গ্রামের একমাত্র বিদ্যালয়টি