এই প্রজন্মের কথাসাহিত্যিক হামিম কামাল। মানুষের অস্বাভাবিক যাপনকে লেখায় তুলে ধরেন আদি ভাব আর সাম্প্রতিক ভাষার মাধ্যমে। চলতি বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার গল্পগ্রন্থ ‘ত্রিস্তান’। নতুন বইয়ের প্রেক্ষাপট, গল্পভাবনা আর ভাষাভাবনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেছেন হামিম কামাল। সাক্ষাৎকার গ্রহণে স্বরলিপি

রাইজিংবিডি: আলোচনার শুরুটা হোক আপনার গল্পের ভাষা নিয়ে। আপনার গল্পে একটি লাইনে যখন ‘পানি’ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে পরের লাইনে দেখা যায় বর্ণনায় পানির বিবর্তনের রূপ গল্পের রূপক হয়ে ওঠে এভাবে যে, মেয়েটি জমে গেলো। একটি মাত্র শব্দ দিয়ে দূরত্ব ছুঁয়ে ফেলতে পারেন। এ ব্যাপারটা অনেকটা কাব্যিক। আবার জনপদ কেন্দ্রিক ভাষার যে বিভাজন সে বিষয়েও আপনি খুব সচেতন। আপনার গল্পভাবনা এবং ভাষাভাবনা সম্পর্কে জানতে চাই।
হামিম কামাল: গল্প-ভাবনা নিয়ে একজন কবি আমাকে প্রশ্ন করছেন। কাব্যলক্ষণ তিনি ঠিক চিহ্নিত করে ফেলেছেন। আমার কাছে অস্বাভাবিক যে-কোনো যাপন বা অভিযাত্রাই গল্প। অবশ্যই শোভনসীমার ভেতর তাকে অশোভন হতে হবে না, সে নরকপ্রতীম অশোভনও হতে পারে। আমার কাছে ভালো লাগে এমন গল্প, যেখানে প্রকৃতি তার রহস্যমিতা আঁধার রূপ নিয়ে উপস্থিত থেকে মানুষকে বিব্রত ও আশীর্বাদ করতে থাকে যুগপৎ। মানুষ বারবার যখন অপ্রস্তুত অবস্থায় অস্বাভাবিকতার মুখে পড়ে, আত্মরক্ষার অংশ হিসেবেই সে ভাষিক প্রতিরক্ষার একটা জগৎ নির্মাণ করে। সেই জগৎ হচ্ছে গল্পের জগৎ। তাই আমরা দেখি যে কোনো রকম প্রচারণা কোনো একটি গল্পের দ্বারস্থ। গল্পের এমন উপযোগের ব্যাপার রয়েছে। সমাজে যে কোনো শিল্পের উপযোগচিন্তা অনিবার্য। মানুষ একটা অপরূপ চিত্রকর্মের পাশ দিয়ে চলে যেতে পারে, কিন্তু ক্ষুধায় তাকে অন্নসংস্থান করতেই হয়, তার পাশ দিয়ে সে নির্বিকার চলে যেতে পারে না। গল্প হচ্ছে ভাষিক ক্ষুধার অন্নসংস্থান, লালনীয়, তাই সাহিত্যকে মানুষ তার ‘সহিত’ বহন করে চলেছে। ধারণা দেওয়া হয় কোনো ধরনের যাপন, অভিযাত্রা বা পরিবর্তনের বাইরে গল্প হতে পারে না। আসলে গল্পের অল্প কিছু কাঠামোর সঙ্গে আমাদের মস্তিষ্কের পরিচয় ঘটেছে। আমার কাছে গল্প মাত্রই ‘একটা পরিবর্তন কিংবা অভিযাত্রা না অথবা পরিবর্তনের জন্য অভিযাত্রা না কিংবা অর্জন-বর্জনের লেখচিত্রও না। গল্প হলো এমন একটুকরো লেখা যেখানে আবেগ প্রবিষ্ট হয়েছে। আবেগ প্রবিষ্ট হলে প্রবন্ধও গল্পমূল্য পায়। গল্পকে জৈবযৌগ হতে হবে। শরীর যেমনই হোক, গল্প হতে হলে তাতে প্রাণ থাকতে হবে। এমনকি মস্তিষ্কও না থাকতে পারে, কিন্তু সঞ্চালনশীল হৃদপিণ্ড থাকতে হবে। গল্পে সেই হৃদপিণ্ড হলো অনুভূতি। রাঙামাটির পাহাড় ধসিয়ে দেওয়া বৃষ্টির বর্ণনা অর্থহীন হয়ে যাবে, যদি না তাতে কোনো না কোনো অনুভূতিরস সঞ্চারিত হয়। মানুষের মন পর্যবেক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়া-উন্মুখ।  বৃষ্টির বিবরণে তখনই তার প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনুভব জাগে যখন সেই বৃষ্টি দেখে মনে ভয় জাগে বা আনন্দ অনুভূত হয়। “অবিশ্রাম বৃষ্টি ঝরছে”— এটা গল্প নয়। “আমার হৃদয়ের কান্না টের পেয়েই কি অবিশ্রাম বৃষ্টি ঝরছে?”— এটা গল্প। এমন মুহূর্তেই তথ্যচিত্র হয়ে ওঠে চলচ্চিত্র, বিবৃতি হয়ে ওঠে অঙ্গীকারনামা। তাতে আবেগ প্রবিষ্ট হয়েছে। শব্দনির্মিত শবদেহে প্রাণ সঞ্চারিত হলে তা গল্প, গল্প উৎকৃষ্ট ভাষাকে আশ্রয় দিলে তা সাহিত্য। ভাষা-ভাবনা সম্পর্কে বলতে পারি যে- মানুষ মস্তিষ্কে ভাব নিয়ে জন্মায় এবং ভাষা সে জন্মের পর অর্জন করে। ভাব যদি হয় আদি, ভাষা তবে সাম্প্রতিক। ভাব যদি হয় অনন্ত, ভাষা তবে সীমাবদ্ধ। অনন্ত ভাব ও সীমাবদ্ধ ভাষা নিয়ে মানুষ কেমন বিপদে পড়েছে তা বোঝা যাবে, যখন দেখা যাবে সেই বিপদটুকু ঠিকভাবে ব্যক্ত করার মতো ভাষা তার সংস্থানে নেই। একি কাণ্ড! কোথায় গেল এতো ভাষার বড়াই? মানুষের বড় বিপদ। টের পাবে কিন্তু বলতে পারবে না সবটুকু, অনুভব করবে কিন্তু ব্যক্ত করতে পারবে না সবটা, এই হলো তার নিয়তি। সে ক্ষুধার জন্য প্রাণি হত্যা না করে পারে না, কিন্তু হত্যা করতে তার ভালোও লাগে না, আবার এই পরিহাসের বিপরীতে না খেয়ে মরে যাওয়াও অন্যায্য মনে হয়। নাহ, এই ভাব ব্যক্ত করতেও ভাষা যথেষ্ট নয়। এতো অ-যথেষ্টতার পরও ভাষা টিকে থাকে, বজায় থাকে, সাহিত্যের উপলক্ষ হয়, কারণ? একটি বিশেষ বিভব পার্থক্য সদা ক্রিয়াশীল, তাই। এটা প্রকৃতির নিয়ম। যতক্ষণ বিভবপার্থক্য বজায় থাকে, ততক্ষণ ধারা অবিরত থাকে। তড়িৎ বর্তনীগুলোতেও উচ্চবিভব থেকে নিম্নবিভবে আধানের প্রবাহ চলছেই। মানববর্তনীতেও তাই। ভাষা হলো সেই আধান। ভাব আছে, ব্যক্ত করার রসদ নেই, ফলে চেষ্টাপ্রবাহ চলছেই, চলছেই। একারণেই ভাষা, ভাসা। প্রবহমান ভাবের ওপর সে ভাসমান। তাই ভাবের নদীতে সে একটা ভেলামাত্র, যাত্রাশীল। একেক ভেলার বাঁধুনি গাঁথুনি একেকরকম। আমার ভেলার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত বোঝাপড়া কেমন? একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারি। একসময় আমি খুব সংকুচিত হয়ে থাকতাম। মনে হতো, নাহ, আমাকে নিয়ে হবে না। মানুষকে বোঝাতে পারছি না এ মুহূর্তে আমি আপেল চাই না, কলার মোচা চাই। বলতে চাই ‘বল’ অর্থাৎ শক্তি, কিন্তু মানুষ বোঝে তারা (মা তারার আমি ভক্ত আমি শাক্ত, সেটা ঠিক আছে)। এখন আমি মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে, সেই সংকোচের নাগরিকত্ব কেড়ে, তাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছি। তার জন্য আমার মায়াই হয়। জগতে যারাই ভাষা নিয়ে সংকুচিত হয়ে থাকেন, তারা ভাবতে পারেন, কারো ভাষা যত সহজবোধই হোক, তা একদিন দুর্বোধ্য গণ্য হবে। যত দুর্বোধ্যই গণ্য হোক, তার একদিন পাঠোদ্ধার হবে। তবে দুর্বোধ্য বা পাঠেদ্ধার হওয়া কোনোটিই সে নিয়ন্ত্রণ করে না।  সুতরাং নিজেকে নিজের প্রথম শ্রোতা হিসেবে মনে রেখে, যেভাবে নিজেকে শুনে সুখ হয়, সে পথে মুখের ভাষা, লেখার ভাষা নির্ধারণ করছি, এখন পর্যন্ত।  

রাইজিংবিডি: ২০২৫ বইমেলায় আপনার নতুন-পুরোন কি কি বই থাকছে?
হামিম কামাল: ২০২৫ এ আমার নতুন বইগুলোর ভেতর থাকছে গল্পগ্রন্থ ত্রিস্তান, এক সন্ধ্যায় শ্যামশ্রী রায়। উপন্যাস দস্তইয়েভ্‌স্কির সঙ্গে দ্বিমত, লিন্ডার বাগানবিলাস, জাদুকরী ভ্রম, কারখানার বাঁশি ও জঠর।

আরো পড়ুন:

বইমেলায় শাওন মাহমুদের ‘থার্টি সেকেন্ড কোয়ান্টাম থিওরি’

দিনশেষে বই একটি সৃজনশীল পণ্য: পলাশ মাহবুব

রাইজিংবিডি: ত্রিস্তানের প্রেক্ষাপট জানতে চাই
হামিম কামাল: ত্রিস্তানের প্রেক্ষাপট দুই পথে বলা যায়। প্রথম পথ- ঢাকায় জন্মে বড় হয়ে ওঠার কারণে এখানকার সৌন্দর্য ও কদর্যতা দুটোই হয়ে উঠেছে আমার নিজ শ্যামলা রঙের মতোই স্বাভাবিক। চট করে প্রশ্ন জানে না, কেন শ্যামলা হলাম। এর পেছনে আমার ভূগোল কী, পূর্বপ্রজন্ম কারা। খাবার টেবিলে বসেছি, আনমনে উদর-উপাসনা করছি। যখন রান্না করা লাল ডিমপাড়া মুরগির সোনালি মাংস নিয়ে বিলাসী আমি, মনেই পড়ছে না আমার খাদ্যাভাসে কবে থেকে কাঁচা মাংস বর্জিত হলো। রসুই ঘরে কবেই বা ঢুকল আগুন।  মনে না পড়লেওে আমি আমার রূপে, আমার গ্রহণে এক মুহূর্তের জন্য ধারাবিচ্ছিন্ন হইনি। ধারাবিচ্ছিন্ন সেদিনও হবো না, যেদিন আমরা ধরাবিচ্ছিন্ন হবো। কারণ সূক্ষদেহে, কি কারণদেহে, কি স্থূলদেহে, যেভাবেই থাকি না কেন, আমরা মহাজাগতিক দেহের অংশবিচ্ছিন্ন কখনো হব না। যা কিছু স্বাভাবিক, যা কিছু মানানসই, সব কিছু অভ্যস্ততায় পর্যবসিত হবে। তাহলে আমি বাঁচব কী করে। একটা প্রশ্নকারী মনকে কোথা থেকে ভাড়া করে সারাক্ষণ নিজের বিরুদ্ধে লেলিয়ে রাখব, বুঝতে পারি না। তবে টের পাই, অভ্যস্ত শহর ও অভ্যস্ত সুন্দর তার অভ্যস্ততা বিষ থেকে আমাকে রেজাই দেয়, যখনই সংখ্যারেখার অন্য অক্ষে যাত্রা করি। যখন কল্পনা করি ‘ঢাকা আর ঢাকা নহে, ইহা ত্রিস্তান’, তখন অনেকটাই সুরাহা হয়। ঢাকাকে ত্রিস্তানের মুখোশ পরাতে একটা যাত্রা দরকার হয়। যাত্রা আনন্দ দেয়, যাত্রা ক্ষয়ও করে। আনন্দ নিজেকে চালাতে দুঃখের জ্বালানি ব্যবহার করে, ক্ষয় তার নিজের নিয়মে অর্জনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসেবে আবির্ভূত হয়। ত্রিস্তানের অনেক ‘কখন’, ‘কেন’ ও ‘কিভাবে’র যাত্রা এ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে যে যাত্রা আনন্দ দেয়, ক্ষয়ও করে। ফরাসী ত্রিস্ত ধাতুর থেকে আসা ত্রিস্তান তাই যুগপৎ ‘দুঃখী’ ও ‘শক্তিমত্ত’, ঈশ্বর যেমন। প্রকারান্তরে ত্রিস্তান এক ঐশ্বরিক শহর। যার অধিবাসীরা শক্তিমত্ত, দুঃখী। দুঃখ সে পায় এবং নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে জানে। এ গেলো প্রেক্ষাপটের একরকম ব্যাখ্যা। প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যার দ্বিতীয় পথ- এখানে অবাস্তব, পরাবাস্তব, অধিবাস্তব, বাস্তব পটে কখনো ক্লিষ্ট নগর জীবন, আবেগবর্জিত জীবনের ভয়, পরাজয়ের ভয়, সহিংসতা, মহামারী, সামাজিক অবিচার প্রভৃতি প্রেক্ষাপট হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

রাইজিংবিডি: আপনি লেখা এবং পড়ার মধ্যে কীভাবে সমন্বয় করেন?
হামিম কামাল: এই সমন্বয় সাধনে বোধহয় আমি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ব্যর্থ। যতক্ষণ যাত্রাপথে থাকি, পড়ি, যখনই গন্তব্যে পৌঁছাই, লিখি।

রাইজিংবিডি: তরুণ কথাসাহিত্যিকদের কার কার লেখা আপনার ভালো লাগে?
হামিম কামাল: ভালো লাগা আপেক্ষিক বিষয় তাই এই প্রসঙ্গে নাম উল্লেখ করতে চাইছি না। তবে পাঠকদের আমি অনুরোধ করব, যদি করেন তরুণ অরুণ-আলোর সন্ধান, আছে সংস্থান— হাসান মাহবুব, আনিফ রুবেদ, সুমন মজুমদার, ইরাজ ইশতিয়াক, ইমরান খান, আশান উজ জামান, কামরুল আহসান, জিল্লুর রহমান সোহাগ, কিযী তাহ্‌নিন, মাহবুব ময়ূখ রিশাদ, সুহান রিজওয়ান, মাহরীন ফেরদৌস, মোজাফ্‌ফর হোসেন, অলাত এহসান, রোমেল রহমান, এনামুল রেজা, রিফাত আনজুম পিয়ার ভেতর। এদের গল্প-উপন্যাস পড়ে দেখতে পারেন। ক’জন তরুণ কবির রচিত কথাসাহিত্য পড়ার অনুরোধ থাকবে, তারা— নির্ঝর নৈঃশব্দ, মাজহার সরকার, স্বরলিপি, কুশল ইশতিয়াক, হাসনাত শোয়েব, নাহিদ ধ্রুব, তাসনুভা অরিন, নুসরাত নুসিন। আরো বেশ কিছু নাম আছে, পরে মনে পড়ার পর, হায় কেন এ নাম বলিনি বলে হাত কামড়াতে হতে পারে। এদের ভেতর কেউ কেউ আবার আছেন, যাদের এখনো তরুণ জ্ঞান করছি বলে খুশি হয়ে উঠতে পারেন। কেউ কেউ আবার রেগে উঠতে পারেন। তাদের জন্য বাণী— বিষাদপ্যমৃতং গ্রাহ্যং! বিষ থেকে অমৃত গ্রহণ করুণ না! চাণক্যবাণী!

ঢাকা/লিপি

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র জন য আনন দ আপন র

এছাড়াও পড়ুন:

পবিত্র রমজানের শিক্ষা বিস্তৃত হোক জীবনব্যাপী

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের দ্বিতীয় স্তম্ভ হলো সালাত বা নামাজ। ইমানের পরেই নামাজ। পবিত্র রমজান মাস হলো নামাজের মাস, যেমন তারাবিহর নামাজ ও কিয়ামুল লাইল নামাজের পাশাপাশি পবিত্র রমজানে সাহ্‌রির বদৌলতে তাহাজ্জুদ নামাজের অভ্যাস গড়া সহজ হয়; এশা ও ফজরের নামাজ জামাতে পড়ার সুযোগ বৃদ্ধি পায়। ফজরের নামাজ আগেভাগে পড়ে ঘুমানোর কারণে সকালে ইশরাক নামাজ পড়ার সুবিধা হয়।

পবিত্র রমজানের কারণে কাজের চাপ কম থাকায় চাশত নামাজ ও জোহরের আগে আওয়াবিন নামাজ আদায়ের সুযোগ হয়। বিকেলে অফিস বা কর্মস্থল থেকে আগে ফেরার কারণে আসরের নামাজ জামাতে পড়া যায়। একসঙ্গে ইফতার করার সুবাদে মাগরিবের নামাজের জামাতও পাওয়া যায়। অন্যান্য নফল নামাজও বেশি পড়া হয়। পবিত্র রমজানেই নামাজের পূর্ণতা আসে।

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের তৃতীয় স্তম্ভ হলো জাকাত। সাহাবায়ে কিরাম পবিত্র রমজানেই জাকাত প্রদান করতেন। পবিত্র রমজানে জাকাত প্রদানে চান্দ্রবর্ষের হিসাব অনুযায়ী সঠিকভাবে জাকাত প্রদান করা সহজ হয়।

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের চতুর্থ স্তম্ভ হলো হজ। পবিত্র রমজানে ওমরাহ পালন করলে নবীজি (সা.)–এর সঙ্গে হজ করার সমান সওয়াব পাওয়া যায়। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের পঞ্চম স্তম্ভ হলো সিয়াম বা রোজা। রোজা হলো পবিত্র রমজানের প্রধান অনুষঙ্গ। আগুন যেমন সোনাকে বিশুদ্ধ করে, তেমনি রোজা ইমানদারের কামনা–বাসনাকে দহন করে তাঁকে খাঁটি বান্দায় পরিণত করে।

রোজার ফিদইয়া পবিত্র রমজানেরই অংশ। রোজা একটি শারীরিক ও মানসিক ইবাদত। কিন্তু অসুস্থ ও দুর্বল ব্যক্তির জন্য কাজার পাশাপাশি অপারগতায় ফিদইয়ার বিধান রাখা হয়েছে, যা আর্থিক ইবাদত। এতে বোঝা যায় রোজার পরিধি কত ব্যাপক।

রোজার কাফফারা পবিত্র রমজানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রোজা শারীরিক ইবাদত হওয়া সত্ত্বেও দুর্বলচিত্তের ব্যক্তি যদি রোজা ভঙ্গ করেন, তবে তাঁর জন্য কাফফারার বিধান রয়েছে। এটি হলো দাস মুক্তি দেওয়া অথবা ৬০ জন গরিবকে দুই বেলা পরিপূর্ণ আহার করানো অথবা একাধারে ৬০টি রোজা রাখা। অর্থাৎ যদি কেউ রমজান মাসের একটি রোজা ভঙ্গ করেন, তবে তাঁকে ৬০ দিনের রোজা রাখতে হবে অথবা কাফফারা আদায় করতে হবে। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, দান–খয়রাত ও সমাজকল্যাণই পবিত্র রমজানের অন্যতম উদ্দেশ্য।

রোজা শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হয়। দাতা ও গ্রহীতার সুবিধার্থে পবিত্র রমজানেও এটি প্রদান করা যায়। ঈদের সঙ্গে ফিতরার সম্পৃক্ততার কারণে এর নাম হয়েছে ঈদুল ফিতর। সদকাতুল ফিতর হলো ঈদের আনন্দ সর্বজনীন করার উপায়। ধনী–গরিব সবাই যেন ঈদের আনন্দে শামিল হতে পারেন, সে জন্য এই ব্যবস্থা। সদকাতুল ফিতর পবিত্র রমজানে রোজা পালনের শুকরিয়াস্বরূপ এবং এটি রোজাকে পূর্ণতা দেয়।

পবিত্র রমজানের বিশেষ উপহার হলো ইতিকাফ। মানবজীবনে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের অন্যতম মাধ্যম হলো ইতিকাফ। পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশকে ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা কিফায়া। এখান থেকেও পবিত্র রমজানের মহিমা বোঝা যায়। এক দশকের কম সময়ের ইতিকাফ নফল হলেও এই ইতিকাফ অন্য সময়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি ফজিলতের। ইতিকাফ বছরের যেকোনো সময় করা যায়, তবে সর্বনিম্ন সীমা হলো এক দিন অর্থাৎ সূর্যাস্তের আগে থেকে পরের দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত।

পবিত্র রমজানের অনন্য উপহার হলো শবে কদর। এটি এমন এক রাত, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। হাজার মাস মানে প্রায় ৮৩ বছর ৪ মাস, যা একটি মানবজীবনের সময়ের সমান। সুতরাং পবিত্র রমজানের সুফল জীবনব্যাপী।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ