গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করা হলে দেশে শিল্প কারখানা থাকবে না। ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশে নতুন কারখানা হবে না। 

রবিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর একটি হোটেলে ইআরএফ ও পলিসি এক্সচেঞ্জের যৌথ আয়োজনে পলিসি কনসিডারেশন ফর এনার্জি এফরডিবিলিটি অ্যান্ড ইম্প্যাক্ট অন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কম্পিটিটিভনেস শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন ব্যবসায়ীরা।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসরুর রিয়াজ, শুভেচ্ছা ও সমাপনী বক্তব্য দেন ইআরএফ সভাপতি দৌলত আকতার মালা, প্রধান অতিথি ছিলেন বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ। 

বক্তব্য রাখেন বুয়েটের ডিন প্রফেসর ইজাজ হোসেন, বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, ইউরোচ্যামের সভাপতি নুরিয়া লোপেজ, বিএসআরএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমীর আলী হোসাইন, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ, জ্বালানি বিষয়ক আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার তানিম হোসেন শাওন প্রমুখ।

মূল প্রবেন্ধ বলা হয়, এখনকার চ্যালেঞ্জিং সময়ে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করা হলে উৎপাদনমুখী খাতে পণ্য উৎপাদনের ব্যয় বাড়বে। কমবে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। নতুন বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে সিমেন্ট, ইস্পাত ও সিরামিক খাতে নতুন করে আমদানি নির্ভরতা বাড়বে। ফলে আর্থিক খাতে চাপ পড়বে। আমদানি বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রা বেশি লাগবে। 

মাসরুর রিয়াজ বলেন, “আবার গ্যাসের দাম বাড়লে অনেক শিল্প বন্ধ হবে, তখন মন্দ ঋণ বাড়বে।”

বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, “এখন পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ অবস্থা চলতে থাকলে নতুন কারখানা এখানে আর হবে না। অনেকগুলো ব্যাংক দেউলিয়া, এনবিআরও সহযেগিতা করছে না। এ অবস্থায় অযৌক্তিকভাবে গ্যাসের দাম বাড়ালে উদ্যোক্তারা কেউ বিনিয়োগ করবে না। বিদ্যমান বিনিয়োগও সম্প্রসারণ হবে না। সার্বিকভাবে দেশে শিল্প থাকবে না।”

তিনি বলেন, “সরকার নতুন শিল্পের জন্য ১৫০ শতাংশ এবং সম্প্রসারণ শিল্পের জন্য ৫০ শতাংশ গ্যাস দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এমন পরিকল্পনার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ; আমরা আর কেউ শিল্প করতে চাই না। তবে বর্তমান শিল্পকে সহায়তা করবেন না, এটা হতে পারে না। সস্তা গ্যাসের কারণে দেশে শিল্প কারখানা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নিরাপত্তা দিতে পারছে না। ব্যাংকে সুদের হার বেশি; এনবিআরেও অন্য সমস্যা আছে। এ অবস্থায় অযৌক্তিকভাবে গ্যাসের দাম বাড়ালে উদ্যোক্তারা কেউ নতুন বিনিয়োগ করবে। বিদ্যমান ব্যবসা–বাণিজ্য সম্প্রসারণও হবে না।” 

দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি, উৎপাদন, কর্মসংস্থানসহ অর্থনীতির বেশকিছু সূচক নিম্নমুখী হওয়ায় এ ব্যবসায়ী উদ্বেগ প্রকাশ করেন। 

তিনি বলেন, “কর্মসংস্থান কমে যাওয়াটা ভয়াবহ ব্যাপার। ছাত্র–জনতার বিপ্লব হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে বেকারত্বের কারণে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে এ হার ছিল ৪ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এভাবে বেকারত্ব বাড়াটা কিন্তু দুঃখজনক। বিপ্লবের স্পিরিট ধরে রাখার দায়িত্ব সবার।” 
 
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার ১১ টাকা ৫৮ পয়সার গ্যাস বাড়িয়ে ৩০ টাকা করে। ওই সময় শিল্পে ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানো হয়। তবে দাম বাড়ানোর পর থেকেই গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা আরও খারাপ হয়। পরবর্তীতে যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। ২০২২ সালের আগে যে শিল্প ইউনিটে গ্যাসবিল ২ কোটি ১০ টাকা ছিল, দাম বাড়ানোর পর সেটি ৫ কোটি ২৫ লাখ হয়। প্রস্তাবিত মূল্য কার্যকর হলে সেটি বেড়ে হবে ১৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে কারখানা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।” 

প্রশ্নোত্তর পর্বে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার মতো দেশের কোনো পরিস্থিতি নেই।” তাই তিনি সরকারকে এ বিষয়ে আরও সময় চাওয়ার অনুরোধ জানান। 

প্রায় একই কথা বলেন, ‘ইউরোচ্যাম’–এর প্রেসিডেন্ট নূরিয়া লোপেজ। তিনি বলেন, “শুধুমাত্র রাজনীতিবিদ ও আমলারা প্রস্তুত বললেও বাংলাদেশ উত্তরণের পর্যায়ে নেই।” 

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, “গ্যাসের বর্তমান দাম কমানোর উপায় নিয়ে গবেষণা করা দরকার। কমিশন খাওয়ায় জন্য স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কিনতে অস্থির ছিল বিগত সরকারের লোকজন। তারা বিদেশে বসে এখনো কমিশন খাচ্ছে। উদ্যোক্তারা মূলত ফেঁসে গেছেন। গ্যাসের দাম বাড়ানোতো দূরে থাক কমানো না গেলে শিল্প থাকবে না।” 

সিস্টেম লস কমানোর পাশাপাশি শুল্ক-কর কমিয়ে গ্যাসের দাম কমানোর সুযোগ রয়েছে  বলেও মন্তব্য করেন এ ব্যবসায়ী।

তিনি বলেন, “কিছু ব্যাংককে টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, কারণ ব্যাংকগুলো লুট হয়েছে। ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখতে টাকা দেওয়া হলেও শিল্প টিকিয়ে রাখার দিকে মনোযোগ নেই। ব্যাংক ঋণের সুদ হার ১৮ শতাংশ। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে চলতি মূলধন অর্ধেক কমে গেছে।” 

তিনি আরও বলেন, “দেশে এতগুলো চিনিকল থাকতেও পাকিস্তান থেকে চিনি আমদানি হচ্ছে, এটা লজ্জাজনক; এই আমদানির কারণে কিন্তু কর্মসংস্থান হবে না। প্রতিদিন একটু একটু করে বিপদ বাড়ছে।”

ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, “বিদেশি বিনিয়োগ কম এটি নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য বিদেশি উদ্যোক্তার মরিয়া হয়ে নাই। অনেকগুলো বিনিয়োগ গন্তব্যের একটি মাত্র এটি খেয়াল রাখতে হবে। বাংলাদেশে জ্বালানির টেকসই ব্যবস্থাপনা ভালো নয়। একইসঙ্গে মূল্য বৃদ্ধি দেশি–বিদেশি উভয় বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করবে।”     

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ড.

ইজাজ হোসেন বলেন, “বাংলাদেশ কখনোই জ্বালানি সংকটের বাইরে ছিল না। তবে বর্তমানে এটি দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছে। গত ২০১৫–১৬ বছরের দিকে দেশে ২ হাজার ৮০০ এমএফসিএফ গ্যাস উৎপাদন হলেও বর্তমানে তা এক হাজার ৯০০ এমএফসিএফে নেমে এসেছে। এতে যারা বেশি সমস্যায় পড়বে তাদের জন্য কি করা যায়, তা নিয়ে বড় পরিসরে পরিকল্পনা দরকার।” 

ঢাকা/হাসনাত/টিপু 

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব যবস য় এ অবস থ র জন য সরক র আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

এডিপির ব্যয় আগের চেয়ে ২৫ হাজার কোটি টাকা কম

দেশে অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতি আরও স্থবির হয়ে পড়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত গত ৯ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের হার ৩৭ শতাংশেরও কম।

গত অর্থবছরের একই সময়ে এ হার ছিল ৪২ শতাংশেরও বেশি। অন্যদিকে একক মাস হিসেবে মার্চে এডিপি বাস্তবায়নের হার ৭ শতাংশেরও কম, যা গত অর্থবছরের একই মাসে ছিল ৯ শতাংশ। সব মিলিয়ে ৯ মাসের ব্যয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা কম। 

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এ বিষয়ে হালনাগাদ প্রতিবেদন আজ বৃহস্পতিবার প্রকাশ করেছে।

এতে দেখা যায়, গত ৯ মাসে বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৮২ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। আগের একই সময়ের চেয়ে ব্যয় কমেছে ২৪ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা। একক মাস মার্চে ব্যয় হয়েছে ১৫ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা। এ ব্যয় গত বছরের মার্চে ছিল ২২ হাজার ১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাসের হিসাবে মার্চে উন্নয়ন ব্যয় গত বছরের মার্চের চেয়ে ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা কম। 

চলতি অর্থবছরে ১ হাজার ৩২৭টি প্রকল্প, ১৭টি উপপ্রকল্প ও উন্নয়ন সহায়তা থোক হিসেবে ৯টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব প্রকল্পের বিপরীতে মূল এডিপিতে বরাদ্দের পরিমাণ ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। তবে বাস্তবায়নে স্থবিরতার কারণে এডিপি সংশোধন করে সংশোধিত এডিপির (আরএডিপি) আকার রেকর্ড পরিমাণ ছোট করা হয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল এডিপি থেকে ব্যয় কমানো হয়েছে ১৮ শতাংশ বা ৪৯ হাজার কোটি টাকা। এতে আরএডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ