কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার উত্তর হারবাং এলাকায় একটি ট্রাক ও যাত্রীবাহী বাসের সংঘর্ষে এক নারী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত পাঁচজন। গতকাল রোববার দিবাগত রাত তিনটার দিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

নিহত নারী বাসের যাত্রী ছিলেন। তাঁর পরিচয় জানাতে পারেনি পুলিশ। আহত পাঁচজনকে চকরিয়া, পার্শ্ববর্তী উপজেলা লোহাগাড়া এবং চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে গিয়ে হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে।

হাইওয়ে পুলিশ জানায়, কক্সবাজারমুখী ট্রাকটি পাথরবোঝাই ছিল। উত্তর হারবাং এলাকায় ওই ট্রাকের সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা হানিফ পরিবহনের বাসের সংঘর্ষ হয়। এতে বাসটির সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান বাসের ওই নারী যাত্রী। আহত হন আরও পাঁচজন। দুর্ঘটনার কারণে প্রায় এক ঘণ্টা যানজটে আটকা পড়তে হয় শতাধিক যানবাহনকে।  

চিরিংগা হাইওয়ে পুলিশের পরিদর্শক আরিফুল আমিন দুর্ঘটনায় হতাহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি দুটি জব্দ করা হয়েছে। নিহত নারীর পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে। লাশ হাইওয়ে থানায় রয়েছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র ঘটন

এছাড়াও পড়ুন:

আমাদের একজন ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী ছিলেন!

ব্রিটিশ শাসিত ১৯৩৩ সাল। এ বছর হাসিনা বেগমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের কোয়োপাড়ার গ্রামের হুমায়ুন মোর্শেদ চৌধুরী, যিনি পরবর্তীতে পুলিশের ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই দম্পতির বহু আকাঙ্খিত প্রথম ও গর্বিত সন্তান আবু তাহের মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী। পরবর্তীতে যিনি ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। 

হাসিনা-মোর্শেদ দম্পতি বিবাহিত জীবনের নয় বছর পর প্রথম সন্তান লাভ করেন পঞ্চাশের মন্বন্তরের দুই বছর আগে; ১৯৪১ সালে। ডা. জাফরুল্লাহ্‌ জন্মের শুভলগ্নে সারা পাড়া আনন্দে মেতে উঠেছিল। তাঁর দাদা, মরহুম আবদুল কাদের চৌধুরী সমাজসেবী এবং তাঁর বাবা অর্থাৎ ডা. জাফরুল্লাহ্‌র বড়োবাবা মরহুম আবদুল করিম চৌধুরী এলাকার স্বনামধন্য জমিদার ছিলেন। 

ডা. জাফরুল্লাহ্‌র মা হাসিনা বেগম চৌধুরী দশ বছর পর্যন্ত সন্তানহীনা থাকলেও পরিবারের কাছে যথেষ্ট আদর পেয়েছিলেন। এবং তাঁর দাদি কুলছুমা খাতুন চৌধুরী বউমার প্রথম সন্তান হবার পর আরও বেশি আদর-যত্নে ভরিয়ে দিতে থাকেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর জন্ম নেওয়া জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী সত্যি সত্যিই সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন কর্মের মধ্য দিয়ে। কারো কাছে তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা, কারো কাছে জাতীয় ওষুধনীতি ও স্বাস্থ্যনীতির প্রবক্তা, আবার কারো কাছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। দরিদ্র মানুষজনের স্বাস্থ্যসেবায় তাঁর অতুলনীয় অবদানের কারণে কেউ কেউ তাঁকে ‘গরীবের ডাক্তার’ হিসেবেও আখ্যা দিয়ে থাকেন। 

আরো পড়ুন:

গল্প হতে হলে তাতে প্রাণ থাকতে হবে: হামিম কামাল

বইমেলায় শাওন মাহমুদের ‘থার্টি সেকেন্ড কোয়ান্টাম থিওরি’

ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী মনে করতেন, তাঁর জীবনে যা কিছু হয়েছে, তা তাঁর মায়ের জন্য হয়েছে। তাঁর ভাষায়, ‘মা সিদ্ধান্ত নিতেন, তাঁর ছেলেমেয়েরা কে কী হবে! মা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাঁর বড়ো ছেলে জাফরুল্লাহ্ খুব দরদি; তাই এ ছেলে ডাক্তার হবে, মানুষের সেবা করবে। আমি এখন পর্যন্ত যা বলছি তা আমার মায়ের শেখানো কথাই বলছি। মা খুব অতিথিপরায়ণ ছিলেন আর খুব দরদি মনের মানুষ। মন্বন্তরে ভাতের ফেন নিতে আসা সবাই নিজের সাধ্য অনুযায়ী চাল, ভাত, ফেন দিতেন আর সন্তানদের সব সময় দুঃখী মানুষের কষ্টের কথা বলতেন।’

ছোটোবেলা থেকেই ডা. জাফরুল্লাহ্‌ অসাধারণ মেধা-মনন, স্কুল-কলেজ ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষকদের ভীষণ চমকিত করেছিল। প্রায়ই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম হতেন। সাধারণ মানুষের জন্য তাঁর ছিল একটি দরদি মন, ভালোবাসাপূর্ণ হৃদয়। তাঁর বাবা হুমায়ুন মোর্শেদ চৌধুরীর ভাষায়, ‘ছোটোকাল থেকেই সে বন্ধু-বান্ধবের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল ছিল। স্কুলে পড়ার সময় তার সঙ্গী ছাত্র বই কিনতে কিংবা স্কুলের বেতন দিতে অসমর্থ হলে, সে ছোটোদের কোচিং করিয়ে যে টাকা পেত তা দিয়ে সাহায্য করত। সে লেখাপড়ায় অত্যন্ত মেধাবী ছিল।’ ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতি ও সমাজমনস্ক হয়ে নিজেকে তৈরি করেছিলেন।

ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাশ করার ডা. জাফরুল্লাহ্ বিলেতে এফআরসিএস পড়তে যান। কিন্তু একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের ডাক শুনে পাাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে চলে আসেন রণাঙ্গণে। প্রবাসী সরকারের সহায়তায় গড়ে তোলেন ৪৮০ শয্যার ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। অপারেশনে অংশগ্রহণ, অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ করা-সহ নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতার পর বিলেতে ফিরে না গিয়ে সুলভে ও সহজে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য গড়ে তোলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।  

ডা. জাফরুল্লাহ্ ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতি করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে আর নির্দিষ্ট কোনো মতের রাজনীতির সঙ্গে থাকেননি। তবে তাঁর রাজনৈতিক মত প্রভাব ফেলেছে সব সময়। তিনিই বাংলাদেশে সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি, মুক্তিযুদ্ধের পর যাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়াসহ দেশের বেশিরভাগ রাজনীতিকের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক ছিল। এই সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভিত তৈরি, জাতীয় ওষুনীতি পাস, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন, ইত্যাদি নানান কাজে ব্যবহার করেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ডা. জাফরুল্লাহ্র ঘনিষ্ঠতা ছিল চোখে পড়ার বিষয়। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্নেহের বলয় থেকে কখনও বের হননি। ১৯৭৫ সালের ১৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রায় ছয় ঘণ্টা সময় কাটিয়েছেন ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী। ডা. জাফরুল্লাহ্ বঙ্গবন্ধুকে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঠিক করার জন্য নানান ধরনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) এবং একটা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কী রকম হতে পারে বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। ডা. জাফরুল্লাহ্ এসব বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে বিস্তারিত জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুও আগ্রহভরে সব শুনেছেন। 

বিভিন্ন সরকারের সময়ে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছেন নির্লোভ চরিত্রের ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী। কিন্তু অনুপ্রাণিত করেছেন বহু ভালো পদক্ষেপ গ্রহণে। বঙ্গবন্ধুকে বহুজাতিক কোম্পানির দুর্নীতির বিষয়ে অবহিত করে সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে ওষুধ আমদানিতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। বাকশালে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ উপেক্ষা করেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ্। উপেক্ষা করেছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দেওয়া মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব। এ সময় তিনি জিয়াউর রহমানকে বলেছিলেন: ‘আপনি দেশ স্বাধীন করতে শাহ আজিজুর রহমান ও শফিউল আযমদের (সচিব) বুদ্ধি লাগেনি। তাহলে দেশ চালাতে এই স্বাধীনতাবিরোধীদের লাগবে কেন?’ জিয়াউর রহমান তখন দেশের প্রয়োজনে ‘অ্যাকোমোডেটিভ’ (সবাইকে নিয়ে) রাজনীতির কথা বলে যুক্তি দেন। পাশাপাশি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে এ-ও বলেন যে, ‘আপনারা সমালোচনা করবেন অথচ দায়িত্ব দিলে সেটি নিতে চাইবেন না!’

কালের কণ্ঠকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে ডা. জাফরুল্লাহ্ বলেন, ‘আমার মা হাসিনা বেগমকে একবার বেশ ধরেছিলেন জিয়াউর রহমান। তো সব মা-ই চায় ছেলে মন্ত্রী হোক। আমি বিপদে পড়ে গেলাম। পরে আমাকে মন্ত্রী করা হলে কী কী অসুবিধা হবে তার ফিরিস্তি তুলে ধরে উনাকে (জিয়াকে) চার পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখেছি। পরে আরও বহুবার দেখা হয়েছে, সবসময় একই কথা বলতেন, আই গিভ ইউ দ্য ব্লাংক চেক। যেকোনো মন্ত্রণালয় দিতে রাজি আছেন। মন্ত্রী না হতে চাওয়ায় একসময় কিছুটা দূরত্ব হলে পরে তিনি আবার ডেকে পাঠাতেন।’

জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের ঠিক এক দিন আগে ১৯৮১ সালের ২৮ মে বঙ্গভবনে তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল ডা. জাফরুল্লাহ্‌র। ওই দিন পরিকল্পনা কমিশনের একটি বৈঠকে অনানুষ্ঠানিক সদস্য হিসেবে ডা. জাফরুল্লাহ্কেও ডাকা হয়। জাফরুল্লাহ্ পরিবার পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনা তুলে সেদিন বলেছিলেন, মানুষ বাড়ছে কি কমছে এ জন্য জন্ম-মৃত্যুর হিসাব থাকা দরকার। জিয়াকে তিনি এ-ও বলেন, তাঁর সরকারের কোনো জবাবদিহি নেই। মাদক, মদ ও সিগারেট নিরুৎসাহ করতে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করলে জিয়া খেপে গিয়ে বলেন, ‘আমি তো সিগারেট খাই না।’ 

সেদিন বঙ্গবভবন থেকে চলে আসার সময় তৎকালীন এনএসআই প্রধান মেজর জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয় ডা. জাফরুল্লাহ্‌র। অভিযোগ করে মহব্বতজান বলেছিলেন, চট্টগ্রাম যাওয়ার বিষয়ে তাঁদের নিষেধাজ্ঞা প্রেসিডেন্ট শুনছেন না। ‘প্রেসিডেন্টকে বোঝানোর দায়িত্ব আপনাদের’- এমন কথা বলে সেদিন বঙ্গভবন ত্যাগ করেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ্। পরদিন ২৯ মে বিমানের একটি ফ্লাইটে চট্টগ্রামে যান জিয়াউর রহমান। ৩০ মে এক দল সেনা সদস্যের হাতে তিনি নিহত হন।

ডা. জাফরুল্লাহ্ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে নাগরিকের পাসপোর্ট পাওয়াকে সহজলভ্য ও নিশ্চিত করেছিলেন। তাঁর মতে, স্বাস্থ্য খাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদান হলো তিনি এনজিওদের প্যারামেডিক প্রথাকে তাঁর দলের ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। জিয়াউর রহমান নারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা সৃষ্টিতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সাহায্য নিয়েছেন। তাঁর আমলে পুলিশে নারী নিয়োগ দেওয়া শুরু হলে দেশের প্রথম দুই নারী পুলিশ কনস্টেবল হিসেবে নিয়োগ পান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এসএসসি পাশ নারী কর্মী হোসনে আরা ও মমতাজ চামেলী। তাঁদের মধ্যে হোসনে আরা পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়েছেন।

ডা. জাফরুল্লাহ্ স্বাস্থ্যমন্ত্রী হতে উপেক্ষা করেছিলেন জেনারেল এরশাদের প্রস্তাবও। তবে তাঁর পরামর্শেই এরশাদ তাঁর আমলে পোস্টার, বিলবোর্ড বাংলায় লেখা ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন, উপজেলাব্যবস্থা ও সফল জাতীয় ওষুধনীতি পাস ও জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করতে পেরেছিলেন। ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর এবং ডা. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুর পর ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বাসায় গিয়ে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহত নেতাকর্মীদের চিকিৎসায় সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে শেখ হাসিনা নিজেই তাঁকে ডেকে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।

এরশাদ আমলে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হলে তাঁকে দ্রুত মুক্তি দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ্। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হলে অসংখ্যবার তাঁর মুক্তি চেয়েছেন তিনি। তাঁর পরামর্শেই কারাগারে যাওয়ার আগের কয়েকবছর ১৫ আগস্টে খালেদা জিয়া তাঁর জন্মদিনে কেক কাটা বন্ধ রেখেছিলেন। 

ডা. জাফরুল্লাহ্ সবসময় অসহায় ও নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেন। বিশেষ করে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর কোনো অত্যাচার-নির্যাতনের সংবাদ শুনলে তিনি অসুস্থ শরীর নিয়েও তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে ছুটে যেতেন। কারণ তিনি মনে করতেন, দেরি করে সেখানে গেলে অসহায় মানুষগুলো আরও অসহায় হয়ে পড়বে এবং আরও নির্যাতনের শিকার হতে পারে। ডা. জাফরুল্লাহ্ ঘটনাস্থলে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হওয়া মানুষের কথা শুনতেন, তাদেরকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া ও সাহস জোগানোর চেষ্টা করতেন। তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠনেরও পরামর্শ দিতেন সরকারকে। 

ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী বিলেতে থাকাবস্থায় চড়তেন নিজস্ব দামি গাড়িতে। ছিল পাইলটের লাইসেন্স। লন্ডনে পড়াশোনাকালীন তিনি রেডিমেড কাপড় পরেননি। বরং রাজকীয় দর্জি তাঁর বাসায় এসে মাপ নিয়ে স্যুট তৈরি করতেন বলে অতিরিক্ত পরিশোধ করতেন ২০ পাউন্ড। অথচ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এ মহান চিকিৎসক পরে একেবারেই সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। একই জামা পরা অবস্থায় তাঁকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা যেত। এমনকি তালি দেওয়া প্যান্ট পরা অবস্থায়ও দেখা যেত তাঁকে। মূলত দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে তিনি সাধারণ বেশভূষায় চলতে পছন্দ করতেন। দেশে-বিদেশে কোথাও তাঁর একটি ফ্ল্যাট পর্যন্ত নেই। বোনকে দান করে দিয়েছেন পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিজমা। ডা. জাফরুল্লাহ্ হয়তো নিজেও ভাবেননি দেশের প্রয়োজনে কোনো একদিন তিনি এভাবে বদলে যাবেন। আরেকটি বিষয় হলো, তিনি চাইতেন গণস্বাস্থ্যের কর্মীরাও সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত থাকুক। 

২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর তারিখে নাগরিক টিভির ‘সবিনয় জানতে চাই’ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমি একজন সমাজতন্ত্রী। আমি এমন একজন ব্যক্তি, যে আমার ব্যক্তিগত কোনো জায়গা-জমি ও ফ্ল্যাট বাড়ি নেই। আমি মনে করি যে, রাষ্ট্র একটা কল্যাণকর রাষ্ট্র হবে এবং সেখানেই সব ব্যবস্থা থাকবে।’

ডা. জাফরুল্লাহ্ একটা স্যান্ডেল শু পায়ে দিতেন যার বয়স নিয়ে গণস্বাস্থ্যের চিকিৎসকগণ দ্বিধান্বিত থাকতেন। সর্বশেষ পায়ে দেওয়া স্যান্ডেলটির বয়স ১০-১২ বছরের কম হবে না। শুধু স্যান্ডেল না, তিনি ছেঁড়া প্যান্ট শার্ট সেলাই করে বছরের পর বছর পরতেন। যে গাড়িতে চড়তেন সেটি ছিল বহু পুরানো মডেলের টয়েটো ১০০। একবার উনার ড্রাইভার রফিক গাড়ি বদলানোর কথা বলার রফিককে ধমক দিয়ে বলেছিলেন: ‘তুমিও তো পুরানো হয়ে গেছো। তোমাকেও কি বদলে ফেলবো?’ তিনি রিপু করা প্যান্ট পরতেন। সেটাও বাতিল করেননি। রিপুর প্রসঙ্গে রিপুযুক্ত স্থানে হাত বুলিয়ে বলেছেন, ‘ভালোই তো আছে। রিপু করে চলছে তো, ওকে ফেলে দেব কেন?’

সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা ডা. জাফরুল্লাহ্কে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘একবার শুনেছি আপনি লন্ডনে থাকাবস্থায় ব্র্যান্ডের জামা-কাপড় পরতেন। আর আপনার গায়ের শার্টটি তো ছিঁড়ে গেছে। কতদিন আগে কেনা শার্ট এটা?’ জবাবে ডা. জাফরুল্লাহ্ বলেছিলেন: ‘১৪-১৫ বছর আগের। শার্ট ছেঁড়ে নাই, একটা বোতাম ছিঁড়ে গেছে (হাত দিয়ে টানতে টানতে বললেন)। আমার ৩০ বছর আগের শার্টও আছে। না ছিঁড়লে ফেলব কেন? লন্ডনে আমি সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ডের স্যুট-টাই, জামা-জুতা পরতাম। দামি গাড়ি চালাতাম। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আমার গাড়ি ছাড়া অন্য কারও গাড়িতে উঠতে চাইত না। পরে চিন্তা করে দেখালাম, এসব অর্থহীন। শুধু শুধু এসবের পেছনে টাকা খরচ করার মানে হয় না। স্বাধীনতার পর থেকেই আমার চিন্তায় এই পরিবর্তন এলো।’

দেশের যেখানেই মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে, মানুষের কষ্টের সংবাদ তাঁর কানে গেছে, সেখানেই ছুটে গেছেন ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী। দেশের স্বার্থে যখন যেখানে দরকার সেখানে বলেছেন ও লিখেছেন জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী। এজন্য অবশ্য প্রিয়জনদের অপ্রিয় তালিকায় ঠাঁই পেতে হয়েছে তাঁকে অনেকবার। তিনি জীবনের শুরু থেকেই স্বাধীনভাবে থেকেছেন, স্বাধীনভাবে কথা বলেছেন। শুরুতে শুনতে খারাপ লাগলেও শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে তিনি সেগুলো দেশের স্বার্থেই বলেছেন। মানুষ যে মানুষের জন্য জীবনের পরতে পরতে সেই জয়গান গেয়ে গেছেন তিনি। 

২০১১ সালে র‌্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমন হোসেন যখন ভয়াবহ বিপদে নিমজ্জিত, তখন পাশে বটবৃক্ষের মতো দাঁড়ান ডাক্তার জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী। সেই লিমন এখন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক। চ্যানেল টুয়েন্টিফোরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লিমন হোসেন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরীকে। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। একজন ব্যক্তি চাইলে আসলেই মানুষের জন্য কী পরিমাণ কাজ করতে পারে, মানুষকে প্রকৃত মানুষ তৈরি করতে পারে, তার জলন্ত উদাহরণ জাফরুল্লাহ্ স্যার।’

ডা. জাফরুল্লাহ্ বলতেন, দেশ গড়তে সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতা দরকার। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ দরকার। দরকার ক্ষমাসুন্দর মনোভাব। তিনি বলতেন, যথাযথ সমালোচনা ও আলোচনার মাধ্যমে গঠনমূলক কাজ করতে হবে সমবেতভাবে। উন্নত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তাতেই রাষ্ট্রের বিকাশ ঘটবে, সাধারণ জনগণের উন্নয়ন হবে, মানুষের জয় হবে, বাংলাদেশের জয় হবে।

ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর মানুষ ছিল না, বরং তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মানুষ, সব মানুষের আপন মানুষ। আমি মনে করি, সৎ, নির্লোভ ও নির্ভিক এই মানুষটির জীবনকাহিনি অনেকের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস ও অনুকরণীয় হতে পারে। 

২০২২ সালের কোনো একদিন আমি ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরীকে ফোন করে তাঁর সাক্ষাৎ চাই। তিনি জানতে চাইলেন কেন? আমি বললাম, ‘স্যার, আপনার জীবনীভিত্তিক একটি সাক্ষাৎকার গ্রন্থ নিয়ে কাজ করতে চাই।’ তিনি বললেন, ‘দেখ নেসার, চারদিকে অন্ধকার। তোমাদের সমস্যা কি জান, তোমরা যেখানে একটু আলো দেখ, সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়। আমি খুবই নগণ্য মানুষ। আমি মনে করি না আমাকে নিয়ে লেখার কিছু আছে।’ স্যারের বিনয়ের কাছে আমার ইচ্ছা হার মানল।

পরবর্তীতে ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ একটি গ্রন্থ লেখার ব্যাপারে আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সিআর আবরার। ২০২৩ সালের ১১ এপ্রিল ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী আমাদের সবাইকে ছেড়ে পরপারে চলে গেলেন। পরদিন রাতে আমাকে ফোন করলেন ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আমার বড় ভাই ও আজব প্রকাশের স্বত্বাধিকারী জনাব জয় শাহরিয়ার। বললেন, ‘নেসার, তুমি তো জান, জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী মারা গেছেন। এই মানুষটাকে আমি অসম্ভব শ্রদ্ধা করি। তুমি তাঁর ওপর একটি জীবনীগ্রন্থ দাঁড় করাও।’ আমার আগের ইচ্ছার সঙ্গে জয় ভাইয়ের ইচ্ছা মিলে যাওয়ায় সম্মতি দিলাম। শুরু হলো কাজ। 

কিন্তু কাজটি সহজ ছিল না। কারণ ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরীর কাজ এত বিস্তৃত ছিল যে সেসব কাজের কাগজপত্র-দলিল যোগাড় করা সহজ ছিল না। কাজ এগোতে লাগল। আমি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী ডা. মনজুর কাদির আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তিনি আমাকে বিভিন্ন যোগাযোগের সূত্র তৈরি করিয়ে দিলেন। মাসিক গণস্বাস্থ্য পত্রিকার সম্পাদক বজলুর রহিম ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরীর লেখা গ্রন্থ, ডা. জাফরুল্লাহ্‌র ওপর লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ ও নিবন্ধ এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সম্পর্কিত বিভিন্ন গ্রন্থ, পত্র-পত্রিকা প্রেরণ করে আমার অসামান্য উপকার করলেন। সঙ্গে চলতে থাকল নানান বিষয়ে পরামর্শ চেয়ে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ মেইল যোগাযোগ। 

আমি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ও কয়েকজন ঊর্ধ্বকর্তা এবং ডা. জাফরুল্লাহ্র পরিবারের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে দেখা করে প্রয়োজনীয় তথ্য যোগাড় করার চেষ্টা করেছি। প্রায় দুই বছর কাজ করার পর অবশেষে তৈরি হলো বহু কাঙ্ক্ষিত ‘জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের রূপকার ও সমাজ বিপ্লবী ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী’। বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।আমি আশা করি, গ্রন্থটি পড়ার মাধ্যমে পাঠক ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরীর জীবন, কর্ম ও চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন এবং মুক্তিযুদ্ধ-সহ ইতিহাসের নানান ঘটনাবলি ও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের অনেক অজানা তথ্য জানতে পারবেন। 

বইয়ের নাম: জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের রূপকার ও সমাজ বিপ্লবী ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী
লেখক : নেসার আমিন
প্রকাশক : আজব প্রকাশ 
পরিবেশক : গণপ্রকাশনী ও বিবলিওফাইল প্রকাশনী 
প্রচ্ছদ : আশরাফুল ইসলাম 
পৃষ্ঠা : ৩২৮
মুদ্রিত মূল্য : ৮০০ টাকা

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ