‘বাসের ৬ নম্বর সিটে ছিলেন এক মেয়ে। তিনি গানের অনুষ্ঠান থেকে ফিরছিলেন। তাঁর মাথায় সিঁদুর ছিল। সঙ্গে ছিলেন স্বামী ও ভাই। দুই ডাকাত ওই মেয়েকে টেনেহিঁচড়ে বাসের পেছনের সিটে নিয়ে যায়। ওই দুইজনের একজনকে শ্যামল বলে ডেকেছিল তাদের এক সঙ্গী। সে পাতলা গড়নের। নীল কোট পরা ছিল। আরেকজন ছিল সাদা চেক শার্ট পরা। এই দুইজন সবার সামনে মেয়েটাকে ধর্ষণ করে। অন্য নারীদের শরীরের স্পর্শকাতর স্থানেও স্পর্শ করে ডাকাতরা। আর ওই মেয়ের শরীরের বিভিন্ন স্থান রক্তাক্ত করে। তাঁর মুখের দিকে তাকানোর মতো অবস্থা ছিল না।’

গলার স্বর একটু নিচুতে নামিয়ে কথাগুলো বললেন রাজশাহী জেলার এক নারী। তিনি গত সোমবার রাতে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী চলন্ত বাসে ডাকাতি ও শ্লীলতাহানি ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। কথা বলতে গিয়ে ভয়ে কাঁপছিলেন। কারণ, সেদিন রাতে ওই বাসে তিনিও ছিলেন। ডাকাতরা তাঁর শরীরও স্পর্শ করে এবং টাকা ও গহনা ছিনিয়ে নেয়। 

ওই নারীর বর্ণনা অনুযায়ী, সোমবার রাতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও গত শনিবার সংবাদ সম্মেলনে টাঙ্গাইলের এসপি মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘নারী যাত্রীদের প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। তবে শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে।’ গতকাল রোববার রাজশাহীর ওই নারী সাংবাদিকদের ধর্ষণের বিষয়টি জানালে এসপি মিজানুরের সঙ্গে কথা বলার জন্য মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি।

রাজশাহীর নারী ঘটনার বর্ণনায় জানান, তিনি সাভারে মেয়ের বাসায় গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন মেয়ের শাশুড়ি। ইউনিক রয়েল রোড পরিবহনের বাসে বাসটি রাত ১১টার দিকে ঢাকার গাবতলী থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ওই নারী ও তাঁর বেয়াইন ১২টার দিকে সাভাবের হেমায়েতপুর থেকে বাসটিতে ওঠেন।

তিনি বলেন, ‘বাসের ভেতরেই ডাকাত ছিল। হেমায়েতপুর থেকে ওঠে আরও দুইজন। অন্যরা গাবতলী থেকেই আসে। তাদের গেটআপ-সেটআপ ছিল ভালো– টাই, স্যুট, কোট, সানগ্লাস পরা। দেখে কেউ বুঝতে পারবে না তারা ডাকাত। আমরা সবাই বসে ছিলাম। সাভারের নন্দন পার্কে গাড়ি এলে হঠাৎ তিনজন দাঁড়িয়ে ড্রাইভারকে ছুরি ধরে বলে, বস, আপনি তো অনেকক্ষণ চালালেন এখন চাবি আমাদের দিয়ে দেন। ড্রাইভার এক কথাতেই চাবি দিয়ে দেন। এর পর গাড়ি নন্দন পার্কের রাস্তা থেকে গাজীপুরের রাস্তায় নিয়ে যায় ডাকাতরা। তখন জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি গাজীপুর, কোনাবাড়ী, সাফারি পার্কের ওই সাইড দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে আসছে। ভাবলাম, সামনে আরও বিপদ আছে বোধহয়।’

সেদিন বাসে চালকের পেছনের আসনে ছিলেন ওই নারী ও তাঁর বেয়াইন। ডাকাতদের একজন প্রথমে তাঁর মাথায় পিস্তল ধরে, আর একজন ছুরি উল্টো করে গলায় ধরে বলে, ‘তোর কাছে কী আছে দে।’ এরপর গলায় থাকা চেইন ও হাতের চুড়ি নিয়ে নেয় ডাকাতরা। মোবাইল ফোনটা আগেই নিয়ে নেয়। ব্যাগে ১০ হাজার টাকা থাকলেও প্রথমে তারা সেটা পায়নি। তাঁকে গালি দিয়ে একজন মাথায় থাপ্পড় মেরে বলে, ‘তোর কাছে টাকা আছে, দে।’ প্রথমে না দিলেও পরে সেই টাকা দিয়ে দেন। তবে ১০ হাজার টাকা পাওয়ার পরও এক ডাকাত সদস্য বলতে থাকে, ‘তোর কাছে আরও টাকা আছে।’ এ কথা বলে তাঁর শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করে।

তিনি জানান, ডাকাত দলে ৯ জন ছিল। তাদের একজন দক্ষ চালক। মূল চালককে সরিয়ে সে দ্রুত গতিতে দক্ষতার সঙ্গে বাস চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। চালকের সহকারীসহ সবাইকে ছুরি ধরে ছিল। সুপারভাইজারের পায়ের ওপর পা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল একজন। তাঁকে নড়াচড়া করতে দেয়নি। পিস্তল ছিল তিনজনের কাছে। বাকি সবার কাছে ছুরি। ডাকাত দলের নেতা সবার পরে উঠে দাঁড়িয়ে যাত্রীদের শরীর ও ব্যাগ তল্লাশি করে টাকা বের করে নেয়।

ওই নারী বলেন, ‘বাস তখন চলছেই। আমরা মোট ছয়জন মেয়ে ছিলাম। তিনজন বাদে সবাই বয়স্ক। ৬ নম্বর আসনে থাকা নারী ধর্ষণের শিকার হন। বাসের সব সিটে তখন যাত্রী ছিলেন। দাঁড়ানো ছিল ৭-৮ জন। পুরো তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা বাস চলে। এই সময় সব যাত্রীর কাছ থেকে টাকা, গহনা, মোবাইল ফোন নিয়ে নেয় ডাকাতরা। কারও কাছে পানি কিনে খাওয়ার মতো ১০ টাকাও ছিল না। সবাই আহাজারি করছিলেন।’

তিনি জানান, প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা এভাবে ঘোরার পর আবার নন্দন পার্কের তেল পাম্পের সামনে বাস থামায় ডাকাতরা। একজন-একজন করে নামতে থাকে এবং পিস্তল ও ছুরি যাত্রীদের দিকে তাক করে রাখে। আটজন নামার পর চক্রের সর্বশেষ সদস্য দৌড়ে চলে যায়। 

ওই নারী বলেন, ‘তখন গভীর রাত, এলাকা নির্জন। কোনো দোকানপাট নেই। আমরা কিছুদূর গিয়ে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে ঘটনা বললাম, সেখানে তিন সেনাসদস্য ছিলেন। তারা বললেন, এখন রাত, আপনারা যে যার মতো নিরাপদে বাড়ি চলে যান। আমরা যেহেতু তিন সদস্য আছি, আমাদের ওপরও অ্যাটাক হতে পারে। ওরা কোনো পদক্ষেপ নেননি। এর পর আমরা টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানায় গেছি। সেখানে ওসি বলেন, এখন আমরা কেস নিতে পারব না, আপনারা সকাল ৯টায় আসেন। কিন্তু আমাদের তো সকাল ৯টা পর্যন্ত বসে থাকা সম্ভব না। তখন আমরা কাছাকাছি হাইওয়ে থানায় গেলাম। সেখানেও মামলা নেয়নি। হাইওয়ে পুলিশ বলে, যেখানকার ঘটনা সেখানে যেতে হবে, মির্জাপুরেই আবার যান।’

কোথাও মামলা না নেওয়ায় এবং ঘটনাটিকে গুরুত্ব না দেওয়ায় বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেন যাত্রীরা। ওই নারী বলেন, ‘বাসে নাটোরের বড়াইগ্রাম থানার দুই ব্যবসায়ী ছিল। একজন গুড় বিক্রেতা আর একজন মাছ ব্যবসায়ী। একজনের কাছে ছিল ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা, আরেকজনের কাছে দেড় লাখ টাকা। ওরা গরিব মানুষ। গাড়ির ভেতরে খুব কান্নাকাটি করছিল। আমরা সবাই-ই কান্নাকাটি করছিলাম, তবে ওরা বেশি। ওই ব্যবসায়ীদের একজন ফোন সেভ করেছিল। সে তার মাকে কল করে। পরে তার মা বড়াইগ্রাম থানার ওসিসহ পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়ান। আমরা পৌঁছানোর পর ওখান থেকে গাড়ি থানার মধ্যে নেওয়া হয়। সেখানে পুলিশদের বলার পর পকেটের টাকা দিয়ে সবাইকে বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এরপর যে যার মতো বাড়ি ফেরে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাটোরের এসপি আমজাদ হোসাইন সমকালকে বলেন, ‘নিয়ম হলো যেখানে ঘটনাস্থল, সেখানেই মামলা করতে হবে। এজন্য তাদের মির্জাপুর থানায় যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। তবে বড়াইগ্রাম থানায়ও মামলা নেওয়া যেত। এটা করলে যাত্রীরা উপকৃত হতো। এজন্য দায়িত্বে অবহেলা পাওয়ায় বড়াইগ্রাম থানার ওসি সিরাজুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। একই কারণে মির্জাপুর থানার ডিউটি অফিসারও বরখাস্ত হয়েছেন।’

এদিকে টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, বাসে ডাকাতি ও শ্লীলতাহানির ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা মাদকাসক্ত। মাদকের টাকা জোগাড় করতে তারা সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় ডাকাতি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজি করে থাকে। সম্প্রতি বাস থেকে লুট করা একটি মোবাইল ফোনের বিনিময়ে তারা গাঁজা নেয়। ওই গাঁজা বিক্রেতার সূত্র ধরেই সন্ধান মেলে ডাকাত চক্রের সদস্যদের। পরে অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গতকাল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা টাঙ্গাইল জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই মো.

আহসানুজ্জামান এসব তথ্য জানিয়েছেন।

রাজশাহীর নারীর বক্তব্যের বিষয়ে টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এক যাত্রীর সাক্ষাৎকারের বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে দু’জন আদালতে সাক্ষী দিয়েছে। জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তাদের গ্রেপ্তার করতে পারলে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র একজন ওই ন র আম দ র স পর শ দ র এক র ঘটন সদস য ব যবস ত নজন

এছাড়াও পড়ুন:

শিক্ষকদের বিচারক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ কতটা যৌক্তিক

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সংবিধানসহ বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার নিয়ে আলোচনা চলছে। রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক সব ক্ষেত্রে সবচেয়ে ‘জনপ্রিয়’ শব্দ হলো সংস্কার। সবাই চায়, পুরোনো স্বৈরশাসন আর কোনোভাবেই ফিরে না আসুক; দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হোক; বন্ধ হোক রাজনৈতিক হানাহানি এবং সব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ।

জনগণের এই অভিপ্রায়কে উপলব্ধি করেই হয়তো অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল, যাদের কাজ সংস্কারের জন্য সুপারিশমালা প্রণয়ন করা।

এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের সংবিধান, আইনসভা, নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, প্রশাসনসহ সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ঢেলে সাজানো হবে। সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ অন্যান্য কমিশন যে সুপারিশমালা প্রণয়ন করেছে, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

আলোচনা দীর্ঘ না করে যে বিষয়টির দিকে দৃষ্টিপাত করতে চাই সেটি হলো, বিচার বিভাগ সম্পর্কে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ সম্পর্কে। সুপারিশগুলোর মধ্যে একটি ভালো দিক হলো, কমিশন সুপারিশ করেছে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের সব বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগের সমান এখতিয়ারসম্পন্ন স্থায়ী আসন স্থাপন করা হবে।

কমিশনের এই সুপারিশ অনেকটা সামরিক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের আমলে নেওয়া বিচার বিভাগকে বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থার মতো, যা বিচার বিভাগের অসহযোগিতার কারণে বাতিল হয়ে যায়। তবে মূল সমালোচনার বিষয়টি হলো সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশনের গঠন এবং বিচারক নিয়োগ নিয়ে।

জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশনের গঠন

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশন প্রতিষ্ঠা করা গেলে বিচারক নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ হবে এবং সততা, নিষ্ঠা, মেধা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, জ্ঞান, পেশাগত অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ দেওয়া যাবে।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, প্রস্তাবিত সাত সদস্যের ‘স্বাধীন’ জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশনের প্রধান হবেন প্রধান বিচারপতি। সদস্য হিসেবে থাকবেন আপিল বিভাগের পরবর্তী দুই জ্যেষ্ঠ বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগের পরবর্তী দুই জ্যেষ্ঠ বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষ কর্তৃক মনোনীত একজন নাগরিক।

 উচ্চকক্ষ কর্তৃক মনোনীত একজন নাগরিককে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হলে তা বিচার বিভাগীয় নিয়োগসংক্রান্ত কমিশনের ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্রকে তুলে ধরবে’ বলে বিবেচনা করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। লক্ষণীয় হলো, জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশন একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিশেষায়িত সংস্থা। এই কমিশনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বা ‘বিশেষজ্ঞ’ ব্যক্তিদের পাশাপাশি একজন ‘সাধারণ’ নাগরিকের নিয়োগ কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাধারণভাবে যে শর্তটি দেওয়া হয়েছে তা হলো তিনি বাংলাদেশের নাগরিক হবেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতাগুলো হলো:

ক. সুপ্রিম কোর্টে কমপক্ষে ১০ বছর অ্যাডভোকেট হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে; অথবা

খ. বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে কমপক্ষে ১০ বছর বিচার বিভাগীয় পদে দায়িত্ব পালন করতে হবে; অথবা

গ. বাংলাদেশের যেকোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

প্রথম দুটি শর্ত নিয়ে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কারণ, ওই দুই শর্তে যাঁদের নিয়োগের কথা বলা হয়েছে, তাঁরা সরাসরি বিচারিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। তবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপকদের বিচারক হিসেবে নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে। আইনের অধ্যাপকদের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করা কি আদৌ সম্ভব?

আরও পড়ুনবিচার বিভাগ প্রকৃত পৃথক্‌করণের এখনই সময়০৮ নভেম্বর ২০২৪

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপকদের বিচারক হিসেবে নিয়োগের সম্ভাব্য সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক। গত দুই-আড়াই দশকে বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যেভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেটি অতিমাত্রায় বিতর্কিত। সেখানে যে যোগ্য মানুষ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হননি, সেটি নয়। কিন্তু একটি বিরাট অংশের শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্ত হন রাজনৈতিক বিবেচনায়। যত ভালো ফল হোক না কেন রাজনৈতিক বিবেচনায় উত্তীর্ণ অথবা ক্ষমতাসীন দলের কাছের কোনো প্রভাবশালী অধ্যাপকের সমর্থন ছাড়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়া প্রায় অসম্ভব; যদিও দু-একটি ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়।

হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বাংলাদেশের অর্ধশত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্যেই। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে নির্ভর করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষকদের ওপর। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নিয়মিত বেতন নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে দৌড়াদৌড়ি করা এসব অধ্যাপকের নৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিচারক হিসেবে নিয়োগ করা হলে একজন ‘দলবাজ’ কিংবা ‘দুর্বল নৈতিকতার অধিকারী’ অধ্যাপক খুব সহজেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হয়ে যেতে পারবেন। তাঁর কাছে হয়তো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা বিবেচ্য বিষয় হবে না। বিচার বিভাগে গিয়ে তিনি পক্ষপাত বা দুর্নীতি করবেন, সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিচারক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ কতটুকু যৌক্তিক?

বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে শিক্ষকতা করা এবং আদালতে বিচার করা—দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষে পড়ান বা গবেষণা করেন। অন্যদিকে বিচারকাজ হলো একটি প্রায়োগিক বিষয়। আদালতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছাড়া এটা অন্য কোনোভাবে অর্জন করা সম্ভব নয়। বিচারকাজের জন্য দরকার বিচারিক মন, শক্ত নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ এবং সর্বোপরি বিচারপ্রার্থীদের প্রতি সহানুভূতি।

একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিচারকের আসনে বসে যখন বিচারকাজ শুরু করবেন, তখন তাঁকে শুরু থেকে বিষয়টি শিখতে হবে। অর্থাৎ একজন শিক্ষানবিশ বিচারকের মতো শুরু করতে হবে। কাজ করতে গিয়ে যখন তিনি খেই হারিয়ে ফেলবেন, তখন তাঁকে নির্ভর করতে হবে আইনজীবী, বেঞ্চ অফিসার, সহকারী বেঞ্চ অফিসারসহ অন্যদের ওপর। এ সুযোগে তাঁরা বিচারককে প্রভাবিত করতে পারেন, এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

তাঁর (আইনের অধ্যাপক থেকে বিচারক বনে যাওয়া) অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে বিচারকাজকে প্রহসনে পরিণত করবেন তাঁরা। ফলে বিচারপ্রার্থীরা সঠিক বিচার পাবেন না। রাষ্ট্র যে অর্থ ও সুযোগ-সুবিধা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে হওয়া বিচারকদের পেছনে ব্যয় করবে, তা অপচয় বা অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে বিচারপ্রার্থীদের এবং দেশের বিচারব্যবস্থার।

এ ছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেভাবে শিক্ষকদের বিভিন্ন গ্রুপ, উপগ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি করে সুপ্রিম কোর্টেও পেশাদার বিচারক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্রুপ সৃষ্টি হতে পারে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ থেকে এমনটা প্রতীয়মান হয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ বাংলাদেশের প্রশাসন ক্যাডারের আদলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরাসরি নিয়োগের সুবিধা নিতে যাচ্ছেন, যা অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান হয়ে দেশের লাখ লাখ বিনিয়োগকারীকে পথে বসিয়ে এখন কারাগারে। জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাত যে সর্বনাশ করেছেন, সেটি সবারই জানা। এ রকম উদাহরণ থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ কি ইতিবাচক?

কেন এমন সুপারিশ?

৯ সদস্যের সংবিধান সংস্কার কমিশনে সদস্য হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের দুই অধ্যাপক এবং একই বিভাগের দুই শিক্ষার্থী (পর্যায়ক্রমে)। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিচারক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশের ক্ষেত্রে কমিটির এই সদস্যদের ভূমিকা থাকতে পারে, কেউ যদি এমন অভিযোগ করেন, তাহলে কি খুব ভুল হবে? এই সমালোচনা খণ্ডন করবেন কীভাবে? ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি’র কথা বলা যেতে পারে, তবে সেটা যথেষ্ট যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয় না।

গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার কর্তৃক প্রস্তাবিত বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে একধরনের সমর্থন রয়েছে। সেই সমর্থন কিন্তু এমন নয়, সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাবে ‘অযৌক্তিক’ কোনো কিছু বলা হলে দেশের মানুষ সেটা বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করবেন।

সাধারণভাবে মানুষের চাওয়া হলো এমন কিছু সংস্কার করা হবে, যার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ভবিষ্যতে যাতে আর স্বৈরাচারী না হতে পারে; দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ হবে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এবং সর্বোপরি একটি উদার স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে টিকে থাকবে।

কিন্তু বিচার বিভাগ সংস্কারের নামে সংবিধান সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ করেছে, সেগুলো দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

সংস্কার কমিশন যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষকদের বিচারক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করেছে, সেটি পক্ষপাতমূলক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।

অনির্বাচিত নাগরিক নিয়োগ

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে অনির্বাচিত নাগরিকদের নিয়োগের সুপারিশের প্রবণতা দেখা গেছে, যেসব স্থানে সাধারণত নির্বাচিত প্রতিনিধিরা থাকেন। যেমন সংসদের উচ্চকক্ষে পাঁচজন নাগরিককে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর ফলে তাঁরা নির্বাচন না করে এবং রাজনৈতিক দলের সমর্থন ও জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াই নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মতোই সুযোগ-সুবিধা, মর্যাদা ভোগ করবেন।

এভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নাগরিকদের যুক্ত করা কতটুকু গ্রহণযোগ্য? একটা বিষয় লক্ষণীয়, বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নাগরিক সমাজ গড়ে উঠেছে কি না, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। তথাকথিত নাগরিক সমাজের সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। উচ্চকক্ষের সদস্য হয়ে তাঁরা কি সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থ রক্ষায় কাজ করবেন? এসব নাগরিকের দায়বদ্ধতা কোথায়? নির্বাচিতরা জনগণ ও নিজ রাজনৈতিক দলের কাছে জবাবদিহি করবেন, কিন্তু অনির্বাচিতরা জবাবদিহির বাইরে থাকবেন—এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।

কামরান রেজা চৌধুরী সাংবাদিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়: আবারও উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা
  • আবারও উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা, ক্ষমা চাইতে আলটিমেটাম
  • ঘরোয়া বাজি এবং ফেসবুক সমাচার
  • যৌন হয়রানি নিয়ে বেরোবি প্রক্টরের বক্তব্য ঘিরে তুমুল বিতর্ক
  • চিকিৎসাকর্মীদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে ইসরায়েলি বক্তব্য মিথ্যা: গাজা কর্তৃপক্ষ
  • ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপের কাজ কী?
  • ক্ষমতার প্রথম ১০০ দিনে ট্রাম্পের যত আলোচিত উক্তি
  • আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি গোলরক্ষক হুগো গাত্তি আর নেই
  • ‘বিসিবি আমার ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছে’
  • শিক্ষকদের বিচারক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ কতটা যৌক্তিক