‘ মেয়েটাকে সবার সামনে ধর্ষণ করে দুজন’
Published: 24th, February 2025 GMT
‘বাসের ৬ নম্বর সিটে ছিলেন এক মেয়ে। তিনি গানের অনুষ্ঠান থেকে ফিরছিলেন। তাঁর মাথায় সিঁদুর ছিল। সঙ্গে ছিলেন স্বামী ও ভাই। দুই ডাকাত ওই মেয়েকে টেনেহিঁচড়ে বাসের পেছনের সিটে নিয়ে যায়। ওই দুইজনের একজনকে শ্যামল বলে ডেকেছিল তাদের এক সঙ্গী। সে পাতলা গড়নের। নীল কোট পরা ছিল। আরেকজন ছিল সাদা চেক শার্ট পরা। এই দুইজন সবার সামনে মেয়েটাকে ধর্ষণ করে। অন্য নারীদের শরীরের স্পর্শকাতর স্থানেও স্পর্শ করে ডাকাতরা। আর ওই মেয়ের শরীরের বিভিন্ন স্থান রক্তাক্ত করে। তাঁর মুখের দিকে তাকানোর মতো অবস্থা ছিল না।’
গলার স্বর একটু নিচুতে নামিয়ে কথাগুলো বললেন রাজশাহী জেলার এক নারী। তিনি গত সোমবার রাতে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী চলন্ত বাসে ডাকাতি ও শ্লীলতাহানি ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। কথা বলতে গিয়ে ভয়ে কাঁপছিলেন। কারণ, সেদিন রাতে ওই বাসে তিনিও ছিলেন। ডাকাতরা তাঁর শরীরও স্পর্শ করে এবং টাকা ও গহনা ছিনিয়ে নেয়।
ওই নারীর বর্ণনা অনুযায়ী, সোমবার রাতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও গত শনিবার সংবাদ সম্মেলনে টাঙ্গাইলের এসপি মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘নারী যাত্রীদের প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। তবে শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে।’ গতকাল রোববার রাজশাহীর ওই নারী সাংবাদিকদের ধর্ষণের বিষয়টি জানালে এসপি মিজানুরের সঙ্গে কথা বলার জন্য মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি।
রাজশাহীর নারী ঘটনার বর্ণনায় জানান, তিনি সাভারে মেয়ের বাসায় গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন মেয়ের শাশুড়ি। ইউনিক রয়েল রোড পরিবহনের বাসে বাসটি রাত ১১টার দিকে ঢাকার গাবতলী থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ওই নারী ও তাঁর বেয়াইন ১২টার দিকে সাভাবের হেমায়েতপুর থেকে বাসটিতে ওঠেন।
তিনি বলেন, ‘বাসের ভেতরেই ডাকাত ছিল। হেমায়েতপুর থেকে ওঠে আরও দুইজন। অন্যরা গাবতলী থেকেই আসে। তাদের গেটআপ-সেটআপ ছিল ভালো– টাই, স্যুট, কোট, সানগ্লাস পরা। দেখে কেউ বুঝতে পারবে না তারা ডাকাত। আমরা সবাই বসে ছিলাম। সাভারের নন্দন পার্কে গাড়ি এলে হঠাৎ তিনজন দাঁড়িয়ে ড্রাইভারকে ছুরি ধরে বলে, বস, আপনি তো অনেকক্ষণ চালালেন এখন চাবি আমাদের দিয়ে দেন। ড্রাইভার এক কথাতেই চাবি দিয়ে দেন। এর পর গাড়ি নন্দন পার্কের রাস্তা থেকে গাজীপুরের রাস্তায় নিয়ে যায় ডাকাতরা। তখন জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি গাজীপুর, কোনাবাড়ী, সাফারি পার্কের ওই সাইড দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে আসছে। ভাবলাম, সামনে আরও বিপদ আছে বোধহয়।’
সেদিন বাসে চালকের পেছনের আসনে ছিলেন ওই নারী ও তাঁর বেয়াইন। ডাকাতদের একজন প্রথমে তাঁর মাথায় পিস্তল ধরে, আর একজন ছুরি উল্টো করে গলায় ধরে বলে, ‘তোর কাছে কী আছে দে।’ এরপর গলায় থাকা চেইন ও হাতের চুড়ি নিয়ে নেয় ডাকাতরা। মোবাইল ফোনটা আগেই নিয়ে নেয়। ব্যাগে ১০ হাজার টাকা থাকলেও প্রথমে তারা সেটা পায়নি। তাঁকে গালি দিয়ে একজন মাথায় থাপ্পড় মেরে বলে, ‘তোর কাছে টাকা আছে, দে।’ প্রথমে না দিলেও পরে সেই টাকা দিয়ে দেন। তবে ১০ হাজার টাকা পাওয়ার পরও এক ডাকাত সদস্য বলতে থাকে, ‘তোর কাছে আরও টাকা আছে।’ এ কথা বলে তাঁর শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করে।
তিনি জানান, ডাকাত দলে ৯ জন ছিল। তাদের একজন দক্ষ চালক। মূল চালককে সরিয়ে সে দ্রুত গতিতে দক্ষতার সঙ্গে বাস চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। চালকের সহকারীসহ সবাইকে ছুরি ধরে ছিল। সুপারভাইজারের পায়ের ওপর পা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল একজন। তাঁকে নড়াচড়া করতে দেয়নি। পিস্তল ছিল তিনজনের কাছে। বাকি সবার কাছে ছুরি। ডাকাত দলের নেতা সবার পরে উঠে দাঁড়িয়ে যাত্রীদের শরীর ও ব্যাগ তল্লাশি করে টাকা বের করে নেয়।
ওই নারী বলেন, ‘বাস তখন চলছেই। আমরা মোট ছয়জন মেয়ে ছিলাম। তিনজন বাদে সবাই বয়স্ক। ৬ নম্বর আসনে থাকা নারী ধর্ষণের শিকার হন। বাসের সব সিটে তখন যাত্রী ছিলেন। দাঁড়ানো ছিল ৭-৮ জন। পুরো তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা বাস চলে। এই সময় সব যাত্রীর কাছ থেকে টাকা, গহনা, মোবাইল ফোন নিয়ে নেয় ডাকাতরা। কারও কাছে পানি কিনে খাওয়ার মতো ১০ টাকাও ছিল না। সবাই আহাজারি করছিলেন।’
তিনি জানান, প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা এভাবে ঘোরার পর আবার নন্দন পার্কের তেল পাম্পের সামনে বাস থামায় ডাকাতরা। একজন-একজন করে নামতে থাকে এবং পিস্তল ও ছুরি যাত্রীদের দিকে তাক করে রাখে। আটজন নামার পর চক্রের সর্বশেষ সদস্য দৌড়ে চলে যায়।
ওই নারী বলেন, ‘তখন গভীর রাত, এলাকা নির্জন। কোনো দোকানপাট নেই। আমরা কিছুদূর গিয়ে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে ঘটনা বললাম, সেখানে তিন সেনাসদস্য ছিলেন। তারা বললেন, এখন রাত, আপনারা যে যার মতো নিরাপদে বাড়ি চলে যান। আমরা যেহেতু তিন সদস্য আছি, আমাদের ওপরও অ্যাটাক হতে পারে। ওরা কোনো পদক্ষেপ নেননি। এর পর আমরা টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানায় গেছি। সেখানে ওসি বলেন, এখন আমরা কেস নিতে পারব না, আপনারা সকাল ৯টায় আসেন। কিন্তু আমাদের তো সকাল ৯টা পর্যন্ত বসে থাকা সম্ভব না। তখন আমরা কাছাকাছি হাইওয়ে থানায় গেলাম। সেখানেও মামলা নেয়নি। হাইওয়ে পুলিশ বলে, যেখানকার ঘটনা সেখানে যেতে হবে, মির্জাপুরেই আবার যান।’
কোথাও মামলা না নেওয়ায় এবং ঘটনাটিকে গুরুত্ব না দেওয়ায় বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেন যাত্রীরা। ওই নারী বলেন, ‘বাসে নাটোরের বড়াইগ্রাম থানার দুই ব্যবসায়ী ছিল। একজন গুড় বিক্রেতা আর একজন মাছ ব্যবসায়ী। একজনের কাছে ছিল ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা, আরেকজনের কাছে দেড় লাখ টাকা। ওরা গরিব মানুষ। গাড়ির ভেতরে খুব কান্নাকাটি করছিল। আমরা সবাই-ই কান্নাকাটি করছিলাম, তবে ওরা বেশি। ওই ব্যবসায়ীদের একজন ফোন সেভ করেছিল। সে তার মাকে কল করে। পরে তার মা বড়াইগ্রাম থানার ওসিসহ পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়ান। আমরা পৌঁছানোর পর ওখান থেকে গাড়ি থানার মধ্যে নেওয়া হয়। সেখানে পুলিশদের বলার পর পকেটের টাকা দিয়ে সবাইকে বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এরপর যে যার মতো বাড়ি ফেরে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাটোরের এসপি আমজাদ হোসাইন সমকালকে বলেন, ‘নিয়ম হলো যেখানে ঘটনাস্থল, সেখানেই মামলা করতে হবে। এজন্য তাদের মির্জাপুর থানায় যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। তবে বড়াইগ্রাম থানায়ও মামলা নেওয়া যেত। এটা করলে যাত্রীরা উপকৃত হতো। এজন্য দায়িত্বে অবহেলা পাওয়ায় বড়াইগ্রাম থানার ওসি সিরাজুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। একই কারণে মির্জাপুর থানার ডিউটি অফিসারও বরখাস্ত হয়েছেন।’
এদিকে টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, বাসে ডাকাতি ও শ্লীলতাহানির ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা মাদকাসক্ত। মাদকের টাকা জোগাড় করতে তারা সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় ডাকাতি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজি করে থাকে। সম্প্রতি বাস থেকে লুট করা একটি মোবাইল ফোনের বিনিময়ে তারা গাঁজা নেয়। ওই গাঁজা বিক্রেতার সূত্র ধরেই সন্ধান মেলে ডাকাত চক্রের সদস্যদের। পরে অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গতকাল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা টাঙ্গাইল জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই মো.
রাজশাহীর নারীর বক্তব্যের বিষয়ে টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এক যাত্রীর সাক্ষাৎকারের বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে দু’জন আদালতে সাক্ষী দিয়েছে। জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তাদের গ্রেপ্তার করতে পারলে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র একজন ওই ন র আম দ র স পর শ দ র এক র ঘটন সদস য ব যবস ত নজন
এছাড়াও পড়ুন:
বাবার ঠিকাদারির লাইসেন্স ছিল, জানিয়ে ক্ষমা চাইলেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ
বাবার ঠিকাদারি লাইসেন্স থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে ‘বাবার ভুলের জন্য’ ক্ষমা চেয়েছেন অন্তবর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি আজ বৃহস্পতিবার নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া পোস্টে ক্ষমা চান।
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বাবার ঠিকাদারি লাইসেন্স থাকার বিষয়টি জানিয়ে গতকাল বুধবার রাতে ফেসবুকে পোস্ট দেন এক গণমাধ্যম কর্মী। তিনি বিষয়টির সত্যাসত্য জানতে চান আসিফ মাহমুদের কাছে। আসিফ মাহমুদ খোঁজ করে জানান যে, তাঁর বাবার লাইসেন্স নেওয়ার বিষয়টি সঠিক। আর বিষয়টি তাঁকে জানান বলেও ওই গণমাধ্যম কর্মী তাঁর পোস্টে উল্লেখ করেন। এরপরই আজকে আসিফ মাহমুদ বিষয়টি নিয়ে পোস্ট দিলেন। সেটি হুবুহু তুলে ধরা হলো:
‘প্রথমেই আমার বাবার ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
গতকাল রাত ৯ টার দিকে একজন সাংবাদিক কল দিয়ে আমার বাবার নামে ইস্যুকৃত ঠিকাদারি লাইসেন্সের বিষয়ে জানতে চাইলেন। বাবার সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলাম তিনি জেলা পর্যায়ের (জেলা নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার এর কার্যালয় থেকে ইস্যুকৃত) একটি লাইসেন্স করেছেন। বিষয়টি উক্ত সাংবাদিককে নিশ্চিত করলাম। তিনি পোস্ট করলেন, নিউজও হলো গণমাধ্যমে। নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে তাই ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজনবোধ করলাম।
আমার বাবা একজন স্কুল শিক্ষক। আকুবপুর ইয়াকুব আলী ভুঁইয়া পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। স্থানীয় একজন ঠিকাদার কাজ পাওয়ার সুবিধার্থে বাবার পরিচয় ব্যবহার করার জন্য বাবাকে লাইসেন্স করার পরামর্শ দেন। বাবাও তার কথায় জেলা নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার থেকে একটি ঠিকাদারি লাইসেন্স করেন। রাষ্ট্রের যেকোন ব্যক্তি ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে যেকোন লাইসেন্স করতেই পারে। তবে আমি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বরত থাকা অবস্থায় বাবার ঠিকাদারি ব্যবসায় জড়ানো স্পষ্টভাবেই কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। বিষয়টি বোঝানোর পর আজ বাবার আবেদনের প্রেক্ষিতে লাইসেন্সটি বাতিল করা হয়েছে।
বাবা হয়তো কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের বিষয়টি বুঝতে পারেন নি, সেজন্য বাবার পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
উল্লেখ্য, মধ্যবর্তী সময়ে উক্ত লাইসেন্স ব্যবহার করে কোনো কাজের জন্য আবেদন করা হয়নি।’