গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট কতটা তীব্র হতে যাচ্ছে?
Published: 23rd, February 2025 GMT
দেশে গরম পড়তে শুরু করায় বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন না হওয়ায় এরই মধ্যে লোডশেডিং শুরু হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম: ‘গ্যাস-বিদ্যুতে ভয়াবহ ভোগান্তির আশঙ্কা’। অন্যান্য সংবাদপত্রেও রয়েছে এ ধরনের খবর। বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমাদের যথেষ্ট সক্ষমতা নেই, তা কিন্তু নয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সক্ষমতাও রয়েছে। তবে আমরা যথেষ্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছি না মূলত প্রাথমিক জ্বালানির অভাবে। অভাবটা আসলে অর্থের। এই অর্থের যথেষ্ট জোগান থাকলে অর্জিত সক্ষমতা ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করে নেওয়া যেত। তাতে অর্থনীতি ও জনজীবনে সুফলও মিলত। বাস্তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অর্জিত সক্ষমতার অনেকখানি অব্যবহৃত থাকায় উল্টো গুনতে হচ্ছে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’।
বিদ্যুৎ সংকটের সঙ্গে গ্যাসের সম্পর্ক নিবিড়। সিংহভাগ বিদ্যুৎ আমরা উৎপাদন করি গ্যাস দিয়ে। এর বড় চাহিদা রয়েছে শিল্প খাতেও। ভারী শিল্পের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসের চাহিদা বেড়েছে দ্রুত। এ অবস্থায় বাসাবাড়িতে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের নীতি থেকে সরে আসে সরকার। সেখানে উৎসাহিত করা হচ্ছে এলপি গ্যাস ব্যবহারকে। গ্যাসের উল্লেখযোগ্য চাহিদা রয়েছে সার কারখানায়। কিন্তু সব সার কারখানা একযোগে চালিয়ে এর উৎপাদন কাম্য পর্যায়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে না কখনোই। এ মুহূর্তে খবর– সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে সামনে এটা জোগানো হবে বিদ্যুতে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে পূর্ণ ক্ষমতায় চালু রাখার চেষ্টা থাকবে মার্চ থেকে। কয়লা, ফার্নেস অয়েল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার চেষ্টাও থাকবে। এসব জ্বালানিতে আমরা আবার ব্যাপকভাবে আমদানিনির্ভর। ‘আমদানি সক্ষমতা’র প্রশ্ন ওঠে স্বভাবতই। গ্যাসও দেশীয় উৎস থেকে যথেষ্ট মিলছে না। দেশীয় উৎস থেকে সিংহভাগ গ্যাস আবার জোগায় বিদেশি কোম্পানি। তাদের বকেয়া বিল পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। বিদেশি যেসব উৎস থেকে এলএনজি এনে পরিস্থিতি সামলানো হচ্ছে, সে ক্ষেত্রেও রয়েছে বকেয়া বিলের সংকট। এ নিয়ে ‘সরবরাহ সংকট’ দেখা দিলে কী হতে পারে পরিস্থিতি, সে প্রশ্নও সামনে এসেছে।
বিদ্যুৎ খাতেও বকেয়া বিল পরিশোধের সংকট কম নেই। বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা অন্তত অর্ধেক পাওনা টাকা চাইছে, যাতে উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে। ভারত থেকেও (প্রধানত আদানি) উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ আমরা আনছি। তারাও বকেয়া পরিশোধে চাপ দিচ্ছে। তাদের সঙ্গে বিগত সরকারের আমলে সম্পাদিত চুক্তি প্রশ্নবিদ্ধ হলেও, এ মুহূর্তে আদানির বিদ্যুৎ আমাদের লাগছে। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের হিসাবায়ন নিয়ে মতভেদ আছে তাদের সঙ্গে। গোটা জ্বালানি খাত বিগত সরকার যেভাবে সাজিয়েছিল, তাতেও আছে গুরুতর প্রশ্ন। সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। তবে এ মুহূর্তে জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে– সামনেই লোডশেডিং কতটা বাড়বে। মার্চের শুরুতে রমজানও শুরু হচ্ছে। এ সময় গ্যাস সরবরাহে সংকট আরও বাড়বে কিনা– এ প্রশ্নও উপস্থিত।
শীতেও গ্যাস সংকট কম মোকাবিলা করতে হয়নি এবার। শিল্পে তো বটেই; বাসাবাড়িতে গ্যাসের ঘাটতি অনেক ভুগিয়েছে। এলপি গ্যাসে রান্না এবং রেস্তোরাঁর ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে মানুষের। তাতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে চলমান মূল্যস্ফীতিতে। আর শিল্পের অন্যান্য সংকটের সময় যুক্ত হয়েছে গ্যাসের ঘাটতিজনিত সমস্যা। গ্যাস সংকটে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোনো কোনো শিল্পাঞ্চলে চলমান অস্থিরতা পেয়েছে নতুন মাত্রা। সামনে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশি গ্যাস জুগিয়ে শিল্পে সেটা কমানো হলে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, কে জানে! প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকেও গ্যাসের চাহিদা অনেক। বস্ত্র, সিরামিক, সিমেন্ট, স্টিলের মতো শিল্প গ্যাসের ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল। এদিকে সরকার আবার শিল্পে (প্রধানত নতুন সংযোগে) ব্যবহৃত গ্যাসের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে চাইছে। এতে স্বভাবতই তীব্র আপত্তি রয়েছে উদ্যোক্তাদের। তবে মূল সমস্যা হলো, উচ্চ দামেও চাহিদামতো গ্যাস পাচ্ছে না শিল্প খাত। বিগত সরকারের আমলে এর দাম তো কম বাড়ানো হয়নি। তখন সংশ্লিষ্ট সবাই এটা মেনে নিয়েছিলেন এই প্রতিশ্রুতিতে– ‘নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস’ মিলবে। কিন্তু বাসাবাড়িতে বাঁধা বিল পরিশোধকারীরাও গ্যাস ঠিকমতো পাচ্ছে না।
গ্যাসের চাহিদা সঠিকভাবে নির্ণীত হয়নি বলেই মনে হয়। বিদ্যুতের চাহিদাও কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা রয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে বলেই দাবি। এ অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহে কতটা কী ঘাটতি হচ্ছে, তা নিশ্চয় স্বচ্ছভাবে জানানো হবে। আগাম তথ্য পরিবেশন করে বিভিন্ন খাতকে প্রস্তুত রাখার ব্যাপারও রয়েছে। তাতে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়তো কিছুটা সুবিধা হবে। সংকটকালে গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতে অপচয় রোধের কথাটি বলা হয়ে থাকে। সম্প্রতি জ্বালানি উপদেষ্টা জোর দিয়েছেন এসির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে এনে দুই হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের ওপর। তাদের ধারণা, সামনে লোডশেডিং দুই হাজার মেগাওয়াটের মধ্যেই থাকবে। সব খাতে এসির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে তাহলে আর লোডশেডিংয়ের প্রয়োজন হবে না– এটাই তাঁর অভিমত। এমন অভিমত অতীতেও কম শোনা যায়নি। বাস্তবতা হলো, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা কঠিন। সরকারি সংস্থা প্রদত্ত হিসাবে গরমিলও থাকে। উপদেষ্টা পরিষদ না চাইলেও আমলারা সংকটের তীব্রতা কিছুটা হলেও আড়াল করতে চাইবে। কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুৎ না পেলে সংশ্লিষ্ট সবাই ঠিকই বুঝতে পারবে এর তীব্রতা। এসব জরুরি সেবা ঘিরে অতীতে বড় অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে মানুষ অবশ্য অনুধাবন করছে, এসবের জন্য বর্তমান সরকার দায়ী নয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা বরং হিমশিম খাচ্ছে।
রমজানে পণ্যের বাজার শান্ত রাখতে এবার আগে থেকেই উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তবে ঘনায়মান গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট সুনিয়ন্ত্রণে থাকবে না বলে মনে হচ্ছে। বকেয়া বিল পরিশোধের সংকটে সরকার কেবল বিপিসির ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আনতে পেরেছে বলে জানা যায়। সংকট নাকি আরও বেড়েছে পিডিবি ও পেট্রোবাংলার ক্ষেত্রে। যেভাবেই হোক, এটাকে আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। আদানি, শেভরন, কাতার এনার্জিসহ যারা বিপুল অর্থকড়ি পায়, তাদের বিল পরিশোধে অন্তত আশ্বস্ত করতে হবে সরকারকে। ডলারে অর্থ পরিশোধে সংকট থাকলে সেটারও দ্রুত নিরসন জরুরি। প্রাথমিক জ্বালানি আমদানি যেন কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়। দূরের উৎস থেকে জ্বালানি আমদানিতে বেশি সময় লাগলে সেটাও সংকট বাড়িয়ে তোলে। এলএনজি পরিশোধনে নিয়োজিত আমাদের দুটি টার্মিনালই ভাসমান। প্রাকৃতিক দুর্যোগে এগুলো অকেজো হয়েও সংকট বাড়ায়। সামনে বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়ে ওঠার সময়ে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস সরবরাহও স্বাভাবিক রাখতে হবে। কূপ খনন আর সংস্কার করে উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়াস জোরদার করা চাই। অন্তর্বর্তী সরকার এ ক্ষেত্রে রেখে যেতে পারে কিছু অনুসরণযোগ্য পদচ্ছাপ।
আমরা ধান-চাল উৎপাদনে কিছুটা সংকটে আছি। এ অবস্থায় চলমান বোরো মৌসুমে সেচে বিদ্যুৎ সরবরাহও স্বাভাবিক রাখতে হবে। নইলে ডিজেল ব্যবহারে খরচ বাড়বে কৃষকের। বিদ্যুতের অভাবে গ্রামীণ অকৃষি খাতও যেন বাড়তি সংকটে না পড়ে। এর কুপ্রভাব পড়বে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্যে।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গ য স সরবর হ ব ল পর শ ধ পর স থ ত উৎস থ ক ব যবহ র ক ষমত সরক র আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
চাল কিনতে ভিড়, আটা বরাদ্দ দাবি
ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা পৌরসভার দুটি ডিলার পয়েন্টে দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে ওএমএসের চাল কিনছেন ক্রেতারা। তারা দীর্ঘদিন ধরে আটার দাবি জানিয়েও না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পৌরসভার বাঁকাইলে ও দুপুরে মিঠাপুর এলাকায় ডিলার পয়েন্ট ঘুরে দেখা যায়, ক্রেতারা চাল কেনার আশায় জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বরাদ্দের থেকে চাহিদা অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন ডিলাররা। চালের পাশাপাশি আটা না থাকায় স্থানীয়রা হতাশ ও ক্ষুব্ধ। তারা আটা বরাদ্দর জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
চাল কিনতে আসা বাঁকাইল গ্রামের রাজমিস্ত্রি কামরুল ইসলাম বলেন, তিনি বেশ কিছু দিন ধরে এখান থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে ৫ কেজি করে চাল কেনেন। চালের মান বেশি ভালো না। ভাত খেতে অনেক কষ্ট হয়। তবু তারা নিরুপায়। কেননা মোটা চাল বাজারে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি।
একই গ্রামের বাসিন্দা ভ্যানচালক মনির হোসেনের স্ত্রী রিনিয়া বেগম বলেন, তাঁর স্বামীর আগের মতো উপার্জন নেই। স্থানীয় এনজিওর ঋণের কিস্তি প্রতি সপ্তাহে পরিশোধ করতে হয়। বেশি টাকায় চাল কিনতে গেলে সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়ে। গত বছর আটা পেয়েছিলেন। আটার মান খারাপ হলেও খেতে সমস্যা হয় না। মোটা চালের ভাত খেতে কষ্ট হয়। তিনি সরকারের কাছে চালের পাশাপাশি আটা বরাদ্দের দাবি জানান।
মিঠাপুর গ্রামের দিনমজুর মহব্বত আলী দুপুর পৌনে ২টার দিকে ডিলার পয়েন্টে আসায় খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। তিনি আসার আগেই চাল শেষ হয়ে যায়। শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটির দিন চাল দেওয়া হয় না। তাই তাঁকে (আজ) রোববার আসতে বলা হয়েছে।
পৌরসভার বাসিন্দা নাছির মিয়া, বাশার শেখসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, আলফাডাঙ্গা পৌরসভার বাকি ৬টি ইউনিয়নে ওএমএসের চাল বিক্রি না করায় বাইরের লোকও এসব ডিলার পয়েন্ট থেকে চাল সংগ্রহ করেন। ফলে এসব পয়েন্টে অনেককেই চাল না পেয়ে ফিরে যেতে হয়। এসব ডিলার পয়েন্টে একসময় আটা বিক্রি হতো। এক বছর হলো কোনো আটা বরাদ্দ নেই। সব ক’টি ইউনিয়নে ওএমএসের ন্যায্যমূল্যে চাল ও আটা বিক্রয় কার্যক্রম চালুর দাবি জানান তারা।
প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ওএমএসের পাশাপাশি টিসিবির কার্যক্রমের বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানান স্থানীয়রা।
বাঁকাইল এলাকার ডিলার আনন্দ কুমার কুণ্ডু জানান, সরকার থেকে প্রতিদিন দেড় টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। অল্প সময়ের মধ্যে সেই চাল শেষ হয়ে যায়। অনেকেই খালি হাতে ফিরে যান। প্রায় সবাই আটা চান। বরাদ্দ না থাকায় আটা দিতে পারেন না বলে জানান তিনি।
আলফাডাঙ্গা খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সানাউল্লাহ সানি জানান, পৌরসভার তিনটি ডিলার পয়েন্ট থাকার কথা থাকলেও একটি বন্ধ রয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে বাকি ডিলার পয়েন্ট চালু করা হবে। এখন ডিলারদের প্রতিদিন দেড় টন চাল সরবরাহ করা হচ্ছে। ইউনিয়নে খাদ্যবান্ধব চাল সরবরাহ করা হয় বছরে পাঁচ মাস। মার্চ-এপ্রিল, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে এর কার্যক্রম চলে। আলফাডাঙ্গা পৌরসভায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কার্ডধারী উপকারাভোগী রয়েছে। আটা বরাদ্দ নেই। বরাদ্দ এলে সব ডিলার পয়েন্টে আটা সরবরাহ করা হবে বলে জানান তিনি।