দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক সংকটময় ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। শুধু অন্ধকার হলে হয়তো টর্চলাইট ফেলে দেখতে পারা যেত। কিন্তু এ অন্ধকার কুয়াশাচ্ছন্ন ও ধোঁয়ায় ভরা। আলো ফেলে নিকটকেও দেখা যাচ্ছে না। এমন একটি পরিস্থিতিতে পথ চলতে, পা ফেলতে অনেক সতর্ক থাকতে হয়। সামান্য ভুলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। 

কেন বলছি এমন কথা? 
জুলাই অভ্যুত্থানের আগে বাংলাদেশের বাস্তবতা ছিল এক রকম। অভ্যুত্থান-উত্তর সে পরিস্থিতি অন্য রকম। তখন বামপন্থিদের সংগ্রামের যে নীতি-কৌশল ছিল, এখন তা বদলে যাওয়াই স্বাভাবিক। এই প্রেক্ষাপটে সংগঠন ও সংগ্রামের নীতি-কৌশল বদল করার বাস্তবতা তৈরি হয়েছে।  

কী সেই বাস্তবতা? 
তখন সিপিবি-বাসদ ও অন্য বামপন্থিদের নীতি ছিল দ্বিদলীয় ধারা ও পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি বিকল্প ধারা তৈরি করা। কিন্তু এখন একটি প্রধান ধারা আওয়ামী লীগ জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে মাঠে অনুপস্থিত। বিএনপি বিদ্যমান থাকলেও লীগের স্থানে দক্ষিণপন্থি ধর্মান্ধ জামায়াত বসেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমন্বয়কদের প্রস্তাবিত রাজনৈতিক দল। দ্বিদলীয় ধারার স্থানে ত্রিদলীয়/বহুদলীয় ধারা তৈরি হলেও এখানে মধ্যপন্থি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারা অনুপস্থিত। এই শূন্যতা পূরণের দায় এসে পড়েছে বামপন্থিদের ওপর। 

সে ক্ষেত্রে কী করতে হবে? 
এ ক্ষেত্রে বামপন্থি দলগুলোকে আরও সুসংহত ও সংগঠিত হতে হবে। দলগুলোর মধ্যে সব ধরনের দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে। শুধু তাই নয়; দেশে একটি বৃহত্তর বাম ও মধ্যবাম ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশে বিকল্প রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা থাকলেও বাম ও মধ্যপন্থি দলগুলোর শক্তি ও সামাজিক অবস্থার দুর্বলতার কারণে তা হয়ে ওঠেনি। এখন ঐক্যের প্রচলিত ধারার বাইরে সামাজিক শক্তিকে সংগঠিত করার কর্তব্য ও কৌশল সামনে এসেছে।   

কেমন হবে সেই ঐক্যের কাঠামো?  
প্রচলিত নিছক রাজনৈতিক দলকেন্দ্রিক ঐক্যের ভাবনা থেকে বেরিয়ে একটি দৃশ্যমান কার্যকর ফলভিত্তিক ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। সেখানে শুধু রাজনৈতিক দলই থাকবে না; সামাজিক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা, জাতি-ধর্ম এবং ব্যক্তি-সংস্থাও থাকতে পারে। এই ধারায় যারা থাকবে তাদের প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। 
(১) প্রথম ধাপে থাকবে বামপন্থি দলগুলোর ঐক্য। তারা থাকবে বৃহত্তর ঐক্যের কেন্দ্রে এবং এই ঐক্য গঠনের মূল অনুঘটক ও শক্তি। 
(২) দ্বিতীয় ধাপে থাকবে মধ্যপন্থি, উদার গণতান্ত্রিক দল ও নীতি-আদর্শের ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা-সংগঠন।  
(৩) তৃতীয় ধাপে থাকবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, জাতি-ধর্ম, ব্যক্তি-সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে এই ধাপে যারা যুক্ত হতে পারে; ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের সংগঠন, শিক্ষক, ট্রেড ইউনিয়ন, নারী সংগঠন, পরিবেশবাদী, হকার-বেকার, রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক, কৃষক-ক্ষেতমজুর, সৎ ব্যবসায়ী, এনজিও, বিভিন্ন সংস্থা-প্রতিষ্ঠান, বিশিষ্ট ব্যক্তি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব-খেলোয়াড়, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার প্রমুখ।  

এই ঐক্যের প্রভাব ও ফলাফল কী হবে? 
এ উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজের ব্যাপক সংখ্যক মানুষের সমাবেশ ঘটানো ও সমর্থন আদায় সম্ভব। যেমন আদিবাসী সংগঠনগুলোর মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা এসব জনগোষ্ঠীর সমর্থন পাওয়া যেতে পারে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ইত্যাদি) কারণে তাদেরও সমর্থন আদায়ের সুযোগ হবে। বিভিন্ন পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তিকে যুক্ত করার মাধ্যমে সমাজে একটি জাগরণ সৃষ্টি সম্ভব। এর বদৌলতে সংসদে কয়েকজন জনপ্রতিনিধি পাঠানো গেলে তাদের ইতিবাচক ভূমিকা জাতীয় রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে।      
এ ধরনের ঐক্যের উদাহরণ কি আছে?

বাংলাদেশে এ ধরনের জোট চর্চার ধারণা অভিনব হলেও অনেক দেশেই তা আছে। শ্রীলঙ্কার কথাই বলা যায়। সেখানকার বামপন্থিরা এই কৌশল অবলম্বন করেই ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন বামপন্থি দল ‘জনতা বিমুক্তি পেরামুনা’র নেতা অনুঢ়া কুমারা দিশানায়েকের নেতৃত্বে গঠিত বাম জোটে আছে ‘পাবলিক সার্ভিসের জন্য পাবলিক সার্ভেন্ট জাতীয় ভিক্ষু ফ্রন্ট, জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য ডাক্তার, ইন্টার কোম্পানি এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন, গণ-গাইডিং শিল্পী, জাতীয় বুদ্ধিজীবী সংস্থা, সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রগতিশীল মহিলা সংঘ, অল সিলন এস্টেট ওয়ার্কার্স ইউনিয়নসহ প্রায় ২২টি সংগঠন।   

বৃহত্তর ঐক্যের নীতি ও পরিধি কী হবে?
এই মুহূর্তে বৃহত্তর ঐক্যের ভিত্তি হবে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে রক্ষা ও সমাজের বিরাজমান সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ। নিপীড়িত শ্রেণি ও জনগোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে ন্যূনতম ইস্যুতে ঐক্য গড়ে তোলা। আমাদের দেশে এ ধরনের ঐক্যের ধারণা নতুন। তাই তা হয়তো এখনই সম্ভবপর হবে না। তবে এর পক্ষে বামপন্থি দলগুলোর ভেতরে-বাইরে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা এবং সংগতিপূর্ণ ক্রিয়া এখনই শুরু করা যায়।

প্রার্থীর সংখ্যা, না নির্বাচিত প্রতিনিধি দরকার?  
সম্প্রতি দৈনিক দেশ রূপান্তরে এক সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে, আগামী নির্বাচনে বামজোট ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে। আমার মনে হয়, বামপন্থিরা নির্বাচনে কতগুলো আসনে প্রার্থী দেবে, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কয়টি আসনে তারা বিজয়ী হবে। নির্বাচনের জন্য নির্বাচন না করে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে নির্বাচন করার কার্যকর কৌশল অবলম্বন করতে হবে। সেটা করতে হলে বৃহত্তর রাজনৈতিক-সামাজিক মধ্য-বাম ঐক্যের আপাতত কোনো বিকল্প নেই। এমনকি কিছু আসনে স্বাধীনতার শক্তি বিএনপির সঙ্গেও নির্বাচনী বোঝাপড়া হতে পারে। সেটা না হলে নিজেদের শক্তিতে এগিয়ে যেতে হবে। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় কনভেনশন আহ্বান সময়ের দাবি। 

ড.

মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত র জন ত ক দলগ ল র ব মপন থ র জন য ধরন র স গঠন

এছাড়াও পড়ুন:

নেপালের দায়িত্বে বাংলাদেশের সাবেক কোচ

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ব্যাটার স্টুয়ার্ট ল নেপালের হেড কোচের দায়িত্ব পেয়েছেন। আগামী দুই বছরের জন্য তাকে জাতীয় দলের প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে নেপাল ক্রিকেট বোর্ড। গত ফেব্রুয়ারিতে কোচ মন্টি দেশাইয়ের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তার স্থলাভিষিক্ত হলেন স্টুয়ার্ট ল।  

স্টুয়ার্ট ল এর আগে বাংলাদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানের কোচ হিসেবে কাজ করেছেন। সর্বশেষ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কোচ ছিলেন, তবে নিয়োগের সাত মাস পর ২০২৪ সালের অক্টোবরে তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে তার কোচিংয়ে দারুণ সাফল্য পেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তার অধীনে বাংলাদেশকে টি-টোয়েন্টি সিরিজে হারায় তারা এবং প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার এইটে জায়গা করে নেয়।  

আগামী জুনে স্কটল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলবে নেপাল, যেখানে স্কটল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে মাঠে নামবে তারা। বিশ্বকাপ লিগ-২ এর অংশ হিসেবে অনুষ্ঠিত এই সিরিজই হবে স্টুয়ার্ট ল'র প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট।  

বাংলাদেশের সঙ্গে স্টুয়ার্ট ল'র সম্পর্ক বেশ পুরোনো। তার কোচিংয়েই ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপের ফাইনালে খেলেছিল বাংলাদেশ। জাতীয় দলের পাশাপাশি বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এছাড়া, অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলের ব্যাটিং কোচ ও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সেন্টার অব এক্সেলেন্সের দায়িত্বেও ছিলেন এই অভিজ্ঞ কোচ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ