জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক আবু সাঈদ খান রচিত ‘মুক্তিসংগ্রামে বিপ্লববাদ ও অন্যান্য’ গ্রন্থটিকে ঐতিহাসিক তথ্যাশ্রয়ী একটি বিশ্লেষণী গ্রন্থ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এ গ্রন্থে সুলতানি শাসনাধীন সময়ের কিছু স্পর্শকাতর অংশ, ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশোত্তর কাল, দেশভাগ, প্রাক-স্বাধীনতাকালের ধারাক্রমিক অভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ, বাংলাদেশোত্তর অস্থির রাজনীতি, এর প্রায় সব ঐতিহাসিক চরিত্র, ধাপ, ঝাঁপ, বাঁক, অভিঘাতসহ বর্ণিত ও বিশ্লেষিত। লেখক নিজেও বর্ণিত আন্দোলনঘন সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের প্রত্যক্ষদর্শী ও অংশী। তাই তাঁর বিশ্লেষণ হয়ে উঠেছে প্রাণময়; তত্ত্বের ওপর তথ্য, স্বপ্নাবিষ্টতার ওপর বাস্তবতা, অনুমানের ওপর অভিজ্ঞতা প্রাধান্য পেয়েছে।

মানুষের পক্ষে নির্মোহ হওয়া কঠিন। গণতান্ত্রিক কাঠামোয় যেহেতু প্রত্যেকের হাতে অদৃশ্য রাজদণ্ড আছে, সেহেতু মোহমুক্ত মন নিয়ে তাকে রাজ্যভার বহন ও চালনার স্বার্থে ইতিহাসের প্রবাহ বুঝতে হয়, গন্তব্যের দিকে চোখ রাখতে হয়, প্রতিবন্ধকগুলোর মুখোমুখি হওয়ার সাহস রাখতে হয়। মোহের খঞ্জর সমষ্টির নিয়তিকে কাটে, তাকে পরিণত দেহ নিয়ে দাঁড়াতে দেয় না। এর প্রতিকার কী? 

ধর্ম ও আদর্শ, অর্থ ও সাম্রাজ্য কিংবা সাম্য সংস্থাপনের তাৎক্ষণিক তাড়নায় যখন শাসক ও শাসিত উভয় পক্ষ বর্তমানের পরিবর্তে অতীত বা ভবিষ্যতে বাস করতে থাকে, তখন বিপর্যয় আসে। বিপর্যয় রোধে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোটাধিকারপ্রাপ্ত প্রত্যেক শিক্ষিত নাগরিককে চিন্তার নৈরাজ্য থেকে বের হয়ে আসতে হয় যেমন তথ্যাশ্রয়ী, তেমনই দর্শনসচেতন হতে হয় তাকে। নিছক তথ্যাশ্রয়ী মন সব সময় সত্য পথ দেখায় না। তথ্যের বিরুদ্ধে তথ্য দাঁড়িয়ে সহজে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে, যদি দর্শনে খাদ থাকে। মানুষের পৃথক দার্শনিক বিভিন্ন অবস্থান থাকতেই পারে। এই বহুত্ববাদ কল্যাণমুখী করে তোলা যায় যদি চরমপন্থা বর্জন করে মধ্যম পন্থাকে আশ্রয় করা যায়। মধ্যমপথ বর্জিত হওয়ার কারণে বিপুল সমর্থন ও ক্ষমতা নিয়ে আবির্ভূত বহু শাসক, বিপুলা বোধ নিয়ে জাগ্রত বহু জনসমষ্টি ব্যর্থ হয়ে যায়। ‘মুক্তিসংগ্রামে বিপ্লববাদ ও অন্যান্য’ গ্রন্থটি এই মধ্যমপন্থাকে এগিয়ে রাখে। যুগে যুগে গণমানুষের দীর্ঘস্থায়ী কল্যাণে যথাসম্ভব কম লোকক্ষয় ও শক্তিক্ষয় ঘটিয়ে কীভাবে এগোনো যেতে পারে, বহুদিকগামী বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে গ্রন্থটি সেই লব্ধি-পথ নির্দেশ করতে চায়।

আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রীয় বিচৈতন্যের দিকে তাকালে একটি কথা মনে বাজে। যখন ভোটাধিকার হরণ করে কোনো শাসক দানব হয়ে ওঠে, নৈরাজ্যবাদ ছাড়া তার পতন ঘটানো প্রায় অসম্ভব। দানবের পতন যখন ঘটে যায়, তখন নৈরাজ্যকে থামতে হয়, কারণ তার কাজ শেষ হয়েছে। তখনও যদি তা চলতে থাকে, দীর্ঘ পরিসরে নাগরিক-অকল্যাণের কারণ ঘটায়। যুগে যুগে, প্রতিটি বাঁক-সন্ধিতে নৈরাজ্য তার ভূমিকা রেখেছে। যখনই বাঁক অতিক্রমের পরও কোনো না কোনো কারণে ও সুযোগে নৈরাজ্য বজায় থেকেছে, জাতি পথ হারিয়েছে। নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে যে দার্শনিক পরিপক্বতা দরকার, তা অর্জনের দায়িত্ব গণতান্ত্রিক কাঠামোয় প্রত্যেক শিক্ষিত বোধ ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিকের ওপর বর্তায়। আমাদের বর্তমান কি সেই দাবি মেটাচ্ছে? আমরা কালের ঘূর্ণায়মান চাকায়, ভুলের একই পরিধির নিচে আবারও পিষ্ট হয়ে চলেছি।

এ গ্রন্থ থেকে হয়তো এ মুহূর্তে আমাদের স্থিরতা অর্জনের কিছু পথনির্দেশ মিলতে পারে। শান্তির গন্তব্যভেদ জরুরি। তীর গন্তব্যে ছুটে যাওয়ার আগে ধনুকে ভর দিয়ে খানিক পেছায়। তীরের পেছানোর মতোই ‘মুক্তিসংগ্রামে বিপ্লববাদ ও অন্যান্য’ আমাদের সুলতানি, ঔপনিবেশিক ও প্রাক-বাংলাদেশকালে নিয়ে যায়, যেখানে তৎকালীন শাসকদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কীভাবে আমরা সংগঠিত হয়েছিলাম, কোন ভুলগুলো আমাদের পিছিয়ে দিয়েছিল, কোন ঠিক সিদ্ধান্তটি নেওয়ায় সবাই সুফল ভোগ করেছে– এসব বিশ্লেষিত হয়েছে। একই সঙ্গে সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের পুরাতন রাজনৈতিক সংশ্রবও এখানে আলোচিত হয়েছে। উপলক্ষ হিসেবে এসেছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

আবু সাঈদ খানের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে দেওয়া ভাষণ ও প্রকাশিত লেখা থেকে উৎকৃষ্টতার বিচারে পনেরোটি রচনা এ গ্রন্থে স্থান দেওয়া হয়েছে। কিছু শিরোনাম আগ্রহ জাগাতে পারে। ‘পলাশীর বিপর্যয় ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড’, ‘মুক্তিসংগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধ’, ‘বিদ্রোহী ও সেই সময়’, ‘ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের রাজনীতি’, ‘একাত্তরের পথ দেখিয়েছে ঊনসত্তর’, ‘সংবাদমাধ্যম রাষ্ট্র ও রাজনীতি’, ‘নিখোঁজ সংস্কৃতি ও সংবাদমাধ্যমের সংবেদনশীলতা’, ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বিপ্লববাদ’, ‘বহুত্ববাদ: সেকাল ও একাল’ প্রভৃতি।

মুক্তিযুদ্ধে বিপ্লববাদ ও অন্যান্য, আবু সাঈদ খান, প্রচ্ছদ আনিসুজ্জামান সোহেল, পাঠক সমাবেশ, পৃষ্ঠা-১৪৬, মূল্য ৩৫০ টাকা।

হামিম কামাল: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: বইম ল আম দ র র জন ত র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য মনোনয়ন পেলেন ইমরান খান

পাকিস্তানের কারাবন্দী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রচারে তার প্রচেষ্টার জন্য নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। 

২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ইমরান খানের নাম প্রস্তাব করেছে পাকিস্তান ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স (পিডব্লিউএ) এবং নরওয়ে ভিত্তিক সংগঠন পার্টিয়েট সেন্ট্রাম। খবর আনাদোলু এজেন্সির।

শনিবার (২৯ ডিসেম্বর) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে পার্টিয়েট সেন্ট্রাম বলেছে, “আমরা আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি যে, মনোনয়নের অধিকারী এমন একজনের সঙ্গে (পাকিস্তান ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স) জোটবদ্ধ হয়ে, আমরা পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে তার কাজের জন্য নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করেছি।” 

আরো পড়ুন:

পাকিস্তানকে বিধ্বস্ত করে সিরিজ জিতল নিউ জিল্যান্ড

পাকিস্তানে ঈদ উপলক্ষে ট্রেনের ভাড়া কমল ২০ শতাংশ

বিবৃতিতে গণতন্ত্রের সংগ্রামে পিটিআই প্রধান ইমরান খানের নেতৃত্ব, মানবাধিকারের প্রতি তার অবস্থান ও পাকিস্তানিদের সমস্যা সমাধানে তার নিষ্ঠার প্রশংসা করা হয়েছে। 

এর আগে, ২০১৯ সালে দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার জন্য ইমরান খানকে নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল। সেবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য ইমরান খানের নাম মনোনীত করেছিল মার্কিন পত্রিকা ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর।

প্রতি বছর, নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি শত শত মনোনীতদের নাম পায়, যার পরে তারা দীর্ঘ আট মাসের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিজয়ী নির্বাচন করে।

 

পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খান ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে কারাগারে রয়েছেন। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত একটি মামলায় তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

এটি চতুর্থ বড় মামলা যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রি, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ফাঁস এবং বেআইনি বিবাহ সম্পর্কিত তিনটি দোষ উচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল বা স্থগিত হয়েছে।

২০২২ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটের পর ইমরান খান ক্ষমতা হারান। তিনি তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন, এগুলোকে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করেন।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ