ইংরেজি-বাংলার আগ্রাসনে সংকুচিত নৃগোষ্ঠীর ভাষা
Published: 23rd, February 2025 GMT
ইংরেজি ও বাংলা ভাষার আগ্রাসনে দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাষা সংকুচিত হচ্ছে। একইভাবে নীতির সংকটে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার বাড়ছে। ফলে বাংলা ভাষাও সংকুচিত হচ্ছে।
রোববার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ‘মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষী শিক্ষা’ শীর্ষক সেমিনারে ভাষা গবেষকরা এসব কথা বলেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট দুই দিনব্যাপী এ সেমিনারের আয়োজক।
বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, জাতি গঠনে বৈচিত্র্যের জন্য মাতৃভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভাষাগত বৈচিত্র্যের লালন ও সুরক্ষার ওপর জোর দিতে হবে, যাতে ভাষার কারণে কোনো বিরোধ ও বৈষম্যের সৃষ্টি না হয়। সব ভাষার প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, দেশে বাংলাসহ ৪১টি ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। তবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ১৪টি ভাষা বিপন্নপ্রায়। এর মধ্যে খাড়িয়া ভাষায় মাত্র দু’জন কথা বলেন, দুই বোন তারা। তাদের মৃত্যুতে এ ভাষাটিও হারিয়ে যাবে। জাতিসংঘে বাংলাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য এখনই প্রশ্ন তুলতে হবে। দেশের সংবিধান ও আইনে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের কথা রয়েছে। কিন্তু এটি এখনও কার্যকর হয়নি। আদালতে সমানে ইংরেজি ব্যবহার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট নামেই আন্তর্জাতিক। আমরা আশাবাদী নতুন নেতৃত্বে ইনস্টিটিউট লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যাবে।
ঢাবির আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক মনসুর মুসা বলেন, ইংরেজি ও বাংলা ভাষার ব্যবহার বহুবিধ। সংবিধানে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা হয়েছে স্বীকৃতির মাধ্যমে। বাংলা ভাষার অবয়ব পরিকল্পনা হয়নি এখনও। আমাদের জ্ঞানের জগৎ অত্যন্ত পশ্চাৎপদ। ভাষানীতি প্রণয়নসহ সার্বিক বিষয়ে সরকারের কাঠামো প্রণয়ন করা জরুরি।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আসাদুজ্জামানের সভাপতিত্বে সেমিনারে বক্তৃতা করেন ঢাবির ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গুলশান আরা বেগম, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী প্রমুখ।
সেমিনারের শেষ দিনে রোববার চারটি বিষয়ে পৃথক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভাষা গবেষকরা। ‘মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষী শিক্ষা: সংকট ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ বলেন, মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে নানা সমস্যা আছে। যদিও কিছু মানুষ ভাষাকে জাগ্রত করছে। অন্য ভাষাগুলোর অবস্থা শোচনীয়। বিভিন্ন ভাষা থেকে মাতৃভাষায় শেখানোটা জোরদার হলে সংকট কেটে যাবে।
তিনি বলেন, সরকারি কাঠামোতে ইংরেজি ভাষাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ইংরেজি যত বেশি বিস্তৃত হবে মাতৃভাষা বাংলা ততই সংকুচিত হবে। অসমতা তৈরি করছে। বাংলা ভাষাও একইভাবে আদিবাসীদের ভাষাকে সংকুচিত করছে। এ ভাষার আগ্রাসন ক্রমশই বাড়ছে। শিক্ষার সূত্রপাত হবে মাতৃভাষায়। এ জন্য সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকা দরকার। পাশাপাশি কৌশল, নিরাপদ পরিবেশ, শক্তিশালী প্রচারাভিযান ও টেকসই অর্থায়ন থাকতে হবে।
‘মাতৃভাষা আশ্রয়ী শিক্ষায় প্রমিত বাংলার প্রয়োগ’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুর রহিম। তিনি বলেন, বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। এ ভাষার গুরুত্ব যেন অবহেলায় পরিণত না হয়।
সেমিনারে পৃথক অধিবেশন ‘উচ্চ শিক্ষায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মাতৃভাষার ব্যবহার: প্রসঙ্গ বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিলেটের পাসকপের প্রধান নির্বাহী গৌরাঙ্গ পাত্র এবং ঢাবির তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদুল কবির ‘মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
সভাপতির বক্তব্যে আসাদুজ্জামান বলেন, প্রশ্নটা অনেক ক্ষেত্রে উচ্চারিত হচ্ছে, আমরা কতটা সফল হচ্ছি? তবে এটি মনে রাখা উচিত প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক যাত্রা ২০১০ সালে শুরু হয়েছে। আমরা লক্ষ্যপূরণে চেষ্টা করছি।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র ব যবহ র
এছাড়াও পড়ুন:
টানা ৭২ ঘণ্টা যুদ্ধ করি
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া বাজারের পাশে বানার নদীতীরে বধ্যভূমিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তিম লাল স্মৃতি স্মারক। এই বাজারেই ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিশালী ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করত পাকিস্তানি সেনারা। পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতো শত শত নারী। দিন-তারিখ ঠিক মনে নেই, তবে শুক্রবার ছিল। আর শুক্রবারই এই অত্যাচারের ইতি টানতে টানা ৭২ ঘণ্টা যুদ্ধ করে এই ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেয় আমার মুক্তিযোদ্ধারা। এখন অবহেলায় পড়ে থেকে বধ্যভূমিটি, একপাশে জমেছে ময়লার ভাগাড়। নতুন প্রজন্মের অনেকের স্মৃতিতে এই যুদ্ধ ধূসর হলেও এখনও তা অটল সত্তরোর্ধ্ব আমার মতো রবীন্দ্র চন্দ্রের কাছে। রোজ একবার এই জায়গাটায় এসে দাঁড়াই। আজ বাড়িতেই সারাদিন, শরীরটা খুব একটা ভালো না, তাই সারাদিন বাড়িতেই। কদিন পরেই ২৬ মার্চ, কত স্মৃতি এসে ভিড় করছে চোখের কোণে।
আমার মায়ের নাম কিরণ বালা, আমার বয়স যখন ছয়-সাত, তখন মা মারা যান। মাকে হারিয়ে অনাদরে শৈশব কাটে আমার, সেই থেকে ঘরছাড়া। লজিং পড়াতাম পার্শ্ববর্তী শিবগঞ্জ এলাকায়। আলামিন উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে, মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। বন্ধুরা মিলে রেডিওতে রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পর সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্ধে যাব। দুই চাচাতো ভাইকে সাথে নিয়ে রাতের আঁধারে বাড়ি ছাড়ি। চলে যাই টাঙ্গাইলের সখিপুরের গহিন গজারি বনে, মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন এক ক্যাম্পে।
জায়গাটার নাম বয়ড়াতলী, সেখানে কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগদান করার পর শুরু হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং। চাচাতো দুই ভাই সুকুমার চন্দ্র দত্ত ও সুবোধ চন্দ্র দওকে নিয়ে আমাদের তৎকালীন কোম্পানি কমান্ডার আলী হোসেন লাল্টুর নেতৃত্বে ৪১ দিনের ট্রেনিং শেষ করি। এর মধ্যেই কানে আসে কত পরিচিত মানুষের মৃত্যু সংবাদ, কত ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলার খবর। তার মধ্যে সবচেয়ে কষ্ট দেয় পাকিস্তানি সেনারা একটি বাড়িতে আগুন দিলে সবাই দৌড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু ঘরে একজন বৃদ্ধ ছিল। বেরোতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ঘরেই পুড়ে মারা গেছে। তাই মনে মনে বিষিয়ে ছিলাম প্রতিশোধ নেওয়ার। হঠাৎ খবর আসে, আমাদের প্রথম যুদ্ধ করতে যেতে হবে রাঙ্গামাটিয়া। রাঙ্গামাটিয়া ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দিতে হবে। এরপর সিদ্দিকালি বাজার আমাদের নতুন ক্যাম্প থেকে কমান্ডারের নির্দেশে অ্যাম্বুশে চলে যাই ৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধা।
আমাদের সাথে ভারী অস্ত্র বলতে দুটো এলএমজি আর থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও গ্রেনেড ছিল। এলএমজি চালাত সেনাবাহিনীর লোক। শক্তিশালী হাতিয়ার। চারটি কোম্পানিতে থাকা প্রায় আড়াইশ মুক্তিযোদ্ধা চারদিক থেকে অ্যাম্বুশ করে ফায়ার শুরু করলাম। শুরু হলো তুমুল গোলাগুলি। এর মধ্যে খবর আসে, মিলিটারিদের একটি গাড়ি গোলাবারুদ ও সৈনিকসহ অন্যত্র সরে পড়ছিল। পশ্চিমদিকে সন্তোষপুর দিয়ে যাবে গাড়িটি। ঠিক তখন দুটো এলএমজিসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা মিলে আমরা ওত পেতে থাকি, কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। গুলির মুখে পড়ে মিলিটারিরা যেখান থেকে কেউ বেঁচে ফিরতে পারেনি। ব্রাশফায়ারে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ে। এরপর চলল টানা ৭২ ঘণ্টা যুদ্ধ। টানা যুদ্ধ চলাকালে বোমা মেরে রাঙ্গামাটিয়া ব্রিজটি ভেঙে ফেললাম আমরা। এতে আরও বেকায়দায় পড়ে পাকিস্তানি সেনারা। এদিকেও যেতে পারে না, ওদিকেও না। পরে খবর পেলাম, আমাদের সঙ্গে থাকা গোলাবারুদ ও রসদ ফুরিয়ে গেছে। কোম্পানি কমান্ডারের নেতৃত্বে আমরা পিছু হটি। আমাদের ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয় রাঙ্গামাটিয়ার যুদ্ধে। অবশ্য অন্তত ৩০০ পাকিস্তানি সেনাও মারা যায়। পরে তাদের ট্রাক ভরে লাশগুলো নিয়ে যায় ওরা। এত লাশ এই এলাকায় মানুষ আগে কখনও দেখেনি। কিন্তু এর পরে আরও পাকিস্তানি সেনা এসে সমস্ত গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছিল। রণাঙ্গনে চারটি বড় ধরনের যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে সম্মুখে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছি।
সব শেষে কেশরগঞ্জ বাজার যুদ্ধ ছিল আরও রক্তক্ষয়ী। গুলি করতে করতে নদীর কাছে চলে আসি আমি আর আমার বন্ধু। হঠাৎ করেই আমার সহযোদ্ধার পায়ের ওপর গুলি লাগে। পরে আমি কাঁধে করে সরিয়ে নিয়ে ওর জীবন বাঁচিয়েছিলাম। সেই বন্ধু এখনও বেঁচে আছে। আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর ৭ মাচের্র ভাষণ আমাদের উজ্জীবিত করেছে, আন্দোলিত করেছে। রণাঙ্গনে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা আমাদের মুক্তির পথ দেখিয়েছিল, উদ্বেলিত করছিল।
একমাত্র দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে একটা স্বাধীন দেশ উপহার দিতেই যুদ্ধে যাওয়া আমাদের। স্বাধীনতার এত বছর পরে এসেও প্রশ্ন জাগে, কতটা স্বাধীন হলাম আমরা?
নতুন প্রজন্মকে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হৃদয়ে লালন করে দেশকে গড়তে হবে।
অনুলিখন
কবীর উদ্দিন সরকার হারুন
ফুলবাড়িয়া প্রতিনিধি, ময়মনসিংহ