কারা কীভাবে ব্যয় করেছে, নিশ্চিত করতে পারছে না কেউ
Published: 23rd, February 2025 GMT
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সার্বিক রাজনীতি শক্তিশালী করতে ২৯ মিলিয়ন ডলার একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। তবে কোন প্রতিষ্ঠান বা কবে দেওয়া হয়েছে বা কত বছর ধরে দেওয়া হয়েছে বাকি কোনো তথ্যই খোলাসা করেননি মার্কিন প্রসিডেন্ট। ফলে দেশে বিষয়টি নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধোয়াসা। বাংলাদেশে যে এনজিওগুলো মার্কিন অর্থায়নে প্রকল্প নিয়ে থাকে, তাদের বৈদেশিক অনুদানের হিসাব–নিকাশ করা শুরু হয়েছে। তবে মার্কিন সরকারের ফরেন অ্যাসিসটেন্টের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সহযোগী এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) বাংলাদেশে গর্ভনেন্স বা সুশাসনখাতে ২৯ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক অনুদান করেছে।
ইউএসএআইডি দীর্ঘ দিন ধরেই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, দুর্যোগ ব্যস্থাপনা, শরণার্থীসহ অন্যান্য বিষয়ে সুশাসন, উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তায় অর্থায়ন করে থাকে। আর তাদের অর্থায়নের আরেকটি খাত হচ্ছে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসন। ফরেন অ্যাসিসটেন্টের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে মানবিক সহায়তা হিসেবে ২৩০ মিলিয়ন, স্বাস্থ্য এবং জনসংখ্যায় ৬০ মিলিয়ন, কৃষিতে ৪১ মিলিয়ন, শিক্ষায় ৩৩ মিলিয়ন, প্রশাসনিক খরচে ২১ মিলিয়ন এবং অন্যান্য খাতে ২৮ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক অনুদান হিসেবে এসেছে। এখানে সুশাসনখাতে ২৯ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক অনুদানের কথা বলা রয়েছে।
ওয়েবসাইটটিতে সুশাসনখাতে ২৯ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক অনুদানের খাত ভিত্তিক খরচ ভাগ করে দেওয়া রয়েছে। এতে গর্ভমেন্ট অ্যান্ড সিভিল সোসাইটিতে ২১ মিলিয়ন এবং অন্যান্য সামাজিক অবকাঠামোতে ৭ দশমকি ৬ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক অনুদান বরাদ্দের তথ্য আছে। সামাজিক অবকাঠামোতে ৭ দশমকি ৬ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে কর্মসংস্থান তৈরিতে ৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন এবং সামাজিক সুরক্ষায় ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার দেখানো হয়েছে।
গর্ভমেন্ট অ্যান্ড সিভিল সোসাইটিতে ২১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে মানবাধিকারে ৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন, গণমাধ্যম ও অবাধ তথ্য প্রবাহে ৭ দশমিক ৪ মিলিয়ন, আইনি ও বিচার ব্যবস্থার উন্নয়নে ২ দশমিক ৮ মিলিয়ন, নির্বাচনে ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন, গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ও সুশীল সমাজে ৯ লাখ ডলার এবং বিকেন্দ্রীকরণ এবং উপজাতির প্রতি সমর্থণে ১ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক অনুদান হিসেবে দেখানো হয়েছে।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ডিওজিই এক্স হ্যান্ডলে বলেছে, বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে নানা প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শক্তিশালী করার লক্ষ্যে নেওয়া প্রকল্প ‘স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ ইন বাংলাদেশ’ এ ২৯ মিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন বাতিল করা হয়েছে।
এরপর গত শুক্রবার ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, বাংলাদেশের সার্বিক রাজনীতি শক্তিশালী করতে ২৯ মিলিয়ন ডলার এমন এক সংস্থার কাছে গেছে, যে সংস্থার নাম আগে কেউ শোনেনি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের উল্লেখ করা ২৯ মিলিয়নই কি ফরেন অ্যাসিসটেন্টের ২৯ মিলিয়ন তা সমকাল নিশ্চিত হতে পারেনি। তবে মার্কিন তহবিল পেয়ে থাকেন এমন কয়েকটি এনজিও সংশ্লিষ্টরা জানান, যে পরিমান অর্থের কথা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তা কোনো একক প্রতিষ্ঠানে বা একভাগে বৈদেশিক অনুদান হিসেবে দেওয়াটা অস্বাভাবিক। মার্কিন অনুদানে চলা প্রকল্পগুলো কয়েক বছর ধরে হয় এবং এসব অনুদান ভাগে ভাগে প্রকল্পের অগ্রগতি হিসেবে এসে থাকে।
ইউএসএআইডি ‘স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ (এসপিএল) ইন বাংলাদেশ’ অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান। আর এর বাস্তবায়নকারি প্রতিষ্ঠানের নাম হচ্ছে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল। প্রকল্পটি ২০১৭ সালের ২ মার্চে গ্রহণ করা হয়, যা শেষ হওয়ার কথা চলতি বছরের ২০ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করার লক্ষ্য নিয়ে ১৭ জেলায় এটি বাস্তবায়ন হচ্ছিলো।
এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো.
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ইউএসএআইডির ফান্ড বন্ধের ফলে উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বে। একই সঙ্গে বিশ্বে কিন্তু বিকল্প অর্থায়নের উৎসও কমে যাচ্ছে। ইউরোপীয় দেশগুলো অন্তর্মুখী হচ্ছে। বৈশ্বিক অবস্থাও ইতিবাচক নয়। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনীতি শক্তিশালী করতে একটি এনজিওকে ২৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি নতুন করে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এটি (ট্রাম্পের দাবি) একটি অস্বাভাবিক দাবি। আমার মনে হয় ইউএসএআইডির অর্থায়ন বাতিলকে বৈধতা দিতে এখানে বাংলাদেশের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ এভাবে কোনো সংস্থার অর্থ নেওয়ারই সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, ২৯ মিলিয়ন ডলার যদি এমন কোনো সংস্থাকে যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে থাকে তাহলে সেটি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা। কারণ ১ ডলারই হোক আর ২৯ মিলিয়ন ডলারই হোক- সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোন অর্থ ছাড় হওয়া অসম্ভব। আর এককভাবে কোনো সংস্থার ২৯ মিলিয়ন ডলার পাওয়ার খবরটিই অস্বাভাবিক।
নাম প্রকাশে অনচ্ছুক একটি এনজিওয়ের প্রধান নির্বাহী বলেন, ট্রাম্পের বক্তব্য ভবিষ্যতে সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে সংকট তৈরি করবে এবং এসব কর্মসূচি নিয়ে আস্থা হারানোর জায়গা তৈরি হবে। যুক্তরাষ্ট্রে কোনো নিবন্ধন না থাকলে ইউএসএআইডি বা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের সরাসরি অর্থায়ন পাওয়া যায় না। আবার বাংলাদেশে কোনো এনজিও বিদেশি অর্থায়ন পেলে সেটি ছাড় করাতে এনজিওব্যুরোতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত সব তথ্য জানানোর নিয়ম আছে। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউএসএআইডির উচিত পরিষ্কার করে বলা যে কারা তাদের ফান্ড নিয়েছে। ফান্ড তো কেউ জোর করে আনেনি। যে পেয়েছে নিয়ম মেনেছে বলেই পেয়েছে। সেখান কোন ত্রুটি থাকলে সেই দায় তো যুক্তরাষ্ট্রের। সবাইকে বিব্রত না করে এটি তাদেরই পরিষ্কার করা উচিত।
বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের টাকা বাংলাদেশে সরাসরি কেউ পায় না, বরং তাদের অর্থ আসে সেখানকারই কোন ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির মাধ্যমে। তারা ঢাকায় অফিস নেয়। লোকাল পার্টনার ঠিক করে কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য। সে কারণে এখানকার কোন সংস্থার ২৯ মিলিয়ন ডলার পাওয়ার দাবিটাই হাস্যকর। আবার বিভিন্ন কর্মসূচিতে যে টাকা তারা দেয় তার ৫০ শতাংশই আবার আমেরিকাতেই চলে যায়। তারপরেও কেউ এমন অর্থ পেয়েছে (ট্রাম্প যা দাবি করেছেন) কি-না সেটি কর্তৃপক্ষের তদন্ত করে দেখা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইউএসএআইড র অন য ন য প রকল প র জন ত এনজ ও দশম ক সরক র ৭ দশম
এছাড়াও পড়ুন:
ইউএসএআইডির সহায়তা স্থগিতে উন্নয়নকর্মীরা কেমন আছেন
বিশ্বায়নের যুগে আমরা কাজ করি একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে। শুধু নিজের উন্নত জীবনযাপন নিশ্চিতভাবেই একান্ত নয়, আমাদের এই আশপাশের সবাইকে নিয়ে এখন চলতে হয়। মনে করছেন, আপনি ভালো আছেন, তাই আর কোনো সমস্যা নেই? নিজেদের ভালো রাখার পাশাপাশি আপনাকে আপনার সঙ্গে যুক্ত সব পর্যায়ের উপকারভোগীদের নিয়ে এগোতে হবে।
এই ধারণা যে কতটা সত্যি, তার একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে অতি সাম্প্রতিক সময়ের বিশ্বব্যাপী নাড়া দেওয়া একটি ঘোষণা—যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০০টি অধ্যাদেশ বাতিলের ঘোষণা। তার মধ্যে অন্যতম ছিল যুক্তরাষ্ট্রের করের টাকায় ব্যয়িত ইউএসএআইডির পরিচালিত বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম। এর ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও একটা বিরাট অংশ হঠাৎ একটা ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে পড়ে গেছে।
শুধু উপকারভোগীরা নন, এর সঙ্গে কর্মরত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের আনুমানিক লক্ষাধিক উন্নয়নকর্মী বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হঠাৎ কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই চাকরি হারিয়েছেন। যাঁরা এত দিন অন্যের জন্য জীবন সহজ করতে নানা সাহায্য–সহযোগিতা নিয়ে পৌঁছে দিতে ব্যস্ত ছিলেন, তাঁদের কী অবস্থা? সবাই ভাবছেন, বড় অঙ্কের বেতনভুক্ত এসব কর্মকাণ্ড যুক্ত ব্যক্তিরা অনেক অর্থসম্পদ জমিয়ে বেশ একটা আরামদায়ক জীবন যাপন করছেন। আসলে ঘটনা কি তা–ই? তাঁরা কেমন আছেন, এর একটি খণ্ডচিত্র তুলে ধরতে চাই।
কেস স্টাডি–১মিথিলা (ছদ্মনাম) একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করে প্রথম থেকেই উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। যেহেতু বেতনের অঙ্কটা ছিল আশানুরূপ, তাই জীবনের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। ঢাকা শহরে ফ্ল্যাটের গর্বিত মালিক হয়েছেন। নতুন ব্র্যান্ডের গাড়ি ব্যবহারে অভ্যস্ততা এসেছে। সন্তানের ভাগ্য গড়ে দিতে ভর্তি করিয়েছেন নামকরা ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে। স্বামীর আয়ও মন্দ নয়। এই পর্যন্ত সব ঠিক চলছিল মাসের বেতন ঘরে ঢুকলে সহজেই জমা করতেন এই বিলাসবহুল জীবনের জন্য করা ব্যাংকের ঋণের মাসিক কিস্তি। বাচ্চাদের নিয়ে নানা পরিকল্পনা করতে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু বিধি বাম, ২৪ জানুয়ারি, ২৫ ইউএসএআইডির বিশ্বব্যাপী ফান্ড বন্ধের ঘোষণা এলে একপলকে পৃথিবীর সব আলো কেড়ে নিল এই পরিবার থেকে। যেটা কখনো এই সুখী পরিবার কল্পনাও করতে পারেনি ঘুণাক্ষরেও! পূর্বঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ স্থগিত ঘোষণা যখন স্থায়ীভাবে বন্ধ করার ঘোষণা এল, তখন এই নারীর চোখে অন্ধকার দেখা ছাড়া কোনো পথ খোলা থাকল না। আজীবন কর্মসূত্রে যেসব মানুষের জন্য এই মানুষটি নিজেকে নিয়ে চিন্তা না করে কাজ করেছেন, তাঁরা আজ অন্য সহযোগিতার আশ্বাস নিয়ে এখন আর মিথিলা আপার খবর রাখেন না।
কেস স্টাডি–২রহমান সাহেব (ছদ্মনাম) দীর্ঘ মেয়াদে নতুন প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ইতিমধ্যেই কর্মস্থলে বাসা ভাড়া নিয়ে থিতু হতে চেয়েছিলেন। পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পের কাজ কীভাবে সহজ করতে পারেন ভেবে জানুয়ারি মাসে বাচ্চাদের ভালো বিদ্যালয়ে পড়ালেখার সুযোগ করে দিতে একটা যথাযথ পরিকল্পনা করেছিলেন। নিজের পরিবারের জন্য অনেক কিছু করতে চেয়েছিলেন। যাঁরা উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত, তাঁরা তাঁদের উপকারভোগীদের পরিকল্পনা করার পাশাপাশি নিজ পরিবারের জন্য নিশ্চিত ভালো থাকার নানা আয়োজন করে ফেলেন চিন্তাভাবনা করে। রহমান সাহেব তার থেকে ভিন্ন ছিলেন না। কিন্তু ইউএসএআইডির সহায়তা বন্ধের ঘোষণা সব এলোমেলো করে দিয়ে তাঁদের ঠেলে দিল এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে। সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাতে আশাবাদী মানুষ এখন দেশব্যাপী সংখ্যায় একদম কম নয়।
যাঁরা শুধু মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন, তাঁদের জীবন এখন কেমন চলছে, কেউ খোঁজ রাখে না। রোজার মাস কীভাবে অতিবাহিত করছেন, তার খবর কেউ জানেন না। পবিত্র ঈদের আয়োজন তাঁদের জন্য কেমন হবে, তা শুধু তাঁরা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে দিনের অধিকাংশ সময় কাটাচ্ছেন চাকরির নানা বিজ্ঞাপন দেখে। অথচ হঠাৎ বিশ্বব্যাপী এই দুর্ঘটনায় বিপর্যস্ত মানুষের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে চাকরি আর সহজলভ্য নয় এখন কারও জন্য। দায়িত্বশীলতার জন্য যাঁরা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের সফল কর্মকর্তা, তাঁরা এখন পরিবারের সব অসহায়ত্বের ঝুলি মাথায় নিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। কিন্তু সামাজিকতার বেড়াজালে আটকে এই অসহনীয় জীবনযাপনের কথা বলতে পারছে না কারও কাছে। তাঁদের আশপাশে লোকজন ধরেই নিয়েছেন, তাঁদের আবার সমস্যা কী? এত টাকা আয় করেছেন, নিশ্চয় তাঁরা প্রচুর সম্পদের মালিক! তাঁদের কেন সমস্যা হবে? একবারের জন্য চিন্তা করলে দেখতে পাবেন, যাঁর যেমন আয়, ব্যয়ের পরিমাণ তাঁর সে রকমই থাকে!
কেস স্টাডি ৩আবদুর রহিম (ছদ্মনাম) দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন। স্বল্প আয়ের এই মানুষটি তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য নিশ্চিত করে চলেছিলেন দৈনন্দিন সব চাহিদা। যদিও মাস যেত বড় হিসাব–নিকাশ করে, তবু চলছিল তাঁদের জীবন। সংসারের প্রয়োজনে তিনি অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য বাকিতে কিনতেন দীর্ঘদিনের পরিচিত এক দোকানির কাছ থেকে। চাইলেই পেয়ে যেতেন আবদুর রহিম। কারণ, মাসের বেতন পেলেই তিনি পাওনা শোধ করে দিতেন। জানুয়ারি মাসে হঠাৎ তাঁর ফান্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর এখন সবাই জানে। লক্ষাধিক মানুষের আয়ের উৎস এখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। আবদুর রহিমসহ যাঁরা এই পর্যায়ে অবস্থান করছিলেন, তাঁদের এখন কেউ আর বাকিতে কোনো দ্রব্য নিতে নারাজ। কারণ, তাঁদের তো চলতে হবে।
একটা ছোট আশা ছিল, হয়তো রিভিউ হয়ে ফান্ড আবার সচল হবে। কিন্তু সর্বশেষ খবর, বাংলাদেশ এখন থেকে এসব ফান্ড বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মুসলিম সমাজে পবিত্র রমজান খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই মাসে যেমন নিজেকে পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে নিবেদন করার, তেমনি দিনশেষে পরিবারের সঙ্গে একটু উন্নত খাবার খেয়ে ইফতার করার।
আবদুর রহিমসহ মাঠপর্যায়ের এই কর্মচারীদের এখন পবিত্র রমজানের এ আয়োজন বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তিন বেলা পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় চাকরি এখন সোনার হরিণ হয়ে গেছে!
এমন সময় একটি মানবিক উদ্যোগ আমাকে নাড়া দিয়েছে। ইহসান নামে একটি উদ্যোগ এসব মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের স্বল্প পরিসরে আয়োজন নিয়ে। অনেকটা ব্যক্তিগত উদ্যোগে বলা যায় এ আয়োজন চলছে। তারা ইউএসএআইডির সব বিপর্যস্ত কর্মীর তালিকা আহ্বান করেছিল তাদের ফেসবুক পেজ থেকে। তাঁদের মধ্য থেকে কিছু মানুষের জন্য রমজান প্যাকেজ প্রদানের ব্যবস্থা করেছে। ইহসানের এই কার্যক্রম সহযোগিতা করতে স্বপ্ন সুপারশপ এগিয়ে এসেছে। হয়তো শুরুটা খুব সামান্য, তবে মানুষ মানুষের জন্য, তা আবারও প্রমাণ করতে পেরেছেন এই ইহসান পেজের অ্যাডমিনরা।
বিশ্বায়নের এই যুগে কারও কোনো সমস্যা হলে তা ঘুরেফিরে আপনার ওপর চলে আসবে, এটি এখন না বুঝতে পারলে সময়মতো ঠিকই বুঝতে পারবেন। বাংলাদেশেও এর ভিন্নতা নেই। গত জানুয়ারির ফান্ড বন্ধের হঠাৎ একটার পর একটা ঘোষণা হাজারো মিথিলা, রহমান সাহেবের জীবন থমকে দিয়েছে।
হয়তো তাঁরা পরিবারের জন্য আয় করতেন, কিন্তু মানুষ হয়ে মানুষের জন্য কাজ করার মানসিকতা তাঁদের আরও বেশি উদ্যোগ নিতে সাহায্য করেছিল। যাঁদের জন্য তাঁরা কাজ করে গেছেন, তাঁরা কি জানেন তাঁদের মিথিলা আপার অথবা রহমান ভাই কেমন আছেন? তাঁদের দিন কীভাবে যাচ্ছে? হয়তোবা মনেও করছেন না!
ভাবছেন, শুধু বেতনের বিনিময়ে পরিবারের সদস্যদের থেকে কাজের প্রয়োজনে বিচ্ছিন্ন থাকাটা ছিল তাঁদের দায়িত্ব পালনের অংশ। বুকের মধ্যে মানুষের জন্য মানবিকতা না থাকলে শুধু বেতনের বিনিময়ে কারও জন্য এত নিবেদিতভাবে কাজ করা যায়?
আমরা আমাদের নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকতে দিন দিন অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। আমাদের জীবনের প্রতিটি অংশ কারও না কারও সঙ্গে যুক্ত। বিশ্বায়নের তত্ত্বকথা তা–ই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন একটি উপস্থাপনা ব্লিডিং ব্লগ।
সেখানে স্পষ্ট বলা আছে, যাঁরা সেবা প্রদানের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের সব অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে তবেই একটি নির্ভরযোগ্য সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। যাঁরা মানুষের জন্য কাজ করছেন, তাঁদের এই মহাবিপদে আমরা কি তাঁদের কোনো খবর রেখেছি? হয়তো ভাবছি, তাঁরা ভালো আছেন। এত বেতনের চাকরি করে তাঁদের আবার সমস্যা কী? কিন্তু ভেবেছেন, এত সামর্থ্যবান মানুষ হঠাৎ এই চাকরিহীন জীবন কীভাবে কাটাচ্ছেন? ভাববেন নিশ্চয়ই; কারণ; একটা সময় এই মানুষগুলো অন্যের জন্য ভেবেছেন। এটা শুধু তাঁদের কাজের অংশ ছিল না, ছিল সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। এই মানুষগুলোকে একটু ভালো রাখতে আমাদের করণীয় কিছুই কি নেই? প্রশ্নটি সবার জন্য।
ফারজানা রহমান এ্যানি, উন্নয়নকর্মী, ঢাকা