দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রভাবশালী মুসলিম শাসক ছিলেন খোদাবক্স খাঁ
Published: 23rd, February 2025 GMT
ষোড়শ শতকে খোদাবক্স খাঁ নামে দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক প্রভাবশালী শাসক ছিলেন। যার শাসনকালে চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক পরিবর্তন ঘটেছিল।
‘খোদাবক্স’ নামটি ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। ‘খোদা’ মানে ঈশ্বর এবং ‘বক্স’ মানে উপহার বা দান। এভাবে, ‘খোদাবক্স’ নামের আক্ষরিক অর্থ হলো ঈশ্বরের উপহার বা ঈশ্বরের দান। এটি মুসলিম শাসক বা নেতাদের মধ্যে প্রচলিত একটি ধর্মীয় নাম।
১৩৫২ সালের আশেপাশে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ গৌড়ের সুলতানী রাজ্যের অংশ হিসেবে হিসেবে চট্টগ্রাম দখল করেন। তাঁর প্রধান সেনাপতি কদল খাঁ গাজী দক্ষিণ চট্টগ্রাম বিজয় করে, দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে আরাকান সাম্রাজ্যের সীমানা পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের চকরিয়ার দক্ষিণ সীমান্ত পর্যন্ত জয় করেছিলেন বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। তাছাড়া ওই সময়েই চট্টগ্রামের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি গৌড়ের সুলতানের স্ব-পক্ষেই ছিল।
তবে মধ্যবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম স্বাধীন সুলতানী সম্রাজ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ চট্টগ্রামের দখল নিয়ে ১৫১৩-১৫১৭ সাল পর্যন্ত ত্রিপুরার রাজা ধনমানিক্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। তবে তিনি সফল হতে পারেননি।
১৫২৫ সালের দিকে তার পুত্র সুলতান নাসির উদ্দীন নুসরত শাহ আরাকানের ঘরোয়া বিবাদ ও শাসকগণের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চট্টগ্রাম পুনঃদখল করেন। চট্টগ্রামকে দুই ভাগে ভাগ করেন। কর্ণফুলির উত্তরাংশের গভর্নর ছিলেন আমিরজা খান, ১৫২৫-২৬ সালে দক্ষিণাংশের গভর্নর করেন খোদাবক্স খানকে।
রামু, চকরিয়া ইত্যাদি অঞ্চল ছিল খোদাবক্স খানের এলাকা। চকরিয়া ছিল তার শাসন কেন্দ্র । এরপর তা গিয়াস উদ্দিন মাহম্মুদ শাহ রাজত্বকাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল।
খোদাবক্স খাঁ চকরিয়ায় আসার পর স্থানীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিদার ও শাসক শ্রেণিগুলোকে পরাজিত করে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হতে থাকেন। তার শাসনকালে দক্ষিণ চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৃশ্যপট গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায়। এক সময়ের অবহেলিত এ জায়গা তখন দক্ষিণ চট্টগ্রামের শাসন কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আনে। এলাকার মানুষের জীবন যাত্রা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের উপরও প্রভাব ফেলে। ফলে ধীরে ধীরে এটি মুসলিম অধ্যুষিত হয়। সামরিক ক্ষেত্রে রাজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
১৫৩৮ সালে শের শাহের সেনারা যখন চট্টগ্রাম দখল করে, তখন খোদাবক্স খাঁর শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তার শাসনকেন্দ্র রামুতে স্থানান্তরিত হয়। খোদাবক্স খাঁর শাসন ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের পতনের পরে খোদাবক্স খাঁর আর কোন ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায় না। এতে নিশ্চিত হওয়া যায়, স্বাধীন হোসেন শাহী বংশের পতনের পরপরই এ খোদাবক্স খাঁর ক্ষমতা লোপ পাই।
দীর্ঘদিন পরে পর্তুগীজদের বর্ণনায় ও মানচিত্রে খোদাবক্স খাঁর সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ১৫১৭ সালে প্রথম পর্তুগীজ জাহাজ চট্টগ্রামের উপকূলে আসে পর্তুগীজরা। যদিও তাদের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ছিল, তবে জলদস্যুতার প্রবণতা তাদের মধ্যে বেশি লক্ষ্য করা যায়। পর্তুগীজদের অবাধ্য আচরণ দেখে সুলতান হোসেন শাহ পর্তুগীজদের দমন করার চেষ্টা করলেন।
কিন্তু এ সময় আফগান শাসক শের শাহ বাংলা আক্রমণ করবে শুনে হোসেন শাহ পর্তুগিজদের সহায়তা কামনা করেন। সামরিক সহায়তার বিনিময়ে পরবর্তীতে গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলে ১৫৩৭ সালে পর্তুগীজরা চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করতে সক্ষম হয় এবং শুল্ক আদায়ের অধিকারও লাভ করে।
পর্তুগীজদের সহযোগিতার পরও শের শাহের কূটকৌশলের কাছে সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ পরাজিত ও নিহত হন। ১৫৩৮ সালে শের শাহের সেনারা চট্টগ্রাম দখল করে নিলে এবং পরবর্তীতে দক্ষিণ চট্টগ্রামের শাসনকেন্দ্র রামুতে স্থানান্তরিত হয়। এ সময়, পর্তুগীজ ভূতাত্ত্বিক জোয়াও দ্য ব্যারোজের মানচিত্রে দক্ষিণ চট্টগ্রামকে ‘এস্টাডো কোদাবাসকাম’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা খোদাবক্স খাঁর শাসিত অঞ্চলকেই নির্দেশ করে।
১৫৩৮ সালে পর্তুগীজ নাবিক মার্টিন আফোনসো দে মেলো এর নেতৃত্বে একটি পর্তুগীজ জাহাজ চট্টগ্রামের দক্ষিণে ঝড়ের কবলে পড়ে এবং চকরিয়া অঞ্চলের একটি দ্বীপে আশ্রয় নেয়। এটি সম্ভবত কুতুবদিয়া ছিল। সেখান থেকে তারা স্থানীয় জেলেদের সহায়তায় চট্টগ্রামে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু খোদাবক্স খাঁর কৌশলে আটকে পড়েন তারা। তাদের বন্দী করেন খোদাবক্স খাঁ।
তাদের ভাষ্য মতে, তখনো খোদাবক্স খাঁর শাসনকার্য চালিত ছিল। কারণ বন্দী হওয়ার পর দীর্ঘ কয়েক বছর জেলে আটকে ছিলেন নাবিক মার্টিন আফোনসো দে মেলো। ধারণা করা হয়, এর অল্পকিছু কাল পরেই তার পতন ঘটে।
ষোড়শ শতকের দক্ষিণ চট্টগ্রামের ইতিহাসে খোদাবক্সের প্রায় ১৫ বছরের দীর্ঘ শাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। তার সুদক্ষ প্রশাসন ও দূরদর্শী নেতৃত্ব ধর্মীয় ও সামাজিক পট পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। বিশেষত তার শাসনামলে চকরিয়া, রামু ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য এক স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। ওই সময় থেকেই দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রতি মুসলিম শাসকদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হতে শুরু করে, যা পরবর্তী সময়ে অঞ্চলটির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
তথ্যসূত্র: জোয়াও দ্য ব্যারোজের মানচিত্র ও উইল্লেম ব্লেউয়ের মানচিত্র, ‘History of the Portuguese in Bengal’- জোয়াকিম জোসেফ এ ক্যাম্পোস, ‘উপনিবেশ চট্টগ্রাম’- হারুন রশীদ.
(লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, শিক্ষাবর্ষ ২০২১-২২, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)
ঢাকা/মেহেদী
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর পর ত গ জ র জন ত ক র শ সনক চকর য়
এছাড়াও পড়ুন:
ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘শিবির’ নিয়ে যা বললেন ছাত্রদল সম্পাদক
মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে ছাত্রদল।
শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাত পৌনে ১টার দিকে সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছিরের নেতৃত্বে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা শহীদ মিনারের শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অপর্ণ করে।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বলেন, “বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন শহীদ দিবস পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সেই সময়ের যে আবহ, যে ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শহীদরা আত্মহুতি দিয়েছিলেন সেটি এখনো আবহমান রয়েছে।”
আরো পড়ুন:
শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে শেরপুরে সমাবেশ
কুয়েটে সংঘর্ষ নিয়ে যা বলছে ছাত্রদল
তিনি বলেন, “আপনারা দেখেছেন, সিলেটের এমসি কলেজে মতামত প্রকাশের জন্য একজন শিক্ষার্থী হামলার শিকার হয়েছেন। ১৯৫২ সালেও নিজের ভাষায় অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য করা আন্দোলনে একটি পক্ষ তাদের মতামতকে বাধাগ্রস্ত করেছে।”
তিনি আরো বলেন, “জুলাই-আগস্ট পরবর্তী সময়ে আমরা মনে করছি, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষ তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারবে। তবে, সিলেটে এমসি কলেজে হামলার বিষয়ে গণমাধ্যমে আমরা দেখেছি, একজন শিক্ষার্থী ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল, ‘শিবিরের গুপ্ত রাজনীতি রগ কাটা রাজনীতি’। এজন্য শিবিরের সন্ত্রাসীরা তাকে হুমকি দিয়েছে, ‘রগ তো কাটিনি, তোমাকে দিয়ে শুরু করবো’। পরক্ষণে তার বক্তব্য পরিবর্তন করার জন্য শিবিরের সন্ত্রাসীরা গণমাধ্যমকর্মীদের হুমকি দিয়েছে। ছাত্রদলের একটি টিম আহত ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে। ওই শিক্ষার্থী এখনো ভয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাও শিবিরের বিপক্ষে কথা বলতে ভীত-সন্ত্রস্ত হচ্ছে যে, কখন না জানি শিবিরের সন্ত্রাসীরা রগ কেটে দেয়।”
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক বলেন, “এই দিবসে আমরা মনে করছি, সবার মধ্যে মুক্ত মনের আবহ থাকবে, মতামত প্রকাশ করতে পারবে, সেটি যেন কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত না হয়।”
ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, “শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আমরা ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন পরে সুশৃঙ্খলভাবে শহীদ মিনারে সমাবেত হয়েছি। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পেরেছি। এর আগে ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে ফুল দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এখানে মারামারির ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। আমাদের আগেও ৮-১০টি ছাত্র সংগঠন ফুল দিয়েছে। আমরা নিয়ম মেনে সিরিয়াল অনুযায়ী ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছি।”
ঢাকা/মামুন/মাসুদ