ষোড়শ শতকে খোদাবক্স খাঁ নামে দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক প্রভাবশালী শাসক ছিলেন। যার শাসনকালে চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক পরিবর্তন ঘটেছিল।

‘খোদাবক্স’ নামটি ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। ‘খোদা’ মানে ঈশ্বর এবং ‘বক্স’ মানে উপহার বা দান। এভাবে, ‘খোদাবক্স’ নামের আক্ষরিক অর্থ হলো ঈশ্বরের উপহার বা ঈশ্বরের দান। এটি মুসলিম শাসক বা নেতাদের মধ্যে প্রচলিত একটি ধর্মীয় নাম।

১৩৫২ সালের আশেপাশে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ গৌড়ের সুলতানী রাজ্যের অংশ হিসেবে হিসেবে চট্টগ্রাম দখল করেন। তাঁর প্রধান সেনাপতি কদল খাঁ গাজী দক্ষিণ চট্টগ্রাম বিজয় করে, দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে আরাকান সাম্রাজ্যের সীমানা পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের চকরিয়ার দক্ষিণ সীমান্ত পর্যন্ত জয় করেছিলেন বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। তাছাড়া ওই সময়েই চট্টগ্রামের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি গৌড়ের সুলতানের স্ব-পক্ষেই ছিল।

তবে মধ্যবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম স্বাধীন সুলতানী সম্রাজ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ চট্টগ্রামের দখল নিয়ে ১৫১৩-১৫১৭ সাল পর্যন্ত ত্রিপুরার রাজা ধনমানিক্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। তবে তিনি সফল হতে পারেননি।

১৫২৫ সালের দিকে তার পুত্র সুলতান নাসির উদ্দীন নুসরত শাহ আরাকানের ঘরোয়া বিবাদ ও শাসকগণের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চট্টগ্রাম পুনঃদখল করেন। চট্টগ্রামকে দুই ভাগে ভাগ করেন। কর্ণফুলির উত্তরাংশের গভর্নর ছিলেন আমিরজা খান, ১৫২৫-২৬ সালে দক্ষিণাংশের গভর্নর করেন খোদাবক্স খানকে।

রামু, চকরিয়া ইত্যাদি অঞ্চল ছিল খোদাবক্স খানের এলাকা। চকরিয়া ছিল তার শাসন কেন্দ্র । এরপর তা গিয়াস উদ্দিন মাহম্মুদ শাহ রাজত্বকাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল।

খোদাবক্স খাঁ চকরিয়ায় আসার পর স্থানীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিদার ও শাসক শ্রেণিগুলোকে পরাজিত করে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হতে থাকেন। তার শাসনকালে দক্ষিণ চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৃশ্যপট গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায়। এক সময়ের অবহেলিত এ জায়গা তখন দক্ষিণ চট্টগ্রামের শাসন কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আনে। এলাকার মানুষের জীবন যাত্রা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের উপরও প্রভাব ফেলে। ফলে ধীরে ধীরে এটি মুসলিম অধ্যুষিত হয়। সামরিক ক্ষেত্রে রাজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।

১৫৩৮ সালে শের শাহের সেনারা যখন চট্টগ্রাম দখল করে, তখন খোদাবক্স খাঁর শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তার শাসনকেন্দ্র রামুতে স্থানান্তরিত হয়। খোদাবক্স খাঁর শাসন ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের পতনের পরে খোদাবক্স খাঁর আর কোন ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায় না। এতে নিশ্চিত হওয়া যায়, স্বাধীন হোসেন শাহী বংশের পতনের পরপরই এ খোদাবক্স খাঁর ক্ষমতা লোপ পাই।

দীর্ঘদিন পরে পর্তুগীজদের বর্ণনায় ও মানচিত্রে খোদাবক্স খাঁর সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ১৫১৭ সালে প্রথম পর্তুগীজ জাহাজ চট্টগ্রামের উপকূলে আসে পর্তুগীজরা। যদিও তাদের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ছিল, তবে জলদস্যুতার প্রবণতা তাদের মধ্যে বেশি লক্ষ্য করা যায়। পর্তুগীজদের অবাধ্য আচরণ দেখে সুলতান হোসেন শাহ পর্তুগীজদের দমন করার চেষ্টা করলেন।

কিন্তু এ সময় আফগান শাসক শের শাহ বাংলা আক্রমণ করবে শুনে হোসেন শাহ পর্তুগিজদের সহায়তা কামনা করেন। সামরিক সহায়তার বিনিময়ে পরবর্তীতে গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলে ১৫৩৭ সালে পর্তুগীজরা চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করতে সক্ষম হয় এবং শুল্ক আদায়ের অধিকারও লাভ করে।

পর্তুগীজদের সহযোগিতার পরও শের শাহের কূটকৌশলের কাছে সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ পরাজিত ও নিহত হন। ১৫৩৮ সালে শের শাহের সেনারা চট্টগ্রাম দখল করে নিলে এবং পরবর্তীতে দক্ষিণ চট্টগ্রামের শাসনকেন্দ্র রামুতে স্থানান্তরিত হয়। এ সময়, পর্তুগীজ ভূতাত্ত্বিক জোয়াও দ্য ব্যারোজের মানচিত্রে দক্ষিণ চট্টগ্রামকে ‘এস্টাডো কোদাবাসকাম’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা খোদাবক্স খাঁর শাসিত অঞ্চলকেই নির্দেশ করে।

১৫৩৮ সালে পর্তুগীজ নাবিক মার্টিন আফোনসো দে মেলো এর নেতৃত্বে একটি পর্তুগীজ জাহাজ চট্টগ্রামের দক্ষিণে ঝড়ের কবলে পড়ে এবং চকরিয়া অঞ্চলের একটি দ্বীপে আশ্রয় নেয়। এটি সম্ভবত কুতুবদিয়া ছিল। সেখান থেকে তারা স্থানীয় জেলেদের সহায়তায় চট্টগ্রামে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু খোদাবক্স খাঁর কৌশলে আটকে পড়েন তারা। তাদের বন্দী করেন খোদাবক্স খাঁ।

তাদের ভাষ্য মতে, তখনো খোদাবক্স খাঁর শাসনকার্য চালিত ছিল। কারণ বন্দী হওয়ার পর দীর্ঘ কয়েক বছর জেলে আটকে ছিলেন নাবিক মার্টিন আফোনসো দে মেলো। ধারণা করা হয়, এর অল্পকিছু কাল পরেই তার পতন ঘটে।

ষোড়শ শতকের দক্ষিণ চট্টগ্রামের ইতিহাসে খোদাবক্সের প্রায় ১৫ বছরের দীর্ঘ শাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। তার সুদক্ষ প্রশাসন ও দূরদর্শী নেতৃত্ব ধর্মীয় ও সামাজিক পট পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। বিশেষত তার শাসনামলে চকরিয়া, রামু ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য এক স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। ওই সময় থেকেই দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রতি মুসলিম শাসকদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হতে শুরু করে, যা পরবর্তী সময়ে অঞ্চলটির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

তথ্যসূত্র: জোয়াও দ্য ব্যারোজের মানচিত্র ও উইল্লেম ব্লেউয়ের মানচিত্র, ‘History of the Portuguese in Bengal’- জোয়াকিম জোসেফ এ ক্যাম্পোস, ‘উপনিবেশ চট্টগ্রাম’- হারুন রশীদ.

বাঁশখালি উপজেলা (ওয়েবসাইট) এবং ‘চুনতি ও এতদঞ্চলের নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস’- ওয়াহিদ আজাদ

(লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, শিক্ষাবর্ষ ২০২১-২২, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)

ঢাকা/মেহেদী

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর পর ত গ জ র জন ত ক র শ সনক চকর য়

এছাড়াও পড়ুন:

মেয়েকে ধর্ষণে বাবার ফাঁসি

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় মেয়েকে ধর্ষণের দায়ে বাবা আলতাপ হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আজ বুধবার দুপুরে চুয়াডাঙ্গা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ হাবিবুল ইসলাম এ রায় ঘোষণা করেন।

দণ্ডিত আলতাপ হোসেন (৪৬) সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ গ্রামের মৃত সাদেক আলী মৃধার ছেলে। তিনি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার চিৎলা হুদাপাড়া গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে বসবাস করতেন।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পার্শ্ববর্তী গাংনী ইউনিয়নে ভুক্তভোগী কিশোরীর বিয়ে হয়। বিয়ের কয়েকদিন পর পেটে ব্যথা ও বমি বমি ভাব হলে পরীক্ষা করা হয়। এতে ২-৩ মাসের অন্তঃসত্ত্বার বিষয়টি ধরা পড়ে। 

ভুক্তভোগী জানায়, ২০২৩ সালের ৫ ডিসেম্বর তার মা বোনের বাড়িতে গেলে ওইদিন রাতে বাবা ঘরে একা পেয়ে তাকে ধর্ষণ করে। হত্যার ভয় দেখিয়ে পরবর্তী ২-৩ মাসে আরও ৭-৮ বার ধর্ষণ করে তার বাবা। ২০২৪ সালের ৭ মার্চ ভুক্তভোগী কিশোরীর মা বাদী হয়ে আলমডাঙ্গা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০(সংশোধিত ২০২০)-এর ৯(১) ধারায় মামলা করেন।

তদন্ত শেষে আলমডাঙ্গা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বাবর আলী গত ২০২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর অভিযুক্ত আলতাপের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এরপর ৮ স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্য গ্রহণ শেষে মামলায় রায় ঘোষণা করেন আদালত।

চুয়াডাঙ্গা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (স্পেশাল পিপি)  এম এম শাহজাহান মুকুল বলেন, কিশোরী ধর্ষণ মামলায় বাবা আলতাপ হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড ও ২ লাখ টাকা জরিমানার আদেশ দিয়েছেন আদালত। জরিমানার আদেশ তার (দণ্ডিত ব্যক্তির) জীবদ্দশায় অথবা মৃত্যুর পরবর্তী পর্যায়ে প্রথম দায়-দেনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, আদালত এটা রায়ে উল্লেখ করেছেন।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ২১ বছর পর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী কিলার মাসুম গ্রেপ্তার
  • জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ১০ জনের প্রশিক্ষণ শুরু
  • মেয়েকে ধর্ষণে বাবার ফাঁসি
  • গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো কবি রফিক আজাদের স্মৃতিস্মারক বাড়ির একাংশ
  • গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কবি রফিক আজাদের স্মৃতিস্মারক বাড়ি
  • দাবি আদায়ে অনড় কুয়েট শিক্ষার্থীরা, সন্ধ্যায় সিন্ডিকেট সভা
  • আমেরিকা-পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনীতি কে চালাবে
  • বৈশাখের আনন্দ তিনগুণ বেড়ে গেছে, কেন বললেন বুবলী
  • নিগারদের বিশ্বকাপ খেলার সম্ভাবনা কি বাড়ল
  • হল না খোলায় ক্যাম্পাসে অবস্থানের ঘোষণা কুয়েট শিক্ষার্থীদের