মাদক কেনার জন্যই মূলত ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী চলন্ত বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে আসামিরা। ডাকাতির সঙ্গে জড়িত সবাই মাদকাসক্ত। বাস থেকে লুট করা একটি মোবাইল সেটের বিনিময়ে গাঁজা নেন তারা। এর সূত্র ধরেই সন্ধান মেলে ডাকাত চক্রের সদস্যদের। নেশার টাকা জোগাড় করতে তারা সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় ডাকাতি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজি করে থাকেন।

আজ রোববার বিকেলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো.

আহসানুজ্জামান এসব তথ্য জানিয়েছেন। 

তিনি বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জানতে পারি, ডাকাত দলের সদস্যরা সাভার আশুলিয়া এলাকায় অবস্থান করছেন। এছাড়াও সোর্সের মাধ্যমে জানতে পারি, ওই এলাকার নেশাখোর কিছু যুবক বাসে ডাকাতি, চুরি ও ছিনতাই করে থাকেন। তারা সাভার এলাকার একজন মাদক কারবারির কাছ থেকে নিয়মিত গাঁজা ও হেরোইন কেনেন। গত শুক্রবার বিকেলে সাভারের চন্দ্রা-নবীনগর সড়কের একটি পেট্রলপাম্পের সামনে থেকে ওই মাদক কারবারিকে আটক করা হয়। 

মামলার তদন্তকর্মকর্তা এসআই মো. আহসানুজ্জামান বলেন, ওই সোর্স জানান- শহিদুল, সবুজ, শরীফুজ্জামানসহ কয়েকজনের কাছে প্রতিনিয়ত গাঁজা ও হেরোইন বিক্রি করে থাকেন। পরে ওই সোর্সকে সঙ্গে নিয়ে সাভারের গেন্ডা এলাকায় অভিযান চালিয়ে শহিদুল, সবুজ ও শরীফুজ্জামানকে আটক করা হয়। ডাকাতির সঙ্গে আরও কয়েকজন জড়িত বলে তারা আমাদের জানিয়েছেন। তাদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান চালানো হচ্ছে।

এর আগে গত শুক্রবার বিকেলে সাভারের গেণ্ডা এলাকা থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন– মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার লাউতারা গ্রামের শহিদুল ইসলাম ওরফে মহিদুল ওরফে মহিত, শরীয়তপুরের জাজিরা থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের মো. সবুজ এবং সাভার পৌরসভার টান গেণ্ডা গ্রামের শরীফুজ্জামান ওরফে শরীফ। গত শুক্রবার বিকেলে গেণ্ডা এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা আন্তঃজেলা ডাকাত দলের সদস্য। 

গতকাল শনিবার বিকেলে তিনজনকে টাঙ্গাইল সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নওরীন করিমের আদালতে হাজির করা হয়। এর পর দু’জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা টাঙ্গাইল গোয়েন্দা পুলিশের এসআই আহসান এসব তথ্য জানিয়েছেন। 

গতকাল নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে গ্রেপ্তার তিনজনের বরাতে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন টাঙ্গাইলের এসপি মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, গত সোমবার রাতে রাজশাহীগামী ইউনিক রয়েল রোড পরিবহন বাসে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে চলন্ত বাসে তিন-চার ঘণ্টা ধরে ডাকাতি ও শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় শুক্রবার রাত ২টার দিকে বাসযাত্রী ওমর আলী মির্জাপুর থানায় একটি মামলা করেন। মামলা করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মির্জাপুর থানা পুলিশ ও টাঙ্গাইলের গোয়েন্দা পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সাভার মডেল থানায় অভিযান চালায়।

গ্রেপ্তার তিনজনের কাছ থেকে তিনটি মোবাইল ফোনসেট, একটি ছুরি এবং নগদ ২৯ হাজার ৩৭০ টাকা জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার মহিতের বিরুদ্ধে দুটি বাস ডাকাতিসহ মোট পাঁচটি মামলা রয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত আরও কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। শিগগিরই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

মিজানুর রহমান আরও বলেন, আমরা বাসের যাত্রীদের খুঁজে বের করেছি। নারী যাত্রীদের ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির যে বিষয়টি উঠে এসেছে, তা আমরা আমলে নিয়ে কাজ করছি। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

মালপত্র ছিনিয়ে নেওয়ার সময় ‘টাচে’ যেতে পারে এবং তা শ্লীলতাহানি পর্যন্ত যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ঘটনার পর দায়িত্বে অবহেলার কারণে মির্জাপুর থানার এএসআই আতিকুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওসি মোশারফ হোসেন।

তিনি বলেন, ভুক্তভোগী বাসযাত্রীরা যখন মির্জাপুর থানায় আসেন, তখন থানার ডিউটি অফিসার ছিলেন আতিকুজ্জামান। তিনি কোনো কাজ না করে যাত্রীদের অপেক্ষা করতে বলেন। যাত্রীরা কয়েক মিনিট পর চলে গেলেও ডিউটি অফিসারের কাছে তাদের নাম-ঠিকানা বা মোবাইল নম্বর ছিল না। এভাবে দায়িত্বে অবহেলা করায় এসপি তাঁকে সাময়িক বরখাস্তের ঘোষণা দেন। শুক্রবার রাতে আতিকুজ্জামানকে মির্জাপুর থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত সোমবার রাত ১১টা ২৫ মিনিটে বাদী ওমর আলী ও তাঁর সঙ্গে থাকা সোহাগ হোসেন ঢাকার গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে বড়াইগ্রাম যাওয়ার উদ্দেশে রাজশাহীগামী ইউনিক রোড রয়েলস বাসে ওঠেন। ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে আরও ১০-১২ যাত্রীকে ওঠান চালক। রাত ১টার দিকে গাজীপুরের চন্দ্রা বাইপাস এলাকায় এসে চা-বিরতির জন্য বাসটি দাঁড় করানো হয়। প্রায় ১৫ মিনিট পর সেখান থেকে আরও তিন-চারজন নতুন যাত্রী উঠিয়ে বাসটি চলতে থাকে। দেড়টার দিকে গাজীপুর হাই-টেক সিটি পার্ক এলাকা অতিক্রমের সময় হঠাৎ ৮-৯ জন হাতে চাকু ও চাপাতি নিয়ে তাদের সিট থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং চুপ থাকতে বলে।

এতে বলা হয়, কথা বললে সবাইকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এ সময় ডাকাত দলের তিন সদস্য গিয়ে চালককে টেনেহিঁচড়ে সিট থেকে ফেলে বাসের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ছয়-সাত ডাকাত চাকু ও চাপাতি দেখিয়ে হুমকি দিয়ে বলে, ‘তোদের কাছে টাকা-পয়সা যা কিছু আছে সব দিয়ে দে।’ ডাকাতরা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা, মোবাইল ফোনসেট, স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিস কেড়ে নেয়। এ সময় দুই-তিন ডাকাত বাসে থাকা নারী যাত্রীর স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দেয়। রাত আনুমানিক ৪টার দিকে ডাকাতরা যাত্রীদের কাছ থেকে নগদ টাকাসহ ৫ লাখ ২৬ হাজার ৬০০ টাকার মালপত্র ডাকাতি করে নন্দন পার্কের সামনে নেমে যায়। 

এজাহারে আরও বলা হয়েছে, যাত্রীরা ৯৯৯ নম্বরে কল করলে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। ঘটনা জানার পর পুলিশ তাদের মির্জাপুর থানায় যাওয়ার পরামর্শ দেয়। পরে যাত্রীরা মির্জাপুর থানার ডিউটি অফিসারের সঙ্গে দেখা করে ডাকাতির বিষয়ে আবহিত করেন। পুলিশ অপেক্ষা করতে বললে কয়েক মিনিট পর চলে যান তারা। নাটোরের বড়াইগ্রাম পৌঁছার পর স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় বড়াইগ্রাম থানা পুলিশকে বিষয়টি জানান যাত্রীরা। পুলিশ গিয়ে বাসের চালক, সুপারভাইজার এবং হেলপারকে আটক করে।

জানা গেছে, বড়াইগ্রাম থানা পুলিশ বুধবার তাদের ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায়। শুনানি শেষে আদালত তাদের জামিন দেন। 

বাদী ওমর আলী বলেন, ‘ডাকাতরা অনেক যাত্রীকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে। যার কাছে যা ছিল, সব নিয়েছে। আমার ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছে। বাসে ৪০ বছরের একজন ও ২০-২১ বছরের এক নারী ছিলেন। তাদের টেনেহিঁচড়ে সবকিছু নিয়েছে ডাকাতরা। এ ছাড়া তারা তাদের শরীরে হাত দিয়েছে।’

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এল ক য় সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

পবিত্র রমজানের শিক্ষা বিস্তৃত হোক জীবনব্যাপী

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের দ্বিতীয় স্তম্ভ হলো সালাত বা নামাজ। ইমানের পরেই নামাজ। পবিত্র রমজান মাস হলো নামাজের মাস, যেমন তারাবিহর নামাজ ও কিয়ামুল লাইল নামাজের পাশাপাশি পবিত্র রমজানে সাহ্‌রির বদৌলতে তাহাজ্জুদ নামাজের অভ্যাস গড়া সহজ হয়; এশা ও ফজরের নামাজ জামাতে পড়ার সুযোগ বৃদ্ধি পায়। ফজরের নামাজ আগেভাগে পড়ে ঘুমানোর কারণে সকালে ইশরাক নামাজ পড়ার সুবিধা হয়।

পবিত্র রমজানের কারণে কাজের চাপ কম থাকায় চাশত নামাজ ও জোহরের আগে আওয়াবিন নামাজ আদায়ের সুযোগ হয়। বিকেলে অফিস বা কর্মস্থল থেকে আগে ফেরার কারণে আসরের নামাজ জামাতে পড়া যায়। একসঙ্গে ইফতার করার সুবাদে মাগরিবের নামাজের জামাতও পাওয়া যায়। অন্যান্য নফল নামাজও বেশি পড়া হয়। পবিত্র রমজানেই নামাজের পূর্ণতা আসে।

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের তৃতীয় স্তম্ভ হলো জাকাত। সাহাবায়ে কিরাম পবিত্র রমজানেই জাকাত প্রদান করতেন। পবিত্র রমজানে জাকাত প্রদানে চান্দ্রবর্ষের হিসাব অনুযায়ী সঠিকভাবে জাকাত প্রদান করা সহজ হয়।

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের চতুর্থ স্তম্ভ হলো হজ। পবিত্র রমজানে ওমরাহ পালন করলে নবীজি (সা.)–এর সঙ্গে হজ করার সমান সওয়াব পাওয়া যায়। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের পঞ্চম স্তম্ভ হলো সিয়াম বা রোজা। রোজা হলো পবিত্র রমজানের প্রধান অনুষঙ্গ। আগুন যেমন সোনাকে বিশুদ্ধ করে, তেমনি রোজা ইমানদারের কামনা–বাসনাকে দহন করে তাঁকে খাঁটি বান্দায় পরিণত করে।

রোজার ফিদইয়া পবিত্র রমজানেরই অংশ। রোজা একটি শারীরিক ও মানসিক ইবাদত। কিন্তু অসুস্থ ও দুর্বল ব্যক্তির জন্য কাজার পাশাপাশি অপারগতায় ফিদইয়ার বিধান রাখা হয়েছে, যা আর্থিক ইবাদত। এতে বোঝা যায় রোজার পরিধি কত ব্যাপক।

রোজার কাফফারা পবিত্র রমজানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রোজা শারীরিক ইবাদত হওয়া সত্ত্বেও দুর্বলচিত্তের ব্যক্তি যদি রোজা ভঙ্গ করেন, তবে তাঁর জন্য কাফফারার বিধান রয়েছে। এটি হলো দাস মুক্তি দেওয়া অথবা ৬০ জন গরিবকে দুই বেলা পরিপূর্ণ আহার করানো অথবা একাধারে ৬০টি রোজা রাখা। অর্থাৎ যদি কেউ রমজান মাসের একটি রোজা ভঙ্গ করেন, তবে তাঁকে ৬০ দিনের রোজা রাখতে হবে অথবা কাফফারা আদায় করতে হবে। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, দান–খয়রাত ও সমাজকল্যাণই পবিত্র রমজানের অন্যতম উদ্দেশ্য।

রোজা শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হয়। দাতা ও গ্রহীতার সুবিধার্থে পবিত্র রমজানেও এটি প্রদান করা যায়। ঈদের সঙ্গে ফিতরার সম্পৃক্ততার কারণে এর নাম হয়েছে ঈদুল ফিতর। সদকাতুল ফিতর হলো ঈদের আনন্দ সর্বজনীন করার উপায়। ধনী–গরিব সবাই যেন ঈদের আনন্দে শামিল হতে পারেন, সে জন্য এই ব্যবস্থা। সদকাতুল ফিতর পবিত্র রমজানে রোজা পালনের শুকরিয়াস্বরূপ এবং এটি রোজাকে পূর্ণতা দেয়।

পবিত্র রমজানের বিশেষ উপহার হলো ইতিকাফ। মানবজীবনে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের অন্যতম মাধ্যম হলো ইতিকাফ। পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশকে ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা কিফায়া। এখান থেকেও পবিত্র রমজানের মহিমা বোঝা যায়। এক দশকের কম সময়ের ইতিকাফ নফল হলেও এই ইতিকাফ অন্য সময়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি ফজিলতের। ইতিকাফ বছরের যেকোনো সময় করা যায়, তবে সর্বনিম্ন সীমা হলো এক দিন অর্থাৎ সূর্যাস্তের আগে থেকে পরের দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত।

পবিত্র রমজানের অনন্য উপহার হলো শবে কদর। এটি এমন এক রাত, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। হাজার মাস মানে প্রায় ৮৩ বছর ৪ মাস, যা একটি মানবজীবনের সময়ের সমান। সুতরাং পবিত্র রমজানের সুফল জীবনব্যাপী।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ