উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) পদের চারজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়েছে সরকার। আজ রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পৃথক প্রজ্ঞাপনে তাঁদের বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার কথা জানানো হয়।

অবসরপ্রাপ্ত এ কর্মকর্তারা হলেন, নৌ পুলিশের ডিআইজি আবদুল কুদ্দুস আমিন, অ্যান্টি টেররিজম বিভাগের নিশারুল আরিফ, হাইওয়ে পুলিশের আমেনা বেগম ও মো.

আজাদ মিয়া।

২০১৮ সালের চাকরি আইনের ধারা অনুযায়ী এ চারজনকে অবসর দেওয়া হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

প্রশাসনে ‘সুনামি’ ও এক অ–ভিআইপি উপদেষ্টা

জনপ্রশাসনে প্রথম ‘সুনামি’ শুরু হয়েছিল ৫ আগস্টের পর। দ্বিতীয় সুনামি শুরু হলো অতি সম্প্রতি। তবে দুই সুনামির মধ্যে ফারাক আছে। প্রথমটি ছিল অনেকটা জোরজবরদস্তিমূলক। কারও মনে হলো, অমুক মন্ত্রণালয়ে পছন্দসই একজনকে বসাতে হবে। কিন্তু সেই পদে তো একজন আছেন। সাবেক সরকারের অপার মহিমায় পদ ছাড়া বহু কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিলেও এক পদে দুজনকে বসানোর কোনো সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে আগেরজনকে সরাতে হবে। সে জন্য একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। এভাবে স্বৈরাচারের দোসর বলে অনেককে সরানো হয়েছে। আবার শূন্যস্থানে যাঁদের বসানো হয়েছে, তঁাদের নামেও একই অভিযোগ তুলেছেন কেউ কেউ। 

জনপ্রশাসনে রদবদল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে ওএসডি করা কিংবা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর উদাহরণ খুব বেশি নেই। আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপি-জামায়াতের দোসর কালিমা দিয়ে অনেক মেধাবী কর্মকর্তাকে ওএসডি করেছিল। ২৫ বছরের দোহাই দিয়ে অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হয়। এর আগে বিএনপি সরকারের আমলেও এমন ঘটনা ঘটেছে।

আলাপ প্রসঙ্গে একজন সাবেক সচিব বললেন, ঢালাও ওএসডি ও অবসরে পাঠানোর কাজটি শুরু হয় বিএনপির দ্বিতীয় সরকারের আমলে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির প্রথম সরকারের সময় কর্মকর্তাদের গায়ে রাজনীতির তকমা লাগানোর ঘটনা তেমন ছিল না। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বিএনপি–জামায়াতের ট্যাগ লাগিয়ে অনেক বেশিসংখ্যক কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রাখে এবং এক পর্যায়ে তাদের অবসরে পাঠিয়ে দেয়।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে জনপ্রশাসনে বঞ্চিত ৭৬৪ জনকে পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পদোন্নতিপ্রাপ্তদের মধ্যে আছেন সচিব পদে ১১৯ জন, গ্রেড-১ (সচিবের সমান বেতন গ্রেড) পদে ৪১ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮ জন, যুগ্ম সচিব পদে ৭২ জন এবং উপসচিব পদে ৪ জন কর্মকর্তা। যাঁরা অবসরে গেছেন, তাঁরা ‘ভূতাপেক্ষভাবে’ পদোন্নতি পাবেন। ২০০৯ সাল থেকে গত বছরের ৪ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বঞ্চিত দাবি করে ১ হাজার ৫৪০ কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। এর মধ্যে মারা যাওয়া কর্মকর্তাদের পক্ষে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের করা ১৯টি আবেদনও ছিল। এ–সংক্রান্ত গঠিত একটি কমিটির সুপারিশে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। 

যে দেশে থানা পর্যায়ের একজন নেতা ও জেলা পর্যায়ের একজন সরকারি কর্মকর্তা ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন, সেখানে সাখাওয়াত হোসেনের এ দৃষ্টান্ত অনুসরণীয় বলে মনে করি। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা যদি সত্যি সত্যি দেশটা বদলাতে চান, শুরুটা নিজেকে দিয়েই করতে হবে। ‘আপনি আচরি ধর্ম শেখাও অপরে।’

এ হলো জনপ্রশাসনের একদিকের চিত্র। অপর দিকের চিত্র হলো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিতর্কিত তিনটি নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) সালে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে থাকা সাবেক জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাঁদের মধ্যে যাঁদের চাকরির বয়স ২৫ বছর হয়েছে, তাঁদের বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। অন্যদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে ২২ জন সাবেক ডিসিকে, যাঁরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগসহ নানা পদে অতিরিক্ত সচিব ও সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আর ওএসডি করা হয়েছে ৩৩ কর্মকর্তাকে। এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা ডিসিদের এই মেসেজ দিতে চাচ্ছি—আপনারা রিটার্নিং অফিসার হবেন, ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে সাহসের সঙ্গে আইনকানুন মেনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করবেন। যাঁরা করবেন না, তাঁরা এই মেসেজ পেয়ে যাবেন যে না হলে কী ফল হবে!’ খুবই কঠিন বার্তা। 

নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের মুখ্য ভূমিকা থাকে, এটা সত্য। কিন্তু ভোটকেন্দ্রের মূল কাজটি তো করে থাকেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, পোলিং কর্মকর্তারা। এর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যদেরও সক্রিয় ভূমিকা ছিল রাতের ভোটে। ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোটে’ আমলাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দৌরাত্ম্য কম ছিল না। সে ক্ষেত্রে অন্যদের বাদ দিয়ে কেবল ডিসিদের শাস্তি দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা হলো দলীয় সরকারের অধীন কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। কারণ, দলীয় সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কাজ করার সুযোগ ও সাহস কেউ দেখাতে পারেননি। সেটা ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪–এর জন্য যেমন সত্য, তেমনি সত্য ১৯৯৬ সালের (১৫ ফেব্রুয়ারি) নির্বাচনের জন্যও।

জনপ্রশাসনসচিব বলেছেন, অপরাধ করে কেউ ভবিষ্যতেও পার পাবেন না, শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু অতীতের অন্যায়ের বিচারের ক্ষেত্রে শুধু রিটার্নিং কর্মকর্তারা কেন শাস্তি পাবেন? অন্যরা কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ নির্বাচনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সবার আমলনামা খতিয়ে দেখা হোক। তদন্ত সাপেক্ষে তাঁদেরও বিচারের আওতায় আনা হোক। 

ডেইলি স্টার–এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন আগামী অক্টোবরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে বলে জানিয়েছেন। ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে অক্টোবরেই তফসিল ঘোষণা করতে হবে। তিনি আগামী বছরের জানুয়ারিতে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বিদায় নেবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। 

নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যে সংশয় সন্দেহ আছে, তাঁর এ বক্তব্যের মাধ্যমে কাটবে কি না জানি না, এর আগে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস তফসিলের বিষয়ে কিছু না বললেও ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। ওই সাক্ষাৎকারে সাখাওয়াত হোসেন সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়েও একটা বাস্তব ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মানুষের প্রত্যাশা সরকারের গতি ৮০ কিলোমিটার হোক, আমরা হয়তো ৪০-৫০–এ চলছি।’ অর্থাৎ সরকারের জনপ্রত্যাশার অর্ধেক পূরণের অবস্থায় আছে।

উপদেষ্টাদের ক্ষমতাচর্চা সম্পর্কে রাজনৈতিক মহলে নানা রকম আলোচনা আছে। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এই উপদেষ্টা বলেন, ‘অন্যদের বিষয়টা বলতে পারব না। আমার জন্য বরাদ্দ সরকারি গাড়ির বাড়তি ব্যবহার করি না, আমার পরিবারের কাউকে করতে দিই না।...বিদেশে গেলে ভিভিআইপি টার্মিনাল ব্যবহার করি না। অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটেও ভিভিআইপি টার্মিনাল ব্যবহার করি না। লন্ডনে গিয়েছি, বিজনেস ক্লাসের টিকিট নিইনি, ইকোনমি ক্লাসে গিয়েছি। ভিআইপি টার্মিনাল ব্যবহার না করায় আমার সহকর্মীদের তো মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। তাদের বলি, তোমরা যারা ভিভিআইপিতে যেতে চাও যাও, আমি সাধারণ লাইনে দাঁড়িয়ে যাব।’

যে দেশে থানা পর্যায়ের একজন নেতা ও জেলা পর্যায়ের একজন সরকারি কর্মকর্তা ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন, সেখানে সাখাওয়াত হোসেনের এ দৃষ্টান্ত অনুসরণীয় বলে মনে করি। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা যদি সত্যি সত্যি দেশটা বদলাতে চান, শুরুটা নিজেকে দিয়েই করতে হবে। ‘আপনি আচরি ধর্ম শেখাও অপরে।’

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দুর্নীতিতে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে দুদক: জনপ্রশাসন স‌চিব
  • পুলিশের ৪ ডিআইজিকে বাধ্যতামূলক অবসর
  • বাধ্যতামূলক অবসরে এবার ৪ ডিআইজি
  • এবার বাধ্যতামূলক অবসরে ৪ ডিআইজি
  • ফাগুনের বৃষ্টিতে ছন্দপতন
  • পেন্টাগনে নজিরবিহীন রদবদল
  • প্রশাসনে ‘সুনামি’ ও এক অ–ভিআইপি উপদেষ্টা
  • বাধ্যতামূলক অবসরে অতিরিক্ত সচিব তপন কুমার
  • কুড়িগ্রামের প্রথম শহীদ মিনারের ইতিহাস জানেন না শিক্ষার্থীরা, পড়ে আছে অবহেলা-অযত্নে