১৯ বছর পর আগামীকাল সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) আওয়ামী লীগের দুর্গখ্যাত গোপালগঞ্জে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিএনপির জনসভা। সভা সফল করতে ইতোমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন দলটির নেতারা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ও নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণাসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অংশ হিসেবে এই সভার আয়োজন করা হচ্ছে।

জনসভাকে ঘিরে গোপালগঞ্জে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে বইছে আনন্দের জোয়ার। কেন্দ্রীয় নেতাদের বরণ করতে বিভিন্ন সড়কে নির্মাণ করা হয়েছে তোরণ। ব্যানার ও ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে সড়কের দুইপাশ।

ক্ষমতায় থাকাকালীন ২০০৬ সালের পর গোপালগঞ্জে আর কোনো জনসভা করতে পারেনি বিএনপি। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী ২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগের তিন মেয়াদে গোপালগঞ্জে বিএনপিকে প্রকাশ্যে কোনো মিছিল-মিটিংও করতে দেখা যায়নি। ঘরোয়া আলোচনার মাধ্যমেই সীমাবন্ধ ছিল তাদের কর্মসূচি বলে জানিয়েছেন নেতারা। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে গোপালগঞ্জের রাজপথ দাঁপিয়ে বেড়াতে শুরু করেছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।

আরো পড়ুন:

প্রধান উপদেষ্টাকে দুদু
আপনাকে ফুলের মালা দিয়ে বিদায় দিতে চাই

অস্ত্র হাতে বাজারে গিয়ে হুমকি, যুবদল নেতা বহিষ্কার

সোমবার গোপালগঞ্জ জেলা শহরের পৌর পার্কে সকাল ১০টায় শুরু হওয়া সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড.

আসাদুজ্জামান রিপনের। প্রধান বক্তা হিসেবে কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (ফরিদপুর বিভাগ) শামা ওবায়েদ উপস্থিত থাকবেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকবেন- কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (ফরিদপুর বিভাগ) সেলিমুজ্জামন সেলিম, কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (ফরিদপুর বিভাগ) খন্দকার মাশুকুর রহমান, সহ-আইন বিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদিন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম পটুসহ অন্য নেতারা। সভায় সভাপতিত্বে করবেন গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শরীফ রফিকউজ্জামান।

সমাবেশ সফল ও রেকর্ড সংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বিএনপি ও দলটির সহযোগী সংগঠনগুলো দফায় দফায় প্রস্তুতি সভা, প্রচারণা ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালন করেছে।

বিএনপির দলীয় সূত্র জানা যায়, গোপালগঞ্জ শহরের শেখ কামল ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ২০০৪ সালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সর্বশেষ ফরিদপুর বিভাগীয় ইউনিয়ন সভা করেছিলেন। যা জনসভায় পরিণত হয়েছিল। সে সময় বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সভা-সমাবেশ করতে পেরেছে। ১৯ বছর পর গোপালগঞ্জে আয়োজন করা জনসভায় ৩০-৪০ হাজর লোক সমাগমের টার্গেট নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা কাজ করছেন। 

গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি সিকদার শহিদুল ইসলাম লেলিন বলেন, ‍“দীর্ঘদিন আমরা উন্মুক্তভাবে রাজনীতি করতে পারিনি। ২৪ তারিখের সমাবেশকে ঘিরে নেতাকর্মীরা মধ্যে আনন্দের জোয়ার বইছে। কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (ফরিদপুর বিভাগ) সেলিমুজ্জামন সেলিমের নির্দেশনায় জনসভা সুন্দরভাবে সফল করতে কাজ করে যাচ্ছি।”

গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্য অ্যাভোকেট তৌফিকুল ইসলাম তৌফিক বলেন, “ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর উন্মুক্ত পরিবেশে আগামীকাল সোমবার পৌর পার্ক মাঠে জনসভা অনুষ্ঠিত হবে।”

গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শরীফ রফিকউজ্জামান বলেন, “ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের গোপালগঞ্জে স্বাধীনভাবে একটি কর্মসূচিও পালন করতে দেয়নি। বিগত সময় জাতীয়তাবাদী ধারার সমর্থকরা ভয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারেননি। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর এখন আর কোনো ভয় নেই। ১৯ বছর পর কোনো বাধা ছাড়াই মুক্ত ও স্বাধীনভাবে জনসভার আয়োজন করা হবে। এতে ৩০- ৪০ হাজার লোকের সমাগম ঘটবে।”

তিনি আরো বলেন, “আমরা ২৪ তারিখের জনসভাকে কেন্দ্র করে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। কোনো বাধা ছাড়াই জনসভার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বিভিন্ন সড়কে নেতাদের তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে।”

ঢাকা/বাদল/মাসুদ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব এনপ প লগঞ জ জ ল র গ প লগঞ জ ব এনপ র স ন ত কর ম সরক র র স মব র

এছাড়াও পড়ুন:

দর্জিদের পতাকার নমুনা দিলাম

মার্চ মাসটা ছিল অগ্নিঝরা। আন্দোলন, মিছিল, জনসভা, হরতাল,  কোনো সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের, কোনো সময় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কর্মসূচিতে গোটা দেশবাসীর সঙ্গে খুলনা ছিল প্রথম কাতারে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছে এবং সংগ্রাম পরিষদ শুধু আন্দোলনই করছে না, প্রশাসনও এই সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশমতো কাজ করছে। অত্যন্ত আন্তরিকভাবেই সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তর সংগ্রাম পরিষদের কথামতোই পরিচালিত হয়। সে সময়ে খুলনা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা মিলে একটা জেলা ছিল। 
আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশ পেয়ে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ দিবস ও পতাকা দিবস’ পালন করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিলাম এবং জনগণকে ওই দিন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলনের আবেদন জানালাম। খুলনা শহরের দর্জিদের পতাকার নমুনা দিলাম। তারা পতাকা তৈরি করে দোকানের সামনে রাখলে সাধারণ মানুষ এই পতাকা ক্রয়ের জন্য ব্যস্ত হলো, এমনকি পতাকার মূল্য ১০ টাকা দাবি করলেও ক্রেতা ১২ টাকা দিয়ে খুশি হয়ে পতাকা কিনতে লাগল। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে জনসাধারণ যাতে সময়মতো পতাকা পায়, তার জন্য পতাকা তৈরি ও বিক্রয় করে লভ্যাংশ সংগ্রাম পরিষদের তহবিলে জমা দেওয়ার জন্য স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য মরহুম শেখ আব্দুল কাইউমের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হলো। দিন নেই, রাত নেই সবাই ব্যস্ত। ২১ ও ২২ মার্চ আমরা অত্যন্ত ব্যস্ত দিন অতিবাহিত করলাম। চাঁদা আদায়, পতাকা বিক্রয়, ফুল সংগ্রহ, গণসংযোগ ইত্যাদির ভেতর দিয়ে পুরো দিনটাই কেটে গেল। ২২ মার্চ রাতে কেউ আর তেমন ঘুমাল না, সারারাত ধরে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করল। খুলনা থেকে জাহাঙ্গীর সম্পাদিত ও প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘দেশের ডাক’ পত্রিকা পূর্ণ পৃষ্ঠা স্বাধীন বাংলার রঙিন পতাকাসহ বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করল। এই সংখ্যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেল এবং সব কপি দুপুরের মধ্যে বিক্রি হয়ে গেল। 
২৩ মার্চ আমরা পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী প্রভাতফেরি সমাপ্ত করে দ্রুত নাশতা-পানি খেয়ে সকাল সাড়ে ৮টায় পার্কে এসে উপস্থিত হলাম। ছাত্র-শ্রমিক-জনতায় পার্ক যেন উপচে পড়ছে। পার্কের উভয় দিকের রাস্তায় এবং সোসাইটি সিনেমা হলের ধারে কয়েকটা মিলিটারি অবস্থান নিয়েছে। 
আমরা ঠিক সকাল সাড়ে ৯টায় বাদ্যের তালে তালে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’– এই গান গেয়ে আমি স্বাধীন বাংলার পতাকা তুললাম। জয় বাংলা বাহিনী সুশৃঙ্খলভাবে আমাদের অভিবাদন জানিয়ে পতাকাকে স্যালুট করল, উপস্থিত জনতা করতালির মাধ্যমে স্বাগত জানিয়ে আমাদের এই পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠান উপভোগ করল এবং কর্মসূচি শেষ হলো। স্বাধীনতার পতাকা তোলার ভেতর দিয়ে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম তথা স্বাধীন বাংলার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হলো। 
উল্লেখ করা আবশ্যক যে, অনেক আওয়ামী লীগ নেতা তখনও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন, কিন্তু স্বাধীন বাংলা ছাত্র পরিষদ ও ছাত্র-জনতা স্বাধীনতার জন্য ছিল অনড়-অবিচল। বিকেলে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পার্কে বিরাট জনসভা হলো। উল্লেখ্য, এই সভায় আমি সভাপতিত্ব করলাম, যেহেতু টসে জিতে ১২ মার্চের সভায় হুমায়ুন কবীর বালু সভাপতিত্ব করেছিলেন। সন্ধ্যায় আমরা পতাকা নামালাম, সন্ধ্যার পরও জনসভা চলল। আমরা বজ্র শপথ নিলাম– ‘দেশ স্বাধীন করবই।’ 
তারপর ২৫ মার্চের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ২৬ মার্চ সকালে খবর পেয়ে আমরা সবার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তখন খুলনা খানজাহান আলী রোডে আলিয়া মাদ্রাসার সম্মুখে অবস্থিত ‘কবীর মঞ্জিল’-এ বৈঠকের পরিকল্পনা করলেন মুজিব বাহিনীর প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকু। ওই দিন আমরা প্রাথমিক আলোচনা করে একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠন এবং যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিই।
২৭ মার্চ সকালে অতি সতর্কতার সঙ্গে একে একে টুকু ভাই, কাইউম, আমিসহ অন্যরা মিলিত হলাম এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হলো যুদ্ধ অনিবার্য। যুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন অস্ত্র, রসদ, পরিকল্পনা, অর্থ ইত্যাদি। কিন্তু কে কীভাবে এ যুদ্ধ পরিচালনা করবে? তাই এই যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটা বিপ্লবী পরিষদ করা হোক। তখন সর্বসম্মতিক্রমে শেখ কামরুজ্জামান টুকুকে চেয়ারম্যান, ডা. আসিফুর রহমান, কে এস জামান, জাহিদুর রহমান জাহিদ, শেখ আব্দুল কাইউম ও আমাকে সদস্য করে এই বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হলো। আরও সিদ্ধান্ত হলো যে, এই পরিষদ যুদ্ধ চলাকালে সর্বোচ্চ পরিষদ হিসেবে বিবেচিত হবে। এই পরিষদের সিদ্ধান্ত হবে চূড়ান্ত। 
২৭ মার্চ সন্ধ্যায় হঠাৎ শেখ কামরুজ্জামান টুকু সিদ্ধান্ত নেন যে, খুলনা সার্কিট হাউসে ও তৎসন্নিকটস্থ ইউএফডি ক্লাবে পাকিস্তানি সেনাদের তাঁবুতে তিনি আক্রমণ পরিচালনা করবেন। আমরা তেমন কেউ ওই সময় তাঁর কাছে না থাকায় শেখ আব্দুল কাইউম, ডালিম, জ্যোতিষ, বিনয়, তপনসহ তিনি এই দুঃসাহসিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তপন, জ্যোতিষ ও বিনয় আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের তেমন সক্রিয় কর্মী না হলেও দেশপ্রেমের কারণে তারা আত্মদানের প্রস্তুতি নিয়ে টুকু ভাইয়ের সঙ্গে যোগ দেয় এবং তারা শক্তিশালী বোমা, মলোটভ ককটেল প্রভৃতি অতি প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক তৈরিতে পারদর্শী হয়ে ওঠে। সামান্য একটা ২২ বোর রাইফেল, গোটা দুয়েক দেশি বন্দুক আর ওদের তৈরি বোমা ও ককটেল নিয়ে ইউএফডি ক্লাবের সেনাছাউনিতে অভিযান চালানো হয়। অতর্কিতে ওই আক্রমণের জন্য খানসেনারা প্রস্তুত ছিল না। ফলে বহু খানসেনা এ হামলায় আহত হয়। হামলা শেষে সবাই নিরাপদে ফিরে আসি। খুলনায় পাকিস্তানি মিলিটারিদের ওপর এটাই ছিল প্রথম গেরিলা আক্রমণ। 
অনুলিখন
হাসান হিমালয়
খুলনা ব্যুরো

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দর্জিদের পতাকার নমুনা দিলাম