কোন সরকারব্যবস্থা আমাদের জন্য বেশি উপযোগী
Published: 23rd, February 2025 GMT
আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি যে গণতান্ত্রিক হতে হবে, গণ-অভ্যূত্থানের পর এ নিয়ে এখন কারোরই কোনো দ্বিমত নেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নানা ধরন আছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন পদ্ধতির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমাদের জন্য অধিকতর প্রযোজ্য হবে?
মোটাদাগে, গণতান্ত্রিক সরকারপদ্ধতি দুই ধরনের। এক, সংসদীয় বা ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচের সরকারপদ্ধতি এবং দুই, রাষ্ট্রপ্রধান দ্বারা পরিচালিত সরকারপদ্ধতি।
সংসদীয় সরকারব্যবস্থা
ওয়েস্টমিনস্টার নামটি এসেছে লন্ডনের প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন ওয়েস্টমিনস্টার প্রাসাদের নাম থেকে, যা ৫০০ বছর ধরে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সংসদীয় পদ্ধতির সূতিকাগার এবং বড় উদাহরণ হলো ইংল্যান্ডের সরকারব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় একজন আলঙ্কারিক রাষ্ট্রপ্রধান থাকেন, যাঁর কোনো নির্বাহী ক্ষমতা থাকে না, তিনি সাধারণত নির্বাচিত হন না, ক্ষেত্রবিশেষে বংশানুক্রমিকভাবে পদটিতে অধিষ্ঠিত হন। ক্ষমতা থাকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত আইনসভার হাতে।
আইনসভার সাধারণত দুটি কক্ষ থাকে। একটি বা দুটি যে সংখ্যক কক্ষই থাকুক না কেন, নিম্নকক্ষ গঠিত হয় জনগণের ভোটে নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে। আর উচ্চকক্ষ গঠিত হয় প্রধানত মনোনীত/বংশানুক্রমিক খেতাবধারী ব্যক্তিদের নিয়ে। আইনসভার নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে, মন্ত্রী হন সংসদ সদস্যদের মধ্যে থেকে আর দলের নেতা হন প্রধানমন্ত্রী।
অর্থাৎ এই ব্যবস্থায় নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভার মধ্যে যেমন কোনো ফারাক থাকে না, তেমনই আবার সরকারপ্রধান আর রাষ্ট্রপ্রধান আলাদা হন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় আইনসভার নিম্নকক্ষের বিরোধী দলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়।
আমাদের সরকারব্যবস্থাটি পাঁচশালা বন্দোবস্তের। কিন্তু আমাদের যে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রকাঠামো, সেটা পাঁচশালা গণতান্ত্রিক বন্দোবস্তের উপযোগী নয়। এর অবশ্যম্ভাবী গন্তব্য ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’। আমাদের রাষ্ট্রকাঠামো, তাতে প্রবিষ্ট মতাদর্শিক পরিকাঠামো আর রাজনৈতিক দলের গঠন—এসব একসূত্রে গাঁথা।রাষ্ট্রপ্রধানশাসিত সরকাব্যবস্থা
রাষ্ট্রপ্রধানশাসিত সরকারব্যবস্থার উদাহরণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্র পরিচালনাপদ্ধতি। মার্কিন সংবিধান গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে এমন এক যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটানো হয়, যেখানে একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান থাকেন, যিনি একই সঙ্গে সরকারপ্রধানও বটে।
ফরাসি আইনবিদ মন্টেস্কুর ‘ক্ষমতার পৃথককরণ তত্ত্ব’ অনুযায়ী যেভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে আইনসভা, সরকার ও বিচার বিভাগে ভাগ করার কথা বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সেই রকমের পৃথককরণ আছে। সেখানে সংসদ সদস্যরা মন্ত্রী বা সরকারের কোনো পদাধিকারী হতে পারেন না। একইভাবে মন্ত্রীরা সংসদ সদস্য থাকতে পারেন না।
এই পদ্ধতিতে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান কার্যত একই ব্যক্তি হন। তিনি নির্বাচিত হন সরাসরি জনগণের ভোটে। তিনি মন্ত্রীদের নিয়োগ করেন এবং তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী মন্ত্রীরা পদে থাকেন। তাঁদের দিয়েই রাষ্ট্রপ্রধান সরকার চালান। অন্যদিকে আইনসভার সদস্যরাও ছোট ছোট নির্বাচনী আসন থেকে সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন।
শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের নিম্নকক্ষ সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও উচ্চকক্ষ বা সিনেটে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা ছিল না। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের জন্য দুজন করে সিনেটর নির্বাচন করতেন সংশ্লিষ্ট রাজ্যের আইনপ্রণেতারা। ১৯১৩ সালে মার্কিন সংবিধানের ১৭তম সংশোধনীর মাধ্যমে সিনেটে সরাসরি নির্বাচনের বিধান করা হয়।
মার্কিন রাষ্ট্রকাঠামোতে সিনেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আইনপ্রণয়ন ও বৈদেশিক চুক্তি অনুমোদনের ক্ষমতা ছাড়াও সিনেটে শুনানি এবং অনুমোদন ছাড়া প্রেসিডেন্ট তাঁর মন্ত্রীদের (সেক্রেটারি) নিয়োগ করতে পারেন না। সুপ্রিম কোর্টসহ ফেডারেল বিচারকদের নিয়োগও সিনেটে অনুমোদিত হতে হয়। রাষ্ট্রপ্রধানসহ অন্য শীর্ষ পদাধিকারীদের চূড়ান্তভাবে অভিশংসিত করার ক্ষমতাও সিনেটের। এভাবে উচ্চকক্ষ মার্কিন রাষ্ট্রকাঠামোতে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রেখে উচ্চকক্ষ বা সিনেট স্বৈরতন্ত্রের উত্থান রোধসহ স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা
আমাদের দেশে ১৯৭২ থেকে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সংসদীয় পদ্ধতি চললেও ১৯৭৫ সালে বাকশালের মাধ্যমে চালু হয় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার। সামরিক-বেসামরিক শাসন মিলে সেটা বহাল থাকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। সে বছরই সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে আবার চালু করা হয় সংসদীয় পদ্ধতির সরকার।
বাংলাদেশের সংসদীয় সরকারপদ্ধতি যুক্তরাজ্যের সংসদীয় পদ্ধতি থেকে কিছুটা আলাদা। এই পার্থক্য সংসদীয় সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে। আমাদের ক্ষেত্রে সংসদ নয়, সংবিধানই সার্বভৌম।
এই ব্যবস্থায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা সরকার গঠন করেন। তাঁদের নেতা একই সঙ্গে সংসদনেতা ও প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি সাধারণত অন্য সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রীদের মনোনীত করেন।
সরাসরি নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত হওয়া ব্যক্তিদের দ্বারাই সংসদ ও সরকার পরিচালিত হয়। অর্থাৎ সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়ন করেন এবং তাঁদের মধ্যকার কেউ কেউ সরকারের মন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতারও অংশীদার হন। সংসদ সদস্যদের নেতা ও মন্ত্রীদের ‘নিয়োগকর্তা’ হিসেবে আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে ওঠেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশে একজন প্রধানমন্ত্রী কতটা ক্ষমতাবান এবং কতটা ক্ষমতার চর্চা করতে পারেন, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসক হয়ে ওঠার জন্য যেমন তাঁর রাজনীতির দায় রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের বিদ্যমান সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভূমিকা রয়েছে।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা এতই বেশি যে এখানে ব্যক্তির ভূমিকা অনেকটাই গৌণ হয়ে যায়; যিনিই প্রধানমন্ত্রী হন, তিনিই থাকেন সব ধরনের জবাবদিহির ঊর্ধ্বে। এসব কিছুর ঊর্ধ্বে ওঠা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক মনের গড়ন এবং নানা অনুঘটকের ক্রিয়াশীলতার ওপরই অসহায়ভাবে আমাদের জনগণকে নির্ভরশীল হতে হয়। এই ব্যবস্থা কোনোভাবেই গণতন্ত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
গণতন্ত্রের কি কোনো বিকল্প আছে
কোন ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমাদের জন্য উপযোগী হবে, এই প্রশ্নের সহজ কোনো উত্তর নেই। একটা রাষ্ট্রে গণতন্ত্র আছে কি না, তা নির্ধারণ করার অনেক ধরনের মাপকাঠি আছে। আধুনিক যুগের অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন, কোনো দেশে গণতন্ত্র আছে কি না, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে একটা ‘সাধারণ’ প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমে।
প্রশ্নটি হলো, রাষ্ট্রের একজন সাধারণ ব্যক্তির সরকারপ্রধান হওয়ার পথ কতটা সহজ বা আদৌ সম্ভব কি না। অর্থাৎ নিজের যোগ্যতা, শ্রম আর ক্যারিশমা দিয়ে জনগণের সমর্থন আদায় করে কোনো একদিন তিনি দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন, এমন কোনো বৈধ পদ্ধতি সে দেশে আছে কি না। যদি সে রকম সুযোগ থাকে, তাহলে সেই দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক বলা যেতে পারে।
কৃষ্ণাঙ্গ ও পূর্বপুরুষ অভিবাসী হওয়া সত্ত্বেও বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছিলেন। এটা তিনি পেরেছিলেন তাঁর নিজস্ব যোগ্যতার কারণে এবং অবশ্যই দেশটির গণতান্ত্রিক কাঠামোর জোরে। অন্যদিকে রাজতন্ত্র না থাকলেও অনেক দেশেই পারিবারিক উত্তরাধিকার ছাড়া রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা চিন্তাই করা যায় না। নামে গণতন্ত্র না হলেও এ দেশগুলোর রাষ্ট্রকাঠামো যে গণতান্ত্রিক, তা সহজেই বোধগম্য।
১৯৮০-এর দশক থেকেই দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান আর ১৯৯১ সাল থেকে সংসদীয় ব্যবস্থা চালুর পর থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় রয়েছে ‘উত্তরাধিকারের রাজনীতি’। যাঁরা এসব পদে ছিলেন, তাঁদের দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়েছে; কিন্তু উত্তরাধিকারের রাজনীতি তাঁদের অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে নিয়ে গেছে।
আমাদের মনে রাখা দরকার, ১৯৯১ সালে সংসদীয় পদ্ধতি চালুর সময় তৎকালীন শাসক দল বিএনপি রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতির পক্ষে ছিল। কিন্তু সংসদীয় পদ্ধতির পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে দিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অনড় মনোভাবের কারণে কিছুটা অনিচ্ছুক হয়েই বিএনপি সংসদীয় পদ্ধতিতে রাজি হয়।
সংসদীয় পদ্ধতিতে জনগণের রায়ের চেয়েও রাজনৈতিক দল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ, এ পদ্ধতিতে জনগণ সরাসরি একজনকে নেতা নির্বাচন করতে পারেন না। দেশকে কয়েক শ ভাগে (৩০০ সংসদীয় আসন) ভাগ করে প্রতিটি ভাগ থেকে একজন করে প্রতিনিধি নির্বাচন করেই জনগণকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
এভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠরা তাঁদের নেতা (প্রধানমন্ত্রী) নির্বাচন করেন। অর্থাৎ জনগণ ও তাঁদের নেতার মধ্যে একদল মধ্যস্থতাকারী (সংসদ সদস্য) থাকেন। এর ফলে সম্ভাব্য নেতা বা প্রধানমন্ত্রীর একটি রাজনৈতিক দল থাকতে হবে; যে দলটির আবার দেশব্যাপী সংগঠন থাকতে হবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে ভোটে জেতার ক্ষমতা থাকতে হবে।
এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। বিশেষ কোনো পরিস্থিতি ছাড়া সাধারণভাবে কারও পক্ষে অল্প সময়ে এ রকম দল গড়ে ক্ষমতায় যাওয়া বেশ দুরুহ। নানা মত-পথের মানুষকে দলে আনা, তাঁদের ধরে রাখা, তাঁদের নানাবিধ চাহিদার সমন্বয় করে দলকে বিকশিত করা সহজ কাজ নয়। এর ফলে আমাদের দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, ‘রেডিমেড’ ও ‘বিশ্বাসযোগ্য’ নেতৃত্বের জন্য দলকে উত্তরাধিকারের রাজনীতির দিকে ঝুঁকতে হয়।
এর ভালো ও মন্দ—উভয় দিকই আছে। দলের জন্য ভালো হলেও জনগণের বিভিন্ন অংশের জন্য তা অস্বস্তি ও সমালোচনার কারণ হয়ে ওঠে। দল ধরে রাখতে পরিবারের ওপরই ভরসা রাখায় হরহামেশাই জনস্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখা গেছে। আবার অনেক সমালোচনা থাকলেও এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হতে পারেন পরিবারেরই কোনো রাজনৈতিক সম্ভাবনাময় সদস্য। যোগ্য হওয়ার পরও উত্তরাধিকারের রাজনীতির বদনাম বহন করে যেতে হয় তাঁকে।
এমন নানা কারণ আর অভিজ্ঞতার আলোকে নাগরিকদের সরাসরি নিজের ও দেশের নেতা নির্বাচন করার অধিকার দেওয়া এবং প্রত্যেক নাগরিকের জন্যই রাষ্ট্রের শীর্ষ পদে যাওয়ার অবারিত সুযোগ রাখার বন্দোবস্ত তৈরি করতে হবে। সেটা করতে চাইলে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারপদ্ধতি অধিকতর উপযোগী বলে মনে হয়।
আমাদের দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক চিন্তার পরিসর বর্তমানে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার পদ্ধতির চেয়ে প্রধানমন্ত্রীশাসিত পদ্ধতির দিকেই অনেকটা ঝুঁকে আছে। সংবিধান সংস্কারসহ নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনেও ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতি বহাল রেখে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার প্রচেষ্টা লক্ষ করা গেছে। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাধ্যমে কমিশনেরই করানো জনমত জরিপে আবার ৮৩ শতাংশ মানুষ সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। (প্রথম আলো, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫)
গণতন্ত্র মানে হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছা বা অভিপ্রায়। রাষ্ট্র পরিচালনায় এখনো গণতন্ত্রের বিকল্প আর কিছু নেই। তাই গণতন্ত্রের বাস্তব বিকল্প হলো অধিকতর গণতন্ত্র। ভুলে গেলে চলবে না, দেশের মালিক জনগণ। জনগণের জান, মাল ও জবানের হেফাজত করতে সক্ষম হবে, এমন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই হোক রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য।
আমাদের সরকারব্যবস্থাটি পাঁচশালা বন্দোবস্তের। কিন্তু আমাদের যে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রকাঠামো, সেটা পাঁচশালা গণতান্ত্রিক বন্দোবস্তের উপযোগী নয়। এর অবশ্যম্ভাবী গন্তব্য ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’। আমাদের রাষ্ট্রকাঠামো, তাতে প্রবিষ্ট মতাদর্শিক পরিকাঠামো আর রাজনৈতিক দলের গঠন—এসব একসূত্রে গাঁথা।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চাইলে এই কাঠামোটাকে কিছুটা হলেও বদলাতে হবে। তা না হলে দেশের ঘাড়ে জোয়ালের মতো চেপে বসা স্বৈরশাসন হটাতে প্রতি এক-দেড় দশক পরপর একটি করে গণ–অভ্যুত্থানের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
মিল্লাত হোসেন সংবিধান, আইন, আদালতবিষয়ক লেখক ও গবেষক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ষ ট রপত শ স ত গণত ন ত র ক ব শ স ত সরক র জনগণ র ভ ট গণতন ত র র মন ত র দ র ব যবস থ য় ন ম নকক ষ ক ব যবস থ আইনসভ র মন ত র র র জন ত র ক ষমত র র সরক র র ক ষমত র জন য র গণত উপয গ হওয় র র গঠন ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
ওরা কারা বসন্ত আটকে দিতে চায়!
শীত চলে গেলেও কুয়াশা কাটে না। কেননা ওরা বসন্ত আটকে দিতে চায়। উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ১০ ফেব্রুয়ারি সোমবার আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘কথিত আন্দোলন আর মবের মহড়া আমরা এখন থেকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করব। রাষ্ট্রকে অকার্যকর এবং ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা করা হলে একবিন্দু ছাড় দেওয়া হবে না’ (সমকাল)। ‘তৌহিদি জনতার’ উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘অভ্যুত্থানের পক্ষে হলে মব করা বন্ধ করেন, আর যদি মব করেন, তাইলে আপনাদেরও ডেভিল (শয়তান) হিসেবে ট্রিট (গণ্য) করা হবে।’ তাঁর এ বিবৃতি যেন কথার কথা না হয়।
মব হলো একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া। আমার কাছে ঘটনাগুলো মব মনে হয় না, এটি আমার কাছে পরিকল্পিত প্রতিক্রিয়াই মনে হয়। প্রথম যেসব ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে, তা সরকার নাই অবস্থায় হয়েছে, সত্য। তা কি শুধু শেখ মুজিব বা শেখ হাসিনার প্রতি ঘৃণা থেকে হয়েছে? মেহেরপুরে যাদের ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে, তারা শেখ মুজিব কিংবা শেখ হাসিনা ছিলেন না– এটা সবারই জানা। এই সেদিনও সুনামগঞ্জের ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে, কৃষক স্বৈরাচার বা শেখ হাসিনা নন, এটাও সবার জানা।
তাই আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, যারা ভাঙছে তারা বৈষম্যে বিশ্বাসী। তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতিতে অবিশ্বাসী। তারা সৌদি আরবসহ পৃথিবীর বহু ইসলামী পরিচয়ধারী দেশে ভাস্কর্য আছে, তা জানা সত্ত্বেও ভাস্কর্য ভাঙাকেই নিজেদের ধর্মীয় পবিত্র দায়িত্ব মনে করে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াকেই নিজেদের পবিত্র দায়িত্ব মনে করে। অগ্রসর মানুষ তাদের ডেভিল মনে করে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব দাঁড়ায় ওই ডেভিলদের মোকাবিলা করা।
সরকার ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ক্রিয়াশীল থাকার সময়ই একের পর এক মাজারে হামলা হয়েছে। যারা হামলা করেছে তারা জানে মাজারে শেখ হাসিনা নেই বা কোনো স্বৈরাচারের দোসর সেখানে নেই। কোনো ব্যাংক লুটের টাকা সেখানে নেই। নির্মমভাবে পিটিয়ে সিলেটের মাজারে যে গরিব মানুষগুলোকে হত্যা করা হলো, তাদের বাড়িঘর পর্যন্ত নেই। চারদিন লাশ মর্গে পড়ে থাকল, তাদের দাফন করার কোনো লোক পর্যন্ত নেই। রাষ্ট্রশাসকদের চোখের সামনে এসব গরিব মানুষ হত্যা এবং উপর্যুপরি মাজারে হামলার পরেও তাদের গায়ে কোনো আঁচড় পড়ল না! আমাকে কেন বিশ্বাস করতে হবে রাষ্ট্র-সরকার ধর্মীয় বৈচিত্র্য রক্ষা করতে চায়? গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে? বহুত্ববাদে বিশ্বাস করে?
নারী খেলোয়াড়দের ওপর আক্রমণ এবং তাদের খেলা প্রতিরোধ করা হলো। বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায় পুলিশের সামনে আক্রমণ এবং বইয়ের স্টল বন্ধের ঘটনা আমাকে স্তম্ভিত করেছে। আমাকে কেন বিশ্বাস করতে হবে এক স্বৈরাচারকে জনতা উচ্ছেদ করার পর যে সরকার তৈরি হলো, তাদের ছায়াপথে আমাদের নিকষ অন্ধকার গর্তে ঢুকে যেতে হবে না? গায়ের জোর দেখালে আপনাকে ডবল স্বৈরাচার ডবল ফ্যাসিবাদ মনে করব না কেন? পাহাড়ে এবং সমতলে সর্বত্র সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ভাষার স্বাধীনতা নেই, ভূমির অধিকার নেই, জীবনের নিরাপত্তা নেই। কেন?
আগের স্বৈরাচারীরা ব্যাংক লুট করেছে, কারও বাড়িঘর লুটপাট করেনি। আজ তো বাড়িঘর লুটপাট চলছে। এটা মানব কেন? গাজীপুরের নেতা এবং সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অপরাধ দেখলে তাঁর নামে ৫০টি মামলা করতে পারে, তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারে, বিচার করে ফাঁসি দিতে পারে, কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু গভীর রাতে তাঁর বাড়ি লুট করতে পারে কি? তাঁর অপরাধের জন্য তাঁর পুত্র-পুত্রবধূর সঙ্গে প্রতিবেশীকে দায় দেওয়া, শাস্তি দেওয়া– কোন গণতন্ত্রে পড়ে? আবার সেখানে গণপ্রতিরোধের অপরাধে শত শত সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার করে সেই আগের সরকারের মতোই পুলিশি রাজত্ব, পুলিশের গ্রেপ্তার বাণিজ্য চালু মানা যায় কি?
আগের সরকার শ্রমিকরা পাওনা মজুরির জন্য আন্দোলন করলে তাকে বিদেশি চক্রান্ত বলে শ্রমিকদের গুলি করে হত্যা করেছে। এখনকার সরকারও হুবহু একই কাজ করছে। আজ পর্যন্ত বেতন দেয়নি বলে একজন মালিককেও কোথাও কোনো ধমক সরকার দিয়েছে বলে দেখিনি। অথচ এখনও মধ্যরাত পর্যন্ত শ্রমিকদের থানার পুলিশ, শিল্প পুলিশের যৌথ বাহিনী মোকাবিলা করতে হয়। তবুও কেন এই সরকারকেই সমর্থন করে যাব? শিক্ষকদের ওপর আগের সরকারও বর্বর কায়দায় জলকামান, রায়টকার ব্যবহার করত, এখনকার সরকারও তা-ই করছে। এই সরকার তৈরির প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের জন্য দ্রোহযাত্রা করেছি। আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে– গণতন্ত্র তুমি কোথায়? তুমি কেন প্রেস ক্লাবে আসো না? মত প্রকাশের স্বাধীনতা, তুমি কেন বইমেলায় আসো না?
বিধান জারি হলো, তারুণ্যকে ভালোবাসা দিবস উদযাপন করলে প্রতিহত করা হবে। বসন্ত বরণ করা যাবে না। ছেলেমেয়ে একসঙ্গে চলতে পারবে না। আমার চোখে আজও ভাসছে ৫ আগস্ট ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বিশাল মিছিল করে শেখ হাসিনার পতন ঘটাচ্ছে। সেদিন বনানীর ওভারব্রিজে যারা ছিল তারা সাক্ষ্য দেবে, যুবক-যুবতী, বোরকা পরা অনেক মেয়ে, জিনস প্যান্ট পরা অনেক মেয়ে ছেলেদের সঙ্গেই মিছিল করে শেখ হাসিনাকে নামিয়েছে। আজ কেন একসঙ্গে বসন্তবরণ কিংবা ভালোবাসা দিবস উদযাপন কিংবা এরশাদ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন দিবস পালন করতে পারবে না?
সরকারকে এসব বিষয়ে শুধু বক্তব্য স্পষ্ট নয়, দৃঢ় অবস্থান নিতেই হবে। নইলে আমরাও বলতে বাধ্য হবো– ‘এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার।’
জহিরুল ইসলাম: সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন