ইউক্রেন যুদ্ধের ৩ বছর: ‘ট্রাম্প একজন অপ্রত্যাশিত বিজয়ী’
Published: 23rd, February 2025 GMT
টোভ্যার শহরের ভেতর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় প্রথমেই আমি যা লক্ষ করলাম, সেটি হলো সেনাবাহিনী। সবখানেই তারা—বিলবোর্ডে, ভবনের পাশে, বাসস্টপেজে; ‘রাশিয়ার নায়ক’ লেখা বিভিন্ন প্রতিকৃতিতেও।
কালাশনিকভ রাইফেল হাতে সেনাদের পোস্টারে রাশিয়াকে ভালোবাসতে, দেশকে নিয়ে গর্ব করতে ও দেশকে রক্ষায় উৎসাহিত করা হয়েছে জনসাধারণকে। অন্য কথায়, সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে ও ইউক্রেনে গিয়ে যুদ্ধ করতে উৎসাহিত করা হয়েছে।
ক্রেমলিন শুরু থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধকে যুদ্ধ না বলে বিশেষ সামরিক অভিযান বলে আসছে। রাশিয়ার অনেক মানুষের কাছে এ যুদ্ধ এমন একটি ঘটনা, যা তাঁরা শুধু টেলিভিশনের পর্দাতেই দেখেছেন। কিন্তু অ্যানার মতো মানুষের কাছে এটি অনেক বেশি বাস্তব।২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেশী ইউক্রেনে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে রাশিয়া। যুদ্ধের তিন বছর পূর্তি আজ। তবে এত দিন পরও রাশিয়া নতুন করে সেনা নিয়োগের চেষ্টা করছে।
আপনি যদি টোভ্যারে থাকেন, তবে বুঝতে পারবেন, শহরের চারপাশে সামরিক দৃশ্যপট ফুটে ওঠা সত্ত্বেও মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক। শহরটি সম্মুখসারির যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কয়েক শ মাইল দূরে।
মিখাইল নামের স্থানীয় একজন শিক্ষক বিবিসিকে বলেন, ‘আপনি শুধু চারপাশে তাকান। পাশ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। দোকানপাট সব খোলা। কোনো গোলা এসে পড়ছে না। আমাদের মধ্যে নেই কোনো আতঙ্ক। সম্ভাব্য হামলার মুখে পড়া নিয়ে কোনো সাইরেনও শুনতে হচ্ছে না। ছুটতে হচ্ছে না কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে।’
ক্রেমলিন শুরু থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধকে ‘যুদ্ধ’ না বলে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ বলে আসছে। রাশিয়ার অনেক মানুষের কাছে এ যুদ্ধ এমন একটি ঘটনা, যা তাঁরা শুধু টেলিভিশনের পর্দাতেই দেখেছেন। কিন্তু অ্যানার মতো কারও কারও কাছে এটি অনেক বেশি বাস্তব।
আপনি শুধু চারপাশে তাকান। পাশ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। দোকানপাট সব খোলা। কোনো গোলা এসে পড়ছে না। আমাদের মধ্যে নেই কোনো আতঙ্ক। সম্ভাব্য হামলার মুখে পড়া নিয়ে কোনো সাইরেনও শুনতে হচ্ছে না। ছুটতে হচ্ছে না কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে।মিখাইল, রাশিয়ার নাগরিকবিবিসির প্রতিনিধির সঙ্গে রাস্তায় আলাপচারিতাকালে অ্যানা বলেন, ‘আমি এমন অনেক লোককে চিনি, যাঁরা যুদ্ধে গেছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আর বাড়ি ফেরেননি। আমি চাই (এ যুদ্ধ) যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ হোক।’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এমনটাই চান বলে দাবি করেছেন। ইউক্রেনকে আলোচনার টেবিলে না ডেকে ট্রাম্প প্রশাসন এরই মধ্যে রাশিয়ার নেতাদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও মস্কোর সঙ্গে তাঁর আলোচনা সম্পর্কে রুশদের মতামত কী—এ বিষয়ে অ্যানার মত, ‘(এ যুদ্ধে) ট্রাম্প একজন অপ্রত্যাশিত বিজয়ী। আমি জানি না তাঁর কাছ থেকে কী আশা করা উচিত।’
প্রসঙ্গত, রাশিয়ার সঙ্গে তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধে ইউক্রেনকে সাবেক প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রশাসনের দেওয়া শত শত কোটি ডলারের সহায়তা ফেরত চান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। গতকাল শনিবার ওয়াশিংটন ডিসির বাইরে নিজ দল রিপাবলিকান পার্টির সদস্যদের বার্ষিক জমায়েতে এ কথা সাফ জানিয়ে দেন তিনি।
দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছেন ট্রাম্প। এ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন তাঁর প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেও ফোনে কথা বলেছেন তিনি। তবে যুদ্ধ বন্ধের আলোচনায় ইউক্রেনকে যুক্ত করা হয়নি। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে নিয়ে কয়েক দফা আক্রমণাত্মক কথাও বলেছেন ট্রাম্প।
ইউক্রেনের জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলে ট্যাংক নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন রুশ সেনারা.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন য দ ধ
এছাড়াও পড়ুন:
জুনের মধ্যে সম্ভব স্থানীয় নির্বাচন
আগামী জুনের মধ্যে স্থানীয় সরকারের সব স্তরে নির্বাচন করা যেতে পারে বলে সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে ইউনিয়ন, উপজেলা এবং জেলা পরিষদের জন্য একটি এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের জন্য আরেকটি অধ্যাদেশ জারি করা যেতে পারে। প্রস্তাবিত ‘স্থানীয় সরকার কমিশন’ এপ্রিলে বিস্তারিত কাজ করলে জুনে ভোট সম্ভব।
গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সুপারিশ গতকাল শনিবার প্রকাশ করা হয়েছে। ড. তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অকার্যকর হয়ে পড়া স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কার্যকরে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশন নির্বাচন একসঙ্গে আয়োজনের সুপারিশ করেছে কমিশন। এতে নির্বাচন ব্যবস্থা সহজ এবং ব্যয়সাশ্রয়ী হবে।
কমিশন স্থানীয় সরকারে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে। মত দিয়েছে, নির্বাচন নির্দলীয় পদ্ধতিতে আয়োজনের। ইউনিয়ন পরিষদে জনসংখ্যার অনুপাতে ওয়ার্ড সংখ্যা ৯ থেকে ৩০ করার সুপারিশ করা হয়েছে। উপজেলা পরিষদে ওয়ার্ডের প্রস্তাব এসেছে। বিদ্যমান প্রতি ইউনিয়নকে তিনটি ওয়ার্ডে বিভক্ত করার কথা বলা হয়েছে। উপজেলায় ওয়ার্ড সংখ্যা হবে সর্বোচ্চ ৩৩। প্রতি উপজেলায় জেলা পরিষদের তিন থেকে পাঁচটি ওয়ার্ড থাকবে। পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনে ওয়ার্ড সংখ্যা হবে জনসংখ্যার অনুপাতে।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের দায়িত্ব সরকারের হাত থেকে নির্বাচন কমিশনে নিতে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনই নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করবে।
সুপারিশে বলা হয়েছে, স্থানীয় নির্বাচনের জন্য জাতীয় নির্বাচনের চেয়েও বেশি টাকা খরচ হয়। প্রতি পাঁচ বছরে অন্তত ২২৫ দিন থাকে নির্বাচনী সময়। এতে সারা বছরই রাজনৈতিক উত্তেজনা, অস্থিরতা থাকে। এতে সরকারের কাজ বিঘ্নিত হয়। তাই স্থানীয় নির্বাচন একই তপশিলে একই দিনে আয়োজনের সুপারিশ করা হয়েছে। ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পরিষদের ভোট একই সঙ্গে হবে। একজন ভোটার তিনটি পরিষদের সদস্যপদে তিনটি আলাদা ভোট দেবে। বর্তমানেও ভোটাররা স্থানীয় নির্বাচনে তিনটি ভোট দেন। একসঙ্গে নির্বাচন প্রতি পাঁচ বছরে মাত্র ৪৫ দিন থাকবে নির্বাচনী সময়। এতে সময় এবং ব্যয়সাশ্রয়ী হবে।
স্থানীয় পরিষদ বা কাউন্সিলে জাতীয় সংসদের আদলে স্পিকার থাকবেন। যিনি পরিচিত হবেন সভাধ্যক্ষ হিসেবে। প্রতি ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত সদস্য বা কাউন্সিলরা গোপন ভোটে চেয়ারম্যান বা মেয়র নির্বাচিত করবেন। চেয়ারম্যান বা মেয়ররা নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য থেকে তিন থেকে পাঁচজন নিয়ে নির্বাহী পরিষদ গঠন করবেন। এ পরিষদ মন্ত্রিসভার মতো কাজ করবে। বাকিরা একজন ছায়া নেতা নির্বাচিত করবেন। যিনি বিরোধীদলীয় নেতা হবেন।
সদস্যপদে প্রার্থী হতে মাধ্যমিক পাস হতে হবে। চেয়ারম্যান-মেয়রদের শিক্ষাগত যোগ্যতা হবে ন্যূনতম স্নাতক। সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সদস্য পদে নির্বাচন করতে পারবেন। তবে তারা চেয়ারম্যান-মেয়র হতে পারবেন না।
স্থানীয় সরকারের সংস্কারে গত ১৮ নভেম্বর আট সদস্যের স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের প্রতিবেদনে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে গ্রাম ও পৌর পুলিশ গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নতুন দুটি পুলিশ বাহিনী গঠিত হওয়ার পর কমিউনিটি পুলিশকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা হবে।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে সময়ের সঙ্গে আধুনিকায়নের জন্য পাঁচ সদস্যের স্থায়ী স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। স্থায়ী সংস্কার কমিশন সব সংস্কার কর্মের একটি ধারাবাহিকতা রক্ষায় সক্ষম হবে। এটি স্থানীয় পর্যায়ে আইনের শাসন ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা রক্ষার একটি নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারে।
প্রতিটি স্থানীয় সরকারের সংগঠন কাঠামো দুটি প্রধান অংশে বিভক্ত থাকবে। একটি হলো বিধানিক অংশ (লেজিসলেটিভ পার্ট), আরেকটি নির্বাহী অংশ (এক্সিকিউটিভ পার্ট)। বিধানিক অংশের প্রধান হবেন জনপ্রতিনিধিদের মধ্য থেকে নির্বাচিত সভাধ্যক্ষ ও নির্বাহী অংশের প্রধান হবেন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেয়র।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে উপজেলা চেয়ারম্যান ও সাধারণ আসনের ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত নারী আসনের ভিন্ন পদধারী তিনজন একই আকারের নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত হন। আবার জাতীয় সংসদ সদস্যের নির্বাচনী এলাকা প্রায় ক্ষেত্রে অভিন্ন। এই চার প্রতিনিধির মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাত তাই অনিবার্য।
নির্বাচিত জেলা পরিষদ গঠনের সুপারিশ করেছে কমিশন। ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলায় মোট ওয়ার্ডের এক-তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে তিন নির্বাচনের পর থাকবে না এই সংরক্ষণ। একইভাবে নির্বাহী পরিষদ এবং স্থায়ী কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ চেয়ারম্যান পদ নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
মেয়র বা চেয়ারম্যান পরিষদের সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে বিবেচিত হবেন। তারা বেতন সম্মানী পাবেন। প্রতিটি পরিষদ বছরের এপ্রিলে বার্ষিক বা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নিতে অধিবেশন করবে। পরিষদের সার্বিক কার্যক্রম ও উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় টাকার ৫০ শতাংশ সরকার অর্থায়ন করবে। বাকিটা নিজস্ব উৎস থেকে পরিষদকে সংগ্রহ করতে হবে। জেলা ও উপজেলা পরিষদের প্রধান দায়িত্ব হবে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন। পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব হবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের নাম বদল করে ‘স্থানীয় সরকার, জনসংগঠন ও জনপ্রকৌশল সেবা মন্ত্রণালয়’ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার জনসংগঠন অংশটি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সব এনজিওর কার্যক্রম তদারকি করবে। আর জনপ্রকৌশল ও সেবা বিভাগের অধীনে থাকে ওয়াসা, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সংস্থা। এই মন্ত্রণালয়ে একজন মন্ত্রী, একজন প্রতিমন্ত্রী ও একজন উপমন্ত্রী থাকতে পারবে।
দুই ভাগে একজন করে সিনিয়র সচিব, একজন করে অতিরিক্ত সচিব, ৪ জন করে যুগ্ম সচিব, ৮ জন করে উপসচিব, ৮ জন করে সিনিয়র সহকারী সচিব ও ৮ জন করে সহকারী সচিব থাকবেন। এলজিইডি ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে একীভূত করে এলজিইডির অধীনে থাকবে। সব উপজেলা পর্যায়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত স্থাপন করতে হবে। এ জন্য বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করেছে কমিশন। গ্রাম আদালত বিলুপ্ত করে বিকল্প হিসেবে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ওয়ার্ড ও কমিউনিটি পর্যায়ে একটি সালিশি ব্যবস্থা যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের বিচারকরা সম্পৃক্ত থাকবেন।