বেপরোয়া বালুখেকোদের থামাতেই হবে
Published: 23rd, February 2025 GMT
গত এক–দেড় দশকে দেশের নদ–নদীগুলোর ভয়াবহ পরিণতির অন্যতম কারণ হচ্ছে অবাধে ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। এ সময়ে বালুখেকোদের রাজনৈতিক দল–মত–নির্বিশেষে একটি চক্র গড়ে ওঠে। প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তারাও এর সঙ্গে যুক্ত। বালুখেকোদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের ফলে নদী ও পরিবেশের ক্ষতি ছাড়াও বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, হুমকির মুখে পড়ছে স্থানীয় জনপদ। যেমনটি দেখা যাচ্ছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলে। সেখানে বালু উত্তোলন নিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে। বিষয়টি সত্যিই উদ্বেগজনক।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, সীতাকুণ্ডের সমুদ্র উপকূলের ১০ কিলোমিটারের বেশি এলাকায় চলছে নির্বিচার বালু উত্তোলন। সাগরের মধ্যে ড্রেজার বসিয়ে বালু তুলে সাগর থেকেই সেসব বালু নৌযানে করে বিক্রি হচ্ছে। নির্বিচার বালু তোলার কারণে সীতাকুণ্ডের কুমিরার আলেকদিয়া থেকে শুরু করে দক্ষিণে চার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকিতে পড়েছে উপকূলের জনবসতি।
বালু উত্তোলনে আইন অনুযায়ী যেসব নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হয়, যেভাবে ড্রেজার ব্যবহার করতে হয়, তার কোনো কিছুই সেখানে মানা হচ্ছে না। এমনকি যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। কারখানা ও জাহাজভাঙা ইয়ার্ড সচল করার নামে বালু তোলা হলেও আদতে সেখানে বালুর ব্যবসা চলছে বলে অভিযোগ করেছেন উপকূলের বাসিন্দারা। বালু তোলা নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। সেখানে অবৈধভাবে বালু তুলতে বাধা দেওয়ায় এক জেলেকে পিটিয়ে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। চার দিন পর গত শুক্রবার তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
এখন বালুখেকোদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তরের তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না বলা যায়। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের দায়িত্বশীল কর্মকর্তার বক্তব্য, ‘বালু তোলার বিষয়টি সাধারণত এসি ল্যান্ড দেখবেন। আমরাও অভিযান করি। তবে সে ক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসনের সাহায্য নিতে হয়।’ অন্যদিকে সীতাকুণ্ড উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার বক্তব্য, ‘দুটি প্রতিষ্ঠান বন্দর থেকে বালু তোলার অনুমতি পেয়েছে বলে আমাকে জানিয়েছে। তবে সেগুলো সঠিক কি না, তা যাচাই করে দেখা হয়নি। বন্দর থেকেও কারা কারা বালু তোলার অনুমতি পেয়েছে, সে বিষয়ে কোনো চিঠির অনুলিপি আমাদের দেওয়া হয়নি। সে জন্য অভিযানও করা হয়নি।’
অবৈধভাবে বালু তোলার কারণে বিশাল এলাকার বেড়িবাঁধ ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে, এমনকি হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটে গেছে। এরপরও প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের বক্তব্য শুনলে মনে হচ্ছে তারা বিষয়টি নিয়ে অতটা চিন্তিত নয়। বিষয়টি একই সঙ্গে দুঃখজনক ও হতাশাজনক। বেপরোয়া বালুখেকোদের বিরুদ্ধে তারাই যদি ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে ভুক্তভোগীরা কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে? অতএব বালুখেকোদের থামাতেই হবে। এখন দেখার অপেক্ষা প্রশাসন কী ব্যবস্থা নেয়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ব শ ব যবস ব ষয়ট উপক ল
এছাড়াও পড়ুন:
আমলাতন্ত্রের দোরগোড়ায় আটকে যায় সব সংস্কার
বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে সবাই কমবেশি অবগত। অনেক আলোচনা হয়েছে। এমনকি তা নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একধরনের ঐকমত্যও আছে। কিন্তু শেষমেশ কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না।
দেশে নীতিপ্রণেতা, পরামর্শক ও বাস্তবায়নকারীদের মধ্যে একধরনের দূরত্ব আছে। এমনকি বিদ্যায়তনের মানুষের কথা রাজনীতিবিদেরা মেনে নিলেও কিছু হয় না। তাতে শেষমেশ দেখা যায়, আমলাতন্ত্রের দোরগোড়ায় গিয়ে সব সংস্কার আটকে যায়।
অর্থনীবিদ সেলিম জাহানের দুটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আজ বৃহস্পতিবার বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। বাঙলার পাঠশালা আয়োজিত এই অনুষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। বই দুটির মধ্যে জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে‘বাংলাদেশের অর্থনীতি: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ এবং মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ: কনটেমপোরারি ডেভেলপমেন্ট ইস্যুস’।
প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। সভাপতিত্ব করেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম। সঞ্চালনা করেন বাঙলার পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ জাভেদ। আর বক্তব্য দেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাসুদা ইয়াসমিন, সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন প্রমুখ।
রেহমান সোবহান বলেন,‘ দেশের সমস্যা কী এবং তার সমাধনই-ই বা কী, তা নিয়ে এক ধরনের ঐকমত্য আছে। আমরা জানি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে আরও বিনিয়োগ করা দরকার। কিন্তু শেষমেশ কোনোটি হয় না।’ কেন বারবার অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোনো সমাধানে পৌঁছানো যায় না, এখন তার ভেতরের গল্প তুলে ধরার আহ্বান জানান তিনি।
পৃথিবীর অনেক দেশে সহিংসতা ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে এবং তারপর তারা অনেকেই আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সেলিম জাহান বৈশ্বিক পরিসরে কাজ করেছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে রওনক জাহান আহ্বান জানান, তিনি যেন সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের প্রসঙ্গে লেখেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে আবার কার্যকর করা যায়, তা বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার আলোকে লেখার আহ্বান জানান।
সংস্কার প্রসঙ্গে সব সরকারই বিশেষজ্ঞদের কথা অগ্রাহ্য করেছে বলে অভিযোগ করেন মাহ্ফুজ আনাম। তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২৯টি টাস্কফোর্স গঠনে রেহমান সোবহান যুক্ত ছিলেন। টাস্কফোর্সগুলোর উদ্দেশ্য ছিল অর্থনীতি ও প্রশাসনপ্রক্রিয়ার নানা সমস্যার সমাধান করা। টাস্কফোর্সগুলোয় ছিলেন সেই সময়কার দেশের ২৫৫ জন সেরা পেশাদার ব্যক্তি। কিন্তু সেই টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন পরবর্তী অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সম্ভবত পড়েও দেখেননি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান চলমান সংস্কারের গতি-প্রকৃতি নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, সংস্কারের চাপ দেওয়ার জন্য সমাজে নানা রকম গোষ্ঠী আছে, বিষয়টি সে রকম নয়। বরং নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠী ছাড়া সমাজে আরও কেউ সংস্কার চায়, তেমনটা মনে হচ্ছে না।
সংস্কার প্রসঙ্গে বক্তারা বলেন, এ বিষয়ে বৃহত্তর ঐকমত্য দরকার, তা না হলে কোনো উদ্যোগই আলোর মুখ দেখবে না। এর আগে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আমলেও সংস্কার নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিছু কাজ সেই সরকার করেছিল; কিন্তু শেষমেশ তার কিছুই টেকেনি।
বই দুটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সেলিম জাহান বলেন, এগুলো গবেষণাধর্মী বই নয়। একদম সাধারণ মানুষ যেন পড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির হালচাল বুঝতে পারেন, সে উদ্দেশ্যে এই বই দুটি লেখা।
আলোচনায় প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন বলেন, বাংলোদেশের অর্থনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বইটি সাংবাদিকদের পড়া উচিত। উন্নয়ন ও অগ্রগতির মধ্যে কী ফারাক, তা বোঝার জন্য এই বই পড়া জরুরি।