সৌদি যুবরাজের গাজা নিয়ে বিকল্প পরিকল্পনার পেছনে কী
Published: 23rd, February 2025 GMT
গাজা সংঘাত নিয়ে সৌদি আরবের সম্পৃক্ততার ধরন ছিল ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ ধরনের। কিন্তু হঠাৎ করেই সৌদি আরব কূটনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়ার একটি অভিজ্ঞতার মুখে পড়েছে।
গাজাকে নিয়ে নেওয়ার ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার জন্য রিয়াদে মিসর, জর্ডান, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতারা মিলিত হয়েছিলেন।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে সৌদি আরব নিজেদের বৈশ্বিক সংঘাত, বৈরিতা মীমাংসার মধ্যস্ততাকারী দেশ হিসেবে দেখছে। ইউক্রেন সংঘাত মীমাংসার জন্য যে আলোচনা হতে যাচ্ছে, তার আয়োজক দেশ সৌদি আরব।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ট্রাম্পের ভয়ানক আপত্তিকর ‘রিভেরা পরিকল্পনায়’ ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। ট্রাম্প গাজা পুনর্গঠনের জন্য সেখানকার বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পাঠাতে চান।
মোহাম্মদ বিন সালমান আশা করেন, আরব নেতাদের সঙ্গে নিয়ে তিনি পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিকল্প একটি প্রস্তাব দিতে পারবেন। তিনি যে বিষয়টিতে জোর দিচ্ছেন সেটা হলো, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারে না।
স্বল্প মেয়াদে মোহাম্মদ বিন সালমান গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে মিসর, জর্ডান ও সৌদি আরবে পুনর্বাসন পরিকল্পনা ঠেকাতে সফল হতে পারেন। ফিলিস্তিনিরা যখন অস্থায়ী তাঁবুতে বাস করছেন। আরব নেতাদের সম্মেলন গাজা পুনর্গঠনের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ তহবিল জোগানের প্রতিশ্রুতি এসেছে।
কিন্তু সবচেয়ে জরুরি ও চ্যালেঞ্জিং বিষয়টি হলো, হামাসকে সরিয়ে গাজা শাসনের জন্য বিকল্প শক্তি খুঁজে বের করা। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান গাজার কয়েকটি ইসলামপন্থী সংগঠনের ঘোর শত্রু। কিন্তু হামাসের প্রতি তাঁর অবজ্ঞা অনেকটা গভীর।
এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনিকে যদি তাঁদের ভূখণ্ড ছেড়ে চলে যেতে হয়, তাহলে সৌদি আরবের সাধারণ নাগরিকেদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার ভয় পাচ্ছেন যুবরাজ। কেননা, তাতে আরব জনগণ বলতে পারেন, আরব রাজতন্ত্র ‘ফিলিস্তিনকে বিক্রি’ করে দিয়েছে। সৌদি আরবের জনগণ তাঁদের শাসকদের চেয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি বেশি সংহতি বোধ করেন।ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে তাঁর যে পরিকল্পনা ছিল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর, সেটা ভেস্তে যাওয়ার জন্য হামাস দায়ী বলে ভাবেন তিনি।
মোহাম্মদ বিন সালমান ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চান সৌদি আরবের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে। ইসরায়েলের কাছ থেকে প্রযুক্তি, সামরিক ও গোয়েন্দা সরঞ্জাম নিতে চায় সৌদি আরব। আরও ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্পর্কও গড়ে তুলতে চায় তারা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যুবরাজ মনে করেন, এতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের আরও ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে দুটি কারণে মোহাম্মদ বিন সালমানের বিকল্প পরিকল্পনা সফল হতে পারবে না। প্রথমত, বেনায়ামিন নেতানিয়াহু দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে তিনি মেনে নেবেন না। ইসরায়েল এখানে তাঁর প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
দ্বিতীয়ত, হামাসকে পুরোপুরি সাইডলাইনে সরিয়ে দেওয়ার বিকল্প পরিকল্পনা সফল হওয়ার সুযোগ খুবই কম। রাজনৈতিক সংগঠনগুলো গাজা পুনর্গঠনের বিনিময়ে গাজার শাসন ছেড়ে দিতে পারে, কিন্তু তারা তো হাওয়া হয়ে যাবে না। কেননা এবার ১৯৮২ সালের মতো কিছু ঘটবে না।
সে সময়ে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলি আগ্রাসনের পর ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থাকে (পিএলও) লেবানন থেকে তিউনেসিয়া যেতে হয়েছিল। এবারে কিন্তু হামাস নিজেদের ভূমিতে লড়াই করেছে।
এ ছাড়া পিএলও চলে যাওয়ার পর সাব্রা ও শাতিলা শরণার্থীশিবিরে লেবাননের খ্রিষ্টানরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। সেই দুঃসহ ঘটনা ফিলিস্তিনিদের স্মৃতিতে এখনো জীবন্ত রয়েছে। ১৫ মাসের গণহত্যা ও নির্মম নিষ্ঠুরতা সহ্য করার পর ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন আবাসভূমির স্বপ্নকে মুছে ফেলা হয়, এমন কোনো পরিকল্পনা হামাস মেনে নেবে না।
সৌদি আরবের বিকল্প প্রস্তাব বিশুদ্ধ রকমভাবে দেশটির স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত। সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি আরব দেশে যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে, তা প্রশমনের জন্যই এই বিকল্প প্রস্তাব।
ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হলে অনিবার্যভাবে হামাসের কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়বে। হামাসের যোদ্ধাদের এবং রাজনৈতিক ইসলামকে (প্রধানত মুসলিম ব্রাদারহুডের মতাদর্শ) এই দেশগুলো সুচিন্তিতভাবে ও সফলতার সঙ্গে দমন করে চলেছে। কোনো আরব শাসকই চান না, তাঁদের দেশে হামাস যোদ্ধা ও তাঁদের মনোভাবাপন্ন মানুষেরা তাঁদের দেশে বাস করুন।
মুসলিম ব্রাদারহুড মতাদর্শে ইসলামের বিধিবিধান অনুযায়ী শাসন ও একই সঙ্গে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়। অনেকটা ইসলামিক গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরা বৈশ্বিক এই আন্দোলন সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের তরুণদের মধ্যে আবেদন তৈরি করেছে। ইসলাম ও গণতন্ত্র নিয়ে তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা রয়েছে। এ কারণেই এটি রাজতান্ত্রিক শাসনের প্রতি সরাসরি হুমকি তৈরি করে।
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদারীকরণের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন। দুই ক্ষেত্রেই তাঁকে মুসলিম ব্রাদারহুডের মতাদর্শকে দমন করতে হবে। ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার যেকোনো পরিকল্পনা অবশ্যই রাজনৈতিক ইসলামের পুনর্জীবন ঘটাবে।
এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনিকে যদি তাঁদের ভূখণ্ড ছেড়ে চলে যেতে হয়, তাহলে সৌদি আরবের সাধারণ নাগরিকেদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার ভয় পাচ্ছেন যুবরাজ। কেননা, তাতে আরব জনগণ বলতে পারেন, আরব রাজতন্ত্র ‘ফিলিস্তিনকে বিক্রি’ করে দিয়েছে। সৌদি আরবের জনগণ তাঁদের শাসকদের চেয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি বেশি সংহতি বোধ করেন।
গাজার শাসনব্যবস্থা কী হবে, তা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান কিংবা আরব নেতারা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়ে গাজার ভাগ্যনির্ধারণে সফল হতে পারবে না।
অনেকগুলো আরব দেশ এরই মধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তি করেছে, কিন্তু তাদের কেউই শান্তি আনতে পারবে না। প্রকৃতপক্ষে, সাধারণ একটা কারণে বিপরীতটা ঘটছে। ফিলিস্তিনিদের সাইডলাইনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। একমাত্র ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের মধ্যে একটা চুক্তিই (যেখানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে) দীর্ঘস্থায়ী শান্তি আনতে পারে।
মাদাউই আল-রশিদ ব্রিটিশ একাডেমির একজন ফেলো এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের মিডল ইস্ট সেন্টারের ভিজিটিং অধ্যাপক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব কল প প র ব কল প আরব র স র জন য গঠন র ইসল ম হওয় র আরব ন
এছাড়াও পড়ুন:
আজ ঢাকায় আসছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দুই কর্মকর্তা
সংস্কার, মানবাধিকার, গণতন্ত্রসহ নানা বিষয়ে আলোচনা করতে আজ বুধবার ঢাকায় আসছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি নিকোল অ্যান চুলিক। এ ছাড়া মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে এদিন আসছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পূর্ব এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল বিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অ্যান্ড্রু আর হেরাপ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর এটাই তাঁর প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রথম বাংলাদেশ সফর। সফরে অ্যান্ড্রু আর হেরাপের সঙ্গে যোগ দেওয়ার কথা মিয়ানমারে ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সুসান স্টিভেনসনের।
মার্কিন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক চুলিক তাঁর চার দিনের সফরে বাংলাদেশে সংস্কার কার্যক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা এবং গণতান্ত্রিক পথে ফেরার বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। তিনি বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও বৈঠক করবেন। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ করার কথা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, নিকোল অ্যান চুলিক বর্তমানে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি হলেও, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি না থাকায় এ দপ্তরের দায়িত্ব তিনি পালন করছেন। সফরকালে তিনি সংস্কারে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে, সে চাহিদাগুলো জানতে চাইবেন। পাশাপাশি গণমাধ্যমগুলোতে জঙ্গিবাদের মাথাচাড়া দেওয়ার খবর আসায় বৈঠকে সন্ত্রাসবাদ এবং মানবাধিকার বিষয়ও আসতে পারে।
তিনি বলেন, ১/১১-এর সময় সংস্কারে জোর না দেওয়াটা এক প্রকার ভুল মনে করে মার্কিনিরা। সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাওয়ায় সহযোগী হিসেবে থাকতে চায় দেশটি।
এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পূর্ব এশিয়া বিষয়ে অভিজ্ঞ কূটনীতিক অ্যান্ড্রু আর হেরারের বৈঠকে মিয়ানমার পরিস্থিতি প্রাধান্য পাবে। সফরকালে তিনি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভসহ বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর বৈঠক করার কথা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। এটিকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল (আইপিএস) বাস্তবায়নে বাধা হিসেবে দেখছে। কারণ মিয়ানমারের কিছু এলাকা বাদে দেশটিতে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বর্তমানে মিয়ানমার মাদক চোরাচালান, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা, বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের অপহরণ করে আটকে রাখা, নারী ও শিশুসহ মানব পাচারের অন্যমত কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে রোহিঙ্গা পরিস্থিতিও রয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডে দেশটির সেনাবাহিনীসহ বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠনগুলো জড়িত। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের অপরাধীরা অপরাধমূলক কার্যক্রম মিয়ানমারের মাটিতে বসে চালাচ্ছে। তাই পুরো পরিস্থিতি আলোচনায় আসবে।