ডেভিল হান্টেও থামেনি ডাকাতি চুরি ছিনতাই
Published: 23rd, February 2025 GMT
বাবার মৃত্যুর পর হাল ধরেন আরমান হোসেন। তিন দশক ধরে মিরপুর ১০ নম্বরে পরিবারটি চালাচ্ছে ‘মা মণি জেনারেল স্টোর’। বৃহস্পতিবার ভোরে প্রাইভেটকারে এসে শাটার ভেঙে এটিসহ আশপাশের কয়েকটি দোকানের মালপত্র ও টাকা নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। দুর্ধর্ষ এ ঘটনার পর আরমানের ভাষ্য, পাশে বেনারসিপল্লি; গভীর রাত পর্যন্ত লোকে গমগম। এখানে এমন ঘটনা কল্পনাও করিনি। একই সময়ে তারা কয়েকটি বাসায় হানা দেয়। ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নই। মুদি দোকানের ওপর তিনটি পরিবার নির্ভরশীল। লুণ্ঠিত মালপত্র, টাকা হয়তো পাব না। তবে এমন ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি চাই না। মূলত পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় এসব হচ্ছে।
শুধু মিরপুর নয়, প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধীদের বহুমাত্রিক তৎপরতার খবর মিলছে। জড়িতরা এতটা বেপরোয়া যে প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম করছে। কিছুই তোয়াক্কা করছে না। আবার দিনদুপুরে বাসে উঠে যাত্রীদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ, টাকা কেড়ে নিচ্ছে। চলন্ত বাসে অস্ত্র দেখিয়ে করছে নারীর শ্লীলতাহানিও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান ‘ডেভিল হান্টের’ মধ্যেই বেপরোয়া অপরাধীরা। শুক্রবার রাতে ঝিনাইদহের শৈলকুপায় তিনজনকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যার পর দায় স্বীকার করেছে চরমপন্থি সংগঠন। বিভিন্ন অঞ্চলে এ ধরনের তৎপরতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে কিনা, আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, অভিযানের মধ্যেও অপরাধমূলক তৎপরতা ইঙ্গিত দেয় ততটা কার্যকরী অভিযান হচ্ছে না। অপরাধ প্রতিরোধে কাজ কম হচ্ছে। যদিও এ ধরনের ঘটনায় সাসপেন্ড, বদলির মতো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে দেখছি।
অপরাধ বিশ্লেষক ড.
জানতে চাইলে পুলিশ সদরদপ্তরের মুখপাত্র এআইজি ইনামুল হক সাগর বলেন, পুলিশের রাতের টহল জোরদার হয়েছে। কৌশলগত স্থানে রয়েছে চেকপোস্ট। অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে নানা কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অপারেশন্স) এস এন মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ দমনে আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। সামনে কিছু বিষয় দৃশ্যমান হবে। সব সংস্থা সমন্বিতভাবে অপারেশন চালাচ্ছে। ঢাকার মতো এত বড় শহরে তারপরও দু-চারটি ঘটনা ঘটতে পারে।
গতকাল শনিবার পুলিশ সদরদপ্তর জানায়, সারাদেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্টে’ গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৭৬৯ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। এ নিয়ে গত ১৪ দিনে মোট গ্রেপ্তার হলো ৮ হাজার ৭৯ জন। অন্যান্য মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে ৫৭২ জন।
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাই আন্দোলনের সময় বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে সব মিলিয়ে ৫ হাজার ৭৫০টি অস্ত্র লুট হয়। তার মধ্যে এখনও বেহাত ১ হাজার ৩৮৪টি। লুণ্ঠিত অনেক অস্ত্র পেশাদার অপরাধীদের হাতে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পুলিশের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত জানুয়ারিতে সারাদেশে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ২৯৪ জন। এ সময়ে ১৭১টি চুরি, ৭১ ডাকাতি, ১০৫ অপহরণ এবং নারী ও শিশু নিপীড়নের ঘটনা ঘটে ১ হাজার ৪৪০টি। গত বছর একই সময়ে হত্যার শিকার হন ২৩১ জন। ডাকাতি ২৯, চুরি ১৪১, অপহরণ ৪৩ এবং নারী ও শিশু নিপীড়নের ঘটনা ঘটে ১ হাজার ৪৩টি। গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় এবার চুরি, ডাকাতি, খুনাখুনি, অপহরণ ও নারী নিপীড়নের ঘটনা বেড়েছে। যদিও অপরাধ বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যান দিয়ে সমাজের প্রকৃত চিত্র বোঝানো কঠিন। কারণ, ঘটনার শিকার হয়ে অনেকে মামলা করতে চান না। আবার মামলা হলেও পুলিশ গড়িমসি করে।
পুলিশের দুই কর্মকর্তা সমকালকে জানান, বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে আরও কার্যকর সমন্বয় রেখে অভিযান পরিচালনার বিষয়ে কাজ চলছে। এরই অংশ হিসেবে রোববার পুলিশ-র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক ইউনিটের মধ্যে সমন্বয় সভা হওয়ার কথা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, একের পর এক অপরাধমূলক তৎপরতার তথ্য পাওয়া গেলেও পুলিশের কারও কারও মধ্যে রয়েছে আত্মতুষ্টির ছাপ। কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে সেটি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশি তৎপর হচ্ছে। ‘আলোচিত’ হওয়ার আগে ঘটনা ‘আমলে না নেওয়া’ বা ‘হালকা’ করে দেখার প্রবণতা রয়েছে অনেকের মধ্যে। এমনকি রাজধানীর অধিকাংশ থানায় নতুন মুখ হওয়ায় তারা এখনও এলাকাভিত্তিক অপরাধী এবং গোয়েন্দা তথ্য রাখার ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় যেতে পারেননি। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবারও অনেককে বড় অপরাধে জড়াতে দেখা যাচ্ছে।
মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে স্বামীর কাছে ফেরার পথে অটোরিকশা থেকে নামিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয় পোশাক কর্মীকে। শুক্রবার ওই নারী বাদী হয়ে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
সম্প্রতি ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী চলন্ত বাসে ডাকাতি ও দুই নারীকে শ্লীলতাহানির ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মালিবাগে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আবু রায়হান ইভান নামে শিক্ষার্থী আহত হন। এ সময় তার কাছে থাকা ৪৫ হাজার টাকা ও একটি দামি মোবাইল ফোন নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।
১৯ ফেব্রুয়ারি সকালে উত্তরায় ভিক্টর পরিবহনের একটি চলন্ত বাসে যাত্রীবেশী ৫-৬ যুবক অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনতাই করে। ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে এক নারী ও পুরুষকে রামদা দিয়ে কোপানোর ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
১৮ ফেব্রুয়ারি রামপুরার বনশ্রী এলাকায় কাঁচাবাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শ্রমিক দলের নেতা জুয়েলকে গুলি করে তারই দলের আরেক গ্রুপ। ১৩ ফেব্রুয়ারি ইস্কাটনের দিলু রোড এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন দুই রিকশাযাত্রী।
২০ জানুয়ারি বিকেলে পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের সিরামিক রোডের বঙ্গবন্ধু কলেজের পাশে নতুন রাস্তার মুখে চাপাতি, সুইচ চাকু, ইট দিয়ে থেঁতলে হত্যা করা হয় বাবু নামে একজনকে। ওই এলাকায় দীর্ঘদিন থেকে বাবু ও সন্ত্রাসী মুসার দ্বন্দ্ব চলছিল। তারই জেরে মুসার লোকজন ডেকে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে বাবুকে। অভিযুক্ত মুসা সাবেক এমপি আউয়ালের অনুসারী। অবিভক্ত মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যা মামলার অন্যতম আসামি মুসা। টিপু হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে ওমানে পালিয়ে যাওয়া মুসাকে ফিরিয়েও আনে ডিবি পুলিশ। তার জবানবন্দিও গ্রহণ করা হয়। সম্প্রতি সে ওই হত্যা মামলায় জামিনে বের হয়ে বাবুকে হত্যা করে।
গত ২০ সেপ্টেম্বর মাদক কারবার ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মোহাম্মদপুরে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। দুটি অপরাধী চক্রের সংঘর্ষে নাসির বিশ্বাস ও মুন্না হাওলাদার খুন হন। সংঘর্ষে জড়ানো অ্যালেক্স ইমন ও আরমানের অনুসারীরা চুরি-ছিনতাই, মাদক কারবারসহ নানা অপরাধে জড়িত। সম্প্রতি তারা জামিনে বেরিয়ে আবারও একই অপকর্মে জড়িয়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ছ নত ই ন র ঘটন অপর ধ দ এল ক য়
এছাড়াও পড়ুন:
২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট সময়কালে ফ্যাসিবাদী শক্তি নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে, এসবির প্রতিবেদন
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে কর্মসূচি পালনকালে ফ্যাসিবাদী শক্তি অনলাইন-অফলাইনে প্রচারণা চালিয়ে সারা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)।
গতকাল সোমবার এসবির এক প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনটি পুলিশের সব বিভাগকে পাঠিয়ে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছে এসবি। এসবির একটি সূত্র প্রথম আলোকে এই প্রতিবেদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঐতিহাসিক জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ফ্যাসিবাদবিরোধী সামাজিক সংগঠনগুলো ১ জুলাই থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। এই ধারাবাহিকতায় ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত কর্মসূচি পালনের সময়কাল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে কর্মসূচি পালনকে কেন্দ্র করে বিতাড়িত ফ্যাসিবাদী শক্তি অনলাইন-অফলাইনে প্রচারণা চালিয়ে দেশব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টি, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির কর্মসূচিতে বাধা প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপচেষ্টা চালাতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাসহ সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তি ও জানমাল রক্ষায় পুলিশের বিভিন্ন বিভাগকে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছে এসবি।
নির্দেশনাগুলো হলো ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা। ৮ আগস্ট পর্যন্ত নিয়মিত সন্দেহজনক ব্যক্তিসহ মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস ও অন্যান্য যানবাহন তল্লাশি করা। বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশন ও বিমানবন্দরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল অভিযান পরিচালনা করা। মোবাইল প্যাট্রোল জোরদার করা। গুজব রোধে সাইবার পেট্রোলিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখাসহ গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা।
এ ছাড়া কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকলে তা তাৎক্ষণিকভাবে এসবিকে অবহিত করার কথাও বলা হয়েছে।