সংস্কার ও নির্বাচন দুটোই হতে হবে
Published: 23rd, February 2025 GMT
এখন কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন চায়, সংস্কার চায় না। তাদের মনে রাখা উচিত, জুলাই গণঅভ্যুত্থান কেবল ক্ষমতার পালাবদলের জন্য হয়নি। এই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা হলো সংস্কার এবং নির্বাচন দুটিই হতে হবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে রাজনৈতিক দলগুলো কেবল ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে নিজেদের স্বার্থে রাজনীতি করেছে। জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। এ ধারার আমূল পরিবর্তন করতে হবে।
রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে গতকাল শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি’ শীর্ষক একটি অধিবেশনে এসব কথা বলেন বক্তারা। গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহানের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইজিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড.
আলোচনায় অংশ নিয়ে সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর কাজের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনার কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে প্রধানমন্ত্রীর স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার যথেষ্ট সুযোগ আছে। সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহি নিশ্চিতের প্রবিধান সংযুক্ত করা হবে।
আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করে তোলার ওপর। বিগত সরকারের সময়ে দেশের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চরমভাবে দুর্বল করে ফেলা হয়, যা প্রধানমন্ত্রীকে কর্তৃত্ববাদী হওয়ার পথ প্রশস্ত করে। ভবিষ্যতে যাতে এমন ধারার পুনরাবৃত্তি না হয়, সেজন্য সংবিধানে বিশেষ অনুচ্ছেদ যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আলী রীয়াজ আরও বলেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থাকে কেউ কেউ ‘বিপ্লব’ বলেন। আদতে এটা বিপ্লব ছিল না। বিপ্লব হলে বিভিন্ন কমিশন গঠন করার দরকার হতো না। তিনি উল্লেখ করেন, সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাব দিয়েছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করবে তারা কতটুকু গ্রহণ করবে।
সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, অতীতের ক্ষমতার চর্চা ছিল অর্থের ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য। আদর্শের চর্চার প্রভাব খুব একটা ছিল না। জাতীয় সংসদের প্রধান থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পর্যন্ত সবাইকে এ ধারায় চলতে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগ চলে গেলেও সেই টাকার প্রভাবের শূন্যতা পূরণ হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, দাবি আদায় করতে লোক জড়ো করা এবং সহিংসতা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজতে হবে।
অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, সবাই সংস্কার চান। তবে কী সংস্কার চান, তা সুস্পষ্ট করা উচিত। সংস্কার কেবল আইনের পরিবর্তনের মধ্যে আটকে থাকলে হবে না। আইন অনেক আছে। সমস্যা রাজনৈতিক চর্চার। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অনেকগুলো সংস্কারের জন্য কাজ করছে। এরই মধ্যে অনেক সংস্কার প্রস্তাবও এসেছে। তবে সংস্কার প্রস্তাবের অনেকগুলো আইন পরিবর্তনের জন্য। সত্যিকার অর্থে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাইলে জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল ভূমিকা রাখতে হবে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক চর্চার পরিবর্তনের জন্য অন্তর্বর্তী নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সরকার ব্যবস্থাকেও রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে ক্ষমতা ধরে রাখার চর্চাও দেখা গেছে। প্রতিবছর সম্পদের হিসাব প্রকাশ করবে– ‘দিন বদলের’ কথা বলে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি। কীভাবে মানুষ এটা বিশ্বাস করবে, রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসছে, সেই প্রতিশ্রুতি রাখবে।
সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, বিগত সরকারের সময়ও অনেক কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ওই কথা শোনার বা শুনে তা আমলে নিয়ে কাজ করা হয়নি। সংবিধান সংশোধনের কথা হচ্ছে। এটা করতে হলে তা কীভাবে যুগোপযোগী হয়, তা নিয়ে ভাবতে হবে।
৫৩ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন হয়নি এবং এ কারণে নব্বই বা চব্বিশে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে বলে মত দেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গভীরে বৈষম্য রয়ে গেছে। মানুষ শান্তি চায়, ভয়ের পরিবেশে বাঁচতে চায় না। তারা চায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের কথা শোনা হোক। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে জবাবদিহি করার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে জনগণের মতকে প্রতিষ্ঠা করার পথে এগোনো সহজ হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক ড. আসিফ শাহান বলেন, অর্গানাইজেশন এবং ইনস্টিটিউশনের মধ্যকার পার্থক্য করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে কঠোরভাবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সহআহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, অতীতের সরকার ব্যবস্থায় মানুষের কথা শোনার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, তারা সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি।
তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে সুষ্ঠু নির্বাচনই ছিল মানুষের প্রধান আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষের আকাঙ্ক্ষা কেবল নির্বাচনে আটকে নেই। অতীতের সরকার ব্যবস্থাগুলোতে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ মানুষের ভোট নিয়ে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন পেয়েছিল এবং তারা সংবিধান বদলের অধিকার পেয়ে ইচ্ছামতো পরিবর্তন করেছে। নতুন বাংলাদেশের মানুষ এর বদল চান। কেবল ক্ষমতার পালাবদল করে দিতে এ গণঅভ্যুত্থান হয়নি।
বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের দাবি বিষয়ে সারোয়ার তুষার বলেন, তারা হয়তো সংস্কার চায় না। তিনি উল্লেখ করেন, জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এখন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নামে আছে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা। এর বদল করতে হবে।
বক্তারা আরও বলেন, নিজেদের পক্ষে কথা বলার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রতিনিধি পাঠানোর পর যদি জনগণ দেখেন তাদের পক্ষে ওই প্রতিনিধি কথা বলছেন না, তাহলে তাকে ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থাও থাকা উচিত। রাজনৈতিকগুলো গণতন্ত্রের কথা বললেও নিজেরা গণতন্ত্রের চর্চা করে না। মুখে জনগণই সব ক্ষমতা উৎস– এমনটা বললেও সংসদে নিজ দলের বিরুদ্ধেই কথা বলতে পারে না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: য় সরক র ব যবস থ গণঅভ য ত থ ন ন বল ন ন র জন র জন য ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
গণঅভ্যুত্থানের ভাষা
বছরঘুরে আরও একবার মহান একুশে ফেব্রুয়ারি এসে হাজির। তবে এবারের দিবসটি গত বছরগুলোর তুলনায় মৌলিকভাবে আলাদা। এবার মুক্ত ও স্বাধীন পরিবেশে ফ্যাসিবাদ-উত্তর বাংলাদেশে উদযাপিত হবে এ দিবস। বাংলাদেশের ইতিহাস এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে; অন্তত ৭০ বছরের মুক্তির সংগ্রামের পরিণতির অপেক্ষায় গোটা জনগোষ্ঠী। এমন এক যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিকতার পাশাপাশি আন্দোলনের ভাব ও ভাষার তাৎপর্য অনুসন্ধান করার জরুরতও অস্বীকার করা যায় না।
প্রতাপশালী ইতিহাসে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক বয়ানে চাপা পড়ে এর প্রকৃত গুরুত্ব ও অঙ্গীকার। অন্তত দুটি বিষয় ভুলে গেলে চলে না–
প্রথমত, আইন যদি ইনসাফ কায়েমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সেই আইন আর আইন থাকে না, ওই আইন খোদ বে-আইনে পরিণত হয়। তখন ওই আইনের বিরোধিতা করাই ন্যায্য। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা জারি ছিল, কিন্তু ইনসাফ ও অধিকারের স্বার্থে তা ভাঙতে হয়েছিল। গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের যে আইনি কাঠামো, তা ঔপনিবেশিক ও গণবিরোধী। এই আইনি কাঠামো ন্যূনতম ইনসাফ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই আইনি কাঠামো এবং সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে জনগণের পক্ষে আনতে হবে। এ জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং আইন-কানুনের সংস্কার অনিবার্য। সংস্কার না করলে আইনের দ্বারা সৃষ্ট জুলুমের কাঠামো বলবৎ থাকবে। এটাই একুশ ও চব্বিশের শিক্ষা।
দ্বিতীয়ত, উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে চাকরি-বাকরিতে বাঙালির
অধিকার হরণ করা হয়েছিল। এ জন্যই আন্দোলনটি ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করার দাবি। চব্বিশের বাংলাদেশে অন্যায্য কোটা প্রথার মাধ্যমে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সরকারি চাকরিতে অধিকার বন্ধ করা হয়েছিল। কাজেই একুশ ও চব্বিশ মূলত বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র করার ঐতিহাসিক ডাক।
পাকিস্তান ছিল পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠীর আন্দোলনের ফসল। অথচ যে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হলো তা কোনোভাবেই পাঞ্জাবিদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার মাধ্যমে মূলত বাঙালি জনগোষ্ঠীকে স্থায়ী দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে রাখার পাঁয়তারা করা হয়েছিল। সঙ্গত কারণেই এ অঞ্চলের ছাত্রসমাজ তা মেনে নেয়নি।
গ্রিক সমাজতাত্ত্বিক নিকোজ পুলান্তাজ মনে করেন, রাষ্ট্র হচ্ছে শ্রেণি সংগ্রামের ময়দান। রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে প্রতিযোগিতা, দ্বন্দ্ব, এমনকি সংঘাতও সৃষ্টি হতে পারে। যে সকল শ্রেণি ঐতিহাসিকভাবে দমিত ও বঞ্চিত, তারা ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে আন্দোলন সংগ্রামের পথ বেছে নিতে পারে। শ্রেণিগত উত্তরণের বন্দোবস্ত না থাকলে সামষ্টিক লড়াই প্রতিরোধই একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়ায়।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানকে বাংলাদেশের বৃহত্তর ঐতিহাসিক পটভূমিতে বিচার করতে হবে। এ অভ্যুত্থানের ভাব ও ভাষার মাধ্যমে গণঅভিপ্রায়ের অভিনব প্রকাশ ঘটেছে। স্লোগান থেকে শুরু করে দেয়ালের গ্রাফিতি সর্বত্র জনগণ কী চায় আর কী চায় না, তা পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত হয়েছে। জনগণের এই ঐতিহাসিক অভিপ্রায়কে লিখিত রূপ দেওয়ার কর্তব্য অন্তর্বর্তী সরকার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, রাজনৈতিক দলগুলোসহ নাগরিক সমাজের।
ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর মতে, ক্ষমতা সর্বত্র। একইভাবে প্রতিরোধও সর্বত্র। ঢাকাসহ সারাদেশের দেয়ালগুলো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ভাষিক প্রতিরোধের অনন্য নজির হয়ে আছে। বিপ্লবের প্রথম খুন নাকি বেরোয় ভাষা থেকে। বাংলাদেশের দেয়ালগুলোর সরবতা সেই কথার পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। এমনকি আন্দোলনের অভিনব সব স্লোগান ফ্যাসিবাদের দাম্ভিকতাকে ধসিয়ে দিয়েছিল। ঢাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের মেয়েদের মুখে শোনা গেছে এমন স্লোগান– ‘পা চাটলে সঙ্গী, না চাটলে জঙ্গি।’ তোষামোদকারী মোসাহেবের দুনিয়া বেশ সরল। তোষামোদ তাদের ফ্যাসিবাদী ও গণহত্যাকারী হাসিনার আস্থাভাজন করেছিল। বিরোধিতাকারী ও সমালোচনাকারী মাত্রই জঙ্গি তকমা পেতে হয়েছে। এ মারণঘাতী রাজনীতির অসারতা ফুটে ওঠে শিক্ষার্থীদের উল্লিখিত স্লোগানে। ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা দেশটা কারও বাপের না’– এমন স্লোগান দেশের মালিকানা জনগণের বলে দাবি করে।
দেশ গঠনের নানা উদ্দীপনামূলক বার্তা দেয়াললিখনে জায়গা করে নিয়েছে। আইনের শাসন, দুর্নীতি ও পাচারমুক্ত অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, ধর্ম পালনের অধিকার, ব্যক্তির মর্যাদা, সামাজিক সহিষ্ণুতার বাসনা ফুটে উঠেছে গ্রাফিতিগুলোয়। গ্রাফিতিগুলো খেয়াল করলে চব্বিশের তারুণ্যের রাষ্ট্রপ্রকল্পের হদিস পেতে একেবারেই বেগ পেতে হয় না।
অনেকেই এই তরুণ প্রজন্মকে ভেবেছেন রাজনীতিবিমুখ। তবে তারা কেউই এই তরুণদের রাজনৈতিকতা উপলব্ধি করাবার প্রয়োজন মনে করেননি। ‘আই হেইট পলিটিকস’ বলার মধ্য দিয়ে তারা মূলত প্রচলিত হানাহানি ও লুটপাটের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যদিকে, আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে এক নতুন রাজনৈতিকতা হাজির করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলনে সাড়া না দিয়ে চাকরিতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মতো জীবনঘনিষ্ঠ ইস্যুতে আন্দোলন করেছে। সেই আন্দোলন নিশ্চিত করেছে শেষতক হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পতন।
শুধু গ্রাফিতি ও স্লোগানই নয়, এমনকি কর্মসূচির নামের অভিনবত্ব এই গণঅভ্যুত্থানকে অর্ধেক সফলতা এনে দিয়েছে। বাংলা ব্লকেড ও কমপ্লিট শাটডাউনের কথাই ধরা যাক। হরতাল, অবরোধ, অসহযোগ ও ধর্মঘটের মতো প্রচলিত শব্দগুলোর বাইরে এসে আন্দোলনের নেতৃত্ব ইংরেজি শব্দের কার্যকর প্রয়োগ ঘটিয়ে ‘জেন-জি’ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে এবারের আন্দোলনের এক গুরুতর তফাৎ ঘটিয়েছে আন্দোলনের ব্যানার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নাম গ্রহণ করার ফলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এ আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পেরেছে।
এমনকি এবারের অভ্যুত্থানের দফা অতীতের যে কোনো আন্দোলন-অভ্যুত্থানের তুলনায় স্বতন্ত্র ও সুদূরপ্রসারী। ফ্যাসিবাদের পতন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত– এক দফার ভেতর তিন উপ-দফা থাকার কারণে আন্দোলনকারী ছাত্রসমাজ বলতে পারছে তাদের রাজনীতি শেষ হয় নাই। ৫ আগস্ট-পরবর্তী যে কোনো ছাত্র জমায়েতের অবধারিত স্লোগান এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক: আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ। অর্থাৎ যে কারণে এতগুলো জীবন দিতে হয়েছে, সেই কারণ, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা, এখনও বিদ্যমান। ছাত্রদের রাজনৈতিক সক্রিয়তাও তাই চলমান।
মূলত গণঅভ্যুত্থানের কারণ ও কর্তব্য সবই পাওয়া যাচ্ছে গ্রাফিতি, স্লোগান, কর্মসূচি ও দাবি-দাওয়ায়। এসব দিক থেকে চব্বিশের অভ্যুত্থান বেশ পরিণত। আন্দোলনের নেতৃত্ব সফলভাবে জনগণের ঐতিহাসিক বঞ্চনাকে তুলে ধরতে পেরেছেন। ‘বাংলাদেশ ২.০’ এখন বাস্তবতা। স্বাধীনতা এসেছে, এখন সংস্কারও আসতে হবে– তরুণদের প্রত্যাশা এমন। রাজনৈতিক দলগুলোর সংকীর্ণ দলীয় চাওয়ার বাইরে জনগণের ঐতিহাসিক দাবি-দাওয়া প্রকাশিত হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের ভাষায়।
জনগণ চায় বিচার ও সংস্কার। রাজনৈতিক দলগুলো চায় নির্বাচন। সংস্কার ও নির্বাচনকে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করানো অনুচিত। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গোড়ায় একটি শক্তিশালী ভিত তৈরি করতে হলে সংস্কার অনিবার্য। নির্বাচন সংস্কারের ফলাফল তথা সংস্কার শেষে নির্বাচনী গণতন্ত্রে আমাদের ফিরে যেতে হবেই। কিন্তু স্রেফ নির্বাচনের জন্য এত প্রাণ ঝরেনি। জনগণের অভিপ্রায় সারাদেশের দেয়ালে দেয়ালে লিখিত রয়েছে। সবখানে একই সুর– দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করতে হবে। অবশ্যই এ সংস্কার অনন্তকাল ধরে চলবে না। কিন্তু একটা যৌক্তিক সময় এ সরকারকে দিতে হবে। নির্বাচনের জন্য অতিরিক্ত চাপ দিতে গিয়ে সংস্কার প্রকল্প ভেস্তে যেন না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। সরকারকে মনে রাখতে হবে ব্যর্থ হওয়ার কোনো অধিকার তাদের নাই। সংস্কার শেষে একটি শক্তিশালী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন দিয়ে নতুন সরকারকে দায়িত্ব গ্রহণের পথ এ সরকার করে দেবে, আমরা সেই প্রত্যাশা করি। অনাগত বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে তরুণরা নেতৃত্ব দেবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ করা চলে না।
গণঅভ্যুত্থানের ভাষায় গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের আকুতি উঠে এসেছে। এমন এক রাষ্ট্র যেখানে বিনা ভোটে কেউ ক্ষমতায় যেতে পারবে না, মৌলিক অধিকার হরণ করতে সক্ষম এমন কোনো আইন করা যাবে না, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো হবে জনবান্ধব।
লেখক
যুগ্ম আহ্বায়ক
জাতীয় নাগরিক কমিটি