সংস্কার ও নির্বাচন দুটোই হতে হবে
Published: 23rd, February 2025 GMT
এখন কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন চায়, সংস্কার চায় না। তাদের মনে রাখা উচিত, জুলাই গণঅভ্যুত্থান কেবল ক্ষমতার পালাবদলের জন্য হয়নি। এই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা হলো সংস্কার এবং নির্বাচন দুটিই হতে হবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে রাজনৈতিক দলগুলো কেবল ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে নিজেদের স্বার্থে রাজনীতি করেছে। জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। এ ধারার আমূল পরিবর্তন করতে হবে।
রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে গতকাল শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি’ শীর্ষক একটি অধিবেশনে এসব কথা বলেন বক্তারা। গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহানের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইজিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড.
আলোচনায় অংশ নিয়ে সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর কাজের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনার কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে প্রধানমন্ত্রীর স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার যথেষ্ট সুযোগ আছে। সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহি নিশ্চিতের প্রবিধান সংযুক্ত করা হবে।
আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করে তোলার ওপর। বিগত সরকারের সময়ে দেশের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চরমভাবে দুর্বল করে ফেলা হয়, যা প্রধানমন্ত্রীকে কর্তৃত্ববাদী হওয়ার পথ প্রশস্ত করে। ভবিষ্যতে যাতে এমন ধারার পুনরাবৃত্তি না হয়, সেজন্য সংবিধানে বিশেষ অনুচ্ছেদ যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আলী রীয়াজ আরও বলেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থাকে কেউ কেউ ‘বিপ্লব’ বলেন। আদতে এটা বিপ্লব ছিল না। বিপ্লব হলে বিভিন্ন কমিশন গঠন করার দরকার হতো না। তিনি উল্লেখ করেন, সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাব দিয়েছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করবে তারা কতটুকু গ্রহণ করবে।
সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, অতীতের ক্ষমতার চর্চা ছিল অর্থের ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য। আদর্শের চর্চার প্রভাব খুব একটা ছিল না। জাতীয় সংসদের প্রধান থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পর্যন্ত সবাইকে এ ধারায় চলতে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগ চলে গেলেও সেই টাকার প্রভাবের শূন্যতা পূরণ হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, দাবি আদায় করতে লোক জড়ো করা এবং সহিংসতা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজতে হবে।
অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, সবাই সংস্কার চান। তবে কী সংস্কার চান, তা সুস্পষ্ট করা উচিত। সংস্কার কেবল আইনের পরিবর্তনের মধ্যে আটকে থাকলে হবে না। আইন অনেক আছে। সমস্যা রাজনৈতিক চর্চার। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অনেকগুলো সংস্কারের জন্য কাজ করছে। এরই মধ্যে অনেক সংস্কার প্রস্তাবও এসেছে। তবে সংস্কার প্রস্তাবের অনেকগুলো আইন পরিবর্তনের জন্য। সত্যিকার অর্থে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাইলে জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল ভূমিকা রাখতে হবে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক চর্চার পরিবর্তনের জন্য অন্তর্বর্তী নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সরকার ব্যবস্থাকেও রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে ক্ষমতা ধরে রাখার চর্চাও দেখা গেছে। প্রতিবছর সম্পদের হিসাব প্রকাশ করবে– ‘দিন বদলের’ কথা বলে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি। কীভাবে মানুষ এটা বিশ্বাস করবে, রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসছে, সেই প্রতিশ্রুতি রাখবে।
সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, বিগত সরকারের সময়ও অনেক কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ওই কথা শোনার বা শুনে তা আমলে নিয়ে কাজ করা হয়নি। সংবিধান সংশোধনের কথা হচ্ছে। এটা করতে হলে তা কীভাবে যুগোপযোগী হয়, তা নিয়ে ভাবতে হবে।
৫৩ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন হয়নি এবং এ কারণে নব্বই বা চব্বিশে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে বলে মত দেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গভীরে বৈষম্য রয়ে গেছে। মানুষ শান্তি চায়, ভয়ের পরিবেশে বাঁচতে চায় না। তারা চায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের কথা শোনা হোক। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে জবাবদিহি করার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে জনগণের মতকে প্রতিষ্ঠা করার পথে এগোনো সহজ হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক ড. আসিফ শাহান বলেন, অর্গানাইজেশন এবং ইনস্টিটিউশনের মধ্যকার পার্থক্য করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে কঠোরভাবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সহআহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, অতীতের সরকার ব্যবস্থায় মানুষের কথা শোনার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, তারা সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি।
তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে সুষ্ঠু নির্বাচনই ছিল মানুষের প্রধান আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষের আকাঙ্ক্ষা কেবল নির্বাচনে আটকে নেই। অতীতের সরকার ব্যবস্থাগুলোতে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ মানুষের ভোট নিয়ে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন পেয়েছিল এবং তারা সংবিধান বদলের অধিকার পেয়ে ইচ্ছামতো পরিবর্তন করেছে। নতুন বাংলাদেশের মানুষ এর বদল চান। কেবল ক্ষমতার পালাবদল করে দিতে এ গণঅভ্যুত্থান হয়নি।
বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের দাবি বিষয়ে সারোয়ার তুষার বলেন, তারা হয়তো সংস্কার চায় না। তিনি উল্লেখ করেন, জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এখন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নামে আছে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা। এর বদল করতে হবে।
বক্তারা আরও বলেন, নিজেদের পক্ষে কথা বলার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রতিনিধি পাঠানোর পর যদি জনগণ দেখেন তাদের পক্ষে ওই প্রতিনিধি কথা বলছেন না, তাহলে তাকে ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থাও থাকা উচিত। রাজনৈতিকগুলো গণতন্ত্রের কথা বললেও নিজেরা গণতন্ত্রের চর্চা করে না। মুখে জনগণই সব ক্ষমতা উৎস– এমনটা বললেও সংসদে নিজ দলের বিরুদ্ধেই কথা বলতে পারে না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: য় সরক র ব যবস থ গণঅভ য ত থ ন ন বল ন ন র জন র জন য ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে অস্পষ্টতা কতটা কাটল
ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন, নাকি আগামী বছর জুনের মধ্যে– এ নিয়ে সংশয় আছে এখনও। তা সত্ত্বেও প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে এ সময়সীমার বাইরে ক্ষমতায় না থাকার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত হওয়া স্বস্তির। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের সঙ্গে বৈঠকে তিনি ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজনের আগে সংস্কার কাজ দ্রুত সম্পন্নের তাগিদ দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অবশ্য নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ঘিরে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে দেখা গেল, তিনি আগের ঘোষণাতেই অটল। অর্থাৎ ‘কম সংস্কার’ হলে ডিসেম্বর; ‘অধিকতর সংস্কার’ হলে আগামী বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং ভুল স্বীকার করলেও তার সমালোচনা হয়েছে। কারণ নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে তিনি সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলবেন, এমন দাবি এখন আরও জোরালো। মাঝে কোনো কোনো সাক্ষাৎকার ও সভায় ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন করার ব্যাপারে সরকারের আন্তরিক ইচ্ছার কথা তিনি জানিয়েছিলেন। এ অবস্থায় প্রেস উইংয়ের প্রথম বিজ্ঞপ্তিতে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়টি সামনে আসায় লোকে ‘নতুন কিছু’ পেয়েছে বলে ধরে নিয়েছিল। সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে স্বভাবতই হতাশ হয় তারা। প্রশ্ন ওঠে, প্রধান উপদেষ্টা কি নিজে তাঁর বক্তব্য বদলেছেন, নাকি অন্য কিছু ঘটেছে?
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বসে প্রধান উপদেষ্টা আগামী বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন করার লক্ষ্যে কাজকর্ম গুছিয়ে নেওয়ার কথা বললেও সেটা গুরুত্ববহ। কেননা, এর মধ্যে ফেসবুক থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়াজ উঠেছে– রোডম্যাপের বাইরেও অন্তর্বর্তী সরকারের থাকা প্রয়োজন। তার সপক্ষে হচ্ছে তত্ত্বায়ন। এর মধ্যে রয়েছে গণঅভ্যুত্থানের সরকারকে নির্বাচিত সরকারের চাইতেও মর্যাদাসম্পন্ন করে দেখানো। উপদেষ্টাদেরও কেউ কেউ বিভিন্ন উপলক্ষে এমনভাবে কথাবার্তা বলছেন; তাতে মনে হচ্ছে, দুইয়ের যোগসূত্র রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আশা করা হচ্ছিল, প্রধান উপদেষ্টা নিজে স্পষ্ট করে কিছু বলবেন। সে কারণে তাঁর এ বক্তব্যও গুরুত্বপূর্ণ– আগের ঘোষণামতোই আগামী জুনের পর সরকারটি আর থাকছে না।
গণঅভ্যুত্থানের পর যে পরিস্থিতিতে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সেটা ছিল তাঁর দিক থেকে সাহসী পদক্ষেপ। যাদের কথায় তিনি এমন দায়িত্ব গ্রহণে রাজি হন, তারাও সুবিবেচনার পরিচয় দিয়েছিলেন। তবে ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। এতে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-তরুণদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বিতর্ক বেড়েছে ক্রমে। সরকারে থেকে তাদের রাজনৈতিক দল গঠন হয়েছে বিশেষভাবে বিতর্কিত। এই ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার কিছু বক্তব্যেও বেড়েছে সমালোচনা। তদুপরি উপদেষ্টা পরিষদের ‘পারফরম্যান্স’ নিয়ে সন্তুষ্টি বেশি নেই। আট মাস পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়নি। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার না হওয়ার কথা স্বীকার করা হচ্ছে সরকারিভাবেই। সামনে রয়েছে গ্রহণযোগ্য বাজেট প্রণয়নের চ্যালেঞ্জ। আগামী বছর জুন পর্যন্ত থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারকেই এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। তার তো বিচার আর সংস্কারের এজেন্ডাও রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে হতাহতদের পরিবারকে প্রয়োজনীয় সহায়তা জোগানোও চ্যালেঞ্জিং।
ভারতের বক্তব্য না হয় আলাদাভাবে বিবেচ্য। এর বাইরে যারা আমাদের ‘উন্নয়ন সহযোগী’ বলে পরিচিত, তারাও কি যথাসম্ভব দ্রুত গণতন্ত্রে উত্তরণের তাগাদা দিচ্ছে না? দেশে যে বিনিয়োগ সম্মেলন হয়ে গেল, সেখান থেকে প্রাপ্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নেও কি সুনির্দিষ্ট মেয়াদের সরকার থাকা জরুরি নয়? দৃঢ়ভাবে জনপ্রশাসন পরিচালনায়ও নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকে নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীকে কার্যত পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। থেমে থেমে এখনও চলছে ‘মব ভায়োলেন্স’। বিনিয়োগ সম্মেলন চলাকালে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠানে যেসব হামলা হয়েছে, সেটাও দেশের ভাবমূর্তির জন্য নেতিবাচক। এতদিন পরও কেন সরকার এসব বন্ধ করতে পারছে না– তার সদুত্তর নেই। এ অবস্থায় ভালো হতো ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হলে। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন সরকারের সুস্পষ্ট ঘোষণা। যতদূর জানা যায়, নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা ধরে নিয়েই কাজকর্ম গোছাচ্ছে। সরকারের দিক থেকে তেমন ‘ইঙ্গিত’ তারা পেয়েছে বলেই অনেকের ধারণা। এমনও হতে পারে, তারা যে কোনো পরিস্থিতিতে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি রাখতে চায়। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনের কাজেও কিছু সংস্কারের প্রশ্ন রয়েছে। ন্যূনতম যেটুকু সবাই চাইছে, তা হলো নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। আগামীতে নির্বাচন যেন কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে জন্যই এটা চাওয়া। দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছিল বলেই অপশাসন ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল– এটা কার না জানা! গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হাতবদল হতে থাকলেও দেশ গণঅভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতিতে উপনীত হতো– এমনটা কেউ বলছেন না। সে কারণেই ‘জরুরি সংস্কার’ সেরে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনেই সরকারকে মনোনিবেশ করতে হবে। কোনো সংস্কার করতে না পারলেও তাকে কেউ দায়ী করবে না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করেও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে না পারলে ইউনূস সরকার হয়ে থাকবে প্রশ্নবিদ্ধ। দেশও অধিকতর সংকটে নিপতিত হবে।
অধ্যাপক ইউনূস ও তাঁর সহকর্মীদের এসব মনে করিয়ে দেওয়ার অবশ্য কিছু নেই। তারা দেশের সম্মানিত ও যোগ্য নাগরিক। বিদেশ থেকেও এক দল বাছাইকৃত মানুষ এসে এই ক্রান্তিকালে ইউনূস সাহেবের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা নিয়ে কম মানুষের মনেই সন্দেহ আছে। নজিরবিহীন জটিল পরিস্থিতিতে এ টিমের কাছে প্রত্যাশাও সীমিত। এ অবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত প্রত্যাশা তৈরি করে ব্যর্থ হওয়া কারও জন্য ভালো হবে না। দেশের জন্য সেটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়েরও আগে রাজনৈতিক সংলাপ সেরে সংস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে দ্রুত এর বাস্তবায়নই কাম্য। ‘প্রয়োজনীয় সব সংস্কার’ কোনো সরকারের আমলেই করা সম্ভবপর হবে না। এ নিয়ে বিতর্কও চলতে থাকবে। সব সংস্কার টেকসই হবে, এমনও নয়। মানসম্মত বিধিবিধানের দেশেও কিন্তু সুশাসন আর গণতন্ত্রের অবনমন হচ্ছে। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারকে দিয়ে প্রত্যাশিত সবকিছু করিয়ে নিয়ে চিরদিনের জন্য নিরাপদ থাকার সুযোগ কার্যত অনুপস্থিত। রাজনৈতিক দলগুলোকেই বরং বেশি দায়বদ্ধ করা দরকার রাষ্ট্র সংস্কারে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায় হলো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে এর অনুকূল পরিবেশ করে দেওয়া। নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার এ ক্ষেত্রে তাই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক।
নির্বাচিত সরকার সংস্কারের কিছুই করবে না– এমন আশঙ্কা কি রয়েছে, নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানের পরও? যদি থাকে তাহলে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার করে গেলেও তারা সেগুলো অক্ষত রাখবে না। তাই এসব অহেতুক প্রশ্ন না তুলে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষেই অবস্থান নিতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার উচিত তাঁর সহকর্মী ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে নির্বাচনের সময়সীমা চূড়ান্ত করে ফেলা। এর মধ্যে বিচার ও সংস্কার কার্যক্রম যেটুকু এগিয়ে নেওয়া যায়, সেটাও দৃঢ়তার সঙ্গে করা। এ অবস্থান নিতে পারলে তার প্রভাব পড়বে গোটা শাসন পরিস্থিতিতে। অস্বস্তি কাটবে সংশ্লিষ্ট সব মহলে। অর্থনীতি আর আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও আসবে
কাঙ্ক্ষিত গতি।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক