কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে গত দুই দিন ছিল অন্যরকম আমেজ। বসন্তের মৃদু হাওয়ার দোলায় এমনিতেই মন উতলা হয়, এর মধ্যে শুক্র ও শনিবার সেই অনুভূতি আরও বাড়িয়ে দেয় ‘বিচ ফেস্টিভ্যাল’। চাকমা, মারমা, ম্রো, বাঙালিসহ ২১টি জাতিগোষ্ঠী এই উৎসবে অংশ নেয়। সেখানে একুশের গান এবং দেশের গান থেকে শুরু করে ‘মারমা পাখা নৃত্য’, ‘বম জীবনধারা নৃত্য’সহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও মহান শহীদ দিবস উপলক্ষে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। সৈকতের লাবণী পয়েন্টে জেলা প্রশাসনের উন্মুক্ত মঞ্চে শুক্র ও শনিবার ‘বিচ ফেস্টিভ্যাল’ হয়। এ উৎসবকে ঘিরে পর্যটকদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২১টি জাতিগোষ্ঠীর পরিবেশিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরাই ‘বিচ ফেস্টিভ্যাল’-এর মূল লক্ষ্য। উৎসবে অংশ নেয় চাকমা, মারমা, ম্রো, ত্রিপুরা, লুসাই, খুমি, বম, খেয়াং, চাক, পাংখোয়া, তঞ্চঙ্গ্যা, মণিপুরি, সাঁওতাল, মাহালী, ওরাওঁ, মালপাহাড়িয়া, গারো, হাজং, কোচ, রাখাইন সম্প্রদায়ের শিল্পীরা। এ ছাড়া কক্সবাজার জেলা শিল্পকলা একাডেমি, উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি এবং স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনের বাঙালি শিল্পীরাও উৎসবে যোগ দেন।
শুক্রবার রাতে অনুষ্ঠানের শুরুতে বিভিন্ন ভাষায় ‘একুশের গান’ পরিবেশন করেন শিল্পীরা। সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হয় ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ গানটি। এরপর ‘মারমা পাখা নৃত্য’, ‘বম জীবনধারা নৃত্য’ এবং ‘সংগীত’ পরিবেশন করা হয়। এ ছাড়া ‘খুমি মাছ ধরা নৃত্য’, ‘ময়ূর নৃত্য’, ‘চাকমা গান’, ‘তঞ্চঙ্গা নৃত্য’, ‘ম্রো জুম নৃত্য’, ‘ত্রিপুরা গান’ ‘চাকমা প্রদীপ নৃত্য’, ‘লুসাই বাঁশ নৃত্য’, ‘সংগীত ও সম্প্রীতি নৃত্য পরিবেশিত হয়। ‘দেশাত্মবোধক গান’ (মাহালী সাঁওতালি পাহাড়িয়া) পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সমতলের শিল্পীদের পরিবেশনা শুরু হয়। তার পর ‘দাসাই নৃত্য’ (সাঁওতালি), ‘পাহাড়িয়া নৃত্য’ এবং ‘কমেডি’ পরিবেশন করা হয়।
এ ছাড়া শিল্পীরা পরিবেশন করেন ‘ওরাওঁ নৃত্য’ ও ‘মাহালী নৃত্য’। সবশেষে ‘মণিপুরি মৃদঙ্গ নৃত্য’ ও ‘মণিপুরি রাস নৃত্য’। একইভাবে বান্দরবান জেলার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিল্পীদের নৃত্য ও গানের মধ্য দিয়ে শনিবার রাতে শেষ হয় দুই দিনের ‘বিচ ফেস্টিভ্যাল’। শুক্রবার কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ড.

সৈয়দ জামিল আহমেদ। 
তিনি বলেন, শিল্পকলা একাডেমি জনগণের মাঝে জনবান্ধব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করতে চায়। সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে আসা ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার ফাহমিদা আকতার বলেন, কক্সবাজার সৈকতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে এ রকম একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে এবারের ভ্রমণ সার্থক হয়েছে। 
জেলা প্রশাসক বলেন, কক্সবাজার সৈকতে ২১টি জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে ‘বিচ ফেস্টিভ্যাল’ পর্যটকদের ভিন্নভাবে বিনোদন দিয়েছে। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন শ ল পকল পর ব শ এক ড ম

এছাড়াও পড়ুন:

উৎসবের অর্থনীতি

দুটি বড় উৎসবের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা। এর একটি মুসলমানদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। দ্বিতীয়টি, বাঙালির সর্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ। অর্থনীতির বিবেচনায় দুটি উৎসবই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ এ ধরনের উৎসবকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, যা সাধারণভাবে উৎসবের অর্থনীতি নামে পরিচিত।

উৎসব আমাদের অর্থনীতির বড় একটা চালিকা শক্তি। অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ, সেবা খাতের চাহিদা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয় নানা উৎসবের সঙ্গে যুক্ত। তাই উৎসবের পরিধি, এর আমেজ, উৎসব ঘিরে আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস যত বেশি থাকে, অর্থনীতিতে তত বেশি গতির সঞ্চার হয়। আয়রোজগার বাড়ে কৃষক, শ্রমিক এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের। তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে এমন সব পণ্যের চাহিদা তৈরি হয়, যা বৃহৎ শিল্প খাতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

নানা কারণে এবার উৎসবের অর্থনীতির জন্য ছিল বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। মব ভায়োলেন্স, ছিনতাই ও ডাকাতি বৃদ্ধি; মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া; রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ছিল আশঙ্কা। এসব কারণে যদি উৎসবের অর্থনীতি ধাক্কা খায়, তাহলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক, ক্ষুদ্র–মাঝারি ব্যবসায়ীসহ জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এর ভুক্তভোগী হবে। তাঁদের আয়রোজগার কমে যাবে, কমবে ক্রয়ক্ষমতা। তাঁদের মধ্যে পণ্য ও সেবার চাহিদা হ্রাস পাবে, যা বৃহৎ শিল্পকেও প্রভাবিত করবে।

উৎসবের অর্থনীতি আসলে কী

উৎসবের অর্থনীতির গুরুত্ব ও এবারের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলোচনা করার এই অর্থনীতির ধরন নিয়ে আরেকটু আলোকপাত করা যেতে পারে। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান অনুসারে, উৎসব হচ্ছে আনন্দ অনুষ্ঠান, যা অনেকটা ধুমধাম বা জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদ্‌যাপন করা হয়। এসব অনুষ্ঠান বা আনন্দ-আয়োজনে জনগোষ্ঠীর বড় অংশ সম্পৃক্ত থাকে।

উৎসবকে আড়ম্বরের সঙ্গে উদ্‌যাপনের উদ্দেশ্যে তাঁরা নানা পণ্য ও সেবা কিনে কিনে থাকেন; নিজ নিজ সামর্থ্য অনুসারে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করেন। উৎসব সামনে রেখে উপহার বিতরণ করাও আমাদের সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতির অংশ।

উৎসব সামনে রেখে সাধারণত যেসব পণ্য বেশি বেচাকেনা হয় সেগুলোর মধ্যে পোশাক, জুতা, ব্যাগ, প্রসাধনসহ নানা ব্যবহার্য জিনিস যেমন আছে; তেমনই আছে ফ্রিজ, টিভি, কম্পিউটার, মুঠোফোনসহ নানা ইলেকট্রনিক ডিভাইস। খাদ্যপণ্যের মধ্যে আছে মিষ্টি, পিঠা, সেমাই, নুডলস, চটপটি, ফলমূল ইত্যাদি। পিঠা-সেমাই, নুডলস-চটপটি ইত্যাদি তৈরি জন্য আবার প্রয়োজন হয় তেল, চিনি, গুড়, মসলা, নারকেল, লেবু, শসাসহ অসংখ্য শিল্প ও কৃষিপণ্য। উৎসবে এমন শত শত পণ্যের চাহিদা বাড়ে। তাতে স্থানীয় উৎপাদন, পণ্য আমদানি, পাইকারি ও খুচরা বিক্রি ইত্যাদি খাতে বিপুল অর্থ লেনদেন হয়।

উৎসবকে কেন্দ্র করে মানুষের চলাচলও অনেক বেড়ে যায়। তাতে ব্যবহার বাড়ে বিমান, বাস, ট্রেন, লঞ্চ, মাইক্রোবাস, রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা বা ইজিবাইকসহ নানা বাহনের। কেনাকাটার মূল্য পরিশোধ, সেবা মাশুল, স্বজনদের কাছে অর্থ পাঠানো ইত্যাদির জন্য ব্যাংক, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, কার্ড ইত্যাদির ব্যবহারও আগের চেয়ে বাড়ে।

সব মিলিয়ে উৎসব কেন্দ্র করে শিল্পপণ্য, কৃষিপণ্য, আমদানি করা পণ্য ও সেবা খাতে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। বাড়তি চাহিদার কারণে পণ্যের জোগানও বাড়ে, যা স্থানীয় উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। পণ্য আমদানি, উৎপাদন ও বিক্রি থেকে সরকার বাড়তি রাজস্ব পেয়ে থাকে। উৎসবের মহাকর্মযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত অর্থনীতির অংশকে উৎসবের অর্থনীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বাংলাদেশের প্রধান উৎসব

বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশ হচ্ছে বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ। দেশের প্রধান উৎসবগুলোর মধ্যে রয়েছে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, শবে বরাত, দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, বড়দিন, বৌদ্ধপূর্ণিমা; স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস; পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ, চৈত্রসংক্রান্তি, বসন্ত উৎসব, হেমন্ত উৎসব, পৌষপার্বণ।

এসবের বাইরেও রয়েছে, বাউল উৎসব, লালন উৎসব, ওরস, নানা ধরনের নাগরিক ও গ্রামীণ মেলাসহ আরও অনেক কিছু।

উৎসবের অর্থনীতির নানা দিক ও গুরুত্ব

উৎসব কেন্দ্র করে কী পরিমাণ বাড়তি পণ্য ও সেবা বিক্রি হয়, তার নির্ভরযোগ্য কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে আকারে এটি যে অনেক বড়, তা নিয়ে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। ব্যবসায়ীদের ধারণা, পোশাকশিল্পের বার্ষিক বিক্রির প্রায় ৬০ শতাংশ হয় দুই ঈদকে কেন্দ্র করে। পূজার সময়ে বিক্রি হয় ১৫-২০ শতাংশ পণ্য। প্রায় ২০ শতাংশই হয় পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে।

সারা বছরে মিষ্টি বিক্রির চার ভাগের এক ভাগ হয় হালখাতা অনুষ্ঠান ও বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে। খ্রিষ্টীয় নববর্ষ এবং ঈদের মতো উৎসবেও মিষ্টিজাতীয় পণ্যের বিক্রি কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

গত এক দশকে করপোরেট, তথা বড় ব্যবসা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উৎসবকেন্দ্রিক উপহার বিতরণের প্রচলন অনেক বেড়েছে।

কৃষি, শিল্প, আমদানি, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, সেবা খাত, কর্মসংস্থান, সরকারের রাজস্ব আহরণ—সবকিছুতেই উৎসব ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

স্থানীয় শিল্পের বিকাশ

উৎসবে পোশাক, জুতা, গয়না, প্রসাধনী, ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এই চাহিদা পূরণে উদ্যোক্তা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক ব্যস্ততায় দিন কাটায়। পোশাকের কথাই ধরা যাক। দেশে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পোশাকের একটি বড় অংশের জোগান দিয়ে থাকে রাজধানীর পুরান ঢাকা, কেরানীগঞ্জ, কালীগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত কারখানাগুলো। ঈদুল ফিতরের তিন–চার মাস আগে থেকে এসব কারখানায় প্রায় ২৪ ঘণ্টা উৎপাদন চলে। পুরান ঢাকার বংশাল, সিদ্দিকবাজারসহ সংলগ্ন এলাকার ছোট ছোট কারখানায় জুতা ও ব্যাগ তৈরির বিশাল কর্মযজ্ঞ চলে। কারখানার মালিক ও শ্রমিকেরা যেন নাওয়া-খাওয়া ভুলে যান। একই অবস্থা বিরাজ করে দেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানায়; সেটি হতে পারে কুটিরশিল্প বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। এ সময় তেল, চিনি, আটা, ময়দা, সেমাই, নুডলসসহ নানা ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যস্ততাও বেড়ে যায়।

খুচরা ও পাইকারি ব্যবসার প্রসার

উৎসবের সময়ে পোশাক, জুতা, গয়না, ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। শহরের বড় শপিং মল থেকে শুরু করে গ্রামীণ জনপদের ছোট্ট দোকান পর্যন্ত ক্রেতার ভিড়ে জমজমাট হয়ে ওঠে। এমনকি মুদিদোকানের বিক্রিও কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের বিস্তার

দিন দিন দেশে ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের বিস্তার ঘটছে। সময়ের অভাব, যানজটের ধকল এড়ানো, যাতায়াত ব্যয় সাশ্রয়সহ নানা কারণে ক্রেতা-ভোক্তাদের মধ্যে ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। উৎসবের সময়ে এসব প্ল্যাটফর্মে পণ্য ও সেবা বিক্রি অনেক বাড়ে, যা এই খাতের বিকাশ ও বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।

পরিবহন ও ভ্রমণশিল্পের বিকাশ

উৎসবের সময়ে মানুষের চলাচল বাড়ে। এদের একটি বড় অংশ পরিবার ও স্বজনের সঙ্গে মিলিত হতে শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে শহরে যায়। একটি অংশ আবার উৎসবকালীন ছুটিকে আরও আনন্দময় করে তুলতে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। এতে পরিবহন ও ভ্রমণ খাতে সেবার চাহিদা বাড়ে।

কর্মসংস্থানে ভূমিকা

উৎসব কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের ছোট-বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল রাখায় এসব খাত বিপুল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের কর্মসংস্থানের প্রায় ৬০ শতাংশই এসএমই, তথা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ওপর নির্ভরশীল। এসব শিল্প আবার অনেকাংশে উৎসবের ওপর ভর করে টিকে থাকে।
বিপুল বেকারের দেশে অসংখ্য তরুণ-তরুণী ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। পাশাপাশি সেখানে কিছু কর্মসংস্থানও তৈরি হচ্ছে। উৎসবে এসব প্ল্যাটফর্মে বিক্রি বাড়ে।

উৎসবে কৃষক, অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক, যেমন রিকশাচালক, ভ্যানচালক, নৌকার মাঝি, মুটে, ডেলিভারিম্যান প্রমুখেরও কাজ এবং আয়রোজগার বাড়ে।

মাটির হাঁড়ি-পাতিল, বাঁশ-বেতের সামগ্রীসহ অনেক পণ্য আছে; সারা বছর যেগুলোর বেচাবিক্রি একেবারে নগণ্য; উৎসবে সেগুলোর বিক্রি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এই খাতের সঙ্গে যুক্ত পেশা বর্তমানে উৎসবের ওপর ভর করেই যেন টিকে আছে।

এ ছাড়া উৎসবকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের অস্থায়ী কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি হয়।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে রক্তসঞ্চালন

উৎসব নানাভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে রক্তসঞ্চালন করে থাকে। ঈদ, পূজা, বিভিন্ন ধরনের মেলা ও পার্বণকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ উৎপাদকদের পণ্য বিক্রি বাড়ে। অন্যদিকে ঈদ ও পূজা সামনে রেখে শহরে ও প্রবাসে থাকা ব্যক্তিরা স্বজনদের কাছে বাড়তি টাকা পাঠান, যাতে তাঁরা উৎসবের ব্যয় নির্বাহ করতে পারেন। তাতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অর্থের প্রবাহ বাড়ে, বাড়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। এ ছাড়া উৎসবের ছুটিতে লাখ লাখ মানুষ নাড়ির টানে গ্রামে ছুটে যান। তাঁরা গ্রামের বাজার থেকে পরিবারের জন্য নানা ধরনের পণ্য কেনেন। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যান।

বিভিন্ন উৎসব বিনোদনশিল্পসহ আরও অসংখ্য খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এমনকি টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের মতো শিল্প খাতেও অবদান রাখে। নানা উৎসবে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে, যা গণমাধ্যমের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।

উৎসবের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জসমূহ

অর্থনীতিতে সব সময়ই নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকে। এবার বেশ কিছু নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়েছে, যা অর্থনীতি, বিশেষ করে উৎসবের অর্থনীতির জন্য হুমকি তৈরি করে।

মব–সন্ত্রাস

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে মব–সন্ত্রাস বড় আতঙ্ক হয়ে দেখা দেয়। নানা অজুহাতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলে পড়ছে অসংখ্য ব্যক্তি। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, কারখানা—এমনকি মাজার পর্যন্ত তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ব্যক্তিস্বার্থ ও লুটতরাজের সুযোগের জন্যও অনেক সময় মব তৈরি করা হচ্ছে।

মবের হুমকিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় লালন উৎসব, বাউল উৎসব, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনসহ বেশ কিছু অনুষ্ঠান ভণ্ডুল হয়ে গেছে। একুশে বইমেলার মতো জাতীয় আয়োজনে পর্যন্ত এর নেতিবাচক প্রভাব ছিল। দেশে অসংখ্য মাজারে ওরস সামনে রেখে কয়েক দিনব্যাপী মেলা হয়ে থাকে। এসব মেলায় নানা ধরনের হস্তশিল্প, খাদ্যপণ্য, কৃষিপণ্য, চুড়ি, ফিতা, প্রসাধনী—এমনকি মাছ পর্যন্ত বিক্রি হয়। থাকে নাগরদোলা, চরকি, বানরের নাচ, সাপখেলার মতো নানা অনুষঙ্গ।

সরকারের নানামুখী চেষ্টায় কয়েক দিনে মব–সন্ত্রাসের ঘটনা অনেকটা কমে এলেও জনমনে আতঙ্ক দূর হয়নি। এ আতঙ্ক পুরোপুরি কাটানো না গেলে আগামী দিনে অনেক উৎসব বাতিল হয়ে যেতে পারে। বাতিল না হলেও কমে যেতে পারে সেগুলোর কলেবর, কমতে পারে মানুষের অংশগ্রহণ।

ছিনতাইয়ের প্রকোপ

প্রতিবছরই উৎসবের সময়ে ছিনতাইকারীসহ অপরাধীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। কিন্তু গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে গণছিনতাইয়ে যে মহড়া হয়েছে, তা অতীতে দেখা যায়নি। বেশ কিছু ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ছিনতাইয়ের ভয়ে সন্ধ্যার পর মানুষের চলাচল অনেকটা কমে গেছে। ঈদবাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

মহাসড়কে ডাকাতি

অল্প সময়ের ব্যবধানে দেশের বিভিন্ন মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও গ্রামীণসংযোগ সড়কে অসংখ্য ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ডাকাতের হাতে বেশ কিছু যাত্রী মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় নাইটকোচগুলোতে যাত্রী অনেক কমে গেছে। সড়কে ডাকাতি কঠোরভাবে দমন এবং মানুষের আস্থা না ফেরানো গেলে এবার উৎসবকেন্দ্রিক চলাচল অনেক সীমিত হয়ে যেতে পারে। তাতে গ্রামীণ অর্থনীতি, পরিবহন ও ভ্রমণ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রান্তিক মানুষ।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব

দীর্ঘদিন ধরে দেশে উচ্চমূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। যদিও গত মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। দীর্ঘ ১০ মাস পর খাদ্যমূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের নিচে এবং চার মাস পর গড় মূল্যস্ফীতি একক অঙ্কে নেমেছে। তবু এখনো তা অসহনীয়। দীর্ঘদিন ধরে চলমান উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। এ কারণে অনেকের পক্ষে উৎসবগুলোতেও আগের মতো কেনাকাটা করা সম্ভব হবে না।

অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। উৎসবের অর্থনীতি ধনী-গরিব, শহর ও গ্রাম—এসবের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য কমাতে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখে। তাই বৈষম্যবিরোধী চেতনার ধারক অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য উৎসবের অর্থনীতিকে সচল রাখতে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া অনেক বেশি জরুরি।

তবে আমরা দেখেছি, এবারের পবিত্র রমজান মাস ও ঈদুল ফিতরকে ঘিরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ স্বস্তিদায়ক ঈদযাত্রার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যা ফলপ্রসূ হয়েছে। এসব পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে উৎসবের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পড়বে।

জিয়াউর রহমান সাংবাদিক ও বিশ্লেষক। সম্পাদক, অর্থসূচক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দেশে দেশে ঈদ
  • উৎসবের অর্থনীতি
  • পর্যটক বরণে নতুন সাজে কক্সবাজার
  • ১ টাকায় ঈদের নতুন পোশাক
  • ঈদে পর্যটক বরণে প্রস্তুত কুয়াকাটা, নেই কাঙ্খিত অগ্রিম বুকিং
  • রাজধানীতে ‘মেহেন্দি বাই মিমি’ আয়োজিত ‘ঈদ মেহেদী ফেস্ট’  
  • ঈদ আনন্দের কুশীলব
  • ঈদ উৎসবে ছেলেদের ফেসিয়াল
  • এমন মানুষ জন্মেছিলেন বলে আমরা যেকোনো দুঃসময়ে দাঁড়িয়েও স্বপ্ন দেখতে পারি
  • ব্র্যাকে খণ্ডকালীন চাকরি, বেতনের সঙ্গে উৎসব বোনাস, স্বাস্থ্যবিমাসহ নানা সুবিধা