স্বামী, শাশুড়ি ও তিন সন্তান নিয়ে সংসার ছিল জ্যোৎস্না অধিকারীর (৩৫)। আধাপাকা বাড়ি, বড় পুকুর, সবজির ক্ষেত– সব মিলে সুখের সংসারই। স্বপ্ন ছিল তিন সন্তানকে প্রতিষ্ঠা করার। কিন্তু তাঁর সব স্বপ্নই এখন ফিকে।
স্বামী অশোক অধিকারী দ্বিতীয় বিয়ে করে পালিয়েছেন। বিয়ের আগে বসতভিটা ও ফসলি জমির কিছু অংশ বিক্রি করেছেন তিনি। কিন্তু নতুন ক্রেতাদের দখলে চলে গেছে সব সম্পদ। এ অবস্থায় ছোট তিন সন্তান নিয়ে এক প্রতিবেশীর বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছেন জ্যোৎস্না অধিকারী। শাশুড়ির রাত কাটে আরেক প্রতিবেশীর গোয়ালঘরে। 
খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের শেখ-সরদারপাড়া গ্রামে এ পরিবারের বসবাস। গত ৬ আগস্ট বসতভিটে থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে তাদের। এরপর কিছুদিন এখানে সেখানে ঘুরেছেন। পরে গ্রামের একটি মুসলিম পরিবারে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। 
জ্যোৎস্না অধিকারী বলেন, ‘স্বামীর ভুল সিদ্ধান্তে আমাগের কপাল পুড়েছে। ভিটেবাড়িতে আশ্রয় নিতি পারলি অন্তত গতর খাটিয়ে তিন সন্তানকে মানুষ করতি পারতাম। কী দুর্ভাগ্য, এখন অন্যের বারান্দায় আশ্রয় নিতি হয়েছে। খাব কী, থাকব কোথায়? ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’ 
জ্যোৎস্না অধিকারীর অভিযোগ, তাঁর স্বামী নিজের নামের জমি বিক্রি করলেও তাঁর শাশুড়ির অংশ রয়ে গেছে। সে হিসাবে বসতভিটেতে থাকার অধিকার ছিল তাদের। গায়ের জোরে তাদের ভিটেছাড়া করা হয়েছে। 
জ্যোৎস্না যখন তাঁর শাশুড়ি মায়া অধিকারী ও তিন সন্তান প্রান্ত (১৪), অঙ্কিতা (৫) ও দিশাকে (৩) নিয়ে পথে পথে ঘুরছিলেন, তখন প্রতিবেশী মাছুরা খাতুন তাদের আশ্রয় দেন। মাছুরা খাতুনের স্বামী ওয়ায়েজ কুরনীও অন্যত্র বিয়ে করে চলে গেছেন। এ অবস্থায় নিজের অভাব-অনটনের সংসারে আরেকটি পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। 
মাছুরা খাতুন বলেন, ‘স্বামী ফেলে গেলে কী অবস্থা হয়, তা আমি জানি। তাই অসহায় পরিবারটিকে আশ্রয় দিছি। কতদিন পারব বলতি পারিনে।’ তিনি বলেন, পরিবারটিকে অন্তত তাদের বসতবাড়িতে তুলে দিতে পারলেও কষ্ট কিছুটা কমত। এজন্য তিনি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্যদের কাছে গিয়েছেন। এমনকি কয়েকবার পুলিশের কাছেও গেছেন। কেউ কোনো সমাধান দিতে পারছে না। 
প্রতিবেশী সুপ্রিয়া অধিকারী বলেন, সরকার পতনের পর দলবল নিয়ে জোরজবরদস্তি করে পরিবারটিকে বের করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদ করায় তাদের নামেও মামলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তাই ভয়ে পরিবারটিকে আশ্রয় দিতে পারেননি। বিষয়টি পুলিশকে জানালেও কাজ হয়নি। 
এ বিষয়ে কয়রা থানার ওসি ইমদাদুল হক বলেন, বিষয়টি সমাধানের জন্য দুই পক্ষকে ডেকে বলা  হয়েছে। পরিবারটি যাতে বসতভিটে থেকে উচ্ছেদ না হয়, সে জন্য চেষ্টা করা হয়েছে। জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়ের জন্য তাদের আদালতে যেতে বলা হয়।
উত্তর বেদকাশি ইউপি চেয়ারম্যান সরদার নুরুল ইসলাম জানান, অশোক অধিকারী কবে জমি বিক্রি করেছেন জানা ছিল না। পরে এ নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে কয়েক দফা সালিশ হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, অশোক অধিকারীর ৬৬ শতাংশ জমির মধ্যে তাঁর কাছ থেকে গোলাম রসুল টুকু নামে এক মালয়েশিয়া প্রবাসী ৪৯ শতাংশ কিনেছেন। বাকি জমি এখনও অবিক্রীত আছে। এ কারণে বসতবাড়িটি রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছিল। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতার সহযোগিতায় সব জমি দখলে নিয়ে পরিবারটিকে ভিটেছাড়া করা হয়েছে।
জ্যোৎস্নার শাশুড়ি বলেন, ‘আমার ছাওয়াল জমি বেইচে গেলিও আমার অংশ বিক্রি হয়নি। 
তারপরও আমাগের এক কাপড়ে জবরদস্তি বের করা দেওয়া হয়েছে।’
বসতভিটায় গিয়ে দেখা গেছে, আধাপাকা ঘরের বারান্দার গেটে তালা দেওয়া। ঘরের সামনে দুই শিশু পুকুরে সাঁতার কাটছে। তাদের কাছে জানতে 
চাইলে হাসান নামের একটি শিশু জানায় বাড়িটি এখন তাদের। তার বাবা মালয়েশিয়া থাকেন। ঘরে তার মা আছেন। তার মাকে ডাকাডাকি করা হলেও সাড়া দেননি।
কয়রার ইউএনও রুলী বিশ্বাস বলেন, ঘটনাটি অমানবিক। যদি ওই অংশে তাদের (জ্যোৎস্না) জমি থেকে থাকে, তাহলে তা উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হবে। একই সঙ্গে পরিবারটির যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা হবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: পর ব র

এছাড়াও পড়ুন:

'গরিবের ছাওয়াক যে সম্মান কইরলেন, মনটা ভরি গেইল'

‘বাহে, শনিবার রাইত ১০টার সময় ছাওয়াটার ব্যথা ওঠে। সে কি ব্যথা, আতালি পাতালি। গ্রামের দাই আসি অনেক চেষ্টা করিল। কই, কিছুই তো হইল না। এলা কি করং, অতো রাইতত হাসপাতাল যাইম কেমন করি! গাড়ি, ঘোড়া, রিকশা-কিছুই নাই। তারপর একখান অটোরিকশা জোগাড় করি ভোর ৫টার সময় ফুলবাড়ি থাকি লালমনিরহাট রওনা হইনো। শহরের সাপটানা বাজারের ক্লিনিকে হাজির হই হামরাগুলা। ক্লিনিকের লোকজন অপারেশন করি মোর ছোট নাতনিক দুনিয়ার মুখ দেখায়ছে।'

নববর্ষের প্রথম প্রহরে জন্ম নেওয়া নাতনির সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন জমিলা বেগম। বলতে থাকেন, ''বাহে, হামরা গরিব মানুষ, অতো কিছু বুঝি না, তোমরাগুলা এই গরিবের ছাওয়াক যে সম্মান কইরলেন, তাতে মনটা ভরি গেইল। হাউস করি নাতনির নাম রাখমো ‘বৈশাখি’।’’

লালমনিরহাট শহরের খোদেজা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সোমবার সকাল ৬টায় শাহ আলম ও হামিদা দম্পতির কোলজুড়ে আসে কন্যাশিশু। বাংলা বছরের প্রথম দিনে সন্তান উপহার পেয়ে তাদের পরিবারে বইছে খুশির বন্যা। এটি তাদের দ্বিতীয় কন্যাসন্তান। বড় মেয়ে শিমু নার্সারি শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে।

পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার নাওডাঙ্গা কুমারপাড়া গ্রামের শাহ আলম মিয়া বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পুরোনো খাতাপত্র, পত্রিকা, ভাঙ্গা টিন কিনে শহরে তা বিক্রি করেন। দিনে তিন থেকে চারশ টাকা আয় হয়। তা দিয়েই চলে সংসার। পাঁচ শতকের বসতভিটায় তিন ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে তিনি বসবাস করেন। বসতভিটার ওইটুকু জায়গা ছাড়া আর কিছুই নেই তার। তাই সন্তানকে ক্লিনিকে রেখে টাকার সন্ধানে ছুটছেন। কারো কাছ থেকে টাকা নিয়ে ক্লিনিকের বিল পরিশোধ করতে হবে। শাহ আলম বলেন, ‘মুই বাহে হকার, দিন আনি দিন খাই। হামার নববর্ষ বলি কিছু নাই। দোয়া কইরবেন ছাওয়াক মুই নেখাপড়া শিখাইম। দুই বেটি নিয়া হামার কোনো কষ্ট নাই। আল্লাহ সুস্থ রাখছে, তাতে হামরা খুশি।'

শাহ আলমের এসব কথা শুনে ক্লিনিকের বিছানায় শুয়ে থাকা নবজাতকের মা হামিদা বেগম বলেন, ‘আমি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করেছি। বাবা অটোরিকশা চালান। অভাবের সংসারে ইচ্ছা থাকার পরও লেখাপড়া করতে পারিনি। ২০১৪ বিয়ে হয়। পরের বছর প্রথম সন্তানের জন্ম হয়।' দুই মেয়েকে লেখাপড়া শেখানোর ইচ্ছা রয়েছে বলে জানান তিনি। 

ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিশ্বজিৎ জানান, বাড়িতে অনেক চেষ্টা করেও হামিদার নরমাল ডেলিভারি করাতে পারেনি পরিবার। সময় ক্ষেপণ করায় বেশ সমস্যা হয়েছিল। পরে অস্ত্রোপচার করেন বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রাক্তন প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. ভোলানাথ ভট্টাচার্য্য। তাকে সহায়তা করেন ডা. হাবিব। ডা. ভোলানাথ ভট্টাচার্য্য জানান, মা ও শিশু এখন সুস্থ রয়েছে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘রাক্ষুইস্যা যমুনা সবকিছু গিইল্লা খাইছে’
  • অসময়ে ব্রহ্মপুত্রে ভাঙন, ঝুঁকিতে বসতভিটা
  • 'গরিবের ছাওয়াক যে সম্মান কইরলেন, মনটা ভরি গেইল'
  • 'দুই বেটি নিয়া হামার কোনো কষ্ট নাই'