ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার ধারার অবসান ঘটাতে হবে
Published: 22nd, February 2025 GMT
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছিল দেশের ক্ষমতার পালাবদলসহ বড় ধরনের আমূল পরিবর্তনের প্রত্যাশায়। যেখানে মৌলিক সংস্কার এবং নির্বাচন দুটো বিষয়ই ছিল। সবাই সারাক্ষণ অভ্যুত্থানের সাফল্যের পেছনে ছাত্র-জনতার কথা বললেও উপেক্ষিত থাকছে জনসাধারণ। সাধারণ মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ, যাঁরা ভোটের মাধ্যমে নিজেদের মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে পারেন। দেশের বিপুল এই জনগোষ্ঠীর মতকে বিবেচনায় না নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
গতকাল শনিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্মাণবিষয়ক এক আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা এমন মন্তব্য করেছেন। বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) অষ্টম বার্ষিক সম্মেলনের ওই প্যানেল আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এখনই নির্বাচন চায়, সংস্কার চায় না। অথচ গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা হলো সংস্কার এবং নির্বাচন উভয়ই হতে হবে। কাজেই ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে রাখার ধারার অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে।
সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেন, প্রধান দুই দলই এককভাবে শক্তিশালী নেতা দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। প্রধান দলগুলোর অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার মূল উৎস খুঁজতে গেলে দেখবেন, প্রত্যেকেরই ছিল শক্তিশালী পরিবারতান্ত্রিক নেতৃত্ব। পরিবারতান্ত্রিক নেতারা তাঁদের ক্ষমতার চর্চার বিষয়ে শক্তিশালী ছিলেন। এবং তাঁরা তাঁদের দলের অগণতান্ত্রিক চর্চায় অবদান রেখেছেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকেই দলগুলোর অগণতান্ত্রিক চর্চার সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। দলগুলোর নেতারা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার চর্চা করেছেন। প্রধান দলগুলোকে কীভাবে গণতান্ত্রিক করা যাবে, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন।
রেহমান সোবহান বলেন, দাবি আদায় করতে লোক জড়ো করা আর সহিংসতা এখন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজতে পারে।
ছাত্রদের প্রতি ইঙ্গিত করে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘আপনারা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছেন। আপনারাই প্রথমবারের মতো তৃতীয় কোনো দল গঠন করার উদ্যোগ নিচ্ছেন। এখন আপনাদের দল গণতান্ত্রিক হয় কি না, সেটা দেখতে হবে। যখন নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধান দলগুলোকে তাদের আসনগুলোতে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবেন, তখনই আপনারা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবেন।’
সিপিডির চেয়ারম্যান বলেন, রাজনীতি এখন টাকার ক্ষমতার কাছে কুক্ষিগত হয়ে গেছে। ফলে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীর মাঝে বিভাজনরেখার বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। অনেক বছর ধরেই রাজনীতিতে অংশগ্রহণ আর আদর্শিক নেই। আর্থিক সুবিধা পেতে হলে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়াটা সবচেয়ে সহজ পথ। এই সমস্যা শুধু জাতীয় সংসদের প্রধান পদে নয়। এটা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পর্যন্ত বিস্তৃত। সবারই ব্যবসায়িক স্বার্থ ছিল। আওয়ামী লীগ এখন মাঠে নেই। কিন্তু তাদের সেই শূন্যতা পূরণ হয়ে গেছে।
দাবি আদায় করতে লোক জড়ো করা আর সহিংসতা এখন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজতে হবে।অধ্যাপক রেহমান সোবহান, চেয়ারম্যান, সিপিডি‘গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নির্মাণ: জনগণকে চালকের আসনে রাখা’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান। আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো মির্জা এম হাসান।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের পর আলোচনার সূত্রপাত করতে গিয়ে অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, ‘আমরা সারাক্ষণই এখন বলছি ছাত্র-জনতা। কিন্তু তার বাইরে আরেকটা ক্যাটাগরি (শ্রেণি) রয়েছে। সেটা হলো জনসাধারণ। ছাত্ররা কী, তা আমরা বুঝি। আর জনতা বলতে রাজপথের রাজনীতিতে যারা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছে জনসাধারণ। তারা সাইলেন্ট মেজরিটি। তারা অপেক্ষায় থাকে সেই নির্বাচনের দিনটার জন্য। গোপন ব্যালটের মারফতে তারা তাদের মতের প্রতিফলন ঘটাবে।’
জুলাই-আগস্টের পর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে রওনক জাহান বলেন, ‘এখন সবাই কথা বলতে পারছে। ভয়ের সংস্কৃতি নেই। আমাদের এটা বুঝতে হবে যে সবাই কথা বলছে, কেউ শুনছে না। কোনটা সত্যি আসলে? এত রকম ন্যারেটিভ বের হয়ে যাচ্ছে যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে আমরা চাচ্ছি যে সবারই স্বাধীনতা থাকুক এবং ভয়ের সংস্কৃতি না থাকুক। কিন্তু আমি শুনেছি যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্যাগিং আর এই সেই নানা কারণে লোকজন আসলে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে না। তাহলে আমরা সত্য কীভাবে প্রতিষ্ঠা করব। নানা কারণে নানা জিনিস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা আমাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।’
জুলাই অভ্যুত্থানকে অনেকেই বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করে থাকেন।এটা যদি বিপ্লব হতো, তাহলে সংস্কার কমিশনের কোনো প্রয়োজন হতো না
অধ্যাপক আলী রীয়াজ, প্রধান, সংবিধান সংস্কার কমিশন।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা এলিট রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন চাই। সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিষয়ে যে সমালোচনা এসেছে, তার জবাবে বলতে চাই যে বিদ্যমান এলিট রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বদলে নতুন একটি উদার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে হবে এবং আমরা সেটাই করার চেষ্টা করছি। এর চেয়ে ভালো কী হতে পারত? হয়তো পারত। বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বিবেচনায় রেখে আমরা মনে করেছি এর চেয়ে ভালো কোনো সমাধান হতে পারে না।’
আলী রীয়াজ বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানকে অনেকেই বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। আমি তা মনে করি না। এটা যদি বিপ্লব হতো, তাহলে এসব সংস্কার কমিশনের কোনো প্রয়োজন হতো না। কাজেই আমরা পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অধীনেই আছি। এ জন্যই বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াত গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা হতে হবে। আলোচনা তাঁদের সঙ্গেও চালাতে হবে, যাঁরা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আবির্ভূত হয়েছেন অর্থাৎ ছাত্ররা, যাঁরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছেন।’
আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সারা হোসেন বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার করতে হলে মৌলিক অধিকার কীভাবে যুগোপযোগী করা যায়, সেটা ভেবে দেখতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনসাধারণের অংশগ্রহণের বিষয়ে, বিচার পাওয়ার বিষয়ে আমরা কতটা সোচ্চার হতে পেরেছি। যাঁরা হত্যার শিকার হয়েছেন, আহত হয়েছেন, তাঁদের ব্যাপারে কতটা সোচ্চার হতে পারছি। এ মুহূর্তেও আমরা দেখছি যে এই ইস্যুতে এক হওয়া যাচ্ছে না। এমনকি জাতিসংঘের প্রতিবেদন প্রকাশের পরও আমরা দেখছি যে এটা অস্বীকার করার নানা চেষ্টা হচ্ছে। এখানে জনগণের কণ্ঠ কতটা উচ্চকিত হবে, সেটা একটা পরীক্ষা আমাদের জন্য।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের সাড়ে ছয় মাস পর আমাদের সবার কি খোলামনে কথা বলার পরিবেশ আছে? নেই। ছাত্র-জনতার কথা বলছি। অনেক আলোচনা, এত গণতন্ত্রের কথা, সুদিনের কথা, কিছু একটা করলেই সমাধান আসবে। এসবের সঙ্গে কি আমরা জনসাধারণকে যুক্ত করছি?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক আসিফ এম শাহান আলোচনায় অংশ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কার্যক্রমকে জবাবদিহির আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সহ-আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, অতীতের সরকারব্যবস্থায় মানুষের কথা শোনার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, তারা সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগে সুষ্ঠু নির্বাচনই ছিল মানুষের প্রধান আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর মানুষের আকাঙ্ক্ষা শুধু নির্বাচনে আটকে নেই। কেবল ক্ষমতার পালাবদলের জন্য এ অভ্যুত্থান হয়নি।
বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের দাবির বিষয়ে সারোয়ার তুষার বলেন, ‘আমরাও নির্বাচন চাই, তবে তারা সংস্কার চায় না। জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হলে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এখন স্থানীয় সরকারব্যবস্থার নামে আছে স্থানীয় প্রশাসনব্যবস্থা। এর বদল করতে হবে।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ব ছ ত র জনত হ ন বল ন ব যবস থ ক ষমত র দলগ ল র আম দ র মত র প সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ পেতে ৪০০ আবেদন, রয়েছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরাও
চট্টগ্রাম নগরের সৌন্দর্যবর্ধন করতে আগ্রহী ৪০০ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি। নগরের বিভিন্ন এলাকায় সৌন্দর্য বাড়াতে নানা ধরনের কাজ করতে চান তাঁরা। অবশ্য সৌন্দর্যবর্ধনের চেয়ে বাণিজ্যের প্রতি ঝোঁক বেশি তাঁদের। কোন প্রতিষ্ঠান কী ধরনের কাজ করতে চায়, তা জানিয়ে সিটি করপোরেশনের কাছে আবেদন ফরম জমা দিয়েছে। এখন তা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে।
সৌন্দর্যবর্ধন করতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। তাঁদের ২০ থেকে ২৫টি প্রতিষ্ঠান কাজ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। আবেদন ফরম জমা দেওয়া যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এক ব্যক্তি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তাও জানিয়েছেন, সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
সৌন্দর্যবর্ধনের কাজের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও দুটি এলাকায় কাজ করতে আবেদন করেছেন নগরের টাইগারপাস এলাকার যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এক ব্যক্তি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদল করেন, এমন অন্তত ৫০ জন ফরম জমা দিয়েছেন এবার। তাঁদের মধ্যে অন্তত ২০ জন তাঁর পরিচিত। ফরম জমা দিলেও কাজ পাবেন কি না, তা নিশ্চিত নন তিনি।
সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে আছেন নগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন। তবে তিনি দাবি করেছেন, দলীয় পরিচয় নয়, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
নগরের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ অতীতে পেয়েছিলেন সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র ও প্রশাসকের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা। মূলত সৌন্দর্যবর্ধনের কাজের নামে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছিল। কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোরও নগরের সৌন্দর্য বাড়ানোর চেয়ে বাণিজ্যের দিকে ঝোঁক ছিল বেশি। এবারও এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের আমলে ২০১৬ সাল থেকে নগরের ৪১টি এলাকা সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ইজারা দেওয়া শুরু হয়। কাজ পাওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশ ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে, যুবলীগের নেতা, পরিবহন মালিক সমিতির নেতা ও সাংবাদিকের প্রতিষ্ঠান। এরপর ছয় মাসের জন্য প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করা মোহাম্মদ খোরশেদ আলমের সময় নগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২টি জায়গা ইজারা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টিই পেয়েছিলেন প্রশাসকের ঘনিষ্ঠ দলীয় লোকজন ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পটপরিবর্তনের পর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনেও পরিবর্তন আসে। তৎকালীন মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীকে অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর আদালতের আদেশে মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপির নেতা শাহাদাত হোসেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর নগরের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য উদ্যোগ নেন।
মেয়রের এই পদক্ষেপের পর গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর ওয়ার্ডভিত্তিক সৌন্দর্যবর্ধনের প্রস্তাব চেয়ে স্থানীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি দেয় সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশন এলাকায় বিভিন্ন সড়কদ্বীপ, ফুটপাত, পদচারী-সেতু (ফুটওভার ব্রিজ), উড়ালসড়ক, পরিত্যক্ত খালি স্থান, উন্মুক্ত স্থান, জলাশয়ে সৌন্দর্যবর্ধন সবুজায়ন এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে প্রস্তাব চাওয়া হয়। এসব কাজে সিটি করপোরেশনের কোনো আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকবে না।
সিটি করপোরেশনের বিজ্ঞপ্তির পর আগ্রহী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আবেদন জমা দিতে শুরু করেন। গত ৩০ জানুয়ারি আবেদনপত্রগুলো উন্মুক্ত করা হয়। এখন সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনা শাখা তা যাচাই-বাছাই করছে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সিটি করপোরেশনের গঠিত আট সদস্যের একটি কমিটি।
নিজেরা না করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করার বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের মেয়র শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিটি করপোরেশনের প্রয়োজনীয় জনবল নেই। তাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হচ্ছে। তারা নিজেরা সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করবে ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে।
সৌন্দর্যে নয়, লাভে আগ্রহ বেশি
সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রতিটি ওয়ার্ডকে সৌন্দর্যবর্ধনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিলেও শুরুতে তা ভেস্তে যেতে বসেছে। করপোরেশনের নগর পরিকল্পনা শাখার তথ্য অনুযায়ী, নগরের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৯টিতেই কোনো আবেদন ফরম জমা পড়েনি। এগুলো হচ্ছে দক্ষিণ পাহাড়তলী, পাঁচলাইশ, পূর্ব বাকলিয়া, দক্ষিণ বাকলিয়া, দেওয়ান বাজার, পশ্চিম মাতারবাড়ী, পূর্ব মাতারবাড়ী, গোসাইলডাঙ্গা ও উত্তর মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ড। এসব ওয়ার্ডের গোসাইলডাঙ্গা ছাড়া অন্যগুলো শহরের প্রান্তিক এলাকায় অবস্থিত। সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনা শাখার এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এসব ওয়ার্ডে বাণিজ্য করার সুযোগ কম। তাই বিনিয়োগ করলেও তাতে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। হয়তো এ কারণে কেউ আবেদন করেননি।
তবে প্রান্তিক ওয়ার্ডগুলো আবেদন জমা না পড়লেও নগরের কেন্দ্রে থাকা ওয়ার্ডগুলোর চিত্র পুরো উল্টো। যেমন নগরের শুলকবহর ওয়ার্ডে আবেদন জমা পড়েছে সর্বোচ্চ ৪৩টি আর বাগমনিরাম ওয়ার্ডে ৩০টি। নগরের মূল সড়কখ্যাত সিডিএ অ্যাভিনিউ, আখতারুজ্জামান চৌধুরী উড়ালসড়ক এ দুটি ওয়ার্ডে অবস্থিত। এ ছাড়া নগরের দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডে আবেদন জমা পড়েছে ১৪টি। এখানে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অবস্থিত।
নগরের চকবাজার ওয়ার্ডে ১৩টি, জামালখান ওয়ার্ডে ১১টি, আলকরণ ওয়ার্ডে ১১টি, উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডে ১২টি ফরম জমা পড়েছে।
নগরের ৪ নম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ডে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করতে আগ্রহ জানিয়ে ফরম জমা দিয়েছেন মোস্তফা মো. জাবেদ নামের এক ব্যক্তি। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কাজ করতে চাইলেও অতীতে এ ধরনের কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই তাঁর।
আবেদনকারী ব্যক্তিরা সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য নগরের বিভিন্ন এলাকায় আলোকায়ন, বাগান, গ্রন্থাগার, ম্যুরাল করার নকশা জমা দিয়েছেন। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে আয়ের জন্য এসব কাজের পাশাপাশি সেখানে যাত্রীছাউনি, দোকান, ছোট আকারের বিলবোর্ড করার কথা বলেছেন তাঁরা।
সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ আবদুল্লাহ আল ওমর বলেন, সৌন্দর্যবর্ধন কাজে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে আবেদন ফরমে সুনির্দিষ্ট ১৪টি তথ্য চেয়েছেন। এখন জমা পড়া ফরমগুলোর সব তথ্য ও নকশা প্রাথমিকভাবে যাচাই করছেন। পরে কমিটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।