তরুণদের নেতৃত্বে যে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন হতে যাচ্ছে, তাতে কোনো পরিবারতন্ত্র থাকবে না বলে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। তিনি বলেছেন, ‘বাপ নেতা হলে ছেলে নেতা হবে—এই ট্র্যাডিশন (ধারা) আর থাকবে না। আপনি যদি যোগ্য হন, তাহলে আপনাকে আমরা চেয়ার ছেড়ে দিতে বাধ্য থাকব।’

গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক সদস্যদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন সারজিস আলম। ‘সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যবৃন্দ’র ব্যানারে মতবিনিময় সভাটির আয়োজন করা হয়।

মতবিনিময় সভায় জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সৈনিকেরা বক্তব্য দেন। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের বক্তব্যে জাতীয় নাগরিক কমিটির রাজনীতিতে নিজেদের সম্পৃক্ত করার এবং ভ্যানগার্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করার প্রতিশ্রুতি দেন।

সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক সদস্যদের নতুন রাজনৈতিক দলে স্বাগত জানিয়ে সারজিস আলম বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশের, নতুন চিন্তাধারার রাজনীতির কথা ছড়িয়ে দিন। আপনাদের দায়িত্ব নিতে হবে। ভোটের রাজনীতিতে আসুন। এই রাজনীতি যেন জনগণের রাজনীতি হয়। আপনারা একজন চেয়ারম্যান, মেয়র, কাউন্সিলর বা এমপি-মন্ত্রী হয়ে উঠুন।’

চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও ঘুষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক বলেন, ‘খুনি শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন; কিন্তু তাঁর যে চর্চা, ১৬ বছর ধরে তাঁর যে একটা সিস্টেম; অতীতের রাজনৈতিক শক্তিগুলো এই সিস্টেম জারি রাখতে চায়। ঐক্যবদ্ধভাবে এই সিস্টেমগুলোকে প্রতিহত করতে হবে।’
তরুণদের গণতান্ত্রিক রাজনীতি বাধাগ্রস্ত করলে সশস্ত্র বিপ্লব হবে বলে মন্তব্য করেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। শেখ হাসিনার পতনের আগে সশস্ত্র বিপ্লবের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, সেই ঘোষণা এখনো আছে। কোনো রাজনৈতিক দল থেকে কিংবা কোনো বিদেশি শক্তি থেকে তরুণদের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রামে বাধা আসে, তাহলে বিপ্লবের পথে হাঁটতে বাধ্য হবেন তাঁরা।

নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, এখন আর পুরোনো রাজনীতি চলবে না। বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসে অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যাচ্ছে। আপনারা একটু ধীরে চলুন। নতুবা ছাত্রলীগের মতো অবস্থা হবে। আমরা আপনাদের রক্ষা করতে পারব না।’

সংবিধান সংশোধনের জন্য গণপরিষদ গঠন করতে হবে বলে মন্তব্য করেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক। তিনি বলেন, গণপরিষদ সংবিধান প্রণয়ন করবে। পাশাপাশি সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিও চলবে।

সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রুকন উদ্দিন বলেন, ছাত্রনেতৃত্বের ওপর শকুনের থাবা ওত পেতে আছে। তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা চলছে। অবৈধ টাকা ছড়াচ্ছে পতিত ফ্যাসিবাদ। এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।
অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন খালেদ হোসাইন আগামীতে তরুণদের দল ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসবে বলে মনে করেন। অবসরপ্রাপ্ত মেজর গোলাম হায়দার তরুণদের যে কোনো উদ্যোগে পাশে থাকার ঘোষণা দেন।

মতমিনিময় সভায় জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের মধ্যে আরও বক্তব্য দেন সারোয়ার তুষার, নিজাম উদ্দিন, মনিরা শারমীন, আতিক মুজাহিদ, হাফেজ আকরাম হোসাইন, আদিব আরিফ প্রমুখ। সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন তাসবির আহমেদ, মেহেদী হাসান, শুভ আফ্রিদি প্রমুখ।

বক্তাদের প্রায় সবাই অভিযোগ করেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা হয়েছে। ভারতীয় আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ধ্বংস করা হয়েছে। তরুণেরাই এ ব্যবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সশস ত র ব হ ন র স অবসরপ র প ত র র জন ত র জন ত ক

এছাড়াও পড়ুন:

প্রাণ দিয়ে সহযোদ্ধাদের বাঁচান শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের

পশ্চিম পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদের কর্মস্থল থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১-এ ছুটিতে ঢাকার বাড়িতে আসেন ৪০ ফিল্ড আর্টলারি রেজিমেন্টের টগবগে তরুণ সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের। ১৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম এসে খালাতো বোন মোর্শেদা জুলিয়াকে কোর্ট ম্যারেজ করে আবার ফিরে যান ঢাকায়। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনারা নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যার নৃশংস ঘটনায় তরুণ এ সেনা কর্মকর্তার মনে জ্বলে ওঠে ঘৃণা আর প্রতিশোধের আগুন। ২৭ মার্চ ঢাকা থেকে চলে যান চট্টগ্রামে। সেখান থেকে ২ এপ্রিল পার্বত্য চট্টগ্রামের ভারত সীমান্তবর্তী মহকুমা শহর রামগড়ে আসেন। 


তেজোদীপ্ত বাংলার বীর সেনানী ক্যাপ্টেন কাদেরের নেতৃত্বে রামগড় হাই স্কুল মাঠে চলতে থাকে যুব প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। রামগড়ের একমাত্র সেনা অফিসার কাদের স্থানীয় ইপিআরের সুবেদার মফিজুল বারী, হাবিলদার আবুল কাশেমসহ কয়েকজন ইনস্ট্রাক্টর এবং স্বল্পসংখ্যক অস্ত্র নিয়ে পরিচালনা করেন গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ। এর মধ্যে মেজর জিয়াউর রহমানও এসে পৌঁছেন রামগড়ে। তিনি এসে চালু করেন মুক্তিফৌজের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।


রামগড় আসার পর ক্যাপ্টেন কাদের সর্বপ্রথম অপারেশন পরিচালনা করেন ফেনীর শুভপুর এলাকায়। রণকৌশলের আবশ্যকীয়তায় তিনি পরিকল্পনা নিয়ে ইপিআরের হাবিলদার কাশেমের প্লাটুনসহ মীরেরসরাইর জোরারগঞ্জে স্থাপন করেন প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। রাঙামাটি শহরে পাকবাহিনীর বড় সমাবেশের খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন কাদের তাঁর গ্রুপ নিয়ে বন্দুক ভাঙ্গা নামক এক দ্বীপের মতো স্থানে অবস্থান নেন। এখানে ২১ এপ্রিল দুই লঞ্চ বোঝাই পাক সেনাদল হঠাৎ আক্রমণ চালায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। ক্যাপ্টেন কাদেরের নেতৃত্বে যুদ্ধ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাত্র শওকত ও অন্য সদস্যরা শত্রুদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি চালায়। ঘণ্টাব্যাপী চলা এ প্রচণ্ড যুদ্ধে শত্রুপক্ষের বেশ কয়েকজন হতাহত হওয়ার পর তারা পিছু হটে। বন্দুক ভাঙ্গায় দুই দিন অবস্থানের পর মেজর শওকতের নির্দেশ পেয়ে ২৪ এপ্রিল তিনি গ্রুপ নিয়ে রওনা হন মহালছড়ির উদ্দেশে। মহালছড়ি যাওয়ার পথে বুড়িঘাট এলাকায় শত্রুপক্ষের অতর্কিত আক্রমণের শিকার হন ক্যাপ্টেন কাদের এবং তাঁর দুই সহযোদ্ধা হাবিলদার সায়ীদ ও হাবিলদার তাহের। এই তিনজন তিনটি এলএমজি নিয়ে প্রবল আক্রমণ চালান পাকস্তানি বাহিনীর ওপর। এখানেও শত্রুরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে লঞ্চ নিয়ে পালিয়ে যায়। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের একের পর এক প্রচণ্ড হামলার মুখে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে স্থল আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে বিমান ও হেলিকপ্টারের সাহায্যে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্ভাব্য অবস্থান ও ঘাঁটির ওপর প্রবল হামলা।


এ অবস্থায় পার্বত্য এলাকায় পূর্ব ট্রেনিংহীন মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েন। রসদ এবং গোলাবারুদ সংকট দেখা দেয় তাদের। এই প্রতিকূল ও দুর্বল মুহূর্তে ২৭ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে পাকবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানি সৈন্য (১৩৬ জন) এবং একটি মিজো ব্যাটালিয়নকে (১০০০ জন) সঙ্গে নিয়ে আক্রমণ চালায় মহালছড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। মেজর মীর শওকত এবং চন্দ্রঘোনা পেপার মিলের প্রকৌশলী ইসহাকের নেতৃত্বে ওই সময় আক্রমণ প্রতিহত করা হচ্ছিল। এর মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী হেলিকপ্টারে দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের আরও এক কোম্পানি সৈন্য এখানে নামিয়ে দিয়ে যায়। দুই পক্ষের প্রচণ্ড এ যুদ্ধের মধ্যে বেলা ৩টায় ক্যাপ্টেন কাদেরের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপটি মহালছড়ি এসে পৌঁছে। অসীম সাহস আর সুদক্ষ যুদ্ধ কৌশল গ্রহণ করে তরুণ সেনা অফিসার কাদের সঙ্গীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রু মোকাবিলায়। তাদের এ সম্মিলিত কঠিন প্রতিরোধের মুখে মিজো বাহিনী প্রথম অবস্থায় পিছু হটলেও এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের সহযোগী মিজো ও চাকমা মুজাহিদরা মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যায়। ৩-৪ গুণ অধিক সংখ্যক শত্রুপক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় চারপাশ ঘিরে ফেলে। চরম এ বিপজ্জনক অবস্থায় সহযোদ্ধারা পশ্চাৎপসরণের পরামর্শ দেন ক্যাপ্টেন কাদেরকে। কিন্তু অকুতোভয় সহযোদ্ধা ছাত্র শওকত, ফারুক এবং দুই ইপিআর সৈনিককে সঙ্গে নিয়ে তিনটি এলএমজির অবিরাম গুলিবৃষ্টি কোণঠাসা করে ফেলে শত্রুদের। এই চরম মুহূর্তে হঠাৎ শত্রুর অস্ত্রের কয়েকটি গুলি এসে বিঁধে তাঁর ডান বগলের কয়েক ইঞ্চি নিচে এবং পেটের বাম পাশে। গুলিবৃষ্টির মধ্যেই গুরুতর আহত কাদেরকে বহন করে একটু নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসেন শওকত, ফারুক ও ইপিআরের ড্রাইভার আব্বাস। 


সেখান থেকে জিপ গাড়িতে রামগড়ে আসার পথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এ তরুণ বীরযোদ্ধা। তখনও তাঁর বিয়ের মেহেদির রং হাত থেকে মুছে যায়নি। ওইদিন শেষ বিকেলে সহযোদ্ধা ফারুক, শওকত ও আব্বাস বীর শহীদের মরদেহ নিয়ে আসেন রামগড়ে। পরে রামগড় কেন্দ্রীয় কবরস্থানে পূর্ণ সামরিক ও ধর্মীয় মর্যাদায় তাঁকে দাফন করা হয়।


ক্যাপ্টেন কাদেরের দুঃসাহসিক অবস্থান ও ভূমিকার কারণে মেজর শওকতের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর কমপক্ষে ৫০০ সদস্য নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ওইদিন রক্ষা পেয়েছিল। ওই ভয়াবহ যুদ্ধে মিজো ব্যাটালিয়নের ৪০০ সৈন্য এবং পাকবাহিনীর কমান্ডো কোম্পানির ৪০ জনের মতো সৈনিক হতাহত হয়। মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ও গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালে সরকার ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরকে মরণোত্তর ‘বীরউত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করে।


লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জের টিওরী গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিক ড. এম আব্দুল কাদের এবং রওশন আরা বেগমের আট পুত্রের মধ্যে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরসহ পাঁচজনই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাদের মধ্যে রেজাউল কাদের, সিরাজুল কাদের ও এমদাদুল কাদের যুদ্ধ শেষে মায়ের কোলে ফিরে এলেও শহীদ হন ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ও ঢাকা ডেন্টাল কলেজের ছাত্র আহসানুল কাদের মামুন। তবে শহীদ আহসানুল কাদেরের সমাধি আজও খুঁজে পাননি বলে জানান তাঁর ভাই অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও রাষ্ট্রদূত ড. আফসারুল কাদের এবং অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের। 

নিজাম উদ্দিন লাভলু: সাংবাদিক
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্রাণ দিয়ে সহযোদ্ধাদের বাঁচান শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের