১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুযারি ঢাকার বুকে যা ঘটেছিল, তা আমরা সবাই জানি। সেই দিন এবং তার পরবর্তী দিনগুলোতে ছাত্র-জনতা অকাতরে যে আত্মদান করেছিল, তা শুধু মাতৃভাষা বাংলারই মান রক্ষা করেনি; বাঙালি জাতির সম্বিৎও ফিরিয়েছিল। বাঙালি জাতি বুঝতে পেরেছিল, আমরা এখনও পরাধীন এবং বাঙালির বৃহৎ ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিশ্বাসের সঙ্গে তৎকালীন রাষ্ট্রটি কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয়। 
এ সত্য সর্বজনবিদিত, পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বাঙালি মুসলমানের ভূমিকা অন্য ভাষাভাষী মুসলমানদের তুলনায় বেশি ছিল। তৎকালীন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থঘেঁষা রাষ্ট্র ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা পাকিস্তানকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ মনে করেছিল। তাই ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা দুই হাজার কিলোমিটারের বেশি দূরত্বের এক অস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পথকে ঠিক মনে করেছিল। 

বাঙালি মুসলমান স্বপ্ন দেখেছিল যে রাষ্ট্র ও ক্ষমতায় তাদের অংশীদারিত্ব থাকবে। রাষ্ট্র তার শ্রেণিস্বার্থের পরিচালনার নিয়ম মেনে চলে। তার অংশ হিসেবে যাদের সংগ্রাম ও আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে রাষ্ট্রটির সৃষ্টি, তাদেরই সে পাশ কাটিয়ে চলে। এর আশু ফল হিসেবে পাকিস্তান বাঙালির ওপর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে।

অনেকেই বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের ষড়যন্ত্র। বায়ান্নতে ভাষার ওপর পাকিস্তান রাষ্ট্রের ওই আক্রমণ কি ভারতের ষড়যন্ত্র ছিল? পরবর্তী সময়ে ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থানও কি তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকদের আক্রমণাত্মক ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল না? এক দেশের রাজনীতি অনেক সময় অন্য দেশের রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। সেটি দেশ দখলের দিকে গড়ানোর উদাহরণ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। ভিয়েতনামের স্বাধীনতা যুদ্ধে চীন সহযোগিতা করেছিল। পরে চীন ভিয়েতনাম দখল করেনি; বরং দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ সময় একটি ছায়াযুদ্ধ চলেছে। ১৯৭৮ সালে ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া যুদ্ধ শুরু হয়, যা বাস্তবে শেষ হয় ১৯৯০ সালে। ১৯৭৯ সালে কম্বোডিয়ায় খেমাররুজ সরকারকে উৎখাত করে ভিয়েতনাম তার পছন্দের সরকার বসায়, তবে ভিয়েতনাম বনাম খেমাররুজ যুদ্ধ থামেনি। এই গোটা যুদ্ধে চীন ছিল খেমাররুজদের পক্ষে। 

অভিজ্ঞতা বলে, একটি বহু জাতিসত্তার দেশ বা ফেডারেল রাষ্ট্র যে কোনো জাতিসত্তার মধ্যে স্বকীয়তাবোধের উত্থান ঠেকাতে প্রথমেই সংশ্লিষ্ট ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ চালায়। ভারতে তামিলরা চেয়েছিল তামিল রাষ্ট্রভাষা হোক, তারা বরাবরই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দির বিরোধিতা করে আসছে। বস্তুত গোটা দক্ষিণ ভারতেই এ হিন্দিবিরোধী সংগ্রাম জারি আছে। সে কারণে ইংরেজির মতো হিন্দি এখনও ভারতের সরকারি ভাষা, রাষ্ট্রভাষা সেখানে নেই। ফেডারেল রাষ্ট্রের ওই নীতি-কৌশল অনুসারে, সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে হিন্দিকে এক প্রকার রাষ্ট্রভাষারূপে চালানোর সরকারি চেষ্টা আছে। রাষ্ট্রবাদীদের ধারণা এক দেশ এক ভাষা না হলে রাষ্ট্র টিকে না বা নিদেনপক্ষে মজবুত হয় না। বহু জাতিসত্তার দেশ পাকিস্তানেও একই নিয়ম অনুসরণ করে বিশেষত বাংলার ওপর উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। 
সৌভাগ্যবশত, আমাদের জনগণের ৯৯ শতাংশ বাংলা ভাষায় কথা বলে। ভাষাই আমাদের ঐক্যের প্রাথমিক উৎস। বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষ এই একই বাংলা ভাষায় কথা বলে। এই সহজ সত্য যদি আমরা আত্মস্থ করতে পারি, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র নিয়ে এত বিভ্রান্তি থাকার কথা নয়। দেশে অন্য যেসব ভাষা আছে, সেগুলোর লোকসংখ্যা যত কম হোক, উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে আমরা সহজেই আমাদের জাতীয় ঐক্য আরও দৃঢ় করতে পারি। লক্ষণীয়, অমর একুশের চেতনা বাঙালির মধ্যে যেমন, তেমনি চাকমা, মারমা বা অন্য জাতিসত্তাগুলোর মধ্যেও সমান মর্যাদা পায়।
আরেকটি বিষয় বলা উচিত, একটি দল ইতিহাসের কোনো এক সময়ে রাষ্ট্র বিনির্মাণে নেতৃত্ব দিতে পারে, তা করতে গিয়ে তার ভুলও হতে পারে। সেই ভুল বা ব্যর্থতার কারণে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জনমানুষ যে তার নেতৃত্ব মেনে ছিল, সেটা ভুল হয়ে যায় না।

আমরা সাম্প্রতিক এক বিশাল গণঅভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। তার শিক্ষা হলো, জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মুখে কোনো শক্তিই টিকে থাকে না। উপরন্তু, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই জনগণের এই ঐক্য ধরে রাখার কার্যকর পথ হতে পারে। অন্য কোনো অশুভ পথে ক্ষমতায় যাওয়া বা টিকে থাকার প্রয়াস না করে, আমাদের তাই গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য মনোযোগী হওয়া উচিত। অমর একুশে শিখিয়েছে, কীভাবে ধর্মীয় বা জাতিগত বাধা পেরিয়ে ভাষা আমাদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারে, পরস্পরের প্রতি সহনশীল করে তোলে। যে তরুণ সমাজ সাম্প্রতিক পরিবর্তনের পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে, তাদের কাছেও এই সত্য ধরা দিক– এবারের একুশে ফেব্রুয়ারিতে এ কামনাই করি।

জয়দ্বীপ রায়: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, লন্ডন

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ম সলম ন আম দ র কর ছ ল র এক শ সরক র র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

দাবি আদায়ে সহিংসতা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে: রেহমান সোবহান

দাবি আদায় করতে লোক জড়ো করা এবং সহিংসতা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজতে হবে।

রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে আজ শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি’ শীর্ষক একটি অধিবেশনে তিনি এসব কথা বলেন। গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহানের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইজিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা এম হাসান।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, অতীতের ক্ষমতার চর্চা ছিল অর্থের ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য। আদর্শের চর্চার প্রভাব খুব একটা ছিল না। জাতীয় সংসদের প্রধান থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পর্যন্ত সবাইকে এ ধারায় চলতে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগ চলে গেলেও সেই টাকার প্রভাবের শূন্যতা পূরণ হয়ে যাচ্ছে। 

আলোচনায় অংশ নিয়ে সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে তার কাজের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনার কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে প্রধানমন্ত্রীর স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার যথেষ্ট সুযোগ আছে। সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহি নিশ্চিতের প্রবিধান সংযুক্ত করা হবে।

আলী রীয়াজ আরও বলেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থাকে কেউ কেউ ‘বিপ্লব’ বলেন। আদতে এটা বিপ্লব ছিল না। বিপ্লব হলে বিভিন্ন কমিশন গঠন করার দরকার হতো না। তিনি উল্লেখ করেন, সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাব দিয়েছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করবে তারা কতটুকু গ্রহণ করবে। 

অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, সবাই সংস্কার চান। তবে কী সংস্কার চান, তা সুস্পষ্ট করা উচিত। সংস্কার কেবল আইনের পরিবর্তনের মধ্যে আটকে থাকলে হবে না। আইন অনেক আছে। সমস্যা রাজনৈতিক চর্চার। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অনেকগুলো সংস্কারের জন্য কাজ করছে। এরই মধ্যে অনেক সংস্কার প্রস্তাবও এসেছে। তবে সংস্কার প্রস্তাবের অনেকগুলো আইন পরিবর্তনের জন্য। সত্যিকার অর্থে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাইলে জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল ভূমিকা রাখতে হবে।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক চর্চার পরিবর্তনের জন্য অন্তর্বর্তী নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সরকার ব্যবস্থাকেও রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে ক্ষমতা ধরে রাখার চর্চাও দেখা গেছে। প্রতিবছর সম্পদের হিসাব প্রকাশ করবে– ‘দিন বদলের’ কথা বলে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি। কীভাবে মানুষ এটা বিশ্বাস করবে, রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসছে, সেই প্রতিশ্রুতি রাখবে। 

বক্তারা আরও বলেন, নিজেদের পক্ষে কথা বলার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রতিনিধি পাঠানোর পর যদি জনগণ দেখেন তাদের পক্ষে ওই প্রতিনিধি কথা বলছেন না, তাহলে তাকে ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থাও থাকা উচিত। রাজনৈতিকগুলো গণতন্ত্রের কথা বললেও নিজেরা গণতন্ত্রের চর্চা করে না। মুখে জনগণই সব ক্ষমতা উৎস– এমনটা বললেও সংসদে নিজ দলের বিরুদ্ধেই কথা বলতে পারে না।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সৌদি যুবরাজের গাজা নিয়ে বিকল্প পরিকল্পনার পেছনে কী
  • ওরা কারা বসন্ত আটকে দিতে চায়!
  • দাবি আদায়ে সহিংসতা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে: রেহমান সোবহান
  • ইউরোপে বিভক্তি তৈরির মার্কিন চেষ্টা
  • যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র রক্ষায় রাজপথে থাকতে হবে
  • গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকার
  • ফ্যাসিবাদবিরোধী সব পক্ষকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে: অ্যাটর্নি জেনারেল
  • মানুষ অবিলম্বে ভোট দেওয়ার জন আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখতে চায়
  • অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে কি না, তা মানুষের ‘রাডারে’ রয়েছে: মঈন খান