তিন কারণে ৩৩৪ দুর্নীতি মামলার বিচারে বিলম্ব
Published: 22nd, February 2025 GMT
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও নূপুর মার্কেটের মালিক সাহেদ আজগর চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৩ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ২০০৩ সালে দুর্নীতি মামলা হয়। ওই বছরের ১২ নভেম্বর আদালতে চার্জশিট দাখিল করে দুদক। কিন্তু মামলাটি বাতিল চেয়ে ২০০৪ সালে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন সাহেদ। ২০২২ সালের ৯ মার্চ রিট খারিজ হয়। ২৪ বছর পর ২০২৪ সালের ১৯ নভেম্বর দুই আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালত। যদিও এর মধ্যে দুজনই মারা গেছেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী মারা যান ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর আর সাহেদ ২০২১ সালের ৮ অক্টোবর। দুই আসামি বিচার শুরুর আগেই মারা যাওয়ায় মামলাটির আইনগতভাবে আর কোনো কার্যকারিতা নেই।
রেলে নিয়োগ দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড সাবেক জিএম ইউসুফ আলী মৃধাসহ তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা করেছে দুদক। এর মধ্যে তিনটি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি ১০টি চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালত বিচারাধীন। এর মধ্যে চারটি মামলা শেষ পর্যায়ে। তিনটি মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। ২০১২ সালের দুদক মামলাগুলো করার পর একযুগ কেটে গেলেও মামলাগুলো নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এরই মধ্যে জামিন নিয়ে কারামুক্ত জীবন কাটাচ্ছেন সাবেক জিএম ইউসুফ আলী মৃধা।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে তিনটি কারণে দুর্নীতি মামলাগুলো নিষ্পত্তি হচ্ছে না। কারণগুলো হলো বিচারক শূন্যতা, হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ, সাক্ষী হাজির না হওয়া। এতে দুর্নীতি করেও শাস্তি পাচ্ছেন না অভিযুক্তরা।
চট্টগ্রাম বিভাগের পাঁচ জেলা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে সংঘটিত দুর্নীতির বিচার হয় বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে। এখানে ৩৩৪টি দুর্নীতি মামলার বিচার চলমান। প্রতি মাসেই যুক্ত হচ্ছে নতুন মামলা। কিন্তু চার্জশিট হওয়ার পর যে পরিমাণ মামলা বিচারের জন্য পাঠানো হচ্ছে, সেই পরিমাণ নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এর মূল কারণ স্পর্শকাতর আদালতটিতে প্রায়ই বদলিজনিত কারণে বিচারকশূন্য থাকে। এ ছাড়া সমন পাঠানো হলেও দুদকের অনেক কর্মকর্তা যথাসময়ে আদালতে এসে সাক্ষ্য দিতে হাজির হন না। মূলত এ দুটি কারণেই বছরের পর বছর ঝুলে থাকে দুর্নীতিতে জড়িত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ব্যক্তিদের বিচার। একযুগ সময় কেটে গেলেও এখনও ৮৮টি দুর্নীতি মামলার বিচার শেষ হয়নি। বিচারিক দীর্ঘসূত্রতার কারণে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে নির্বিঘ্নে বিচরণ করছেন। অনেক ক্ষেত্রে কৌশলে সাক্ষী, আইনজীবীসহ মামলা–সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে প্রভাবিত করার ঘটনাও ঘটছে।
এ বিষয়ে সিনিয়র আইনজীবী চৌধুরী আবদুল্লাহ বলেন, ‘দুর্নীতি মামলার চার্জশিট হওয়ার পর এক থেকে দুই বছরের মধ্যে প্রতিটি মামলার বিচার হওয়া উচিত। তখনই দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতি করতে শতবার চিন্তা করবেন। কিন্তু এখন মামলা হওয়ার পর কয়েক বছর কেটে যায়। চার্জশিট হওয়ার পর রায় হতে কখনো অর্ধযুগ, কখনো একযুগ কেটে যায়। অনেকে সাক্ষী, আসামিও বিচার শেষ হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেন। বিচারিক দীর্ঘসূত্রতার কারণে দুর্নীতিবাজরা শাস্তির আওতায় না আসায় দুর্নীতি কমার চেয়ে বরং বাড়ছে।’
দুদক পিপি অ্যাডভোকেট মাহমুদুর হক মাহমুদ বলেন, ‘দুর্নীতি মামলার চার্জশিট আসার পর অনেক প্রভাবশালী ও অর্থবিত্তের মালিক আসামিরা হাইকোর্টে রিট করেন। উচ্চ আদালত রুল ইস্যু করেন। কিন্তু তারপর বছরের পর বছর কেটে গেলেও রুল নিষ্পত্তি না হওয়ায় অনেক মামলার বিচার আমাদের আদালতে শেষ করতে পারছি না। এছাড়া আদালত বিচারকশূন্য হয়ে পড়াও অন্যতম কারণ। এসব কারণে মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তিতে স্থবিরতা দেখা দেয়। তাতে রাষ্ট্রপক্ষ তথা প্রসিকিউশন, মামলার বাদীসহ সবপক্ষও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের উন্নতির ক্ষেত্রে বড় সংকট দুর্নীতি। বিচারকশূন্যতার কারণে বিচার বিলম্বিত হচ্ছে। বিচার বিলম্বিত হওয়ায় দুর্নীতিবাজদের শাস্তি না হওয়ায় তারা আরো বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছেন। বিচারের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিয়ে তাদের মধ্যে ভয় ধরানো যাচ্ছে না বলেই সমাজে দুর্নীতি বাড়ছে। তাই সরকারের উচিত বিচারক বদলির সঙ্গে সঙ্গে নতুন বিচারক পদায়ন করা।’
চট্টগ্রাম অঞ্চলে দুর্নীতি ঠেকাতে দুর্নীতিবাজদের বিচার করার জন্য রয়েছে মাত্র একটি আদালত। দুর্নীতির মামলার বিচারের জন্য বিশেষ জজ আদালতের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ আদালতটি বিচারকশূন্য হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে যোগদানের পর একটানা তিন বছর দায়িত্ব পালন করেছেন বিচারক মীর রুহুল আমিন। তারপর ছন্দপতন হতে থাকে। ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত বিচারক ছিল না আদালতে। তখন বিচার কার্যক্রম বন্ধই ছিল। শুধুমাত্র ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক রুটিন কাজ সেরেছেন। ২০২১ সালের ২০ এপ্রিল যোগ দেন বিচারক মুন্সী আব্দুল মজিদ। তিনি দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করে সুনাম অর্জন করেন। ভয় ধরিয়ে দেন দুর্নীতিবাজদের মনে। ২০২৪ সালের মার্চে তিনি কক্সবাজার জেলা জজ হিসেবে বদলি হলে ফের বিচারকশূন্য হয়ে পড়ে আদালতটি। এরপর এক বছরের মাথায় দুই দফায় বিচারকশূন্য হয়ে যায় এই আদালত।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে বর্তমানে দুর্নীতির মামলা রয়েছে ৩৩৪টি। বিশেষ জজ আদালতে পাঁচ বছর ও পাঁচ বছরের অধিক বিচারাধীন রয়েছে এমন মামলার সংখ্যা ৮৮টি। এর মধ্যে চাঞ্চল্যকর বিচারাধীন মামলার হচ্ছে, কক্সবাজারের উখিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি, কক্সবাজারের আনিসুর রহমান ইয়াহিয়া, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির আবু আহমে, টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ, চট্টগ্রামের সাবেক সিভিল সার্জন ও জেনারেল হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ডা.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: হওয় র পর র জন য বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
ঢাকাবাসী ৯ বছরে মাত্র ৩১ দিন নির্মল বাতাসে নিশ্বাস নিয়েছেন
বায়ুদূষণে রাজধানী ঢাকা প্রায়ই বিশ্বের শীর্ষে থাকছে। বাতাসে বুকভরে শ্বাস নেওয়াই এখন কঠিন। রাজধানীতে বসবাসকারী মানুষ গত ৯ বছরে (৩ হাজার ১১৪ দিনের হিসাব) মাত্র ৩১ দিন নির্মল বাতাসে নিশ্বাস নিতে পেরেছেন। যা গত ছয় বছরের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ সময়।
ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে পাওয়া ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঢাকার বায়ুমানের সূচক বা একিউআইয়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এসব তথ্য জানিয়েছে। ক্যাপস বলছে, দেশে প্রতি বছরই বায়ুদূষণ আগের চেয়ে বেড়েছে।
মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) ‘বিশ্ব ধরিত্রী দিবস ২০২৫: বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও ক্যাপসের উদ্যোগে এই সংবাদ সম্মেলন হয়।
গবেষণার তথ্য তুলে ধরে ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার জানান, ঢাকায় গত ৯ বছরে মানুষ মাত্র ৩১ দিন (১%) নির্মল বা ভালো বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে পেরেছে। তবে এক্ষেত্রে ৬২৪ দিন (২০%) মাঝারি বায়ু, ৮৭৮ দিন (২৮%) সংবেদনশীল বায়ু, ৮৫৩ দিন (২৭%) অস্বাস্থ্যকর, ৬৩৫ দিন (২১%) খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৯৩ দিন (৩%) দুর্যোগপূর্ণ বায়ু গ্রহণ করেন। ২০২৪ সালের সবচেয়ে ভাল ও সবচেয়ে খারাপ বায়ুমানের দিনসংখ্যা হলো যথাক্রমে ২ ও ৩৫ দিন।
বিশ্ব ব্যাংকের ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশে বায়ু দূষণের কারণে অন্তত ২ লাখ ৩৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) গবেষণায় বলা হয়েছে, বায়ু দূষণের কারণে প্রতিবছর ৫ হাজার ২৫৮ শিশুসহ ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৬ জন মানুষের অকালমৃত্যু হয়।
গবেষণায় বলা হয়, গত ৯ বছরের মধ্যে ঢাকায় ২০২৩ এবং ২০২১ সালে খুব অস্বাস্থ্যকর বায়ুমানের দিনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল। ২০২১ সালে খুব অস্বাস্থ্যকর দিন ছিল ৮৬ এবং ২০২৩ সালে অস্বাস্থ্যকর দিন ছিল ১৩৩। কিন্তু ২০২৩ সালে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১৪ দিন ছিল অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বা দুর্যোগপূর্ণ যা অন্য বছরগুলোর তুলনায় বেশি ছিল।
আহমেদ কামরুজ্জামান বলেন, ঢাকায় ৯ বছরে সবচেয়ে বেশি দূষিত বাতাস ছিল ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। ওই মাসে সূচকে গড় বায়ুমান ছিল ৩০০। আর সবচেয়ে ভালো অবস্থান ছিল ২০২১ সালের জুলাইয়ে। ওই মাসে গড় বায়ুমান ছিল ৯৭। ২০২৪ সালের ৩৬৬ দিনের মধ্যে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বা দুর্যোগপূর্ণ দিনের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৩৫ দিনে।
সম্প্রতি প্রকাশিত আইকিউএয়ারের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ একাধিক বছর বিশ্বের শীর্ষ দূষিত বাতাসের দেশের তালিকায় রয়েছে। ২০২১ ও ২০২৩ সালে বাংলাদেশ শীর্ষে ছিল। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। সেই সঙ্গে গত বছর দূষিত বাতাসের শহরগুলোর বৈশ্বিক তালিকায় রাজধানী ঢাকা ছিল তিন নম্বরে।
জেলাভিত্তিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের জেলা গাজীপুর। এ জেলার বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে ১৮ গুণ বেশি। অন্যদিকে সবচেয়ে কম দূষিত বাতাসের জেলা সিলেট। যদিও সিলেট শহরের বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা ডব্লিউএইচওর মানমাত্রার চেয়ে ৯ দশমিক ৭ গুণ বেশি। এমনকি এটা বাংলাদেশের নির্ধারিত জাতীয় আদর্শ (বার্ষিক) মানের চেয়ে ৩ দশমিক ২৩ গুণ বেশি।
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে বাপা ও ক্যাপসের বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। এগুলো হলো—মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধ করে বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড যানবাহনের ব্যবহার বাড়ানো। ব্লক ইটের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ করে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা। বিদ্যমান জ্বালানি নীতিগুলোতে সংশোধন আনা। নির্মল বায়ু আইন প্রণয়ন করা। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প কারখানায় বিশ্বমানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নিঃসরণ মান নির্ধারণ এবং এর কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা।