দাবি আদায় করতে লোক জড়ো করা এবং সহিংসতা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজতে হবে।

রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে আজ শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি’ শীর্ষক একটি অধিবেশনে তিনি এসব কথা বলেন। গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহানের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইজিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড.

মির্জা এম হাসান।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, অতীতের ক্ষমতার চর্চা ছিল অর্থের ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য। আদর্শের চর্চার প্রভাব খুব একটা ছিল না। জাতীয় সংসদের প্রধান থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পর্যন্ত সবাইকে এ ধারায় চলতে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগ চলে গেলেও সেই টাকার প্রভাবের শূন্যতা পূরণ হয়ে যাচ্ছে। 

আলোচনায় অংশ নিয়ে সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে তার কাজের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনার কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে প্রধানমন্ত্রীর স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার যথেষ্ট সুযোগ আছে। সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহি নিশ্চিতের প্রবিধান সংযুক্ত করা হবে।

আলী রীয়াজ আরও বলেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থাকে কেউ কেউ ‘বিপ্লব’ বলেন। আদতে এটা বিপ্লব ছিল না। বিপ্লব হলে বিভিন্ন কমিশন গঠন করার দরকার হতো না। তিনি উল্লেখ করেন, সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাব দিয়েছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করবে তারা কতটুকু গ্রহণ করবে। 

অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, সবাই সংস্কার চান। তবে কী সংস্কার চান, তা সুস্পষ্ট করা উচিত। সংস্কার কেবল আইনের পরিবর্তনের মধ্যে আটকে থাকলে হবে না। আইন অনেক আছে। সমস্যা রাজনৈতিক চর্চার। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অনেকগুলো সংস্কারের জন্য কাজ করছে। এরই মধ্যে অনেক সংস্কার প্রস্তাবও এসেছে। তবে সংস্কার প্রস্তাবের অনেকগুলো আইন পরিবর্তনের জন্য। সত্যিকার অর্থে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাইলে জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল ভূমিকা রাখতে হবে।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক চর্চার পরিবর্তনের জন্য অন্তর্বর্তী নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সরকার ব্যবস্থাকেও রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে ক্ষমতা ধরে রাখার চর্চাও দেখা গেছে। প্রতিবছর সম্পদের হিসাব প্রকাশ করবে– ‘দিন বদলের’ কথা বলে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি। কীভাবে মানুষ এটা বিশ্বাস করবে, রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসছে, সেই প্রতিশ্রুতি রাখবে। 

বক্তারা আরও বলেন, নিজেদের পক্ষে কথা বলার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রতিনিধি পাঠানোর পর যদি জনগণ দেখেন তাদের পক্ষে ওই প্রতিনিধি কথা বলছেন না, তাহলে তাকে ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থাও থাকা উচিত। রাজনৈতিকগুলো গণতন্ত্রের কথা বললেও নিজেরা গণতন্ত্রের চর্চা করে না। মুখে জনগণই সব ক্ষমতা উৎস– এমনটা বললেও সংসদে নিজ দলের বিরুদ্ধেই কথা বলতে পারে না।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র ব যবস থ র জন ত ক র জন য সরক র ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

ওরা কারা বসন্ত আটকে দিতে চায়!

শীত চলে গেলেও কুয়াশা কাটে না। কেননা ওরা বসন্ত আটকে দিতে চায়। উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ১০ ফেব্রুয়ারি সোমবার আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘কথিত আন্দোলন আর মবের মহড়া আমরা এখন থেকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করব। রাষ্ট্রকে অকার্যকর এবং ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা করা হলে একবিন্দু ছাড় দেওয়া হবে না’ (সমকাল)। ‘তৌহিদি জনতার’ উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘অভ্যুত্থানের পক্ষে হলে মব করা বন্ধ করেন, আর যদি মব করেন, তাইলে আপনাদেরও ডেভিল (শয়তান) হিসেবে ট্রিট (গণ্য) করা হবে।’ তাঁর এ বিবৃতি যেন কথার কথা না হয়।

মব হলো একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া। আমার কাছে ঘটনাগুলো মব মনে হয় না, এটি আমার কাছে পরিকল্পিত প্রতিক্রিয়াই মনে হয়। প্রথম যেসব ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে, তা সরকার নাই অবস্থায় হয়েছে, সত্য। তা কি শুধু শেখ মুজিব বা শেখ হাসিনার প্রতি ঘৃণা থেকে হয়েছে? মেহেরপুরে যাদের ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে, তারা শেখ মুজিব কিংবা শেখ হাসিনা ছিলেন না– এটা সবারই জানা। এই সেদিনও সুনামগঞ্জের ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে, কৃষক স্বৈরাচার বা শেখ হাসিনা নন, এটাও সবার জানা।

তাই আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, যারা ভাঙছে তারা বৈষম্যে বিশ্বাসী। তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতিতে অবিশ্বাসী। তারা সৌদি আরবসহ পৃথিবীর বহু ইসলামী পরিচয়ধারী দেশে ভাস্কর্য আছে, তা জানা সত্ত্বেও ভাস্কর্য ভাঙাকেই নিজেদের ধর্মীয় পবিত্র দায়িত্ব মনে করে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াকেই নিজেদের পবিত্র দায়িত্ব মনে করে। অগ্রসর মানুষ তাদের ডেভিল মনে করে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব দাঁড়ায় ওই ডেভিলদের মোকাবিলা করা।

সরকার ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ক্রিয়াশীল থাকার সময়ই একের পর এক মাজারে হামলা হয়েছে। যারা হামলা করেছে তারা জানে মাজারে শেখ হাসিনা নেই বা কোনো স্বৈরাচারের দোসর সেখানে নেই। কোনো ব্যাংক লুটের টাকা সেখানে নেই। নির্মমভাবে পিটিয়ে সিলেটের মাজারে যে গরিব মানুষগুলোকে হত্যা করা হলো, তাদের বাড়িঘর পর্যন্ত নেই। চারদিন লাশ মর্গে পড়ে থাকল, তাদের দাফন করার কোনো লোক পর্যন্ত নেই। রাষ্ট্রশাসকদের চোখের সামনে এসব গরিব মানুষ হত্যা এবং উপর্যুপরি মাজারে হামলার পরেও তাদের গায়ে কোনো আঁচড় পড়ল না! আমাকে কেন বিশ্বাস করতে হবে রাষ্ট্র-সরকার ধর্মীয় বৈচিত্র্য রক্ষা করতে চায়? গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে? বহুত্ববাদে বিশ্বাস করে?

নারী খেলোয়াড়দের ওপর আক্রমণ এবং তাদের খেলা প্রতিরোধ করা হলো। বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায় পুলিশের সামনে আক্রমণ এবং বইয়ের স্টল বন্ধের ঘটনা আমাকে স্তম্ভিত করেছে। আমাকে কেন বিশ্বাস করতে হবে এক স্বৈরাচারকে জনতা উচ্ছেদ করার পর যে সরকার তৈরি হলো, তাদের ছায়াপথে আমাদের নিকষ অন্ধকার গর্তে ঢুকে যেতে হবে না? গায়ের জোর দেখালে আপনাকে ডবল স্বৈরাচার ডবল ফ্যাসিবাদ মনে করব না কেন? পাহাড়ে এবং সমতলে সর্বত্র সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ভাষার স্বাধীনতা নেই, ভূমির অধিকার নেই, জীবনের নিরাপত্তা নেই। কেন?
আগের স্বৈরাচারীরা ব্যাংক লুট করেছে, কারও বাড়িঘর লুটপাট করেনি। আজ তো বাড়িঘর লুটপাট চলছে। এটা মানব কেন? গাজীপুরের নেতা এবং সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অপরাধ দেখলে তাঁর নামে ৫০টি মামলা করতে পারে, তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারে, বিচার করে ফাঁসি দিতে পারে, কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু গভীর রাতে তাঁর বাড়ি লুট করতে পারে কি? তাঁর অপরাধের জন্য তাঁর পুত্র-পুত্রবধূর সঙ্গে প্রতিবেশীকে দায় দেওয়া, শাস্তি দেওয়া– কোন গণতন্ত্রে পড়ে? আবার সেখানে গণপ্রতিরোধের অপরাধে শত শত সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার করে সেই আগের সরকারের মতোই পুলিশি রাজত্ব, পুলিশের গ্রেপ্তার বাণিজ্য চালু মানা যায় কি?

আগের সরকার শ্রমিকরা পাওনা মজুরির জন্য আন্দোলন করলে তাকে বিদেশি চক্রান্ত বলে শ্রমিকদের গুলি করে হত্যা করেছে। এখনকার সরকারও হুবহু একই কাজ করছে। আজ পর্যন্ত বেতন দেয়নি বলে একজন মালিককেও কোথাও কোনো ধমক সরকার দিয়েছে বলে দেখিনি। অথচ এখনও মধ্যরাত পর্যন্ত শ্রমিকদের থানার পুলিশ, শিল্প পুলিশের যৌথ বাহিনী মোকাবিলা করতে হয়। তবুও কেন এই সরকারকেই সমর্থন করে যাব? শিক্ষকদের ওপর আগের সরকারও বর্বর কায়দায় জলকামান, রায়টকার ব্যবহার করত, এখনকার সরকারও তা-ই করছে। এই সরকার তৈরির প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের জন্য দ্রোহযাত্রা করেছি। আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে– গণতন্ত্র তুমি কোথায়? তুমি কেন প্রেস ক্লাবে আসো না? মত প্রকাশের স্বাধীনতা, তুমি কেন বইমেলায় আসো না?

বিধান জারি হলো, তারুণ্যকে ভালোবাসা দিবস উদযাপন করলে প্রতিহত করা হবে। বসন্ত বরণ করা যাবে না। ছেলেমেয়ে একসঙ্গে চলতে পারবে না। আমার চোখে আজও ভাসছে ৫ আগস্ট ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বিশাল মিছিল করে শেখ হাসিনার পতন ঘটাচ্ছে। সেদিন বনানীর ওভারব্রিজে যারা ছিল তারা সাক্ষ্য দেবে, যুবক-যুবতী, বোরকা পরা অনেক মেয়ে, জিনস প্যান্ট পরা অনেক মেয়ে ছেলেদের সঙ্গেই মিছিল করে শেখ হাসিনাকে নামিয়েছে। আজ কেন একসঙ্গে বসন্তবরণ কিংবা ভালোবাসা দিবস উদযাপন কিংবা এরশাদ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন দিবস পালন করতে পারবে না? 
সরকারকে এসব বিষয়ে শুধু বক্তব্য স্পষ্ট নয়, দৃঢ় অবস্থান নিতেই হবে। নইলে আমরাও বলতে বাধ্য হবো– ‘এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার।’

জহিরুল ইসলাম: সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ওরা কারা বসন্ত আটকে দিতে চায়!
  • অমর একুশে আমাদের গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ
  • ইউরোপে বিভক্তি তৈরির মার্কিন চেষ্টা
  • যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র রক্ষায় রাজপথে থাকতে হবে
  • গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকার
  • ফ্যাসিবাদবিরোধী সব পক্ষকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে: অ্যাটর্নি জেনারেল
  • মানুষ অবিলম্বে ভোট দেওয়ার জন আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখতে চায়
  • আমলাতন্ত্রের দোরগোড়ায় আটকে যায় সব সংস্কার
  • অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে কি না, তা মানুষের ‘রাডারে’ রয়েছে: মঈন খান