ঘটনাস্থলে দুই দশকে আরও ৮ খুন, দায় স্বীকার নিয়ে ধোঁয়াশা, পরিস্থিতি থমথমে
Published: 22nd, February 2025 GMT
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পিয়ারপুর গ্রামের শেষ প্রান্ত পেরোলে একটি বড় মাঠ। মাঠ পেরোলেই ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রাম। দুই জেলার এই দুই গ্রামের মধ্যবর্তী প্রায় দুই কিলোমিটারজুড়ে মাঠ। এই মাঠেই গতকাল শুক্রবার রাতে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁদের দুজনের বাড়ি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলায়। আরেকজনের বাড়ি কুষ্টিয়া সদরে।
শনিবার দুপুরে রামচন্দ্রপুর গ্রামে যেতে বাঁ পাশে বড় একটি খাল দেখা যায়। মাঠের ভেতর দিয়ে সড়ক ভেদ করে ডান দিকে আরেকটি খাল চলে গেছে। মূল সড়ক থেকে ডানে নামতে গভীর ঢাল। অন্তত ১০০ হাত দূরে দুটি স্থানে ঘাসের ওপর ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। দুটি স্থানের দূরত্ব ১৫ থেকে ২০ ফুট। সেখান থেকে ২০ হাত দূরে খালের সামান্য পানিতে লাগানো ধানগাছ ভাঙা দেখা যায়। স্থানীয় লোকজন বললেন, একটি লাশ খালের এই পানির মধ্যে পড়ে ছিল।
ঘটনাস্থলে স্থানীয় ১০ থেকে ১২ জনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। সেখানে এক পর্যায়ে পুলিশ ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন ব্যক্তিও হাজির হন। তাঁরাও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে স্থানীয়দের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ দেখা যায়। কেউই নাম প্রকাশ করতে চাইলেন না। কয়েকজন বললেন, শুক্রবার ঠিক ৯টার দিকে তাঁরা মাঠের মধ্যে তিন থেকে চারটি বিকট শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। তবে কেউই সাহস করে মাঠের দিকে সড়কে যাননি।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ২০০৩ সালের ৫ ডিসেম্বর এই মাঠের খালের ধারে পাঁচজনকে হত্যা করে চরমপন্থীরা। পাঁচ থেকে ছয় বছর আগে দুজনকে হত্যা করা হয়েছিল। আর একজনকে হত্যার পর লাশ ফেলে রাখা হয়েছিল। তাঁর মাথা পড়েছিল অন্য স্থানে। এসব ঘটনার কারণে ওই সড়কে মানুষজন খুবই আতঙ্কে চলাচল করেন। বিকেলের পর নিতান্তই বিপদ ছাড়া কেউ ওই সড়কে যান না।
স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, মাঠের মধ্যে ওই স্থানটি খুবই ভয়ংকর। দিনের বেলায় চলতেও তাঁরা ভয় পান। স্থানীয় এক কৃষক জানালেন, গত ২২ বছরে ওই এলাকায় অন্তত আটজনকে গুলি ও গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, শুক্রবার রাত আটটার দিকে তিনি পিয়ারপুর বাজারে থাকতে জানতে পারেন, রামচন্দ্রপুর গ্রামে যাওয়ার ওই সড়কে যাওয়া যাচ্ছে না। সেখানে নাকি অস্ত্র নিয়ে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। কাউকে যেতে দিচ্ছে না। এর ঠিক এক ঘণ্টা পর তিনটা গুলির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। রাত হওয়ায় তিনি বাড়িতে চলে যান। কী হয়েছে তা জানতেও চাননি, দেখতেও যাননি।
আরেক ব্যক্তি দাবি করেন, তাঁর বাড়ি রামচন্দ্রপুর গ্রামে। তাঁর এক আত্মীয় রাত সাড়ে আটটার দিকে পিয়ারপুর যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই সড়কে মাঠের মধ্যে লোকজন দাঁড়িয়ে ছিল বলে প্রবেশপথেই তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ জন্য তিনি আর যাননি।
দায় স্বীকারের বার্তা নিয়ে ধোঁয়াশা
ঘটনার পরপরই ঝিনাইদহে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হয়। বার্তায় উল্লেখ করা হয়, ‘তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কালু জাসদ গণবাহিনী।’ তবে ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে এই বার্তা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে যেমন আতঙ্ক ছড়িয়েছে, তেমনি ধোঁয়াশাও তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, ঘটনা অন্যদিকে মোড় দিতে হয়তো বার্তা পাঠানো হয়েছে।
এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কালুর বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আবদালপুর ইউনিয়নের পশ্চিম আবদালপুর গ্রামে। তিনি দীর্ঘ দুই যুগ ধরে এলাকায় থাকেন না। চরমপন্থী সংগঠনের শীর্ষ নেতা। তাঁর একটা নিজস্ব বাহিনী আছে। দীর্ঘদিন ভারতে আছেন। সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন বলেও জনশ্রুতি আছে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
শৈলকুপায় প্রতিপক্ষ তিনজনকে হত্যার পর চরমপন্থীদের দায় স্বীকার
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর মাঠের মধ্যে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা হানিফ আলীসহ তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাত ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। হত্যার বিষয়ে চরমপন্থী সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর নেতা কালু দায় স্বীকার করে গণমাধ্যমকর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠিয়েছেন।
চরমপন্থী নেতা কালু পরিচয় দিয়ে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনাবাসীর উদ্দেশে জানানো যাচ্ছে, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী কুখ্যাত ডাকাত বাহিনীর শীর্ষ নেতা অসংখ্য খুন, গুম, দখলদারী, ডাকাতি, ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হরিণাকুণ্ডুনিবাসী হানিফ তাঁর দুই সহযোগীসহ জাসদ গণবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন। এই অঞ্চলের হানিফের সহযোগীদের শুধরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো, অন্যথায় আপনাদের একই পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে।’
শৈলকুপা থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুম খান জানান, রামচন্দ্রপুর মাঠের মধ্যে তিনজনকে গুলি করে মারা হয়েছে। বিস্তারিত পরে বলা যাবে।
এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল রাতে এই এলাকায় তাঁরা একাধিক গুলির শব্দ শুনতে পান। পরে তাঁরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ইবি থানার পিয়ারপুর ও শৈলকুপায় রামচন্দ্রপুর গ্রামের মাঠের মধ্যে শ্মশানঘাট এলাকায় তিনজনকে গুলি করে হত্যার পর ফেলে রাখা হয়েছে। তাঁরা এগিয়ে গিয়ে দেখতে পান তিনজনের মৃতদেহ পড়ে আছে। পাশে তাঁদের ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল পড়ে আছে। যার নম্বর চুয়াডাঙ্গা ল ১২-০১২৩।
এলাকার বাসিন্দারা আরও জানান, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামের হানিফ আলী, তাঁর শ্যালক লিটন হোসেন রয়েছেন। একজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি। তাঁরা সবাই চরমপন্থী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনজুর মোরশেদ গতকাল দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে তাঁদের কীভাবে মারা হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।