তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন: কৃষক ও ভূমিহীনের কথা শুনবে কে
Published: 22nd, February 2025 GMT
উত্তরের জীবনরেখা তিস্তা নদী রক্ষায় পাঁচ জেলায় ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি হয়ে গেল। তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে এই কর্মসূচির নেতৃত্ব দিয়েছে বিএনপি। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (রংপুর বিভাগ) আসাদুল হাবিব (দুলু) ছিলেন এই কর্মসূচির প্রধান সমন্বয়কারী। ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’—স্লোগানে এ কর্মসূচি সাড়া ফেলেছে দেশ-বিদেশে। একটি ‘হারিয়ে যাওয়া’ বিষয় থেকে তিস্তা ইস্যু আবার সামনে এসেছে।
৪৮ ঘণ্টার এ অবস্থান কর্মসূচিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চ্যুয়ালি বক্তব্য দিয়েছেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের শীর্ষ নেতা ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা কয়েকটি দলের নেতারা এসেছেন। কর্মসূচি থেকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবি উঠেছে। কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিবেশী দেশ ভারতের পানি আগ্রাসন নীতির।
জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোয় তিস্তার পানির ন্যায্য অধিকারের বিষয়টি তুলে ধরতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতা। প্রয়োজনে সম্ভাব্য সব বিকল্প ভেবে দেখার কথা উঠেছে। কিন্তু তিস্তার প্লাবনভূমি ও চরের হাজার হাজার একর জমি যে ভূমিদস্যু কোম্পানিগুলো দখল করে নিচ্ছে, তাদের উচ্ছেদের দাবিটি ওঠেনি।
অথচ এটিও গুরুত্বপূর্ণ দাবি হওয়ার কথা ছিল। কারণ, তিস্তার অব্যাহত ভাঙনে জমি হারিয়ে চরের খাসজমিতে চাষাবাদ করা কৃষকেরা জমি হারাচ্ছেন। ভূমিহীন কৃষকেরা ভূমিদস্যু কর্তৃক উচ্ছেদ হচ্ছেন।
অবশ্য তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী আসাদুল হাবিব প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যাঁরা এসব চরে সৌরবিদ্যুৎসহ বিভিন্ন প্রকল্প করেছেন, তাঁরা স্বৈরশাসকের দোসর ছিলেন। জনগণের কাছে তাঁদের কোনো জবাবদিহি ছিল না। তাঁরা এই আন্দোলন করছেন, কৃষক ও তিস্তাপারের মানুষকে বাঁচানোর জন্য।
২.বড় কোম্পানিগুলো কীভাবে তিস্তাপারের জীবন-জীবিকাকে হুমকিতে ফেলেছে, তার একটি উদাহরণ তিস্তা সোলার লিমিটেড। গত বছরের ২ আগস্ট গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে দুই শ মেগাওয়াটের তিস্তা সোলার লিমিটেডের উদ্বোধন করেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের তারাপুর ইউনিয়নের লাটশালা ও চর খোর্দা মৌজার তিস্তার প্লাবনভূমির প্রায় এক হাজার একর জমিতে দেশের সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে বেক্সিমকোর গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো পাওয়ার লিমিটেড।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রকল্পটির আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, তিস্তা সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি নদীর তীরে বালুর বাঁধ নির্মাণ করে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে প্রকল্প স্থাপন করছে, যা পানি আইন ২০১৩–এর ২০ (১) ধারামতে সুস্পষ্ট লঙ্ঘন; তিস্তা একটি আন্তসীমান্ত নদী। এই নদীর প্লাবনভূমি রক্ষা করা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। এ নদীর তীরভূমি ও প্লাবনভূমি ব্যবহার করে এ প্রকল্প এবং অন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করা অবিবেচনাপ্রসূত।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের এই প্রকল্প এলাকার অবৈধভাবে নির্মিত বালুর বাঁধ (টিএসএল) ভেঙে দিতে ও উচ্ছেদ কাজের তদারকি করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলেছিল।
অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের বিপক্ষে উল্টো মতামত দেয় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়কে। পাউবোর প্রতিবেদনে বলা হয়, মাননীয় বিদ্যুৎমন্ত্রীসহ (তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ও প্রতিষ্ঠানের যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা এই প্রকল্প অনুমোদন লাভ করেছে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কর্তৃক ওই প্রকল্পকে অবৈধ বলার আগে বিষয়টি সম্পর্কে সঠিকভাবে জেনে নেওয়া উচিত ছিল।
৩.রংপুরের গঙ্গাচড়ার ছালাপাকে দেশের বড় একটি শিল্প গ্রুপ তিস্তার চরের জমিতে কারখানা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। শিল্প গ্রুপটির প্রস্তাবিত কারখানা হওয়ার কথা পাউবোর ডান তীর রক্ষা বাঁধের ভেতরে। নদীর ভেতরে শিল্পকারখানা স্থাপনের ছাড়পত্র দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
শিল্প গ্রুপটি তিস্তার চরাঞ্চলে মানুষের কয়েক শ একর জমি কিনেছে বলে এলাকায় আলোচনা আছে। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের কাছে শিল্প গ্রুপটি প্রতীকী মূল্যে প্রায় এক হাজার একর জমি বন্দোবস্ত চেয়েছিল, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
ছালাপাকের স্থানীয় কৃষকেরা বলছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তন না হলে তিস্তার খাসজমি এত দিনে ওই শিল্প গ্রুপটির গ্রাসে চলে যেত। কোম্পানির লোকজনের ভয়ে ও বাধায় গত বছর তাঁরা জমিতে নামতে পারেননি।
অথচ এই সম্পত্তিতে বংশপরম্পরায় এই এলাকার মানুষজন চাষাবাদ করে আসছেন। পূর্বপুরুষের কাছ থেকে ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া জমিতে ধান, আলু, মিষ্টিকুমড়া, চিনাবাদাম, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি ফসল উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর কৃষকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছেন, অনুমোদনকৃত জমির অধিকাংশ নদীর বাঁধ তীরবর্তী জমি এবং এসএস রেকর্ডে নদী শ্রেণি রয়েছে। এই কোম্পানি কর্তৃক জোর করে জমি দখল এবং জমি বিক্রি বাবদ পাওনা বুঝে না পাওয়ার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক। কৃষিজমিকে অকৃষি খাতে ব্যবহারের জন্য জেলা প্রশাসকের অনুমোদন নিতে হয়। রংপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক নদীর মধ্যে কারখানা স্থাপনের অনুমতি দিয়েছেন। তাহলে নদী, কৃষক ও ভূমিহীনের স্বার্থ দেখবে কে? ওই জেলা প্রশাসককে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে না কেন?
পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের তিস্তা নদীঘেঁষা ভোটমারী ইউনিয়নের শৌলমারীতে তিন বছর আগে তিস্তা নদীর ভেতরে ৩০ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ওই কোম্পানির বিরুদ্ধেও নদীর চরের কয়েক শ একর জমি দখলের অভিযোগ করে আসছেন কৃষকেরা।
মূলত ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে তিস্তা নদীর চারদিকে এখন ধু ধু বালুচর। এ কারণে ভূমিদস্যুদের চোখ এখন তিস্তার দিকে। রংপুর বিভাগের ডিমলা, হাতীবান্ধা, জলঢাকা, গঙ্গাচড়া, কালীগঞ্জ ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তিস্তার চরগুলোয় বিভিন্ন কোম্পানি স্থানীয় দালাল, প্রশাসন ও দুর্বৃত্তদের ব্যবহার করে কৃষকদের জমি কেড়ে নিচ্ছে।
৪.তিস্তাপারের মানুষ চায় নদীভাঙন রোধ। ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচিতে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন এই নদীভাঙনের শিকার ও ভূমিহীন। তাঁরা তিস্তা মহাপরিকল্পনা বোঝেন না। বোঝেন, নদী খনন করা হলে গভীরতা বাড়বে। দুই তীরে বাঁধ দিলে নদীভাঙন রোধ হবে। কৃষকের খেতের ফসলও আর নষ্ট হবে না।
ভারতের হঠাৎ পানি ছেড়ে দেওয়া নদীভাঙনের অন্যতম কারণ। তবে তিস্তার ভেতরে ও প্লাবনভূমিতে গড়ে ওঠা এসব প্রকল্পও কম দায়ী নয়। কুড়িগ্রামের তিস্তায় গত কয়েক বছর থেকে যে তীব্র ভাঙন, তার একটি কারণ তিস্তা সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, তিস্তা সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কুড়িগ্রামের উলিপুরের বিস্তৃত অঞ্চল ভাঙনের সম্মুখীন হবে। অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ড আশঙ্কা নাকচ করে বলেছিল, মরফলজিক্যাল পরিবেশে তা (নদীভাঙন) যথাযথ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। তবে যদি প্রমাণিত হয়, এর কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, তবে শর্ত মোতাবেক তিস্তা সোলার লিমিটেড তা মেরামত করে দেবে।
গত কয়েক বছর উলিপুরের বজরা ও কাশিমবাজার এলাকার কিলোমিটারের পর কিলোমিটার এলাকা তিস্তায় বিলীন হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই সব কর্মকর্তার ভাঙন রোধে অবহেলার কারণে। তাঁদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত।
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে স্থাপিত সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রে যাতায়াতের জন্য নদীর ওপর আড়াআড়িভাবে প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা হয়। নদীর গলা চিপে ধরে সংকুচিত করা হয় বেইলি ব্রিজ বানানোর জন্য। ওই সব কারণে ২০২৩ সালে ভোটমারী, শৈলমারী ও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক নদীভাঙন হয়। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, ‘নদী, তুমি কোন কথা কও?’ তিস্তার আর্তনাদ কে শুনবে?
৫.নদী ও নদীপারের মানুষের প্রতি অনাচার বুঝি শেষ হবে না। সরকারের কৃষি খাসজমি বন্দোবস্ত নীতিমালায় স্পষ্ট ভূমিহীনের অধিকারের কথা বলা আছে। কিন্তু নদীভাঙা মানুষ খাসজমি বন্দোবস্ত পায় না। পায় ওই সব কোম্পানি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন সৌরবিদ্যুতের ওই কোম্পানিকে ৫৮ একর খাসজমি বন্দোবস্ত দিয়েছে।
তবু নদীপারের কৃষক ও ভূমিপুত্ররা রুখে দাঁড়াচ্ছেন, লড়াই করছেন। সুন্দরগঞ্জের লাটশালা ও চর খোর্দা মৌজায় কৃষকেরা বাপ-দাদার ফসলি জমি ও বাস্তুভিটা রক্ষায় ‘বাস্তুভিটা ও আবাদি জমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’র ব্যানারে লড়াই করেছেন। স্থানীয় দালাল, দলীয় ক্যাডার, পুলিশ প্রশাসন, ভূমি অফিসের দালাল কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমের একটা অংশ বিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁদের কোণঠাসা করতে পারেনি। আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ পুলিশ মামলা দিয়ে ১০ জন নারী-পুরুষকে কারাগারে পাঠায়। ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল পুলিশের এলোপাতাড়ি আক্রমণ ও গুলিতে আহত কৃষক নেতা মোজাফফর মণ্ডল, সরফুন্নেছা, মুক্তি বেগম, আর্জিনা, রুপিয়া, রেজাউলের রক্তে চর খোর্দার মাটি লাল হয়ে আছে।
কৃষক বিদ্রোহের ভূমি রংপুর। কৃষক সমাজের প্রথম ও প্রধান মূল্যবোধ হচ্ছে জমি। তবু পুঁজিবাদী উন্নয়নের স্বার্থে কৃষক উচ্ছেদ চলছে। তিস্তাপার থেকে কৃষকেরা চরাঞ্চলে ভূমিদস্যু ব্যক্তি ও কোম্পানিকে উৎখাত করার দাবি তুলেছেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সরকারকে কৃষক ও ভূমিহীনের কথা শুনতে হবে।
জহির রায়হান প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ন দরগঞ জ প ল বনভ ম ব এনপ র প রকল প র জন য বল ছ ল সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ইউক্রেনে ট্রাম্পের ১০০ দিনের ব্যর্থতা
ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিরে আসার প্রায় ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের ওপর আঘাত হানছে। ট্রাম্প ‘প্রথম দিনেই’ যুদ্ধ বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো কোনো শান্তির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। প্রশ্ন হলো, ট্রাম্প প্রশাসন কবে স্বীকার করবে যে তারা ব্যর্থ হচ্ছে?
শুরুতে ট্রাম্পের দাবি ছিল খুব সহজ, ‘যুদ্ধ থামাও, আলোচনায় বসো।’ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে প্রথম ফোনালাপের পর তিনি বলেছিলেন, খুব দ্রুত যুদ্ধ বন্ধ হবে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও সেই সম্ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
কিন্তু এরপর যা ঘটেছে, তা হলো পুতিন ও তাঁর ক্রেমলিনের ছোট একটি দল ট্রাম্পের অনভিজ্ঞ আলোচক স্টিভ উইটকফকে এমন এক জটিল ও অসম্ভব শর্তের গোলকধাঁধায় ফেলেছেন, যেখান থেকে বেরোনো কঠিন। এত দিন ধরে এই নাটক চলার পর এমনকি সবচেয়ে বোকা আলোচকেরও বোঝার কথা, পুতিনের যুদ্ধ থামানোর কোনো ইচ্ছা নেই। তিনি ট্রাম্পের পরিকল্পনা বা সময়সূচিও মানবেন না।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুতিন যখন ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় হামলা শুরু করেন, তখন থেকেই তিনি মূলত রুশ সামরিক শক্তির ওপর ভরসা করেছিলেন, যাতে তিনি ইউক্রেনের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। প্রথমে তাঁর সেনাবাহিনীতে প্রায় দুই লাখ ভাড়াটে সৈনিক ছিলেন। এরপর তিনি কয়েক দফা আংশিক মোতায়েন এবং বিশাল আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে সেনাসংখ্যা বাড়িয়ে তা প্রায় ছয় লাখে নিয়ে যান।
এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার সাত–আট লাখ সেনা হতাহত হয়েছেন, যার মধ্যে দুই লাখের বেশি নিহত হয়েছেন। এত বড় ক্ষয়ক্ষতির পরও কথিত শক্তিশালী রুশ সেনাবাহিনী এখন ইউক্রেনের আগের চেয়ে কম ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে। সুনির্দিষ্টভাবে বললে, মাত্র ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ ভূখণ্ড রুশ সেনারা নিয়ন্ত্রণ করছে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সামরিকভাবে পুতিনের যুদ্ধকে এক ভয়াবহ ব্যর্থতা বলা যেতে পারে। হয়তো তিনি এখনো বিশ্বাস করেন, তাঁর বাহিনী ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে কোনো না কোনো বড় সাফল্য অর্জন করবে। কিন্তু নিরপেক্ষ বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এর সম্ভাবনা খুবই কম।
রাশিয়া হয়তো ইউক্রেনের তুলনায় যুদ্ধে বেশি সংখ্যায় সেনা পাঠাতে পারবে, বেশি বোমাও ফেলতে পারবে, কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে থাকা সেনাদের মধ্যে লড়াই করার মানসিকতা জাগিয়ে তুলতে পারবে না। এখন পর্যন্ত দেখা গেছে, আত্মরক্ষা যত সহজ, আক্রমণ করা ঠিক ততটাই কঠিন। এর মানে দাঁড়ায়, শেষ পর্যন্ত পুতিন কোনো ধরনের বিজয়ের ছবি তুলে ধরতে চাইলে তাঁকে রুশ সেনাবাহিনীর চেয়ে ট্রাম্পের ওপর বেশি ভরসা করতে হবে।
তাত্ত্বিকভাবে ট্রাম্প চাইলে নিজেই নিজের অবস্থান বদলে পুতিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন এবং ইউক্রেনকে আরও সহায়তা দিতে পারেন। যদি তিনি এটা করেন, তাহলে হয়তো সেই যুদ্ধবিরতি আদায় করতে পারবেন, যার প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। তা না হলে তিনি ব্যর্থই হবেন, আর পুতিন ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা তাঁর পেছনে বসে হেসেই যাবেন।এ কারণে ট্রাম্পকে প্রভাবিত করার জন্য পুতিন তাঁর হাতে থাকা সব কৌশল কাজে লাগাচ্ছেন। সবাই জানে, ট্রাম্প প্রশংসায় দুর্বল হয়ে পড়েন। আর সেই সুযোগ নিয়েই পুতিন বাড়াবাড়ি রকমের চাটুকারিতা করছেন। তিনি দাবি করেছেন, ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ‘চুরি’ হয়েছিল এবং যদি ট্রাম্প তখন ক্ষমতায় থাকতেন, তাহলে এই যুদ্ধ কখনোই হতো না।
এমনকি পুতিন বলেছেন, ২০২৪ সালে ট্রাম্পের ওপর হামলার পর তিনি তাঁর ব্যক্তিগত প্রার্থনাকক্ষে গিয়ে ট্রাম্পের জন্য প্রার্থনা করেছেন। শুধু তা–ই নয়, তিনি ক্রেমলিনের দরবারি শিল্পীকে দিয়ে ট্রাম্পের একটি প্রতিকৃতি আঁকিয়ে তা উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন।
শুধু প্রশংসা নয়, পুতিন ট্রাম্প ও তাঁর প্রতিনিধি স্টিভ উইটকফকে ব্যবসার প্রলোভনও দেখাচ্ছেন। রিয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রথম আলোচনায় পুতিনের দল একটি বিশাল বিনিয়োগ সম্ভাবনার তালিকা নিয়ে আসে, যেগুলো নাকি বাস্তবায়ন করা হবে যদি ট্রাম্প ইউক্রেনকে ছেড়ে দেন এবং রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।
উইটকফ জানিয়েছেন, পুতিনের সঙ্গে তাঁর সাম্প্রতিক বৈঠকের একটি বড় অংশ এই বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়েই আলোচনা হয়েছে।
আরও পড়ুনট্রাম্পকে রুখতে চীন-ইউরোপ কি হাত মেলাবে১৯ এপ্রিল ২০২৫দুই ধরনের কৌশলই স্পষ্টভাবে কাজ করেছে। পুতিন জানেন, কীভাবে কাজ করতে হয় এবং তিনি জানেন, কার সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। এখন পর্যন্ত কোনো যুদ্ধবিরতি হয়নি এবং পুতিন যে এমন কিছুতে রাজি হবেন, তার কোনো লক্ষণও নেই। তিনি নির্দ্বিধায় ইউক্রেনের শহরগুলোতে বেসামরিক লক্ষ্যে হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই তথাকথিত আলোচনায় ক্রেমলিন মূলত দুটি দাবি তুলেছে। প্রথম দাবি হলো, ইউক্রেন যেন লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন—এই চারটি অঞ্চল রাশিয়ার হাতে তুলে দেয়। উইটকফ এ বিষয়ে ইতিমধ্যে একপ্রকার রাজিও হয়ে গেছেন: যুক্তরাষ্ট্র নাকি রাশিয়ার দখল করা এই চার অঞ্চলের ওপর রাশিয়ার মালিকানা মেনে নিতে প্রস্তুত।
কিন্তু রাশিয়া এখনো এ চার অঞ্চলের পুরোটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি।
জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসনের আঞ্চলিক রাজধানীগুলোতে (যেখানে যুদ্ধের আগে এক মিলিয়ন লোকের বসবাস ছিল) এখনো ইউক্রেনীয় পতাকা উড়ছে। কিয়েভের কোনো সরকার এসব শহর হেলায় ছেড়ে দিলে টিকে থাকতে পারবে না। হয়তো ইউক্রেন বর্তমান যুদ্ধরেখাকে কেন্দ্র করে একধরনের ‘জমে থাকা’ সংঘাত মেনে নিতে পারে, কিন্তু এর চেয়ে বেশি নয়।
রাশিয়ার দ্বিতীয় দাবি হলো, ইউক্রেনের ওপর নিরাপত্তাগত কর্তৃত্ব বজায় রাখা। অর্থাৎ ভবিষ্যতে ইউক্রেনে পশ্চিমা সামরিক উপস্থিতি বা সহায়তা যেন না থাকে। ট্রাম্প ইতিমধ্যেই ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ ন্যাটো সদস্য পদ প্রশ্নে হার মানিয়েছেন এবং তিনি সম্ভবত পুতিনকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সহায়তা পুরোপুরি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতিও দিতে যাচ্ছেন।
কিন্তু এখানেই ইউরোপীয়দের ভূমিকা শুরু হয়। পুতিন ও ট্রাম্প—দুজনেই ইউরোপীয়দের আলোচনার টেবিলে আনতে চাননি। কিন্তু এটাই ভালো হয়েছে। ইউরোপীয়রা যদি ইউক্রেনকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থানে থাকেন, তাহলে পুতিন ও ট্রাম্প যা-ই নিয়ে নিজেদের মধ্যে একমত হোন না কেন, তা বাস্তব মাটিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
এ অবস্থায় ইউরোপের হাতে রয়েছে সবচেয়ে বড় তাস। যদি তারা রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে পারে, তাহলে ইউক্রেনকে ‘মিউনিখ চুক্তি’র মতো লজ্জাজনক বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব। ইউরোপীয় নেতাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া উচিত, যেভাবেই হোক তাঁরা ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে তাদের সহায়তা অব্যাহত রাখবেন।
তাত্ত্বিকভাবে ট্রাম্প চাইলে নিজেই নিজের অবস্থান বদলে পুতিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন এবং ইউক্রেনকে আরও সহায়তা দিতে পারেন। যদি তিনি এটা করেন, তাহলে হয়তো সেই যুদ্ধবিরতি আদায় করতে পারবেন, যার প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। তা না হলে তিনি ব্যর্থই হবেন, আর পুতিন ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা তাঁর পেছনে বসে হেসেই যাবেন।
● কার্ল বিল্ডট সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ