শ্রীলঙ্কায় হাতিদের প্রধান ‘অনাথ আশ্রমের’ ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত রোববার এদের জন্য ফলের এক বিশাল ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। আশ্রমটি বিশ্বে এ ধরনের প্রাণীদের প্রথম সেবাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।

‘অনাথ আশ্রম’টির নাম পিন্নাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফানেজ। পর্যটকদের কাছে এটি অন্যতম একটি আকর্ষণের জায়গা। গত রোববার এ আশ্রম প্রাঙ্গণ কলা, তরমুজ ও শসায় ভরে গিয়েছিল।

প্রতিদিন এ আশ্রমের হাতিগুলোকে নদীতে নিয়ে গোসল করানো হয়। রোববারও এদের গোসলের জন্য নদীতে নেওয়া হয়। আশ্রমে থাকা চার প্রজন্মের হাতি নিকটবর্তী মহা ওয়া নদীতে গোসল করে। সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপনে আমন্ত্রিত কয়েকজন কর্মকর্তা এবং পর্যটককে দুধভাত ও ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি পরিবেশন করা হয়।

আশ্রমটির প্রধান কিউরেটর সঞ্জয়া রত্নানায়েকে বলেন, ‘১৯৮৪ সালে এ অনাথ আশ্রমে প্রথম হস্তীশাবকের জন্ম হয়। তখন থেকে এ পর্যন্ত মোট ৭৬টি হাতির জন্ম হয়েছে।’ তিনি এ উদ্যোগকে একটি সফল প্রজনন কর্মসূচি বলেও উল্লেখ করেন।

সঞ্জয়া রত্নানায়েকে আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের এখানে চার প্রজন্মের হাতি রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোটটির বয়স ১৮ মাস ও বড়টির বয়স ৭০ বছর।’

২০২১ সালের আগস্টে আশ্রমটিতে প্রথমবারের মতো যমজ হস্তীশাবক জন্ম নেয়। এশীয় হাতির ক্ষেত্রে যমজ শাবক জন্মানোর ঘটনা বিরল। দুটো হস্তীশাবকই ভালো আছে।

১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে হাতির ‘অনাথ আশ্রম’টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর দুই বছর আগে থেকে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বেনটোটার একটি ছোট সেবাকেন্দ্রে পাঁচটি অনাথ হাতিকে লালন–পালন করা হচ্ছিল।

রত্নানায়েকে বলেন, ‘১৯৭৫ সালে পিন্নাওয়ালায় একটি নারকেলবাগানে আশ্রমটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই প্রাণীরা বিচরণের জন্য আরও বেশি জায়গা ও ভালো পরিবেশে পায়। আশপাশের এলাকায় তখন প্রচুর খাবারও পাওয়া যেত।’

হাতিদের ক্ষুধা মেটাতে এ আশ্রমে ১৪ হাজার ৫০০ কেজি নারকেল এবং পামসহ ও অন্যান্য গাছের পাতার প্রয়োজন হয়।

শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার (৫৬ মাইল) পূর্বে আশ্রমটির অবস্থান। সেখানকার কর্তৃপক্ষ হস্তীশাবকদের জন্য টন টন ফল ও দুধও কিনে রাখে। বিদেশি ও স্থানীয় দর্শনার্থীদের কাছে হস্তীশাবকগুলো খুব পছন্দের।

এ আশ্রম শ্রীলঙ্কার রাজস্ব আয়েরও অন্যতম বড় উৎস। সেখান থেকে প্রতিবছর প্রবেশ ফি হিসেবে লাখ লাখ ডলার আয় হয়। দর্শনার্থীরা দূর থেকে হাতিদের দেখতে পারেন, কাছেও আসতে পারেন। স্নানের সময় হাতিদের গা ঘষতে সাহায্য করতে পারেন তাঁরা।

সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আশ্রমে উপস্থিত হয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মাহুত কে জি সুমানাবন্দ। এএফপিকে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠার সময় এ আশ্রমে পানি ও বিদ্যুতের অভাব ছিল। পরবর্তী বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।

হাতি লালন–পালনকারী হিসেবে তিন দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন সুমানাবন্দ। ৬০ জনের বেশি মাহুতকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। এখনো বিভিন্ন মন্দির ও অন্যান্য জায়গার হাতি লালন–পালনকারীরা তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে থাকেন।

২০ বছর আগে শ্রীলঙ্কার কর্তৃপক্ষ দেশের দক্ষিণে আরেকটি হাতির আশ্রম খোলেন। সেখানে অনাথ, পরিত্যক্ত বা আহত হাতিদের যত্ন নেওয়া হয় এবং পরে এদের বনে ফেরত পাঠানো হয়।

পিন্নাওয়ালা আশ্রমটিকে অনেকে সফল এক উদ্যোগ হিসেবে দেখছেন। এরপরও শ্রীলঙ্কায় বন্য প্রাণীদের ঐতিহ্যবাহী অভয়ারণ্যগুলোর সীমান্তবর্তী এলাকায় মানুষ ও হাতির মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ঘটছে।

পরিবেশ উপমন্ত্রী আন্তন জয়াকোড়ি রোববার এএফপিকে বলেন, ২০২৩ সালে এমন সংঘাতে ৪৫০টি হাতি মারা যায়। এ ছাড়া ১৫০ জন নিহত হন। আগের বছর ৪৩৩টি হাতি ও ১৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

শ্রীলঙ্কায় হাতি হত্যা বা হাতির ক্ষতি করা ফৌজদারি অপরাধ বলে বিবেচিত। দেশটিতে আনুমানিক সাত হাজার বন্য হাতি রয়েছে এবং সেখানে হাতিকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বৌদ্ধ সংস্কৃতিতে হাতির গুরুত্ব থাকা এর একটি কারণ বলে মনে করা হয়।

তবে হাতি হত্যা থামছেই না। হাতি ফসলের খেত নষ্ট করে দেওয়ায় কৃষকেরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। উপমন্ত্রী আন্তন জয়াকোড়ির দৃঢ় বিশ্বাস, নতুন সরকার গ্রামে হাতিদের প্রবেশ বন্ধ করে সমস্যাটি মোকাবিলা করতে পারবে।

আন্তন জয়াকোড়ি এএফপিকে বলেন, বন্য হাতিদের গ্রামে প্রবেশ করা কঠিন করে তুলতে তাঁরা বৈদ্যুতিক বেড়া, পরিখাসহ একাধিক বেষ্টনি তৈরির পরিকল্পনা করছেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

‘সাংগ্রাইমা ঞি ঞি ঞা ঞা রি ক্যাজাইকে পা-মে্’ সাংগ্রাইয়ের প্রাণ

পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি তিন জেলায় চলছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায় উৎসব সাংগ্রাই। এ উৎসব ঘিরে পাহাড়ি জনপদের প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় বেজে উঠেছে এক পরিচিত সুর ‘সাংগ্রাইমা ঞি ঞি ঞা ঞা রি ক্যাজাইকে পা-মে্’। 

মারমা ভাষায় লেখা একটি গানের প্রথম লাইন এটি। এর বাংলা অর্থ হলো ‘এসো হে সাংগ্রাইতে সবাই মিলেমিশে একসাথে পানি খেলি।’

মারমা জনগোষ্ঠীর সাংগ্রাইং উৎসবের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে আছে ‘মৈতা রিলং পোয়ে’ বা ‘মৈত্রী পানিবর্ষণ উৎসব’। এই উৎসবে পরস্পরের দিকে পানি ছিটিয়ে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হন মারমারা। ‘সাংগ্রাইমা ঞি ঞি ঞা ঞা রি ক্যাজাইকে পা-মে্’ (এসো হে সাংগ্রাইতে সবাই মিলেমিশে একসাথে পানি খেলি) গানটিও দীর্ঘদিন ধরে হয়ে আছে এই উৎসবের ‘থিম সং’।

মারমা জনগোষ্ঠীর প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে মৈত্রী পানিবর্ষণ উৎসবের শুরু গত শতকের সত্তরের দশকে। কিছু তরুণ মিয়ানমারে সাংগ্রাই উৎসবে এ ধরনের আয়োজন দেখে দেশেও এর প্রচলন শুরু করেন। আর ‘সাংগ্রাইমা ঞি ঞি ঞা ঞা রি ক্যাজাইকে পা-মে্’ গানটি আশির দশক থেকে উৎসবের থিম সং হয়েছে আসছে।

মারমা ভাষার এই গান শুধু মারমা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি এখন একটি সর্বজনীন প্রিয় গান। চাকমা, চাক, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, ম্রো, খিয়াংসহ পাহাড়ি-বাঙালি সবার কাছেই এ গান অত্যন্ত প্রিয় ও হৃদয়স্পর্শী। গানে যেমন ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার কথা বলা আছে, তেমনি বর্ষবরণের আনন্দের কথাও উঠে এসেছে।

গানে বলা আছে, ‘‘আসো ভাই- বোনেরা ঐতিহ্যের পানি খেলা করি/ পানি যেভাবে শরীরকে পরিষ্কার করে, তেমনি পুরোনো বছরের ভুল, দুঃখ ও গ্লানি দূর করে মনের মাঝে বিশুদ্ধতা ও নির্মলতা এনে দেয়/ আসো আমরা সেই উদ্দেশ্যেই পানি খেলি/ নতুন বছর আসছে, আসো পূণ্যের কাজ করি/ যে পূণ্য আমাদের আগামী দিনগুলোকে সুন্দর করে তুলবে/ মন্দিরে গিয়ে পঞ্চ শীল গ্রহণ করব, বুদ্ধ পূজা করব, গুরুজনদের শ্রদ্ধা জানিয়ে পূণ্যের পথে চলব।” 

এই গানটির ইতিহাসও বেশ পুরোনো। গানের গীতিকার ও সুরকার হলেন প্রয়াত উ পঞ্ঞা জোত মহাথের ওরফে উচহ্লা ভান্তে। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন এ গানের পেছনের গল্প। সালটা ছিল ১৯৭৫, তখন বান্দরবান সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন তিনি কলেজে পড়তেন। সেই সময় সাংগ্রাই উৎসবের আগে তাঁর মনে দোলা দেয় সাংগ্রাইকে কেন্দ্র করে একটি গান লেখা দরকার, কারণ এটি শুধু মারমা সম্প্রদায়ের নয় বরং সমগ্র বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর প্রাণের উৎসব। তখন বান্দরবানের বোমাং রাজবাড়ীর পুকুরপাড়ে এক টুকরো কাগজ, কলম ও গিটার নিয়ে বসে গানটি রচনা করেন তিনি।

প্রথমে গানটি সাংগ্রাই উৎসবে মানুষের মুখে মুখে গাওয়া হত। পরে বান্দরবান বেতারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এই গান মানুষ মুখে মুখে গেয়ে সাংগ্রাই উৎসবে মেতে উঠত। ১৯৯৯ সালে বান্দরবান মারমা শিল্পী গোষ্ঠীর শিল্পীরা গানটি অডিও রেকর্ড করেন। এরপর থেকে সাংগ্রাই উৎসব এলেই এই গানের সুর ছড়িয়ে দেয় আনন্দের আমেজ এবং তুলে ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উচ্ছ্বাস।

চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এই গানটি সাংগ্রাই উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। প্রতিবারের মতো এবারও জলকেলি বা মৈত্রীয় পানি বর্ষণের উৎসবে সব বয়সের মানুষ এ গানের তালে তালে নেচে-গেয়ে আনন্দে মেতে উঠবে। সাংগ্রাই ও এই গান যেন একে অপরের পরিপূরক।

মারমা শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও মারমার সংগীত শিল্পী চথুইপ্রু মারমা বলেন, “সাংগ্রাইমা ঞি ঞি ঞা ঞা রি ক্যাজাইকে পা-মে্’ গানটি রচিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। সেই সময় থেকেই গানটি গ্রাম থেকে গ্রামে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এবং মৈত্রী পানি বর্ষণ উৎসবের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। ১৯৯৯ সালে মারমা শিল্পীগোষ্ঠীর অডিও ক্যাসেট প্রকাশের পর গানটি আরও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। সাংগ্রাই উৎসব এলেই এই গানটির সুরে ও তালে মেতে ওঠে সবাই। গানটি যেন উৎসবের আবহ তৈরি করে। এই গান শুনলেই মন ভরে যায়, প্রাণ জেগে ওঠে সাংগ্রাই উৎসবের আনন্দে।”

আজও এই গান দিয়েই শুরু হয় মৈত্রী পানি বর্ষণ উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এটি শুধুমাত্র একটি গান নয়, বরং সাংগ্রাই উৎসবের আনন্দের প্রতীক।

ঢাকা/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘সাংগ্রাইমা ঞি ঞি ঞা ঞা রি ক্যাজাইকে পা-মে্’ সাংগ্রাইয়ের প্রাণ