লুণ্ঠিত অস্ত্র–গুলি অপরাধীদের হাতে
Published: 22nd, February 2025 GMT
চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে পুলিশ চট্টগ্রাম শহরে দুটি অভিযান চালিয়ে অস্ত্র, গুলিসহ ছয় ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে, তাঁরা ছিনতাইকারী এবং উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও গুলি চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানা থেকে লুট করেছেন। গত বছরের ২৯ আগস্ট বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় মো. আনিছ নামের এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ পাঁচটি গুলির খোসা ও অস্ত্র বহনের একটি ব্যাগ আলামত জব্দ করে। পুলিশ জানায়, উদ্ধার করা গুলির খোসায় পুলিশ লেখা রয়েছে।
গত বছরের ১৪ নভেম্বর গোপন তথ্যের ভিত্তিতে কোস্টগার্ড সদস্যরা কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়নের মোহাম্মদ শাহ ঘোনা এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি পিস্তলসহ জিয়াউর রহমান নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেন। জিজ্ঞাসাবাদে জিয়াউর পুলিশকে বলেন, তিনি ডাকাত সরদার। এর আগে তিনি অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করলেও চট্টগ্রামে পুলিশের স্থাপনা থেকে পিস্তল লুট করে আবার ডাকাতি করছেন।
জেল থেকে পালানো ৭০০ আসামিকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। তাঁদের মধ্যে ১০০ জন নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করা হচ্ছে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো.মোতাহের হোসেন, মহাপরিদর্শক, কারা অধিদপ্তর
এর আগে গত বছরের ৩০ নভেম্বর মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার দোগাছি এলাকায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের সার্ভিস লেন থেকে শাহিদা আক্তার (২২) নামের এক তরুণীর গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ ওই ঘটনায় শাহিদার কথিত বন্ধু তৌহিদ শেখ ওরফে তন্ময়কে গ্রেপ্তার করে। ঢাকার ওয়ারী থানা থেকে লুট করা পিস্তল দিয়ে শাহিদাকে গুলি করে হত্যা করেন তৌহিদ। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যায় ব্যবহৃত পিস্তলটি উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশের লুট হওয়া বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ অপরাধীদের হাতে চলে গেছে। এখনো ১ হাজার ৩৯২টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২ লাখ ৬০ হাজার ৫৩১টি গোলাবারুদ উদ্ধার হয়নি।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, দেশে ৬৬৪টি থানা আছে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন থানা-ফাঁড়ি, পুলিশ বক্সসহ বিভিন্ন ইউনিট-স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় থানা-পুলিশের কাজে ব্যবহৃত গাড়ি। এসব স্থাপনা থেকে ৫ হাজার ৭৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬ লাখ ৫১ হাজার ৬০৯টি গোলাবারুদ লুট হয়। লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদের মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের রাইফেল, এসএমজি (স্মল মেশিনগান), এলএমজি (লাইট মেশিনগান), পিস্তল, শটগান, গ্যাসগান, কাঁদানে গ্যাস লঞ্চার, কাঁদানে গ্যাসের শেল, কাঁদানে গ্যাসের স্প্রে, সাউন্ড গ্রেনেড ও বিভিন্ন বোরের গুলি।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশের লুট হওয়া বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ অপরাধীদের হাতে চলে গেছে। এখনো ১ হাজার ৩৯২টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২ লাখ ৬০ হাজার ৫৩১টি গোলাবারুদ উদ্ধার হয়নি।লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর যৌথ অভিযান শুরু হয়। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, এ অভিযানে গত ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৫৮টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৩ লাখ ৯১ হাজার ৪৩৮টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। তবে এখনো ১ হাজার ৩৯২টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২ লাখ ৬০ হাজার ৫৩১টি গোলাবারুদ উদ্ধার হয়নি।
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. আকরাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্রের বেশির ভাগ উদ্ধার হয়েছে। পুলিশের খোয়া যাওয়া কিছু অস্ত্র আবার খাল–বিলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বাকি অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে অভিযান চলছে। লুট করা অস্ত্র নিয়ে কেউ যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে, সে ব্যাপারে পুলিশ তৎপর রয়েছে।
লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধীদের হাতে
কক্সবাজারের মহেশখালীর ডাকাত জিয়াউর পাঁচ বছর আগে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণের পর এখন আবার অপরাধে নেমেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি হত্যাসহ অন্তত ১৪টি মামলা রয়েছে।
১৫ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (সদ্য প্রত্যাহার হওয়া) মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, লুট হওয়া পুলিশের একটি পিস্তল ডাকাত সরদার জিয়াউরের হাতে গেছে বলে জানার পর গত ১৪ নভেম্বর কোস্টগার্ডের গার্ডের কর্মকর্তারা সেটি উদ্ধার করেন এবং তাঁকে আটক করেন। কোস্টগার্ড জানায়, জিয়াউর স্বীকার করেন যে ৫ আগস্ট থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র সংগ্রহ করে আবারও ডাকাতিতে নামেন তিনি।
গত ২৫ জানুয়ারি চট্টগ্রাম শহরের ডবলমুরিং থানার ঝরনাপাড়ায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে ১৬টি গুলি, ১টি রাবার বুলেটসহ শাহাবুদ্দীন, শাহ জামালসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। এ ছাড়া ১৫ ফেব্রুয়ারি ডবলমুরিং থানার চৌমুহনী এলাকার চারিয়া পাড়ায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ একটি এলজিসহ (লোকাল গান) তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম ইউসুফ শান্ত (২৫) ও অপর দুজন বয়সে কিশোর।
পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্রের বেশির ভাগ উদ্ধার হয়েছে। পুলিশের খোয়া যাওয়া কিছু অস্ত্র আবার খাল–বিলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বাকি অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে অভিযান চলছে। লুট করা অস্ত্র নিয়ে কেউ যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে, সে ব্যাপারে পুলিশ তৎপর রয়েছে।পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. আকরাম হোসেনগত সোমবার যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী রফিক প্রথম আলোকে বলেন, উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও গুলি ডবলমুরিং থানা থেকে লুট হওয়া এবং গ্রেপ্তার ছয়জনই ছিনতাইকারী। তাঁরা থানা থেকে লুট করা অস্ত্র ও গুলি নিয়ে ছিনতাইয়ের চেষ্টা করছিলেন।
গত বছরের ১২ আগস্ট রাতে ফেনী মডেল থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র, গুলিসহ মো. রুবেল নামের এক যুবককে শহরের শাহীন একাডেমি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই রাতে সেখানে অস্ত্র বিক্রি করতে গেলে পুলিশ খবর পেয়ে রুবেলকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁর কাছ থেকে ১টি নাইন এমএম পিস্তল, ১৪টি গুলি ও ২টি ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়। ৫ আগস্ট ফেনী থানায় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের সময় রুবেল ওই অস্ত্র ও গুলি লুট করার কথা স্বীকার করেন।
গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বরে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে গোলাগুলি-হত্যাকাণ্ডের পর উদ্ধার হওয়া পিস্তল-রিভলবারগুলো থানায় জমা রাখা সাধারণ মানুষের হতে পারে পুলিশ ধারণা করছে।
উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও গুলি ডবলমুরিং থানা থেকে লুট হওয়া এবং গ্রেপ্তার ছয়জনই ছিনতাইকারী। তাঁরা থানা থেকে লুট করা অস্ত্র ও গুলি নিয়ে ছিনতাইয়ের চেষ্টা করছিলেন।চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী রফিকজেল পালানো ৭০০ আসামি এখনো অধরা
কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত বছরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে ২ হাজার ২০০ আসামি পালিয়ে যান। তাঁদের মধ্যে ১ হাজার ৫০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখনো ৭০০ আসামি পলাতক। তাঁদের মধ্যে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তসহ অতিঝুঁকিপূর্ণ ৭০ জন আসামি রয়েছেন।
এ বিষয়ে কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জেল পলাতক ৭০০ আসামিকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। তাঁদের মধ্যে ১০০ জন নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করা হচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে দু-একজন করে ধরা পড়ছেন।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও ডিন অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ এখন ছিনতাই-ডাকাতিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। যৌথ বাহিনী অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ মনোযোগ না দিলে জননিরাপত্তা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা হুমকির মুখে পড়বে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ল শ র ল ট হওয় অপর ধ দ র হ ত গ র প ত র কর গত বছর র ন ম র এক ত র জন র কর ন ল ট কর আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র-গুলি দিয়ে ডাকাতি–ছিনতাই, দলনেতা গ্রেপ্তার
চট্টগ্রামে আরিফ হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র-গুলিসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, আরিফ একটি ডাকাত দলের নেতা। থানা থেকে লুট করা অস্ত্র-গুলি দিয়ে ডাকাতি, ছিনতাই করেন তিনি।
আজ বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে নগরের ডবলমুরিং থানার বারিক বিল্ডিং মোড় এলাকা থেকে আরিফকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাঁর আস্তানা থেকে ইতালির তৈরি একটি ৭.৬৫ এমএম পিস্তল ও ৫০টি গুলি উদ্ধার করা হয়।
ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে খবর পেয়ে ডাকাত দলের নেতা আরিফকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁর কাছ থেকে অস্ত্র-গুলি উদ্ধার হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরিফ স্বীকার করেছেন তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার করা অস্ত্র-গুলি ডবলমুরিং থানা থেকে লুট করেছিলেন। তবে এগুলোর বাইরে তাঁর কাছে আরও অস্ত্র-গুলি আছে কি না, তা কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছেন। এ জন্য তাঁকে থানা লুটের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য আবেদন করা হবে আদালতে। তা মঞ্জুর হলে রিমান্ডের আবেদন করা হবে। রিমান্ডে হয়তো তাঁর কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নগরের ৮টি থানা ও ৮টি ফাঁড়ি লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন বিক্ষুব্ধ লোকজন। ওই সময় ৮১৩টি অস্ত্র ও ৪৪ হাজার ৩২৪টি গুলি লুট হয়। এসব অস্ত্রের বেশির ভাগ এখনো উদ্ধার হয়নি। সাজ্জাদ হোসেনের মতো সন্ত্রাসী লুট হওয়া গুলি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়ায় চিন্তিত পুলিশ।
ওসি রফিক আহমেদ বলেন, গ্রেপ্তার আরিফ একজন অপরাধী। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ডাকাতি, ছিনতাই করে থাকেন। এই পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজির ১৩টি মামলা পাওয়া গেছে। আরও আছে কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এর আগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে বারেক বিল্ডিং এলাকায় ডাকাতদের আস্তানায় অভিযান চালাতে গিয়ে ছুরিকাঘাতে আহত হন উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আহলাত ইবনে জামিল ও মো. নজরুল ইসলাম। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় মো. তারেক, মো. জুয়েল ও জাহেদুল ইসলাম নামের তিন ছিনতাইকারীকে। কিন্তু পলাতক ছিলেন তাঁদের দলনেতা আরিফ। এই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে।