পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে তার রাষ্ট্রভাষা কী হবে, এ বিতর্ক উঠেছিল দেশভাগের আগেই। সে সময় ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহের হোসেন প্রমুখ বাংলা ভাষার পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই তমদ্দুন মজলিস গঠনের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায। তারা পকিস্তানবাদী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়েই বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলে। এর পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আবদুল মতিন বাংলা ভাষাকে উর্দুর পাশাপাশি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এগিয়ে নিতে থাকেন।

এরই মধ্যে ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক সমাবেশে ঘোষণা দেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’।  এমন ঘোষণার জেরে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী ছাত্র ও  সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয়। দফায় দফায় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। এরই চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখতে পাই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন সরকারের জারি করা কারফিউ ভেঙে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার কলাভবনের আমতলায় ছাত্ররা জড়ো হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইট অতিক্রম করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেদিন দুপুরে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। বহু ছাত্রকে পুলিশে ধরে ট্রাকে করে জয়দেবপুরের দিকে নিয়ে যায় এবং সেখানে নিয়ে ছেড়ে দেয়।  অবশ্য যাদেরকে সন্দেহজনক মনে হয়েছে তাদের এক দুজনকে ধরেও রাখে। বিশেষ করে কোনো দলের কর্মী অথবা নেতা মনে করে কয়েকজনকে তারা সেদিন ধরে রেখেছিল। 

তখন প্রভেন্সিয়াল অ্যাসেম্বলির অধিবেশন চলছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৫ সালের ১৫ই অক্টোবর জগন্নাথ হলের একটি হলরুমের ছাদ ধসে পড়ে মারা গিয়েছিলে ৪০ জন।  ওই হলরুমটিই তখন ছিল ‘পরিষদ ভবন’ বা ‘ইস্ট পাকিস্তান অ্যাসেম্বলি হল।’ সেখানে অধিবেশন চলছিল। আর যে জায়গায় এখন শহীদ মিনার হয়েছে সেই জায়গাতে ওই সময় টিনশেডের বড় বড় রুম ছিল। যেগুলোতে ডাক্তার বসতেন ‘আউটডোর’-এ রোগী দেখার জন্য। 

আরো পড়ুন:

ভাষা: আত্মপরিচয়ের আঁতুড়ঘর

মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আজ

অধিবেশন চলাকালে ছাত্ররা যখন কারফিউ অমান্য করে সংসদ ভবন অতিক্রম করে সামনের দিকে যেতে চাইলো তখন পুলিশ বাধা দিয়েছে এবং কাদানে গ্যাস ছুঁড়েছে। এতে ছাত্ররা আর এগোতে পারেনি। বর্তমানে যেখানে মেডিকেল কলেজের আউটডোর ওখানে আশ্রয় নেয় তারা। পুলিশের বাধার মুখে ছাত্ররা পুলিশের দিকে ইট, পাথর ছুঁড়েছিল। আর পুলিশ ছাত্রদের বেয়নেট দেখিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে এবং এক পর্যায়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। তখনকার দিনে পুলিশ গুলি করতো পায়ের দিকে। যাতে থামানো যায়। শরীরের উপরের অংশে গুলি লাগলে মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেজন্য অপরাধীর পায়ে গুলি করার নির্দেশ ছিল উপরমহল থেকে। ছাত্ররা যখন কিছুতেই থামছিল না পুলিশ প্রথমে উপরের দিকে ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। এক পর্যায়ে গুলি একটু নিচের দিকে ছুঁড়তে শুরু করে। এতে দুই তিনজন শহীদ হন। এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র আবুল বরকত পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। 

এই যে পুলিশের গুলিতে একজন মারা গেছেন এবং জনসাধারণের ভেতর থেকেও চার পাঁচজন মারা গেছেন এই সংবাদ আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। কারণ সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে পুলিশের গুলিতে ছাত্র এবং সাধারণ জনতা মারা গেছে এই ঘটনা তখনকার দিনে অনেক বড় ঘটনা। বিশেষ করে গুলি করে ছাত্রদের মেরে ফেলা হবে, এটা একেবারেই সহ্য করার মতো ছিল না। তখনকার দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাধারণ মানুষ খুব শ্রদ্ধা করতো, শিক্ষকদের তো আরও বেশি।

সেই অবস্থায় ফৌজিয়ান অ্যাসেম্বলিতে যারা উপস্থিত ছিলেন মুসলিম লীগ ছাড়া অন্যান্য দলের যারা আওয়ামী মুসলীম লীগ ছিলেন তারা একে একে বেরিয়ে আসেন এবং যেখানে ছাত্রদের গুলি করা হয়েছিল সেখানে দাঁড়িয়ে তারা প্রতিবাদ করেন। অ্যাসেম্বলিতে তখনকার প্রধানমন্ত্রী (এখন বলা হয় মুখ্যমন্ত্রী) নুরুল আমিন ছিলেন। তিনি ছিলেন পার্লামেন্টে ‘লিডার অব দি হাউস’। তিনি ছাত্রদের মৃত্যুর খবর শুনে অধিবেশনে বক্তব্য দেন। এবং বলেন যে,  পুলিশের গুলিতে একজন ছাত্র এবং আরও কয়েকজন লোক নিহত হয়েছে, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। কিন্তু আমাদের অধিবেশন চালিয়ে যাওয়াই উচিত। কারণ এখানে গুরুত্বপূর্ণ নানান সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ কথা শোনামাত্র হলের ভেতরে যারা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন এবং নির্দলীয় সদস্য ছিলেন তারা ক্ষুব্ধ হন এবং নুরুল আমিনের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে হল থেকে বেরিয়ে আসেন। 

পুলিশের গুলিতে ছাত্র নিহত হয়েছে, সাধারণ জনতা নিহত হয়েছে মানে এই ঘটনা তখন অনেক বড় ঘটনা। ইংরেজরা শোষক ছিল কিন্তু তারাও এ রকম ঘটনা ঘটায়নি। সরাসরি ছাত্রকে হত্যা করার বা মানুষকে হত্যা করার সাহস দেখায়নি। সেই জায়গাতে নুরুল আমিনের সরকার এবং তার অধীনে ঢাকার বিসিক, পুলিশ, এসপি তারা যে জঘন্যরকমের তুলনাহীন অপরাধ করেছে; এর পেছনে নুরুল আমিনের নির্দেশনা ছিল। যাই হোক, এ ঘটনার পর নুরুল আমিন তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন। এর পরবর্তী কয়েকদিন অন্তত পনেরো দিন পর্যন্ত ঢাকায় যে কোনো সরকার আছে; এইটা বোঝা যেত না। মানুষ সরকারবিহীন হয়ে পড়েছিল। কার্যত তখন যে সরকার ছিল সেটা ছিল জনসমর্থন হারা সরকার, পুলিশি ব্যবস্থাপনায় চলা সরকার। 

এই যে ছাত্র হত্যা এবং জনগণের ভেতর থেকে কিছু মানুষকে হত্যা করা এই ঘটনার প্রতিবাদের ঢাকা শহরের সব মানুষ নারী, পুরুষ, শিশু তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা এই প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিল। এমন একটি অবস্থা তৈরি হয়েছিল যেটাকে গণঅভ্যুত্থান বলে অভিহীত করা হয়। এরপরেও নানাভাবে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে মহিমান্বিত করা হয়েছে।  

নুরুল আমিন সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার এই তীব্র নিন্দার প্রতি মনোযোগ দেননি। কিংবা ছাত্র ও জনসাধারণের এই সব দাবিদাওয়ার প্রতি কোনো ধরণের সহানুভূতি প্রকাশ করেননি। ফলে প্রতিবাদ আরও তীব্র হয়। সাধারণ মানুষ এবং ছাত্র স্বাধীনভাবে শৃঙ্খলা রক্ষা করে সরকারের বিরুদ্ধে দিনের পর দিন আন্দোলন চালিয়ে যায়। এই আন্দোলনে আমার ধারণা তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের সব থানায় ছাত্রদের প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের কল্লা চাই’। সেই সাথে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ এটাও বলেছে। কারণ ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ না বললে একেবারে দেশদ্রোহীতা হয়ে যেত।

আমি তখন বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জে পাকুন্দিয়া থানা হেড কোয়ার্টারের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম। ২২ ফেব্রয়ারিতে স্কুলে গিয়ে দেখলাম, শিক্ষকদের দেখা যাচ্ছে না। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে একটা হাই মাদ্রাসা ছিল। সেই হাই মাদ্রাসার যারা সেভেন এইটে পড়ে অর্থাৎ আমাদের চেয়ে যারা উপরের ক্লাসে পড়ে তারাও কেউই ক্লাসের দিকে যাচ্ছে না। একটা জামগাছের নিচে প্রায় শতাধিক ছাত্র জড়ো হয়েছিল। আমি তখন চতুর্থ শ্রেনির ছাত্র ছিলাম। আমিও ওই জামতলায় গিয়ে জড়ো হলাম। এবং মিছিলে অংশ নিলাম। 

আমাদের প্রাইমারি স্কুল, হাই মাদ্রাসা এবং কাছাকাছি থাকা আরও দুইটি হাইস্কুলের ছাত্র সব মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার মানুষ মিছিল করি। থানার ভেতরের মাঠে ঢুকে পড়েছিলাম আমরা। আমাদের স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের কল্লা চাই’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। কিন্তু ছাত্র-শিক্ষক কারও আচরণে বোঝার উপায় ছিল না যে দেশে কার্যত সরকার নেই। সবাই যার যার জায়গা থেকে শৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিয়েছিল। আমরা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না হলে আমরা পিছিয়ে পড়বো। আমাদের বাংলা ভাষা অনেক অনেক উন্নত। শুধু ভারতে নয় গোটা এশিয়ায়, আফ্রিকায়, দক্ষিণ আমেরিকায় এই অঞ্চলে বাংলা ভাষা সবচেয়ে উন্নত ভাষা। ইংরেজি এখানে ব্যবহার হয় সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে।

রাষ্ট্র ভাষার জন্য আন্দোলন বাংলা ভাষার অগ্রগতির জন্য অনেক বেশি তরান্বিত করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর আমরা বাংলা ভাষাকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করতে পারিনি। স্বীকার করতে হবে, শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষার গুরুত্ব আগের চেয়ে কমে গেছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংলিশ ভার্সন চালু করা হয়েছে এবং তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এতে মূলধারার শিক্ষা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার ব্যবহার কমেছে। 

আমরা যদি প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার উন্নয়ন চাই, বাংলা ভাষাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকেই অবলম্বন করা জরুরি। সুষ্ঠু জাতীয় ভাষানীতি প্রণয়ন করে, জনসমর্থন নিয়ে তার বাস্তবায়ন দরকার। আমাদের উচিত একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করা এবং রাষ্ট্রভাষা ও রাষ্ট্র দুটোকেই যথাসম্ভব উন্নতিশীল রাখা। 

লেখক: শিক্ষাবিদ ও বাংলা একাডেমির সভাপতি 

তারা//

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব ল এক ড ম এক শ ফ ব র য় র ন র ল আম ন র অ য স ম বল আম দ র অবস থ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করা উচিত

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে তার রাষ্ট্রভাষা কী হবে, এ বিতর্ক উঠেছিল দেশভাগের আগেই। সে সময় ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহের হোসেন প্রমুখ বাংলা ভাষার পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই তমদ্দুন মজলিস গঠনের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায। তারা পকিস্তানবাদী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়েই বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলে। এর পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আবদুল মতিন বাংলা ভাষাকে উর্দুর পাশাপাশি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এগিয়ে নিতে থাকেন।

এরই মধ্যে ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক সমাবেশে ঘোষণা দেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’।  এমন ঘোষণার জেরে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী ছাত্র ও  সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয়। দফায় দফায় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। এরই চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখতে পাই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন সরকারের জারি করা কারফিউ ভেঙে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার কলাভবনের আমতলায় ছাত্ররা জড়ো হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইট অতিক্রম করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেদিন দুপুরে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। বহু ছাত্রকে পুলিশে ধরে ট্রাকে করে জয়দেবপুরের দিকে নিয়ে যায় এবং সেখানে নিয়ে ছেড়ে দেয়।  অবশ্য যাদেরকে সন্দেহজনক মনে হয়েছে তাদের এক দুজনকে ধরেও রাখে। বিশেষ করে কোনো দলের কর্মী অথবা নেতা মনে করে কয়েকজনকে তারা সেদিন ধরে রেখেছিল। 

তখন প্রভেন্সিয়াল অ্যাসেম্বলির অধিবেশন চলছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৫ সালের ১৫ই অক্টোবর জগন্নাথ হলের একটি হলরুমের ছাদ ধসে পড়ে মারা গিয়েছিলে ৪০ জন।  ওই হলরুমটিই তখন ছিল ‘পরিষদ ভবন’ বা ‘ইস্ট পাকিস্তান অ্যাসেম্বলি হল।’ সেখানে অধিবেশন চলছিল। আর যে জায়গায় এখন শহীদ মিনার হয়েছে সেই জায়গাতে ওই সময় টিনশেডের বড় বড় রুম ছিল। যেগুলোতে ডাক্তার বসতেন ‘আউটডোর’-এ রোগী দেখার জন্য। 

আরো পড়ুন:

ভাষা: আত্মপরিচয়ের আঁতুড়ঘর

মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আজ

অধিবেশন চলাকালে ছাত্ররা যখন কারফিউ অমান্য করে সংসদ ভবন অতিক্রম করে সামনের দিকে যেতে চাইলো তখন পুলিশ বাধা দিয়েছে এবং কাদানে গ্যাস ছুঁড়েছে। এতে ছাত্ররা আর এগোতে পারেনি। বর্তমানে যেখানে মেডিকেল কলেজের আউটডোর ওখানে আশ্রয় নেয় তারা। পুলিশের বাধার মুখে ছাত্ররা পুলিশের দিকে ইট, পাথর ছুঁড়েছিল। আর পুলিশ ছাত্রদের বেয়নেট দেখিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে এবং এক পর্যায়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। তখনকার দিনে পুলিশ গুলি করতো পায়ের দিকে। যাতে থামানো যায়। শরীরের উপরের অংশে গুলি লাগলে মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেজন্য অপরাধীর পায়ে গুলি করার নির্দেশ ছিল উপরমহল থেকে। ছাত্ররা যখন কিছুতেই থামছিল না পুলিশ প্রথমে উপরের দিকে ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। এক পর্যায়ে গুলি একটু নিচের দিকে ছুঁড়তে শুরু করে। এতে দুই তিনজন শহীদ হন। এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র আবুল বরকত পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। 

এই যে পুলিশের গুলিতে একজন মারা গেছেন এবং জনসাধারণের ভেতর থেকেও চার পাঁচজন মারা গেছেন এই সংবাদ আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। কারণ সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে পুলিশের গুলিতে ছাত্র এবং সাধারণ জনতা মারা গেছে এই ঘটনা তখনকার দিনে অনেক বড় ঘটনা। বিশেষ করে গুলি করে ছাত্রদের মেরে ফেলা হবে, এটা একেবারেই সহ্য করার মতো ছিল না। তখনকার দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাধারণ মানুষ খুব শ্রদ্ধা করতো, শিক্ষকদের তো আরও বেশি।

সেই অবস্থায় ফৌজিয়ান অ্যাসেম্বলিতে যারা উপস্থিত ছিলেন মুসলিম লীগ ছাড়া অন্যান্য দলের যারা আওয়ামী মুসলীম লীগ ছিলেন তারা একে একে বেরিয়ে আসেন এবং যেখানে ছাত্রদের গুলি করা হয়েছিল সেখানে দাঁড়িয়ে তারা প্রতিবাদ করেন। অ্যাসেম্বলিতে তখনকার প্রধানমন্ত্রী (এখন বলা হয় মুখ্যমন্ত্রী) নুরুল আমিন ছিলেন। তিনি ছিলেন পার্লামেন্টে ‘লিডার অব দি হাউস’। তিনি ছাত্রদের মৃত্যুর খবর শুনে অধিবেশনে বক্তব্য দেন। এবং বলেন যে,  পুলিশের গুলিতে একজন ছাত্র এবং আরও কয়েকজন লোক নিহত হয়েছে, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। কিন্তু আমাদের অধিবেশন চালিয়ে যাওয়াই উচিত। কারণ এখানে গুরুত্বপূর্ণ নানান সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ কথা শোনামাত্র হলের ভেতরে যারা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন এবং নির্দলীয় সদস্য ছিলেন তারা ক্ষুব্ধ হন এবং নুরুল আমিনের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে হল থেকে বেরিয়ে আসেন। 

পুলিশের গুলিতে ছাত্র নিহত হয়েছে, সাধারণ জনতা নিহত হয়েছে মানে এই ঘটনা তখন অনেক বড় ঘটনা। ইংরেজরা শোষক ছিল কিন্তু তারাও এ রকম ঘটনা ঘটায়নি। সরাসরি ছাত্রকে হত্যা করার বা মানুষকে হত্যা করার সাহস দেখায়নি। সেই জায়গাতে নুরুল আমিনের সরকার এবং তার অধীনে ঢাকার বিসিক, পুলিশ, এসপি তারা যে জঘন্যরকমের তুলনাহীন অপরাধ করেছে; এর পেছনে নুরুল আমিনের নির্দেশনা ছিল। যাই হোক, এ ঘটনার পর নুরুল আমিন তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন। এর পরবর্তী কয়েকদিন অন্তত পনেরো দিন পর্যন্ত ঢাকায় যে কোনো সরকার আছে; এইটা বোঝা যেত না। মানুষ সরকারবিহীন হয়ে পড়েছিল। কার্যত তখন যে সরকার ছিল সেটা ছিল জনসমর্থন হারা সরকার, পুলিশি ব্যবস্থাপনায় চলা সরকার। 

এই যে ছাত্র হত্যা এবং জনগণের ভেতর থেকে কিছু মানুষকে হত্যা করা এই ঘটনার প্রতিবাদের ঢাকা শহরের সব মানুষ নারী, পুরুষ, শিশু তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা এই প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিল। এমন একটি অবস্থা তৈরি হয়েছিল যেটাকে গণঅভ্যুত্থান বলে অভিহীত করা হয়। এরপরেও নানাভাবে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে মহিমান্বিত করা হয়েছে।  

নুরুল আমিন সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার এই তীব্র নিন্দার প্রতি মনোযোগ দেননি। কিংবা ছাত্র ও জনসাধারণের এই সব দাবিদাওয়ার প্রতি কোনো ধরণের সহানুভূতি প্রকাশ করেননি। ফলে প্রতিবাদ আরও তীব্র হয়। সাধারণ মানুষ এবং ছাত্র স্বাধীনভাবে শৃঙ্খলা রক্ষা করে সরকারের বিরুদ্ধে দিনের পর দিন আন্দোলন চালিয়ে যায়। এই আন্দোলনে আমার ধারণা তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের সব থানায় ছাত্রদের প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের কল্লা চাই’। সেই সাথে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ এটাও বলেছে। কারণ ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ না বললে একেবারে দেশদ্রোহীতা হয়ে যেত।

আমি তখন বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জে পাকুন্দিয়া থানা হেড কোয়ার্টারের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম। ২২ ফেব্রয়ারিতে স্কুলে গিয়ে দেখলাম, শিক্ষকদের দেখা যাচ্ছে না। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে একটা হাই মাদ্রাসা ছিল। সেই হাই মাদ্রাসার যারা সেভেন এইটে পড়ে অর্থাৎ আমাদের চেয়ে যারা উপরের ক্লাসে পড়ে তারাও কেউই ক্লাসের দিকে যাচ্ছে না। একটা জামগাছের নিচে প্রায় শতাধিক ছাত্র জড়ো হয়েছিল। আমি তখন চতুর্থ শ্রেনির ছাত্র ছিলাম। আমিও ওই জামতলায় গিয়ে জড়ো হলাম। এবং মিছিলে অংশ নিলাম। 

আমাদের প্রাইমারি স্কুল, হাই মাদ্রাসা এবং কাছাকাছি থাকা আরও দুইটি হাইস্কুলের ছাত্র সব মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার মানুষ মিছিল করি। থানার ভেতরের মাঠে ঢুকে পড়েছিলাম আমরা। আমাদের স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের কল্লা চাই’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। কিন্তু ছাত্র-শিক্ষক কারও আচরণে বোঝার উপায় ছিল না যে দেশে কার্যত সরকার নেই। সবাই যার যার জায়গা থেকে শৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিয়েছিল। আমরা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না হলে আমরা পিছিয়ে পড়বো। আমাদের বাংলা ভাষা অনেক অনেক উন্নত। শুধু ভারতে নয় গোটা এশিয়ায়, আফ্রিকায়, দক্ষিণ আমেরিকায় এই অঞ্চলে বাংলা ভাষা সবচেয়ে উন্নত ভাষা। ইংরেজি এখানে ব্যবহার হয় সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে।

রাষ্ট্র ভাষার জন্য আন্দোলন বাংলা ভাষার অগ্রগতির জন্য অনেক বেশি তরান্বিত করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর আমরা বাংলা ভাষাকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করতে পারিনি। স্বীকার করতে হবে, শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষার গুরুত্ব আগের চেয়ে কমে গেছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংলিশ ভার্সন চালু করা হয়েছে এবং তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এতে মূলধারার শিক্ষা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার ব্যবহার কমেছে। 

আমরা যদি প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার উন্নয়ন চাই, বাংলা ভাষাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকেই অবলম্বন করা জরুরি। সুষ্ঠু জাতীয় ভাষানীতি প্রণয়ন করে, জনসমর্থন নিয়ে তার বাস্তবায়ন দরকার। আমাদের উচিত একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করা এবং রাষ্ট্রভাষা ও রাষ্ট্র দুটোকেই যথাসম্ভব উন্নতিশীল রাখা। 

লেখক: শিক্ষাবিদ ও বাংলা একাডেমির সভাপতি 

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ