বেসরকারিতে বাণিজ্য সরকারিতে নৈরাজ্য
Published: 22nd, February 2025 GMT
সরকারি হাসপাতালে শক্ত তদবির ছাড়া মিলছে না মুমূর্ষু রোগীর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) বরাদ্দ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাগছে ঘুষও। আর বেসরকারি হাসপাতালে এই সেবার নামে কাটা হচ্ছে রোগী ও স্বজনের পকেট। সমন্বয়হীনতার কারণে সরকারের কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। উল্টো বেড়েছে আইসিইউতে নৈরাজ্য।
জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরও বিপৎসংকুল হতে পারে। সরকারের উচিত এখনই আইসিইউর ব্যাপারে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেওয়া। বিশেষ করে অচল আইসিইউ সচল করার ব্যাপারে জোর দেওয়া উচিত।
এখন সারাদেশে আইসিইউর শয্যা আছে ১ হাজার ১৯৫টি। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই রাজধানী ঢাকায়। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হলো, ৩৪ জেলা শহরেই নেই জটিল রোগীর জন্য আইসিইউর ব্যবস্থা। ফলে দেশের নানা প্রান্ত থেকে অনেক মুমূর্ষু রোগী ছোটেন রাজধানীর দিকে। শারীরিক পরিস্থিতি বেশ জটিল হলে অনেক রোগীর প্রাণ নিভে যায় পথেই। ঢাকামুখী রোগীর চাপ কমাতে করোনা মহামারিতে প্রতি জেলায় ১০ শয্যার আইসিইউ তৈরির উদ্যোগ নেয় সরকার।
পরে ২৭ জেলায় স্থাপনও করা হয় আইসিইউ ইউনিট। তবে এর মধ্যে ১৮টিই সচল করা যায়নি। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ডিসেম্বরে। আইসিইউ স্থাপন নিয়ে খামখেয়ালিতে ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক। ফলে ফেরত যাচ্ছে প্রকল্পের ১৪৬ কোটি টাকা।
দেশে আইসিইউ সেবার কী অরাজক হাল, তা আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন সাংবাদিক মাসুমা আক্তার। গেল ১৪ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লায় সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন মাসুমা। আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য রাতেই কুমিল্লা থেকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। তবে ঢামেক হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ফাঁকা না থাকায় বেকায়দায় পড়ে তাঁর পরিবার। স্বজনরা রাজধানীর আরও কয়েকটি হাসপাতালে চেষ্টা-তদবির করেও আইসিইউর ব্যবস্থা করতে পারেননি। অগত্যা নারায়ণগঞ্জের একটি হাসপাতালে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নেমে চার দিন পর হেরে যান মাসুমা।
এদিকে, মসজিদের ইমাম আশরাফ আলী গত মঙ্গলবার হঠাৎ স্ট্রোক করলে চিকিৎসক তাঁকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢামেক হাসপাতালে পাঠান। আইসিইউর খোঁজে রাজধানীতে এসে তাঁরও একই গতি। শয্যা ফাঁকা না থাকায় ঢামেক হাসপাতালে জায়গা হয়নি আশরাফ আলীর। কর্তৃপক্ষ তাঁর ছেলেকে সাফ জানিয়ে দেয়, এক সপ্তাহের আগে মিলবে না আইসিইউ। বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউর খোঁজ নেবেন– আর্থিক সংগতি না থাকায় সেই পথও রুদ্ধ। অসহায় ছেলে এখন বাবার জীবন-মৃত্যু সঁপে দিয়েছেন আল্লাহর ওপর।
আরও জটিল পরিস্থিতি নিয়ে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি এ এস এম হাসান। কিডনি, লিভার, হৃদরোগসহ নানা রোগ নিয়ে তিনি ঢাকা মেডিকেলে পা রাখেন গত ১৩ ফেব্রুয়ারি। ভর্তির পরপরই চিকিৎসক তাঁকে আইসিইউতে নেওয়ার পরামর্শ দেন। তবে আইসিইউ নামের ‘সোনার হরিণ’ দেখার অপেক্ষায় এখনও হাসান। তাঁর স্ত্রী আমেনা খাতুনের অভিযোগ, ‘টাকা ও তদবির ছাড়া এখানে আইসিইউ শয্যা মেলে না। আমাদের পরে কাগজ জমা দিয়েও অনেকে আইসিইউ বরাদ্দ পেয়েছেন। আনসাররা প্রকাশ্যে টাকা চান। টাকা না থাকায় সেই সুযোগটা আমরা নিতে পারিনি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢামেক হাসপাতালে ৬০ শয্যার আইসিইউর বিপরীতে দিনে শতাধিক আবেদন জমা পড়ে। তবে দিনে আইসিইউর শয্যা খালি হয় মাত্র তিন থেকে চারটি। শুধু ঢামেক নয়, দেশের সব সরকারি হাসপাতালেই একই পরিস্থিতি। ঢাকা শিশু হাসপাতালে ২৫ আইসিইউ শয্যার বিপরীতে গত বৃহস্পতিবার ৭৪টি আবেদন জমা পড়ে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ২০ শয্যার বিপরীতে ৪৫টি আবেদন পড়ে। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০ শয্যার আইসিইউর আবেদন জমা পড়েছে ৩৩টি।
ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো.
একটি যন্ত্র বিকল হলে ছয় মাসেও মেরামত করা সম্ভব নয় না। এতে নতুন করে জটিলতা দেখা দেয়। নতুন ভবনে ১৫টি আইসিইউর মধ্যে তিনটি যন্ত্র শুরু থেকে নষ্ট। বারবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জানানো
হলেও কাজ হচ্ছে না।
৭৫ শতাংশ আইসিইউ শয্যা ঢাকায়
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে মোট আইসিইউ শয্যা আছে ১ হাজার ১৯৫টি। ঢাকা মহানগরে ৮২৬টির মধ্যে ৩৮৪টি সরকারি হাসপাতালে, বাকি ৪৪২টি বেসরকারি হাসপাতালে। আর ঢাকার বাইরে ৩৬৯টি। আইসিইউর প্রায় ৭৫ শতাংশ ঢাকা বিভাগে। তাই এই সেবা নিতে রোগীরা সব সময় ঢাকামুখী।
ক্লিনিকে বাণিজ্য
সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যার জন্য আলাদা খরচ দিতে হয় না। সাশ্রয়ের জন্য বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি অনেক রোগীকে সরকারি হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা-তদবির করে স্বজনরা। এ পরিস্থিতিতে সরকারি হাসপাতালে রোগীর লম্বা সারি দেখা যায়। যারা সরকারি হাসপাতালে চেষ্টা করেও আইসিইউর ব্যবস্থা করতে পারেন না, তারা আবার ফিরে যান বেসরকারি হাসপাতালে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর মাঝারি মানের একটি বেসরকারি হাসপাতালের দৈনিক আইসিইউ শয্যা ভাড়া ১৫ হাজার টাকা। চিকিৎসক ফি, ওষুধের দাম এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ এর বাইরে। সব মিলিয়ে দিনে স্বাভাবিক খরচ হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। রোগীর অবস্থা জটিল হলে এই খরচা ৮০ হাজার থেকে লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। যে হাসপাতাল যত বড়, তার আইসিইউর খরচ তত বেশি। এই খরচ অনেক রোগীর স্বজনের পক্ষে টানা সম্ভব হয় না। মাত্রাতিরিক্ত খরচার নিচে চাপা পড়ে অনেকে মাঝপথে চিকিৎসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন। অনেক সময় রোগী মারা গেলেও তা স্বজনকে না জানিয়ে আইসিইউতে রেখেই ‘বিল বাণিজ্য’ করার অনৈতিক পথে হাঁটে কোনো কোনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
গত বুধবার ঢামেক হাসপাতালে শয্যা খালি না পেয়ে আল আমিন নামের এক রোগীকে যাত্রাবাড়ীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। শুরুতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দিনে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচের কথা জানায়। তবে এক দিন না যেতেই ৫৭ হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়। পরে রোগীর স্বজন কোনোমতে বিল পরিশোধ করে দুপুরেই আল আমিনের ছাড়পত্র নেন। গ্রামের বাড়ি বরিশাল যাওয়ার পথেই ওই রোগীর মৃত্যু হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ছোট ও মাঝারি গোছের বেসরকারি হাসপাতালে যেসব আইসিইউ শয্যা আছে, সেগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যথাযথ অনুমতি নিয়ে তারা আইসিইউ সেবা চালু করেনি। তবু এসব হাসপাতাল বন্ধের ব্যাপারে উদ্যোগ নেই অধিদপ্তরের।
৩৪ জেলায় নেই আইসিইউ সেবা
সরকারি হাসপাতালে মোট শয্যার ১০ শতাংশ আইসিইউ থাকা আন্তর্জাতিক নিয়ম। তবে দেশের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ যেন ‘ডুমুরের ফুল’। ৬৪ জেলার ৩৪টি সদর হাসপাতালে আইসিইউ সেবা নেই। হাসপাতালে হাসপাতালে আইসিইউর অভাব প্রকট হয়ে ওঠে করোনাকালে। সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২০ সালের ২ জুন জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেন। চার বছর পার হলেও সেই নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
এ প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ গোলাম নবী তুহিন বলেন, প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু জায়গায় আইসিইউ স্থাপন করা হয়েছে। আবার কিছু জায়গায় আইসিইউর যন্ত্রপাতি সরবরাহে দরপত্রও দেওয়া হয়। তবে সে সময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নতুন করে স্পেসিফিকেশন কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেন। এতে দরপত্র উন্মুক্ত করা হলে ট্রায়াল রিভিউ ও এলসি খোলা নিয়ে জটিলতায় পড়তে হয়। এ পরিস্থিতিতে দরপত্র বাতিল করা হলে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে যায়।
১৮ জেলায় আইসিইউ অচল
করোনা মহামারির সময় জেলা হাসপাতালে স্থাপিত ২৭ আইসিইউর ১৮টি এখনও অচল। করোনার পর এসব ইউনিট পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত জনবল ডেপুটেশনে চলে যায়। এতে ১৮ জেলা হাসপাতালে ২০২টি আইসিইউ শয্যা অকার্যকর হয়ে পড়ে।
জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করেন, সমন্বয়হীনতার কারণে দেশের অচল আইসিইউ সচলের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। এতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুসারে আইসিইউ সেবা মিলছে না। সেবাবঞ্চিত হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, সরকার টাকা খরচ করে আইসিইউ প্রতিষ্ঠা করলেও নানা সংকটে অনেক শয্যা পড়ে আছে শুধু জনবল সংকট ও সমন্বয়হীনতার কারণে। করোনার সময় গড়ে তোলা ১৮ জেলায় আইসিইউ সচল থাকলে বহু মানুষের জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখতে পারত। তবে দুঃখের বিষয়, এর কিছুই হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, যেসব ক্লিনিক আইসিইউ সেবার নামে অনৈতিক বাণিজ্য করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এটিও মানতে হবে, দেশে আইসিইউ পরিচালনায় লোকবলের সংকট রয়েছে। তাই অনেক জেলায় স্থাপিত আইসিইউ পড়ে আছে। জনবল নিয়োগে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। জেলা পর্যায়ের আইসিইউগুলো সচল করা আমাদের প্রথম লক্ষ্য।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রকল প র আইস ইউত পর স থ ত ব যবস থ ব সরক র আম দ র র জন য তদব র
এছাড়াও পড়ুন:
‘বাবার অপদস্ত হওয়ার ভিডিও দেখে রাতে ঘুমাতে পারছি না’
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারী হাজী তোবারক আলী চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্য্যকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে পুরো উপজেলায়।
গত বুধবার (১৬ এপ্রিল) দুপুরে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের অফিস কক্ষে এ ঘটনা ঘটে। এক জন শিক্ষককে অসম্মান করে বিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়ায় নিন্দার ঝড় উঠেছে।
সীতাকুণ্ড ভাটিয়ারী হাজী তোবারক আলী চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের নবগঠিত অ্যাডহক কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জানিয়েছেন, গত বুধবার দুপুরে বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সভা চলছিল। দুপুর ২টার দিকে একটি দল মানুষ বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঢুকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্য্যকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
তিনি বলেন, “১৯৯১ সাল থেকে কান্তি লাল আচার্য্য এ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। তিনি আমারও শিক্ষক। এভাবে অসম্মান করে এক জন শিক্ষককে বিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া নিন্দনীয়।”
ভাটিয়ারী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি নুরুল আনোয়ার বলেছেন, কান্তি লাল আচার্য্য দীর্ঘদিন ধরে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নেতাকর্মীরা তার পদত্যাগ দাবি করে মিছিল-সমাবেশ করেন। উত্তেজিত জনতার চাপে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯১ সালের ১ মার্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন কান্তি লাল আচার্য্য। ২০০০ সালে প্রধান শিক্ষকের পদ খালি হলে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্তে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে কান্তি লাল আচার্যকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০২৮ সালের মার্চ মাসে তার চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
কান্তি লাল আচার্য্যকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, অভিযোগ করে তার মেয়ে ভাবনা আচার্য্য বৃহস্পতিবার ফেসবুকে লিখেছেন (হুবহু তুলে ধরা হলো), “আমার বাবা জনাব কান্তি লাল আচার্য্য। ৩৫ বছর ভাটিয়ারী হাজী তোবারক আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। আমার বাবাকে গতকাল ১৬.০৪.২৫ তারিখে কোন রকম প্রমানিত অভিযোগ ছাড়া বলপূর্বক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে পদত্যাগ করানো হয়। আমার বাবার কি অপরাধ, কি সমস্যা কিছু বলা হয়নি। জানেন, স্কুলে ঝামেলা হওয়ার আগে বাবাকে মানা করা হয় স্কুল যেতে। বলছিল, স্কুলে গেলে অপমান হতে হবে।
বাবা সেই কথার উত্তরে বলেন, আমি কোন অন্যায় করিনি, আমার কোন অপরাধ নেই। আমাকে পদ থেকে সরে যেতে বল্লে নির্দ্বিধায় আমি সরে যাবো। তবুও আমি স্কুলে যাব। আমি কেন পালিয়ে বেড়াবো। কেউ আমার অপরাধের প্রমাণ আনতে পারলে আনুক।
বাবাকে পদত্যাগ করার আগে স্কুলে ককটেল ফাটানো হচ্ছিল। আমার বাবা তখনো নির্ভীক। জোর করে সাইন করতে বলছিল এমন একটি কাগজে যেখানে লেখা ছিল, দুর্নীতির অভিযোগে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করছি। বাবা নির্ভয়ে বলেছিল, আমি দুর্নীতি করিনি, এই পেজে আমি সাইন করবো না। এমনিতেই পদত্যাগ করছি। সেই সময় বাবাকে একদল মারতে যায়।
পরবর্তীতে, আরেকটি কাগজে লেখা হয়: ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেছি।
কি সুন্দর তাই না! আমার বাবা কত মানুষকে ঘরে রেখে পড়িয়েছেন, কত মানুষকে টাকা ছাড়া পড়িয়েছেন, কত মানুষের ফি মওকুফ করেছেন। আজ একজন শিক্ষকের এই পরিনতি! আমার বাবা অসুস্থ হয়ে গেছে বিশ্বাস করেন। আমার বাবা এবং আমরা কেউ মানতে পারছি না যে, একজন মানুষ ৩৫ বছর চাকরিরত থাকার পর তাঁর এই পরিনতি।
আপনারা উগ্র হয়ে একজন জলজ্যান্ত মানুষকে কবর দেয়ার মতো যন্ত্রণা দিয়েছেন। এতোদিন অন্য মানুষের এমন ঘটনা দেখতাম। আজ আমার বাবার সাথে এই হেন কাজ হয়েছে।
জানেন, আমরা মেয়েরা বাবার অপদস্ত হওয়ার ভিডিও দেখে রাতে ঘুমাতে পারছি না। ভাবুন উনি শিক্ষক নয় শুধু, উনি আমাদের বাবা। আপনার বাবার সাথে এমন হলে আপনার কেমন লাগবে বলুন!
একজন শিক্ষকের এই অপমান!পৃথিবীতে একমাত্র হীন জাতি আমরা যারা পদে পদে শিক্ষকদের টার্গেট করে এই অপমানজনক পরিস্থিতি উপহার দিচ্ছি।
আজ আমাদের সাথে হলো। কাল ঠিকই সবার পাল্লায় এই মব এসে উপস্থিত হবে। ঈশ্বর ছেড়ে দেই না ভাই। বিশ্বাস করেন, আমার বাবার দীর্ঘশ্বাস, চোখে এক আতঙ্কের আভাস এই সব কখনো ভালো ফল বয়ে আনবে না।”
পদত্যাগ প্রসঙ্গে কান্তি লাল আচার্য্য বলেছেন, “সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। অ্যাডহক কমিটি আমাকে বাদ দিতে পারত। কিন্তু, এভাবে অসম্মান করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। যারা এ কাজ করেছে, অধিকাংশই আমার ছাত্র ছিল।”
সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফখরুল ইসলাম বলেছেন, “প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগ করানোর বিষয়টি জেনেছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ঢাকা/রেজাউল/রফিক