গতকাল একুশে ফেব্রুয়ারির ছুটির দিনের বিকেলে অমর একুশে বইমেলার মাঠে তিলধারণের স্থান ছিল না। তবে অগুনতি মানুষের এই ভিড় আশা জাগাতে পারেনি প্রকাশকদের। বিক্রির ভাটা কাটেনি এই দিনেও। অধিকাংশ মানুষই এসেছিলেন বেড়াতে বা ছবি তুলতে। সকাল থেকে শুরু হলেও একেবারে নির্জন ছিল একুশের সকালের মেলা। অনন্যা প্রকাশের স্বত্বাধিকারী মনিরুল হক যেন তাই ক্ষোভ নিয়েই বললেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে এত কম বিক্রি আগে কোনো দিন হয়নি। সবাই আসছে যেন মেলা দেখতে।’ এখন ফেসবুককেন্দ্রিক লেখার জোয়ার চলছে অভিযোগ করে তিনি প্রশ্ন করলেন, মেলার ভেতরে আগে কোনো দিন এমন ছোট ছোট খাবারের দোকান দেখেছেন?
একুশে ফেব্রুয়ারি, তার ওপর শুক্রবার। তাই মেলায় ছিল শিশুপ্রহরের আয়োজনও। শিশুদের বই প্রকাশনী ময়ূরপঙ্খির বিক্রয়কর্মী চন্দনা মণ্ডল বললেন, ‘বাচ্চাদের বই করা কঠিন। শিল্পীদের কাজের ওপর নির্ভরশীল। এত যত্নের বই বিক্রি না হলে হয়?’ মেলার মাঠের ভেতর অলিগলি দিয়ে কোনোমতে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে দেখা গেল উপকথা প্রকাশনীর সামনে জটলা। সেখানে সোনার বাংলা সার্কাস ব্যান্ডের একজন ভোকালিস্টের বই এসেছে।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের কালি ও কলম পত্রিকার স্টলে যামিনী রায়ের আঁকা নিয়ে প্রকাশিত বই খুঁজতে এসেছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী রিশতা মাহজাবীন। প্রথম আলোকে বললেন, এই শিল্পীর কাজ রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যায় ছবি আঁকার সময়। ইন্টারনেটে অনেক ছবি থাকলেও বইয়ের পাতায় আঁকাগুলো হয় বিস্তারিত। তাই হয়তো শিল্পীরা জয়নুল বা যামিনীর কাছে ফিরে যান এখনো।
এই অতীতে ফিরে যাওয়ার রেশ পাওয়া যাবে অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত কবি ফরিদ কবিরের নীল মাকখির চোখ–এ। এ উপন্যাসে আছে পুরোনো ঢাকার বংশাল, নারিন্দা, জমাদার লেন বা চকবাজারের রহস্যময় গলিতে পাঠকের প্রবেশের পথ। আরও আশা জাগল পাঠক সমাবেশে গিয়ে। সেখানে এসেছে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের পদার্থ বিজ্ঞানের দর্শন অনুবাদ বইটি। এ বইয়ের অনুবাদক আমিনুল ইসলাম ভুইয়া প্রথম আলোকে বললেন, তরুণ যাঁরা বিজ্ঞান পড়েন, তাঁদের বিজ্ঞানের দর্শনটাও পড়া উচিত বলে এই বই অনুবাদ করা। আলাপের সূত্রে তিনি শোনালেন, সৈয়দ মুজতবা আলীর খাইবার গিরিপথ অতিক্রমের একটি রম্যগল্পও।
ফিরতি পথে সেই অসম্ভব ভিড় ঠেলে টিএসসির গেটের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ত্রাহি অবস্থা। এর মধ্যে এক শিশু মাটিতে আছাড় খেল, আরেকজনের চশমার কাচ ভাঙল। প্রথমার স্টলে কেউ এসে খুঁজলেন মির্জা গালিবের গজলের অনুবাদ। গণিত অলিম্পিয়াড ১০১ সমস্যা ও সমাধান, সৈয়দ আবুল মকসুদের সংগ্রহ ও সম্পাদনায় প্রকাশিত ভাসানীর ঐতিহাসিক অভিভাষণ ভালো চলছে বলে জানালেন বিক্রয়কর্মীরা।
একুশের বইমেলা শুরু হয়েছিল সকাল আটটায়। স্বরচিত কবিতাপাঠে দেড় শতাধিক কবি কবিতা পাঠ করেছেন সকালের সাংস্কৃতিক আয়োজনে। বিকেলে মূলমঞ্চে ছিল অমর একুশে বক্তৃতা ২০২৫।
১৯৭১: কলকাতা কোন্দল১৯৭১ সালে যুদ্ধ না বাধলে শেখ মুজিবুর রহমানই হতেন পাকিস্তানের সরকারপ্রধান। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর দল এলোমেলো হয়। দেখা যায়, কলকাতায় বসে নেতারা নানান ইস্যুতে কোন্দল করছেন। সব ছাপিয়ে তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়েছিল—ভারত সরকারের পরিকল্পনায় সমর্পিত হয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য অপেক্ষা, নাকি একটা আশু নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হবে, সে প্রসঙ্গ।
দেখা গেছে, পাকিস্তানের সঙ্গে ফয়সালার জন্য কেউ ঝুঁকেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। এ নিয়েই প্রবাসী সরকারে বিরোধ ও কোন্দল, যার কেন্দ্রে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ। প্রবাসী সরকার ভারতের ওপর নির্ভরশীল ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নও তখন ভারতের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করে। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে অবস্থান নেয়। বাংলাদেশ হয়ে পড়ে দুই পরাশক্তির ছায়াযুদ্ধের ক্ষেত্র। তাজউদ্দীন-মোশতাক দ্বন্দ্ব ছিল এরই প্রতিফলন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বুঝতে হলে দুই পরাশক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্ব বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। মহিউদ্দিন আহমদের ১৯৭১ কলকাতা কোন্দল বইয়ে পাওয়া যাবে বিষয়গুলো।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
আজ সারা দিন মেলার দ্বার খোলা
বইমেলার মাহেন্দ্রক্ষণ হলো অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। আজ মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করার মহিমায় উদ্ভাসিত দিনটিতে বইমেলার দুয়ার খুলবে সকাল সাতটায়। চলবে টানা রাত নয়টা পর্যন্ত। গতকাল বৃহস্পতিবার মেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল বারবার। গতকাল শহীদ দিবসের আগের দিন বরাবরের মতোই মেলায় লোকসমাগম আর বেচাকেনাও বেড়েছে। আজ ভালো বিক্রি হবে বলে আশা করছেন বিক্রেতারা।
গতকাল মেলায় এসেছিলেন দেশের অন্যতম প্রধান যাত্রা পালাকার অভিনেতা ও নির্দেশক মিলন কান্তি দে। প্রবীণ যাত্রাশিল্পী জানালেন, এবার নবান্ন প্রকাশনী থেকে এসেছে আমি এক যাত্রাওয়ালা নামে তাঁর আত্মজীবনী। এতে দেশের যাত্রাশিল্পের ইতিহাস এবং বর্তমান অবস্থাও উঠে এসেছে।
বইমেলা এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। অধিকাংশ প্রকাশনী থেকেই তাদের বেশির ভাগ নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। গতকাল তথ্যকেন্দ্রে নতুন বইয়ের নাম এসেছে ১১২টি। এ বছর বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক রশীদ করীমের জন্মশতবর্ষ। তাঁর দুটি উপন্যাস ও ছোটগল্প, প্রবন্ধ, স্মারক বক্তৃতাসহ বিভিন্ন রচনা নিয়ে রশীদ করীম অমনিবাস প্রকাশ করেছে সাহিত্য প্রকাশ। এটি সম্পাদনা করেছেন প্রাবন্ধিক মফিদুল হক। দিব্যপ্রকাশ এনেছে কবি হেলাল হাফিজের কবিতা সমগ্র। আগামী এনেছে সুরকার সত্য সাহাকে নিয়ে তাঁর স্ত্রী রমলা সাহার স্মৃতিকথা আমার সত্য আমার জীবন, টাঙ্গন এনেছে প্রণব মজুমদারের প্রবন্ধ অর্থের কারবার, অন্যপ্রকাশ এনেছে সজল আশফাকের গল্প ইলিশ ইলিউশনস, ঐতিহ্য এনেছে শামিমা সুলতানার গবেষণা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য: নানা প্রসঙ্গ, পাঞ্জেরী এনেছে দন্তস্য রওশনের ছোটদের অণুকাব্য।
প্রথমার স্টলে কাল যথেষ্ট ভিড় ছিল গ্রন্থানুরাগীদের। ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন জানান, শহীদ দিবস সামনে থাকায় আহমদ রফিকের ভাষা আন্দোলন বইটি বেশি চলেছে। এ ছাড়া মেজর হাফিজ উদ্দিন বীর বিক্রমের সৈনিক জীবন: গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পঁচাত্তর, মহিউদ্দিন আহমদের বিএনপি সময়-অসময়, মোস্তাক শরিফের কিশোর উপন্যাস তুমি রবে নীরবে, মশিউল আলমের উপন্যাস দ্বিতীয় খুনের কাহিনি, বিজ্ঞানবিষয়ক বই আবুল বাশার অনূদিত স্টিফেন হকিংয়ের বড় প্রশ্ন ছোট উত্তর বইগুলোর কাটতি ভালো ছিল।
লাল জুলাই: চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পথপরিক্রমাচব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বড় ঘটনা। অভ্যুত্থান নিয়ে অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন এখনো চলমান। সাধারণভাবে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে অভ্যুত্থানের একটি পর্ব শেষ হয়েছে। সেই পর্বের তথ্য-উপাত্ত ও প্রাথমিক ঘটনাক্রমের নির্মোহ বিবরণ সংরক্ষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে লাল জুলাই: চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পথপরিক্রমা বইটিতে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক আলতাফ পারভেজ অভ্যুত্থানের পটভূমি থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক পরিণতি পর্যন্ত অন্তত ১০টি ভাগে অভ্যুত্থানকালীন ঘটনাবলি বইটিতে নথিবদ্ধ করেছেন। অভ্যুত্থানের স্মৃতি ধরে রাখা এবং তখনকার ঘটনাবলির বহুমাত্রিক দিক সামনে রেখে ভবিষ্যতে ইতিহাস লেখার কাজ এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে বইটি।