Samakal:
2025-02-22@08:59:12 GMT

ভাষার উৎকর্ষ সাধন উপেক্ষীয় নয়

Published: 21st, February 2025 GMT

ভাষার উৎকর্ষ সাধন উপেক্ষীয় নয়

মধ্যবিত্ত শ্রেণি জন্মসূত্রেই ইংরেজের সঙ্গে তাঁবেদারি সূত্রে আবদ্ধ ছিল। মধ্যবিত্তের ‘চৌকস’ অংশ সোৎসাহে ইংরেজির চর্চা করেছে, চর্চা করে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়েছে, সাহেব সুবো সেজেছে। সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদারি কমেনি, তা বরঞ্চ অধিকতর সূক্ষ্ম ও গভীর হয়েছে। আজও তাই পণ্ডিতি লেখা ইংরেজিতেই লেখা হয়। আজও তাই বাংলা প্রবন্ধে আমরা ভূরি ভূরি ইংরেজি উদ্ধৃতি দিই– এটা প্রমাণ করবার জন্য যে, বাংলায় লিখলেও ইংরেজি যে জানি না, তা নয়। এই হীনম্মন্যতাবোধ অস্বাভাবিক নয়, নতুনও নয়; এটি হচ্ছে তাঁবেদারির সুদীর্ঘ ঐতিহ্যধারার পরিণত ফসল। মধ্যবিত্তের জীবনের সীমাবদ্ধতা, তার জীবনে প্রবলতার ও উদ্ভাবনার স্বল্পতা, অভিজ্ঞতার সংকীর্ণতা, দার্শনিক চিন্তার সামান্যতা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির অকার্যকরতা– সবকিছুই প্রতিফলিত হয়েছে ভাষায়।

ধনবৈষম্য গদ্যের বিকাশকে ব্যাহত করছে আরও একভাবে। সম্পদ উৎপাদন করে যে শ্রমশক্তি, অসাম্য তাকে শোষণ করে করে পঙ্গু করে ফেলছে এবং কায়েমি স্বার্থের নিজের সুবিধার জন্য শ্রমশক্তিকে বিদেশে রপ্তানি করছে। ফলে উৎপাদন বাড়ছে না। দারিদ্র্যও ঘুচছে না। এবং দারিদ্র্য না ঘুচলে যে গদ্যের মুক্তি সম্ভবই হবে না; তার প্রচলনও যে ব্যাপক ও বিস্তৃত হবে না, সেটা বোঝার জন্য তো বিশেষ বিবেচনা শক্তির আবশ্যক হয় না।

বাংলা গদ্যের কতগুলো বৈশিষ্ট্য গদ্যের ব্যাপক অপ্রচলনেই প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া; যেমন ক্রিয়াপদের বৈচিত্র্যহীনতা। যেমন সর্বনামের ক্ষেত্রে আপনি, তুমি, তুই-এর ব্যবহার। মাথায় চন্দ্রবিন্দুর পাগড়ি চাপিয়ে দিয়ে ‘তাকে’কে ‘তাঁকে’তে পরিণত করা যেন ধ্বনির প্রতি অতিরিক্ত মোহ, অনেক সময় অর্থকে খাটো করে ফেলে হলেও। 
এই সমস্ত ব্যাপার-স্যাপার অপচয়মূলক তো বটেই, এরা আবার ভাষার দ্রুত ও যথার্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকও বটে। সামাজিক শ্রেণি-বিভাজন বাইরে থেকে বাধা দিচ্ছে ভাষার ব্যাপক ব্যবহারকে-ধনবৈষম্যের গভীর পরিখা খনন করে রেখে, সেই পরিখাকে দিনে দিনে গভীরতর করে। সেই শ্রেণি-বিভাজন এত চতুর যে, বাইরের প্রতিবন্ধকের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা না রেখে ভাষার অভ্যন্তরেও নিজেদের লাঠিয়াল বসিয়ে রেখেছে, ভাষা যাতে ব্যাপক প্রচার না লাভ করে, সে যেন কিছুতেই সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারে।

ভাষার ওপর এর চেয়ে স্থূল এবং অনেক সময় হাস্যকর পন্থায় লাঠিসোটা হাতে লাফিয়ে পড়ার যে-সমস্ত ঘটনা একের পর এক ঘটেছে, তারা তো ওই একইভাবে সামাজিক-বিপ্লব-বিরোধী, এবং সে-কারণে ভাষার মুক্তিবিরোধী, শক্তির কারসাজি। বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কী– এই বিতর্ক একদিন ওঠানো হয়েছিল। উর্দুই যে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা– এই মতবাদ যখন ওই বিতর্কের সাহায্যে কিছুতেই প্রতিষ্ঠা করা গেল না, তখন এলো নতুন বিতর্ক। ততদিনে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তাই বলা হলো, বাংলা ভাষা যথেষ্ট মুসলমানি নয়। তাই এ ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবে না। মাতৃভাষা বিতর্কের পর রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক। তাতেও ভরসা করা যায় না দেখে চেষ্টা হলো ভাষা সংস্কারের। বলা হলো– হরফ বদলাও, আরবি হরফ নাও; নইলে যথেষ্ট ইসলামী হতে পারবে না। নিলে অন্তত রোমান হরফটা নিয়ে নাও, ভাষার অবৈজ্ঞানিকতা ঘুচে যাবে। 

সাধু-চলিতের বিতর্ক অনেক আগেই মীমাংসা হয়ে গেছে আসলে ঐতিহাসিকভাবে। সাধুকে পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছে চলতি বাংলা। একটা ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই ঘটেছে এ ঘটনা। সাধু ভাষাটা কৃত্রিম ছিল। সংস্কৃত পণ্ডিতদেরই অবদান ওটি প্রধানত। আলালের, হুতোম পেঁচার, মধুসূদনের প্রহসনের, বিদ্যাসাগরের বিতর্কের ভাষাও চালু ছিল বটে, কিন্তু সে-ভাষাকে যথেষ্ট ‘ভদ্র’ মনে করা হয়নি বা তাকে যথেষ্ট ‘ভদ্র’ করে তোলা হয়নি। বাধাটা ছিল কোথায়? ছিল সামাজিক বিন্যাসের মধ্যেই। ছিল ভদ্রলোকদের শ্রেণিচরিত্রের অভ্যন্তরেই। কথা ছিল, বাংলা ভাষা-সাহিত্য আরও এগোবে। এগোলও। এলো চলতি ভাষা। কথা ছিল, আরও এগোবে; তা এগোল না। কেননা, তার শ্রেণি-দূরত্বটা রয়ে গেল। ভদ্রলোকেরা ‘ইতর’জন হতে রাজি হলেন না কিছুতেই। আঞ্চলিক শব্দের চয়ন করবেন বলে আঞ্চলিকতা প্রচার করলেন হয়তো-বা কখনও কখনও, কিন্তু ভাষাকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন ছিল যে সামাজিক ঐক্য, অর্থাৎ শ্রেণিভেদের অবলুপ্তি, তা গড়া সম্ভব হয়নি বলে ভাষার চরিত্রেও কোনো বড় রকমের পরিবর্তন আসেনি।
ভাষার বিকাশে সংবাদপত্রের ভূমিকা অবহেলার বস্তু নয়। এটা বোধ হয় তাৎপর্যবিহীন নয় যে, আমাদের সংবাদপত্রে সংস্কৃতি পাতাটা আলাদা করে রাখা হয়; ছোটদের পাতার মতো বিচ্ছিন্ন পাতা সেটা। আর সংস্কৃতি বলতে সেখানে বোঝানো হয় চলচ্চিত্র ও নাটককেই। এই যে একদিকে সংস্কৃতিকে সংবাদপত্রের সাধারণ ক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং অন্যদিকে সংস্কৃতি বলতে দৃশ্যমান বস্তুকে বোঝানো, এর অভ্যন্তরে নিশ্চয় একটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির সাংবাদিক তাৎপর্য এই যে, সংবাদপত্রের ভাষার পক্ষে সংস্কৃতিবান হওয়ার কোনো আবশ্যকতা নেই। সাংবাদিকরা সাহিত্যিক নয়– এই কথাটা নীরবে সরবে সব সময়েই বলা হচ্ছে। এবং এই বলাটাই অজুহাত হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভাষাকে যথেষ্ট সুসংগত না করার। যেমন তেমন করে লিখলেই চলে যদি মনে করা হয়, তবে সে-লেখা দায়সারাগোছের হতে বাধ্য। আর ওই যে গ্রেসামের আইন আছে– খারাপ মুদ্রা ভালো মুদ্রাকে তাড়িয়ে ছাড়ে; সেই আইন এখানেও চালু হয়ে যাচ্ছে; স্বাভাবিকভাবেই। দ্বিতীয়ত, সংস্কৃতি অর্থই যদি প্রদর্শনী হয়, তবে সেই ঘটনা সাংবাদিকতার গদ্যের তুলনায় চিত্রকে প্রধান হতে সাহায্য করবে বৈ কি। করছেও তাই। সংবাদপত্র যত বেশি সচিত্র হচ্ছে তত বেশি অসাহিত্যিক হচ্ছে। সলজ্জভাবে নয়, সন্তুষ্টভাবে। অনেক পত্রিকার পরিচালকই বলেন, তাদের পত্রিকার দর্শকের সংখ্যা পাঠকের সংখ্যার সমান বটে। ছোটদের পত্রিকাতেও দেখি চিত্র যতটা থাকে, সাহিত্য ততটা থাকে না। এরই নাম বোধ করি স্থূলতা।

এ প্রসঙ্গেই উল্লেখ্য আরেকটি সত্য। সংবাদপত্রে চুরি-ডাকাতি-রাহাজানির খবর থাকে; সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অর্থহীন, অর্বাচীন উক্তিগুলো গলা ফাটিয়ে চেঁচায়, কিন্তু কোনো বইয়ের খবর কিংবা সমালোচনা অথবা লেখক-বুদ্ধিজীবীর কোনো প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য কিছুতেই নিজের জন্য ছোট একটু স্থানও খুঁজে পায় না। বলতে দ্বিধা থাকা উচিত নয়, সংস্কৃতির (যথার্থ অর্থে) অবমূল্যায়ন শুধু প্রতিক্রিয়াশীলরাই করেননি (তারা তো করবেনই, তারা জীবনের বিকাশবিরোধী), প্রগতিশীলরা– যারা সমাজবিপ্লব চান, তারাও করেছেন। উভয়ত-অবমূল্যায়িত সংস্কৃতির নিজের মানকে উন্নত করার অবকাশ তেমন একটা পায়নি এ দেশে।

সাংবাদিকতার সাহিত্য-বিরোধিতা আরও একভাবে ঘটেছে। আন্তরিকতাহীনতা যে সাহিত্যের পরম শত্রু– এ তো কোনো প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। সাংবাদিকতার আন্তরিকতাহীনতা পদে পদে এসেছে। যা ঘটেছে তা বলা যায়নি; যা বলা গেছে তা ঘটেনি। যা লেখা হয়েছে, তাতে আস্থা থাকেনি। না, লেখকের নিজেরও নয়; আর যাতে আস্থা ছিল, তা লেখা যায়নি। সত্য গোপনের লুকোচুরি ও মিথ্যার বেসাতি মাশুল আদায় করে নিয়েছে সাংবাদিকতার প্রতি অবিশ্বাসের মূল্যে যেমন, তেমনি সাংবাদিকতার ভাষার ক্ষতিসাধনের মুদ্রাতেও। সাংবাদিকতার ক্ষতি গদ্যেরই ক্ষতি; তার প্রতি অনাস্থা ভাষার প্রতি অনাস্থার আকর বটে। এবং লেখকদেরও ধিক্কার এসেছে নিজেদের কাজের ওপর। গ্লানিময় হয়ে উঠেছে সমস্ত ব্যাপার; গৌরবময় না হয়ে। নজরুল ইসলামের সাংবাদিকতা যে সমান উজ্জ্বল ছিল, তার কারণ তাঁর আন্তরিকতা; সেটি না থাকলে শুধু প্রতিভায় কুলাতো না অথবা প্রতিভা প্রতিভাই হতো না।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ২১ ফ ব র য় র স ব দপত র ব দ কত র র জন য সমস ত

এছাড়াও পড়ুন:

ভাষার উৎকর্ষ সাধন উপেক্ষীয় নয়

মধ্যবিত্ত শ্রেণি জন্মসূত্রেই ইংরেজের সঙ্গে তাঁবেদারি সূত্রে আবদ্ধ ছিল। মধ্যবিত্তের ‘চৌকস’ অংশ সোৎসাহে ইংরেজির চর্চা করেছে, চর্চা করে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়েছে, সাহেব সুবো সেজেছে। সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদারি কমেনি, তা বরঞ্চ অধিকতর সূক্ষ্ম ও গভীর হয়েছে। আজও তাই পণ্ডিতি লেখা ইংরেজিতেই লেখা হয়। আজও তাই বাংলা প্রবন্ধে আমরা ভূরি ভূরি ইংরেজি উদ্ধৃতি দিই– এটা প্রমাণ করবার জন্য যে, বাংলায় লিখলেও ইংরেজি যে জানি না, তা নয়। এই হীনম্মন্যতাবোধ অস্বাভাবিক নয়, নতুনও নয়; এটি হচ্ছে তাঁবেদারির সুদীর্ঘ ঐতিহ্যধারার পরিণত ফসল। মধ্যবিত্তের জীবনের সীমাবদ্ধতা, তার জীবনে প্রবলতার ও উদ্ভাবনার স্বল্পতা, অভিজ্ঞতার সংকীর্ণতা, দার্শনিক চিন্তার সামান্যতা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির অকার্যকরতা– সবকিছুই প্রতিফলিত হয়েছে ভাষায়।

ধনবৈষম্য গদ্যের বিকাশকে ব্যাহত করছে আরও একভাবে। সম্পদ উৎপাদন করে যে শ্রমশক্তি, অসাম্য তাকে শোষণ করে করে পঙ্গু করে ফেলছে এবং কায়েমি স্বার্থের নিজের সুবিধার জন্য শ্রমশক্তিকে বিদেশে রপ্তানি করছে। ফলে উৎপাদন বাড়ছে না। দারিদ্র্যও ঘুচছে না। এবং দারিদ্র্য না ঘুচলে যে গদ্যের মুক্তি সম্ভবই হবে না; তার প্রচলনও যে ব্যাপক ও বিস্তৃত হবে না, সেটা বোঝার জন্য তো বিশেষ বিবেচনা শক্তির আবশ্যক হয় না।

বাংলা গদ্যের কতগুলো বৈশিষ্ট্য গদ্যের ব্যাপক অপ্রচলনেই প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া; যেমন ক্রিয়াপদের বৈচিত্র্যহীনতা। যেমন সর্বনামের ক্ষেত্রে আপনি, তুমি, তুই-এর ব্যবহার। মাথায় চন্দ্রবিন্দুর পাগড়ি চাপিয়ে দিয়ে ‘তাকে’কে ‘তাঁকে’তে পরিণত করা যেন ধ্বনির প্রতি অতিরিক্ত মোহ, অনেক সময় অর্থকে খাটো করে ফেলে হলেও। 
এই সমস্ত ব্যাপার-স্যাপার অপচয়মূলক তো বটেই, এরা আবার ভাষার দ্রুত ও যথার্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকও বটে। সামাজিক শ্রেণি-বিভাজন বাইরে থেকে বাধা দিচ্ছে ভাষার ব্যাপক ব্যবহারকে-ধনবৈষম্যের গভীর পরিখা খনন করে রেখে, সেই পরিখাকে দিনে দিনে গভীরতর করে। সেই শ্রেণি-বিভাজন এত চতুর যে, বাইরের প্রতিবন্ধকের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা না রেখে ভাষার অভ্যন্তরেও নিজেদের লাঠিয়াল বসিয়ে রেখেছে, ভাষা যাতে ব্যাপক প্রচার না লাভ করে, সে যেন কিছুতেই সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারে।

ভাষার ওপর এর চেয়ে স্থূল এবং অনেক সময় হাস্যকর পন্থায় লাঠিসোটা হাতে লাফিয়ে পড়ার যে-সমস্ত ঘটনা একের পর এক ঘটেছে, তারা তো ওই একইভাবে সামাজিক-বিপ্লব-বিরোধী, এবং সে-কারণে ভাষার মুক্তিবিরোধী, শক্তির কারসাজি। বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কী– এই বিতর্ক একদিন ওঠানো হয়েছিল। উর্দুই যে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা– এই মতবাদ যখন ওই বিতর্কের সাহায্যে কিছুতেই প্রতিষ্ঠা করা গেল না, তখন এলো নতুন বিতর্ক। ততদিনে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তাই বলা হলো, বাংলা ভাষা যথেষ্ট মুসলমানি নয়। তাই এ ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবে না। মাতৃভাষা বিতর্কের পর রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক। তাতেও ভরসা করা যায় না দেখে চেষ্টা হলো ভাষা সংস্কারের। বলা হলো– হরফ বদলাও, আরবি হরফ নাও; নইলে যথেষ্ট ইসলামী হতে পারবে না। নিলে অন্তত রোমান হরফটা নিয়ে নাও, ভাষার অবৈজ্ঞানিকতা ঘুচে যাবে। 

সাধু-চলিতের বিতর্ক অনেক আগেই মীমাংসা হয়ে গেছে আসলে ঐতিহাসিকভাবে। সাধুকে পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছে চলতি বাংলা। একটা ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই ঘটেছে এ ঘটনা। সাধু ভাষাটা কৃত্রিম ছিল। সংস্কৃত পণ্ডিতদেরই অবদান ওটি প্রধানত। আলালের, হুতোম পেঁচার, মধুসূদনের প্রহসনের, বিদ্যাসাগরের বিতর্কের ভাষাও চালু ছিল বটে, কিন্তু সে-ভাষাকে যথেষ্ট ‘ভদ্র’ মনে করা হয়নি বা তাকে যথেষ্ট ‘ভদ্র’ করে তোলা হয়নি। বাধাটা ছিল কোথায়? ছিল সামাজিক বিন্যাসের মধ্যেই। ছিল ভদ্রলোকদের শ্রেণিচরিত্রের অভ্যন্তরেই। কথা ছিল, বাংলা ভাষা-সাহিত্য আরও এগোবে। এগোলও। এলো চলতি ভাষা। কথা ছিল, আরও এগোবে; তা এগোল না। কেননা, তার শ্রেণি-দূরত্বটা রয়ে গেল। ভদ্রলোকেরা ‘ইতর’জন হতে রাজি হলেন না কিছুতেই। আঞ্চলিক শব্দের চয়ন করবেন বলে আঞ্চলিকতা প্রচার করলেন হয়তো-বা কখনও কখনও, কিন্তু ভাষাকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন ছিল যে সামাজিক ঐক্য, অর্থাৎ শ্রেণিভেদের অবলুপ্তি, তা গড়া সম্ভব হয়নি বলে ভাষার চরিত্রেও কোনো বড় রকমের পরিবর্তন আসেনি।
ভাষার বিকাশে সংবাদপত্রের ভূমিকা অবহেলার বস্তু নয়। এটা বোধ হয় তাৎপর্যবিহীন নয় যে, আমাদের সংবাদপত্রে সংস্কৃতি পাতাটা আলাদা করে রাখা হয়; ছোটদের পাতার মতো বিচ্ছিন্ন পাতা সেটা। আর সংস্কৃতি বলতে সেখানে বোঝানো হয় চলচ্চিত্র ও নাটককেই। এই যে একদিকে সংস্কৃতিকে সংবাদপত্রের সাধারণ ক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং অন্যদিকে সংস্কৃতি বলতে দৃশ্যমান বস্তুকে বোঝানো, এর অভ্যন্তরে নিশ্চয় একটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির সাংবাদিক তাৎপর্য এই যে, সংবাদপত্রের ভাষার পক্ষে সংস্কৃতিবান হওয়ার কোনো আবশ্যকতা নেই। সাংবাদিকরা সাহিত্যিক নয়– এই কথাটা নীরবে সরবে সব সময়েই বলা হচ্ছে। এবং এই বলাটাই অজুহাত হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভাষাকে যথেষ্ট সুসংগত না করার। যেমন তেমন করে লিখলেই চলে যদি মনে করা হয়, তবে সে-লেখা দায়সারাগোছের হতে বাধ্য। আর ওই যে গ্রেসামের আইন আছে– খারাপ মুদ্রা ভালো মুদ্রাকে তাড়িয়ে ছাড়ে; সেই আইন এখানেও চালু হয়ে যাচ্ছে; স্বাভাবিকভাবেই। দ্বিতীয়ত, সংস্কৃতি অর্থই যদি প্রদর্শনী হয়, তবে সেই ঘটনা সাংবাদিকতার গদ্যের তুলনায় চিত্রকে প্রধান হতে সাহায্য করবে বৈ কি। করছেও তাই। সংবাদপত্র যত বেশি সচিত্র হচ্ছে তত বেশি অসাহিত্যিক হচ্ছে। সলজ্জভাবে নয়, সন্তুষ্টভাবে। অনেক পত্রিকার পরিচালকই বলেন, তাদের পত্রিকার দর্শকের সংখ্যা পাঠকের সংখ্যার সমান বটে। ছোটদের পত্রিকাতেও দেখি চিত্র যতটা থাকে, সাহিত্য ততটা থাকে না। এরই নাম বোধ করি স্থূলতা।

এ প্রসঙ্গেই উল্লেখ্য আরেকটি সত্য। সংবাদপত্রে চুরি-ডাকাতি-রাহাজানির খবর থাকে; সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অর্থহীন, অর্বাচীন উক্তিগুলো গলা ফাটিয়ে চেঁচায়, কিন্তু কোনো বইয়ের খবর কিংবা সমালোচনা অথবা লেখক-বুদ্ধিজীবীর কোনো প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য কিছুতেই নিজের জন্য ছোট একটু স্থানও খুঁজে পায় না। বলতে দ্বিধা থাকা উচিত নয়, সংস্কৃতির (যথার্থ অর্থে) অবমূল্যায়ন শুধু প্রতিক্রিয়াশীলরাই করেননি (তারা তো করবেনই, তারা জীবনের বিকাশবিরোধী), প্রগতিশীলরা– যারা সমাজবিপ্লব চান, তারাও করেছেন। উভয়ত-অবমূল্যায়িত সংস্কৃতির নিজের মানকে উন্নত করার অবকাশ তেমন একটা পায়নি এ দেশে।

সাংবাদিকতার সাহিত্য-বিরোধিতা আরও একভাবে ঘটেছে। আন্তরিকতাহীনতা যে সাহিত্যের পরম শত্রু– এ তো কোনো প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। সাংবাদিকতার আন্তরিকতাহীনতা পদে পদে এসেছে। যা ঘটেছে তা বলা যায়নি; যা বলা গেছে তা ঘটেনি। যা লেখা হয়েছে, তাতে আস্থা থাকেনি। না, লেখকের নিজেরও নয়; আর যাতে আস্থা ছিল, তা লেখা যায়নি। সত্য গোপনের লুকোচুরি ও মিথ্যার বেসাতি মাশুল আদায় করে নিয়েছে সাংবাদিকতার প্রতি অবিশ্বাসের মূল্যে যেমন, তেমনি সাংবাদিকতার ভাষার ক্ষতিসাধনের মুদ্রাতেও। সাংবাদিকতার ক্ষতি গদ্যেরই ক্ষতি; তার প্রতি অনাস্থা ভাষার প্রতি অনাস্থার আকর বটে। এবং লেখকদেরও ধিক্কার এসেছে নিজেদের কাজের ওপর। গ্লানিময় হয়ে উঠেছে সমস্ত ব্যাপার; গৌরবময় না হয়ে। নজরুল ইসলামের সাংবাদিকতা যে সমান উজ্জ্বল ছিল, তার কারণ তাঁর আন্তরিকতা; সেটি না থাকলে শুধু প্রতিভায় কুলাতো না অথবা প্রতিভা প্রতিভাই হতো না।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ