হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় ভাষাশহীদদের স্মরণ করেছে জাতি। একই সঙ্গে গোটা জাতির কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে শহীদদের স্বপ্নের বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদমুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার দৃঢ় অঙ্গীকার। 
গতকাল শুক্রবার সারাদেশে পালিত হয়েছে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের পতন-পরবর্তী বাংলাদেশে এটিই ছিল প্রথম শহীদ দিবস। 
এদিন ভোর থেকেই দেশের সব পথ যেন মিশে যায় শহীদ মিনারে। মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে জয়ী বীর বাঙালি জাতি বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করে তার গর্বিত পূর্বসূরিদের। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাই সারিবদ্ধভাবে শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শহীদ মিনারের বেদিগুলো ভরে ওঠে ফুলে ফুলে। এ সময় সবার কণ্ঠে ছিল অমর একুশের কালজয়ী সেই গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি.

..।’ 

গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছোঁয়ার আগেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীর সারি দেখা যায় রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। একুশের প্রথম প্রহরে সেখানে ভাষাশহীদদের প্রতি পৃথকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা। রাত ১২টা ১ মিনিটে প্রথমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। এর পর রাত ১২টা ১২ মিনিটে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান। ভাষাশহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তারা।  
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি, সরকারের উপদেষ্টা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনার, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার, কূটনীতিক ও বিদেশি মিশন প্রধান, পুলিশের আইজি, অ্যাটর্নি জেনারেল, ডিএমপি কমিশনার, আনসার মহাপরিচালক, ডিজিএফআই মহাপরিচালক, বিজিবি মহাপরিচালক, র‌্যাব মহাপরিচালক ও এনএসআই মহাপরিচালক। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও অমর একুশে উদযাপন কমিটির সদস্যরাও শহীদ বেদিতে ফুল দেন।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রধান বিচারপতি সাংবাদিকদের বলেন, বাঙালি জাতিসত্তার একটি প্রাথমিক স্তম্ভ একুশ। একাত্তর-পরবর্তী রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক এবং অন্যতম অনুপ্রেরণা একুশ। 
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ওই এলাকা ত্যাগ করলে সর্বস্তরের জনগণের জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার খুলে দেওয়া হয়। রাতভর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সাধারণ মানুষ পুষ্পার্ঘ অর্পণের মাধ্যমে ভাষাশহীদদের স্মরণ করেন। রাতেই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও সদস্য সচিব আখতার হোসেনের নেতৃত্বে সংগঠনের নেতাকর্মীরা। 

গতকাল ভোর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণে মানুষের ঢল নামে। প্রভাতফেরি ও শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বে অংশ নেন শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ সব বয়সী নারী-পুরুষ। কেউ পরিবার, কেউবা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে এসেছিলেন। কেউ এসেছেন শোকের রং কালো পাঞ্জাবি ও শাড়ি পরে। কেউ হাতে ফুল নিয়ে, কেউবা মাথায় লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা বেঁধে। লাল পাড়ের শাড়ি, লালরঙা পাঞ্জাবি আর শিশুদের গালে ‘অ আ ক খ’ আঁকা একটি ভিন্ন আবহ তৈরি করে। সবার কণ্ঠে ছিল ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...’ গানটি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে আসা সর্বস্তরের মানুষের সারি আরও দীর্ঘ হয়। দুপুর পর্যন্ত শ্রদ্ধা নিবেদনের পর্ব চলেছে।  

সকাল ৮টায় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে রিজভী বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা অম্লান। যদি আবারও কোনো ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটে, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের দামাল ছেলেদের, এদেশের জনগণকে আবারও রাজপথে লড়াইয়ে নামতে উদ্বুদ্ধ করবে। 
ফুল নিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে এসে তাহসিন আলম নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রথমবার শহীদ মিনারে এসে আমি উচ্ছ্বসিত। স্বৈরাচারের পতনের পর নতুনভাবে বাংলাদেশকে উপলব্ধি করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। শারীরিক প্রতিবন্ধী আব্দুর রশিদ বলেন, বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন ভাষাশহীদরা। তাদের শ্রদ্ধা জানানো আমাদের সবারই দায়িত্ব। 
সেমন্তী দাস সন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন শহীদ মিনারে। তিনি বলেন, বাচ্চাদের এসব না দেখালে তাদের ভেতরে দেশপ্রেম জন্মাবে না। সে জন্য তাদের নিয়ে এসেছি। 
একুশের প্রথম প্রহর ও শুক্রবার দিনভর আরও শ্রদ্ধা জানিয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি, বাসদ, জাগপা, যুবদল, শ্রমিক দল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, জাসাস, তাঁতী দল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, বিএফইউজে, ডিইউজে, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব) এবং উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন দল, সংগঠন ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। 

আরও যেসব আয়োজন
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী শিশু একাডেমির প্রধান ফটকের সামনে উন্মুক্ত সড়কে শহীদ স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। উদীচীর সহসভাপতি মাহমুদ সেলিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সহসভাপতি প্রবীর সরদার, সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে প্রমুখ। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে পরিবেশিত হয় গান, আবৃত্তি, নৃত্য ও পথনাটক। 
এ ছাড়া দিবসটি উপলক্ষে দোয়া মাহফিল ও ভাষাশহীদদের কবর জিয়ারত করেছে ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। 

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র ষ ট রপত স মরণ স গঠন প রথম সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

যে কারণে আমেরিকানরা গণতন্ত্র প্রত্যাখ্যান করলেন

কয়েক দিন আগে, ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশে একটি রহস্যময় বার্তা পোস্ট করেছেন। বার্তায় বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি নিজের দেশকে রক্ষা করে, সে কোনো আইন লঙ্ঘন করে না। ‘এটি অনেকটা ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের একটি বিখ্যাত উক্তির মতো শোনায়। তবে জনশ্রুতি আছে যে ট্রাম্প বই পড়েন না, সিনেমাও দেখেন না। হয়তো তাঁর সহযোগী ইলন মাস্ক বা অন্য কেউ এই কথা জোগান দিয়েছেন।

ট্রাম্প সব সময় বিশ্বাস করেন, তিনি আইনের ঊর্ধ্বে। তাঁর মনে হয়, ঈশ্বর তাঁকে প্রেসিডেন্ট বানিয়েছেন, তাই তিনি কোনো শাস্তি পাবেন না। তাঁর এই বিশ্বাসের সঙ্গে ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুইয়ের বিখ্যাত উক্তিটি বেশি মানানসই—‘আমিই রাষ্ট্র।’ ট্রাম্পের কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে চান।

ট্রাম্প কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান রক্ষা করতে চাননি; বরং দেশটির দুই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান—কংগ্রেস ও আদালতকে তিনি অবজ্ঞা করেন। এখন তিনি প্রেসিডেন্ট নয়, একজন স্বৈরশাসকের মতো আচরণ করছেন। যা খুশি তা–ই করছেন, ভয় বা পরিণতির পরোয়া না করেই।

যদি জনমত জরিপকে নির্ভরযোগ্য ধরে নেওয়া হয়, তাহলে বলা যায় যে বেশির ভাগ মার্কিন খুশিমনেই গণতন্ত্রের ক্ষয়ে যাওয়া অবশিষ্ট অংশকে ছুড়ে ফেলতে রাজি। তাঁরা মনে করেন, দাপুটে শক্তিমান নেতা ট্রাম্প তাঁদের রক্ষা করবেন। দেশের ভেতরে ও বাইরের শত্রুদের কবল থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি বাঁচাবেন, সেটা বাস্তবে হোক বা কল্পনায়।

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এত মার্কিন ট্রাম্পের মতো একজন বেপরোয়া প্রতারকের পেছনে ছুটছেন? কেন তাঁরা এমন উৎসাহ নিয়ে একজন এমন ব্যক্তিকে সমর্থন দিচ্ছেন, যিনি সমতার আদর্শকে অপ্রাসঙ্গিক ও বিরক্তিকর বলে মনে করেন। অথচ এই আদর্শ একসময় বিপ্লবের জন্ম দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে গড়ে তুলেছিল।

আমার বিশ্বাস, বেশির ভাগ মার্কিন গণতন্ত্রকে পরিত্যাগ করেছেন; কারণ, গণতন্ত্রই তাঁদের পরিত্যাগ করেছে। হাওয়ায় উড়তে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা, বুকে হাত রেখে নেওয়া শপথ—এগুলো পুরোনো বিশ্বাস আর ধরে রাখতে পারছে না। দেশের ক্ষমতাশালী ধনীরা সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করেন—এই বিশ্বাস আজ মৃত যেন।

হতাশাজনক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এক প্রতারকের কাছে মুক্তির আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য হয়েছেন। ট্রাম্প সহজ সমাধানের আশ্বাস দেন; কিন্তু কঠিন সমস্যাগুলোর গভীরে যেতে চান না।

অন্তত চারটি বড় ঘটনা একসঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ভেতরের ফাঁপা বাস্তবতা প্রকাশ করে দিয়েছে। এ ঘটনাগুলো মানুষের মনে গভীর হতাশা তৈরি করেছে। এই হতাশা ট্রাম্পকে শুধু রাজনৈতিক নয়; বরং সাংস্কৃতিকভাবেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমনকি বহু বুদ্ধিদীপ্ত নাগরিকও গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস হারিয়েছেন।

এই মিথ্যার ভিত্তি আসলে বহু আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও তাঁর সমর্থক হোয়াইট হাউস, কংগ্রেস এবং যুদ্ধ-উন্মাদ মিডিয়া নির্লজ্জভাবে প্রচার করেছিল যে ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র মজুত আছে। এই ভিত্তিহীন দাবির ওপর দাঁড়িয়ে ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করল, একটি স্বাধীন দেশকে ধ্বংস করে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করল। সচেতন নাগরিকেরা এই যুদ্ধের বিপক্ষে প্রতিবাদ করলেন। ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী তাঁদের অগ্রাহ্য তো করলই, সেই সঙ্গে তাঁদের বিশ্বাসঘাতক তকমা দিল।

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করার ব্যবস্থা। তখন তা ব্যর্থ হলো। গণতন্ত্রের এই কাঠামো রাষ্ট্রের ভুল সিদ্ধান্ত ঠেকানোর জন্য তৈরি হয়েছিল। সেটিই কাজে লাগানো হলো যুদ্ধবিরোধীদের দমন করতে। এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক বিপর্যয়ের নেপথ্যে থাকা বুশ ও তাঁর কয়েকজন অপরাধবোধহীন সহযোগী আজও দিব্যি আরামদায়ক অবসর উপভোগ করছেন।

অন্যদিকে যেসব মার্কিন সেনা ইরাক আক্রমণ করেছিলেন, লড়াই করেছিলেন, হত্যা করেছিলেন এবং নিজের প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁরা আজ বিস্মৃতপ্রায়। সাধারণ মানুষকে বলি দেওয়া হলো কয়েকজন ক্ষমতাশালীর সাম্রাজ্যবাদী স্বপ্ন পূরণের জন্য।

সরকার ও জনগণের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল, সেটি আরও দুর্বল হয়ে পড়ল ২০০৫ সালে হারিকেন ক্যাটরিনার আঘাতে। বন্যায় হাজার হাজার বাড়ি ডুবে গেল। প্রাণ হারালেন ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষ। যাঁরা বেঁচে রইলেন, তাঁরা নিজেরাই আশ্রয়, খাবার ও পানির সন্ধানে দিশাহারা হয়ে গেলেন।

এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও প্রেসিডেন্ট বুশ নিজের ব্যর্থ প্রশাসনের প্রশংসা করলেন। তিনি তখন হেলিকপ্টারে করে ধ্বংসস্তূপের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলেন। সেই মুহূর্তের ছবি যুক্তরাষ্ট্রের মনে গেঁথে গেল—একজন গর্বিত, বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি অসহায় নাগরিকদের কষ্ট বোঝার প্রয়োজনও বোধ করলেন না।

কিন্তু ২০০৮ সালে যখন ওয়াল স্ট্রিটের ধনী ব্যাংকাররা নিজেদের লোভের কারণে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করলেন, তখন বুশ তড়িঘড়ি করে তাঁদের রক্ষায় এগিয়ে এলেন। এই সংকটের কারণ ছিল সাবপ্রাইম মর্টগেজ প্রতারণা—একধরনের জালিয়াতি। যখন সেই প্রতারণার ফল ভোগ করার সময় এলো, তখন সাধারণ মার্কিনদের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে সেটি পুষিয়ে দিতে হলো। দেশের ভঙ্গুর আর্থিক ব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে গেল।

করদাতাদের মোট ৭ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার দিয়ে জরুরি ঋণ দেওয়া হলো, যাতে বড় ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে না যায়। অথচ সাধারণ মানুষ তখন ঋণের দুশ্চিন্তায় দৈনন্দিন খরচ চালাতেও হিমশিম খাচ্ছিলেন। এই সংকটকে বলা হয় ‘গ্রেট রিসেশন’। দুই বছর ধরে মার্কিনরা ভয়ানক অর্থনৈতিক দুর্দশায় কাটিয়েছিলেন।

সমাজের শীর্ষ ধনী শ্রেণির বুশ আবারও প্রমাণ করলেন যে তাঁর দায়িত্ব আসলে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা নয়; বরং তাঁর প্রধান লক্ষ্য বিত্তবান বন্ধুদের ও ক্ষমতাবান ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা দেওয়া। এর জন্য যত কষ্ট, তা সাধারণ মানুষই সহ্য করুক।

এরপর যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ আশায় বুক বাঁধল বারাক ওবামাকে নিয়ে। তিনি বললেন, তিনি সাধারণ ঘরের ছেলে। তাঁর শিকড় শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে যুক্ত। তিনি বুঝতে পারেন সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট। এসব কথা তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলল। তিনি হয়ে উঠলেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন গণতন্ত্রের প্রতীক; কিন্তু ওবামাও বুঝতে পেরেছিলেন যে বুশের মতোই তাঁর আসল দায়িত্ব হলো ক্ষমতাবান ও ধনিকশ্রেণিকে খুশি রাখা। তাঁর বিখ্যাত স্লোগান ‘হ্যাঁ, আমরা পারি’ আসলে ছিল একধরনের ধোঁকা। তিনি সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে তিনি তাঁদের পাশে আছেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি ছিলেন সেই ধনী অভিজাতদের বন্ধু, যাঁরা তাঁকে প্রেসিডেন্ট বানিয়েছিলেন।

এই ভানও পুরোপুরি উন্মোচিত হলো। দেখা গেল, ওবামার প্রশাসন ব্যাংক জালিয়াতদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি। লাখো শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত মার্কিনদের সর্বনাশ করেছিল যে ব্যাংক জালিয়াতেরা, তাঁরা কেউ বিচারের মুখোমুখি হননি।

ওবামার এই ব্যর্থতা প্রমাণ করল যে যুক্তরাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা আসলে দ্বিস্তরবিশিষ্ট। এখানে গরিবদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। অপর দিকে সুরক্ষিত রাখা হয় ধনীদের।

এই হতাশাজনক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এক প্রতারকের কাছে মুক্তির আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য হয়েছেন। ট্রাম্প সহজ সমাধানের আশ্বাস দেন; কিন্তু কঠিন সমস্যাগুলোর গভীরে যেতে চান না।

যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের আবার আশাহত হওয়াটা এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।

এন্ড্রু মিত্রভিকা আল–জাজিরার কলাম লেখক

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া ইংরেজির বাংলা অনুবাদ জাভেদ হুসেন

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ছাড়া প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়
  • যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র রক্ষায় রাজপথে থাকতে হবে
  • ফ্যাসিবাদবিরোধী সব পক্ষকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে: অ্যাটর্নি জেনারেল
  • মানুষ অবিলম্বে ভোট দেওয়ার জন আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখতে চায়
  • যে কারণে আমেরিকানরা গণতন্ত্র প্রত্যাখ্যান করলেন
  • অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে কি না, তা মানুষের ‘রাডারে’ রয়েছে: মঈন খান
  • নীতি নির্ধারণে নাগরিকের অংশগ্রহণ
  • শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে শেরপুরে সমাবেশ
  • বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের প্রত্যাশায় মানুষ বসে আছে: দুদু