শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে হেঁটে বইমেলায় প্রবেশ করার চিরাচরিত রূপটি গতকাল শুক্রবার দেখা যায়নি। একুশে ফেব্রুয়ারি হওয়া সত্ত্বেও সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ফাঁকা ছিল। দর্শনার্থী ও পাঠকশূন্য পরিবেশ বিরাজ করে দুপুর পর্যন্ত। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ চিত্র পাল্টাতে থাকে। দিনশেষে টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর জনসমুদ্রে পূর্ণ হয়।
শ্যামলী থেকে দুই মেয়েকে নিয়ে মেলায় আসেন সরকারি চাকরিজীবী আসমা আক্তার। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় আমি পত্রিকা দেখে তালিকা করে রাখতাম কোন কোন বই কিনব। মেলার শেষ দিকে এসে সেই বইগুলো কিনতাম। অন্য কিছু না পারি, সন্তানদের সেই ধারাটা শেখানোর চেষ্টা করছি।’
কমিক্সের স্টলে দেখা যায় ভিড়। তরুণদের কাছে জনপ্রিয় মাঙ্গা কমিক্সের প্রকাশনী সোর্সের মহাব্যবস্থাপক নয়ন বলেন, ‘বিকেলের পর থেকে স্টলে ভিড় বাড়ছে। বলতে পারি, আজকে বিকেল থেকে ৩০০-৪০০ বই বেচেছি।’
গতকাল মেলায় নতুন পালক যুক্ত করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান। যৌথ আয়োজনে উদ্যানের মুক্তমঞ্চে চলছে অমর একুশে নাট্যোৎসব। এই মঞ্চে নাটক উপভোগ করতে আসা আল আমিন বলেন, ‘একদিকে নাটক, অন্যদিকে বইমেলা, খুব ভালো লাগছে।’
গতকাল শিশু চত্বরও ছিল সরব। বিকেলের পর থেকে শিশু চত্বরের প্রতিটি স্টলে ভিড় দেখা গেছে। ছোট্ট রিমু মেলায় তার বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রথম এসেছে। সে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন স্টলে গিয়ে ছবিযুক্ত বই আছে কিনা, জিজ্ঞেস করছে। তার এই আনন্দ দেখে বাবা আমিনুল বলেন, ‘মেলায় এসে এ রকম খোলা পরিবেশ, নানান বই দেখে ওদের আনন্দে আমরাও আনন্দিত হচ্ছি।’
আগামী প্রকাশনীর মালিক ওসমান গণি বলেন, ‘আমাদের প্রকাশনা শিল্প বিকাশে অমর একুশে গ্রন্থমেলা বড় ভূমিকা রেখেছে। আমরা চাইব, এই মেলা যেন কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রকাশকরা সব সময় আশাবাদী। সামনের দিনগুলো ভালো হবে– এই প্রত্যাশা আমাদের।’
অসংগতি
টিএসসি চত্বরের মেলার প্রবেশদ্বারে নারী-পুরুষের চেকিং গেট থাকলেও গতকাল ভিড়ে আলাদা করে ঢোকার উপায় ছিল না। টিএসসি ও দোয়েল চত্বরে ছিল প্রচুর হকার। দিনে দেখা যায় অবাধে দোয়েল চত্বর থেকে ঢুকছে মোটরসাইকেল ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা। সন্ধ্যায় সে পরিস্থিতি না থাকলেও হকারদের অত্যাচার বাড়ে। পুরো এলাকাজুড়ে সৃষ্টি হয় মেলায় আগত পাঠক ও দর্শনার্থীদের, ফলে যানজট। পুলিশ ও মেলার নিরাপত্তারক্ষীদের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হিমশিম খেতে হয়।
নতুন বই
গতকাল মেলায় আসে ৩০৭টি নতুন বই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো–আবদুন নূরের রক্তস্নাত একুশে (আগামী), মাসুম মাহমুদের ইফা ও জাদুর পেনসিল (ময়ূরপঙ্খি), দেওয়ান আজিজের মাটির ময়না ও হিম বাতাসের গল্প (অর্জন), হাসান হাফিজের সোনালী সব রূপকথা (বার্ডস), ড.
মঞ্চের আয়োজন
সকাল ৮টায় মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। এতে প্রায় দেড় শতাধিক কবি অংশ নেন। সভাপতিত্ব করেন হাসান হাফিজ। বিকেল ৪টায় মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বক্তৃতা ২০২৫। স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম। ‘ভাষার লড়াই, গণঅভ্যুত্থান ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আনু মুহাম্মদ। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি আবুল কাসেম ফজলুল হক।
আনু মুহাম্মদ বলেন, ভাষা আন্দোলনের প্রেরণাই ছিল পরবর্তী উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন এবং চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শক্তি। ন্যায়সংগত, বৈষম্যমুক্ত সমাজের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে নিরন্তর সংগ্রাম করেছি।
লেখক বলছি মঞ্চে আলোচনা করেন মোহন রায়হান এবং আবিদ আজম।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন রুম্মানা জান্নাত, নিলয় রফিক ও কাজিম রেজা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী শাহিন পারভীন, অধরা সরকার রিয়া, এ কে এম সাইদ হোসেন, তাহরিমা বতুল রিভাসহ অনেকে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সুরে-গানে-তালে বৈশাখকে বরণ করল রাবি
বাংলা বছরের প্রথম দিনকে স্বাগত জানাতে বাঙালি মেতে উঠেছে নানা আয়োজনে। বাঙালি জাতিসত্তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অন্যতম দিনটিকে কেন্দ্র করে সর্বত্রই বইছে উৎসবের আমেজ। জাতি-গোত্র-বর্ণ সব ভেদাভেদ ভুলে সকলে একযোগে দিনটি উদযাপন করেছে।
বৈশাখের আগমনকে নতুন সুরে, গানে, তালে বরণ করে নিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষক শিক্ষার্থীরা।
সোমবার (১৪ এপ্রিল) সকাল ৯টায় চারুকলা চত্বরে মুক্তমঞ্চে বর্ষবরণের কর্মসূচি উদ্বোধন করেন উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব। পরে বেলা ১০টায় চারুকলা চত্বর থেকে শুরু হওয়া বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে।
আরো পড়ুন:
নববর্ষে থাকবে রাবি অধ্যাপকের ৩০০ ফুটের স্ক্রলচিত্র প্রদর্শনী
রাবি শিক্ষার্থীদের বিজু উৎসব উদযাপন
শোভাযাত্রায় উপাচার্য, উপ-উপাচার্যসহ বিপুল সংখ্যক শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অংশ নেন।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনও নিজ নিজ কর্মসূচির মাধ্যমে বর্ষবরণ উদযাপন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, লোক প্রশাসন বিভাগ, ফলিত গণিত বিভাগ, মার্কেটিং বিভাগসহ একাধিক বিভাগ নতুন বছরকে বরণ করে নিতে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
এবারের আয়োজনে ছিলো নানা ধরনের ব্যানার আর ফেস্টুন। শোভাযাত্রায় ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান, বাঙালির ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কালচার তুলে ধরতে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন মোটিফ। তবে আগের বছরগুলোর তুলনায় এবার আয়োজনের ব্যাপ্তি কিছুটা কমেছে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরা কেউ শখের হাড়ির ভাস্কর্য, আবার কেউ বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে রঙ তুলিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। কেউ ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে এঁকেছেন নানা চিত্র। মাঠজুড়ে বিরাজ করছে বাঁশের ফালি দিয়ে শখের হাঁড়ি ও পালকি। আবার কেউ কেউ মধ্যপ্রাচ্যের মানবতার বিপর্যয়কে প্রতীকী করে শলাকা দিয়ে মিসাইল বোমা ও ড্রোন বানিয়েছেন।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ফারিহা সাঈদ নিশা বলেন, “এটা আমার জীবনের প্রথম বৈশাখ পালন। আগে কখনো এত বড় করে পালন করা হয়নি। সবার সঙ্গে অনেক আনন্দ করলাম, অনেক ভালো লাগলো। বৈশাখের আনন্দ সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক, এই কামনা করছি।”
রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেন বকুল বলেন, “শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে নতুন বর্ষকে আমরা বরণ করে নিলাম। আমার শিক্ষার্থীরা গত এক সপ্তাহ ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে ব্যানার ফেস্টুন তৈরি করেছে। সেসব নিয়ে সবাই উল্লাসে মেতেছে আজ। নববর্ষে এমন আয়োজন করতে সত্যি খুশি লাগছে। এর জন্য আমার শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তারা অনেক পরিশ্রম করেছে।”
বর্ষবরণের কর্মসূচিতে ক্যাম্পাস জুড়ে বিভিন্ন বিভাগ ও সংগঠনের উদ্যোগে দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়েছে।
ঢাকা/ফাহিম/মেহেদী