বাংলাদেশের এক আবছায়া অধ্যায় ১৯৭২ থেকে ’৭৫ সাল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের শত্রু ছিল চেনা। কিন্তু সাতচল্লিশ-পরবর্তী বাংলাদেশের এই সময়টা এত বেশি আলো-আঁধারিময় যে তখনকার দেশ ও সমাজের নিখুঁত পরিস্থিতি জানা এবং তা শিল্পে দক্ষতার সঙ্গে প্রতিস্থাপন শুধু কঠিনই নয়, একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জের। ফলে যখন শুনলাম, দুঃসময়ের অন্যতম এই সময়েও যারা সফলভাবে কলম সচল রেখেছেন তাদেরই একজন অঞ্জন আচার্য ১৯৭২ থেকে ’৭৫ সময়কাল নিয়ে গল্প লিখছেন, তখন বইটি নিয়ে আগ্রহটা তীব্র হলো। ‘সাদা রাত’ নামে ইতিহাসধর্মী গল্পগ্রন্থটি পড়ে মনে হলো এটি সাহিত্য সৃষ্টিতে অঞ্জন আচার্যের উল্লেখযোগ্য চেষ্টাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
অন্যতম বলার কারণ অনেক। প্রথমত অঞ্জন আচার্যের ভাষা ও গদ্যের গাঁথুনি। বইটির প্রতিটি গল্পের চরিত্ররাই কেমন আলো আঁধারিময়। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এ চরিত্রগুলো আমাদের অতি চেনা। তারপরও যেন বহু চেনা বাকি রয়ে গিয়েছিল। বইটিতে লেখক চেষ্টা করেছেন চরিত্রগুলোকে নতুন করে চেনাতে। তথ্যের সত্যাসত্য এখানে প্রচণ্ডভাবে বিবেচ্য। এই দেশের ইতিহাসের নানা চরিত্র সম্পর্কে যেভাবে পক্ষপাতিত্বমূলক ভিন্ন ভিন্ন ন্যারেশন তৈরি হয়েছে, তাতে নিজস্ব পড়া বা জানার বাইরে বিশ্লেষণ ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটানো কঠিন। তবে বইটি হয়তো সেই বিতর্ক উতরে যাবে ফিকশনের বদৌলতে। তারপরও অঞ্জন ইতিহাসের ঘোড়ায় চড়ে চেনা চরিত্র বিশ্লেষণে যেভাবে আবেগের লাগাম ধরেছেন, তা সত্যি প্রশংসনীয়।
বইয়ের গল্পগুলো পড়তে পড়তে পাঠক ভেসে চলেন এক রহস্যময় কালপর্বের মেঘের ভেলায়। খন্দকার মোশতাক আহমেদকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে প্রথম গল্প ‘আগামসি লেনের কিস্তি টুপি’, সিরাজ সিকদারের ঘটনাকে উপজীব্য করে লেখা ‘দ্য লাস্ট কনফেশন’, সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা পার্টির পরিণতি নিয়ে ‘পেয়ারাবাগানের ইশতেহার’, রক্ষীবাহিনী ও বাকশালকে নিয়ে ‘জলপাই রঙের ছায়া’, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্র করে ‘আকালের আখ্যান’, তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে ‘যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ’, খালেদ মোশাররফকে কেন্দ্র করে গল্প ‘অপাঙক্তেয়’, কর্নেল তাহেরকে উপজীব্য করে গল্প ‘অনবসরপ্রাপ্ত ক্রাচ’, জাতীয় চার নেতার জেলহত্যাকে কেন্দ্র করে রচিত গল্প ‘গারদে গুলির দাগ’।
বইটি সম্পর্কে ফ্ল্যাপে লেখক নিজেই বলেন, এই সময়কে ধরে এর আগে কোনো সিরিজ গল্প লেখা হয়েছে বলে জানা নেই। কারও প্রতি পক্ষপাত হয়ে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে-মিশিয়ে লেখা নয়, কিংবা সত্যকে আড়াল করে কেবল চাটুকারিতা নয়। অন্যদিকে প্রতিপক্ষের ভূমিকায় নেমে একপেশে নিন্দা-মন্দ নয়, বরং সত্যকে সৎসাহসের সঙ্গে বলার লক্ষ্যে দেশের ইতিহাস ও সাধারণ মানুষের প্রতি দায় থেকেই এই বই লেখা। এটি নিছক কোনো গল্পের বই নয়।
লেখকের স্বীকারোক্তিতে এটি স্পষ্ট যে তিনি শিল্পের চেয়ে দায়বোধকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তার মানে তিনি ঠিক গল্পও লিখতে চাননি। এখানেই বিতর্কের সমূহ অবকাশ থাকে। ইতিহাসের এমন এক যুগ সন্ধিক্ষণের ঘটনা গল্পের আঙ্গিকে উপস্থাপন আলোচনা-সমালোচনার দাবি রাখে। লেখক নিজেকে যতই নির্মোহ বলে ঘোষণা করুন না কেন, পাঠকও আতশকাঁচ দিয়ে তা মূল্যায়ন করতে সচেষ্ট হতে পারেন। কারণ, শিল্পীর কাছে শিল্পের চেয়ে ইতিহাস ও সাধারণ মানুষের প্রতি দায় যদি প্রকট হয়ে ওঠে, সেখানে শিল্প তার সৌন্দর্য হারাবেই; এটি সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। ইতিহাস জানার জন্য গল্পের গহীন সরোবরে অবগাহনের আদৌ কোনো যুক্তি আছে কিনা, তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। এরপরও ইতিহাস ও আখ্যানের মেলবন্ধনে গল্পকার অভিনব কায়দায় কিছু কালপ্রভাবী গল্প সরল ভঙিমায় নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করে বিমোহিত করেছেন। পাঠককে চিন্তার সমুদ্রে পক্ষ-বিপক্ষের ঢেউয়ে হাবুডুবু খাওয়ার সুযোগ করে দেওয়াটাও কম কৃতিত্বের নয়।
বইটির চলমান পাঠক্রমের ভেতর দিয়ে নিজের অমীমাংসিত প্রশ্নের হয়তো অনেক উত্তর খুঁজেছি। যেমন স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও দলের জ্যেষ্ঠ নেতা খন্দকার মোশতাক কেন, কীভাবে ক্ষমতা দখল করলেন? সে সময় চরমপন্থি নেতা সিরাজ সিকদার ও তাঁর দল সর্বহারা পার্টির ভূমিকা কী ছিল? রক্ষীবাহিনী কেন গঠন করা হলো, তাদের নিয়ে কেন এত বিতর্ক? চুয়াত্তর সালে কেন দুর্ভিক্ষ হলো? কেন একদলীয় শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’ গঠন করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান? তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নিবিড় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ফাটল কেন ধরল? কী কারণে তাদের দু’জনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হলো, কেন একসময় বাধ্য হয়ে তাজউদ্দীনকে মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করতে হলো? জেলখানার মতো নিরাপদ জায়গায় আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে কেন ও কীভাবে হত্যা করা হলো? ৪ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ কীভাবে ক্যু করলেন, এরপর মাত্র তিন দিনের মাথায় ৭ নভেম্বর তাঁর দুই সহযোগী কর্নেল নাজমুল হুদা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল হায়দারকে হত্যার পর পাল্টা ক্যু হলো, সে সময় কর্নেল তাহের ও তাঁর দল জাসদ গণবাহিনীর কী ভূমিকা ছিল? গল্পকার যতই তাঁর নিজের মতো করে এসব সত্য উপস্থাপন করেন, পাঠক হিসেবে আমিও ইতিহাসের এই অধ্যায়কে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করি।
প্রতিটি গল্পে ইরাজ নামক চরিত্রটির উপস্থিতি লক্ষণীয়। ইরাজকে কেন্দ্র করে গল্প আবর্তিত হলেও সুকৌশলে গল্পকার ঐতিহাসিক চরিত্র ও ঘটনার অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন। গল্প পড়ার সময় মাঝে মাঝে থমকে যেতে হয় এ ভেবে যে, পাঠক কি ইতিহাসের পাঠ নিতে এসেছেন গল্পকারের কাছে। এভাবে সরাসরি ইতিহাসের ঘটনা ও চরিত্রকে উপজীব্য করে গল্পপাঠ কখনও পাঠকের কাছে অযৌক্তিক বলেও মনে হতে পারে। পূর্বনির্ধারিত বিষয়কে পাঠকের নজরে আনার জন্য গল্পকার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ ঘটাতে চেয়েছেন; যা নিয়ে পাঠকের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার অবকাশ থাকে।
সাদা রাত ।। অঞ্জন আচার্য ।। গল্প ।। প্রকাশক: বিদ্যাপ্রকাশ ।। প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ ।। পৃষ্ঠা: ৭২ ।। মূল্য: ২২০ টাকা
পলাশ মজুমদার, কথাসাহিত্যিক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বইম ল ক ন দ র কর ত জউদ দ ন কর ন ল উপস থ
এছাড়াও পড়ুন:
গণহত্যার অস্বীকার ঠেকাতে আগে বিচার দরকার
ব্যক্তির স্বাধীনতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার বোধও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার বিচারের দাবি দানা বাঁধতে বাঁধতে প্রতিশোধপরায়ণ রাজনীতিতে পর্যবসিত হয়েছিল। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান অস্বীকারের প্রবণতা একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস এবং গণহত্যা দিবস স্মরণে বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত সেমিনারে উঠে এসেছে এ কথাগুলো। গতকাল মঙ্গলবার বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আয়োজিত এ সেমিনারে ‘গণহত্যা, অস্বীকারের প্রবণতা এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসর’ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লেখক ও গবেষক সহুল আহমদ।
সহুল আহমদ তাঁর প্রবন্ধে বলেন, গণহত্যাকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদাহরণ পৃথিবীতে কমই আছে। গণহত্যা বা এ ধরনের অপরাধের ঘটনার সত্যতার অস্বীকার ঠেকাতে সবার আগে দরকার বিচার।
এই প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম ও লেখক সারোয়ার তুষার। তাঁদের বক্তব্যে উঠে আসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণমানুষের অধিকার ও ন্যায্যতার হিস্যা বুঝে নেওয়ার লড়াই। তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পক্ষপাতের পঙ্ক থেকে মুক্ত করতে হবে। ১৯৭১ থেকে ২০২৪—গণহত্যার পক্ষগুলো সব সময় জাতিগত অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করে দিয়েছে, মানুষের মনে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করেছে।
স্বাগত ভাষণে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, ১৯৭১–এর পূর্বকালে এ অঞ্চলের মানুষ সুদীর্ঘকাল রাজনৈতিক আলোচনা, মীমাংসা ইত্যাদি চালিয়েছে। তবে একাত্তরের ২৫ মার্চ সবকিছু ছাপিয়ে সর্বাত্মক স্বাধীনতা অর্জনের প্রশ্নই বড় হয়ে উঠেছে।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্নে সুদীর্ঘকাল লড়াই–সংগ্রাম করেছে, রক্ত দিয়েছে, স্বপ্নভঙ্গের শিকারও হয়েছে। যে বিপুল জনগোষ্ঠী একাত্তরে গণহত্যার শিকার হয়েছে, তাদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বদেশে আমরা স্বাধীনতাকে অর্থবহ এবং মানুষের জন্য কল্যাণকর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি কি না, সেটাই আজকের দিনের বড় প্রশ্ন।’
অনুষ্ঠান শেষে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।