‘বইয়ের অনুবাদ স্বত্ব কেনা মোটেও সহজ নয়’
Published: 21st, February 2025 GMT
মুম রহমান গল্পকার, ঔপন্যাসিক। অনুবাদক হিসেবে তার আলাদা পরিচিতি রয়েছে পাঠক সমাজে। পাশাপাশি তিনি শিল্প সমালোচক, নাট্যকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। গদ্যকার হিসেবে গণমাধ্যম সম্পাদকদের কাছেও তিনি সমাদৃত। প্রকাশিত গ্রন্থ ৫০-এর অধিক। শিক্ষকতা, বিজ্ঞাপন কর্মকর্তা, সাংবাদিকতা, এনজিও ইত্যাদি নানা পেশা ছেড়ে বর্তমানে পূর্ণকালীন লেখক। একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে অনুবাদ প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন অলাত এহ্সান।
অলাত এহ্সান: দেশে অনূদিত বইয়ের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনুবাদক হিসেবে আপনি কী বলেন?
মুম রহমান: আমার অভিজ্ঞতা আপনাদের মতোই। আমিও লক্ষ্য করেছি, অনুবাদ হওয়া বই সংখ্যায় বাড়ছে এবং সেইসব বইয়ের প্রতি পাঠক, সমালোচক, প্রকাশক এবং ক্রেতা-বিক্রেতার আগ্রহ বাড়ছে।
আরো পড়ুন:
একুশে ফেব্রুয়ারি বইমেলা শুরু হবে সকাল ৭টায়
‘অনুমতি ছাড়া অনূদিত বই প্রকাশ সম্পূর্ণ অবৈধ’
অলাত এহ্সান: এ প্রসঙ্গে যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো- বইগুলোর অনুবাদ স্বত্ব। আমাদের এখানে অধিকাংশ অনূদিত বইয়ের অনুবাদ স্বত্ব নেয়া হয় না। এর কারণ কী বলে মনে করেন?
মুম রহমান: এর প্রথম কারণ অনেকটাই অর্থনৈতিক। এটা তো স্বীকার করতে হবে আমাদের দেশে একটা বই ছাপা হয় ৩০০ থেকে ৫০০ কপি। সব কপিও এক বছরে বিক্রি হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে বই ছাপানোর খরচ, অনুবাদকের পারিশ্রমিক দিয়ে প্রকাশককে লাভের মুখ দেখতে বেগ পেতে হয়। আদতে প্রকাশনা ব্যাপারটা এ দেশে এখনও বুটিক ইন্ডাস্ট্রি বা কুটিরশিল্প পর্যায়ে রয়ে গেছে। যেসব বই আমরা অনুবাদ করি, মূল ভাষায় বা ইংরেজিতে তা ছাপা হয় লাখ লাখ কপি। ফলে সেখান থেকে লেখক, প্রকাশক একটা বড় অঙ্কের আর্থিক সাফল্য আশা করতে পারেন। সচরাচর দেখা যায়, আমরা খুব আলোচিত বইগুলোই অনুবাদ করি। এইসব বইয়ের বৈশ্বিক বাজার বিশাল। কিন্তু বাংলাদেশে সেই বই ৫০০ বা বড় জোর ১০০০ কপি বিক্রি হতে পারে। এখন ১০০০ বই প্রকাশ করতে ১ বছরে ধরে নিন ১ লাখ টাকা লগ্নি করলেন, তাতে বছর শেষে কতো টাকাই-বা উঠে আসতে পারে?
দ্বিতীয়ত আমাদের প্রকাশনা যেহেতু এখন বিশ্ব প্রকাশনার সঙ্গে সংযুক্ত নয়, আমাদের প্রকাশনা এখনও বড় মাপের ব্যবসায়িক পূঁজির নয়, সেহেতু বাইরের বইয়ের স্বত্ব কেনাটা চাইলেও সহজ নয়। ধরুন আমি বা আপনি সদ্য নোবেলজয়ী কোনো লেখকের বই অনুবাদ করতে চাই এবং কপিরাইট নিয়েই; তাহলেও কিন্তু ব্যাপারটা কঠিন। বিশ্বে বই প্রকাশনা পেশাদার এজেন্ট নির্ভর। সেই এজেন্টদের সঙ্গে আমাদের সংযোগ নেই। আর একজন সদ্য নোবেল লরিয়েটের কাছে পৌঁছানো, তার বইয়ের অনুবাদ স্বত্ব কেনা মোটেও সহজ নয়। আমি এখনও বাংলাদেশে দেখিনি, শুনিনি যে নোবেলজয়ী কোনো লেখকের অনুমতিসাপেক্ষে তার অনুবাদ দেশে প্রকাশিত হয়েছে।
অলাত এহ্সান: অনুবাদ স্বত্ব না কেনায় আমাদের অনুবাদকেরা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাচ্ছেন না। এমনকি উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, কলকাতায় কিছু বই অনুবাদ হয়, পাঠক সমাদর পায় এই কারণে। তাতে আমরা কি পিছিয়ে পড়ছি না?
মুম রহমান: পিছিয়ে তো পড়েছি। সবচেয়ে বড় কথা, পাঠক হিসেবেই আমরা পিছিয়ে আছি। তারপর প্রকাশক, আন্তর্জাতিক অনুবাদ সংগঠকদের সঙ্গে যোগাযোগেও আমরা পিছিয়ে আছি। আর এই পিছিয়ে থাকার মূল কথাটা অর্থনৈতিক। এর ব্যাখ্যা আমি একটু আগেই দিয়েছি। যেখানে বই মূদ্রিত হয় ৫০০ কপি সেখানে অনুবাদককে যদি ১৫% রয়্যালটি দেন আর মূল লেখক বা যিনি অনুবাদ করেছেন তাকে যদি ১৫% দেন তাতে বইয়ের দাম হয়ে যাবে অনেক। তাছাড়া আপনি একজন বিদেশি লেখককে কতো টাকা দেবেন? আমরা একটা ভালো বিক্রি হওয়া বই থেকে সারা বছরে হয়তো ১০ হাজার টাকা রয়্যালটি পাই, ডলার বা পাউন্ডে তার পরিমাণ কতো? এখন একজন নোবেল লরিয়েট কিংবা বেস্ট সেলার লেখককে কি আপনি ২০০ বা ৪০০ ডলার বা পাউন্ডে সম্মানী দেবেন? ওটা তো ওদের কাছে খুচরো টাকার মতো। না হয় আপনি দিলেন, কিন্তু আপনি এ দেশের মার্কেট থেকে টাকা উঠিয়ে আনবেন কীভাবে? আপনি তো হাজার হাজার পাঠক, ক্রেতা তৈরি করতে পারেননি।
অলাত এহ্সান: দেশে একটা বইয়ের পাঁচ-সাতটা পর্যন্ত অনুবাদ হচ্ছে। সেক্ষেত্রে পাঠক কোনটা বেছে নেবেন? অনুবাদ স্বত্ব নিলে এমনটা হতো না। অনুবাদের মান নিয়েও কিছু বলার থাকত না।
মুম রহমান: মান নির্ধারণ কে করবে? পাঠক তো? তো সেটা পাঠকই ঠিক করে নেবে, কোন অনুবাদটার মান কেমন? সে কার বই কিনে পড়বে। পাঠক হিসেবে আপনি-আমিও মতামত দিতে পারি, প্রচার করতে পারি অনুবাদের মান নিয়ে। আসলে যে কোনো দেশের যে কোনো ভাষার সাহিত্যিকের ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাই পুরস্কার পাওয়ামাত্র তার বই অনূদিত হচ্ছে, ছাপা হচ্ছে। এটা বাণিজ্যিক কারণেই হয়। বাজারে যার চাহিদা আছে তার সাপ্লাই সবাই দিতে চায়।
অলাত এহ্সান: অনুবাদ বইয়ের প্রকাশনা এখন বিকাশমান একটা ক্ষেত্রে। কিন্তু মানহীন প্রকাশনার কারণে পাঠক নিজেদের প্রতারিত বোধ করে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। তাহলে প্রকাশনাও মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। আবার প্রকাশনীগুলোতে এখনো অনুবাদ বইয়ের পাণ্ডুলিপি দেখার মতো দুই ভাষাতেই দক্ষ ব্যক্তি কম। তাহলে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
মুম রহমান: আপনার নিশ্চয়ই ধারণা থাকার কথা এ দেশের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে। তারা লেখকের রয়্যালটি দিতেই গড়িমসি করে, দামাদামি করে, সেখানে আপনি আশা করতে পারেন না যে একেকটা প্রকাশনীতে অনুবাদ বইয়ের পাণ্ডুলিপি দেখার জন্য একেক ভাষার বিশেষজ্ঞ রাখবেন তারা। এটা অর্থনৈতিকভাবেও সম্ভব না, চিন্তাটাও অবাস্তব। এমন তো নয় যে আমাদের দেশে হাজার হাজার ড.
অলাত এহ্সান: দেশে বই প্রকাশের ক্ষেত্রে লেখক-প্রকাশক চুক্তি খুব একটা গুরুত্ব পায় না। অনুবাদের ক্ষেত্রেও কথাটা বলা যায়। অনেক ক্ষেত্রে অদক্ষ কাউকে দিয়ে, আবার ‘গুগল ট্রান্সলেট’ বলেও শোনা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রকাশকের ভূমিকা কেমন হওয়া দরকার মনে করেন?
মুম রহমান: প্রথমত প্রকাশককে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি সচেতন হতে হবে। আমাদের প্রকাশনায় জড়িত একটা বিরাট জনগোষ্ঠীর কিন্তু শিল্পসাহিত্য জ্ঞান নেই। প্রকাশকের কাজ তো বই ছাপা না। ভালো প্রোডাকশন, ভালো ছাপাখানা, ভালো কাগজ, চকচকে প্রচ্ছদ একটা বইকে ভালো চেহারা দেয়, কিন্তু বইয়ের ভেতরের খবর রাখাটা হলো প্রকাশকের আসল কাজ। সঠিক পাণ্ডুলিপি নির্বাচন করা প্রকাশকের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। ‘গুগল ট্রান্সলেট’ যদি কোন প্রকাশক ছেপেও থাকেন তাকে আমি প্রকাশক বলবো না, মূদ্রাকর বা বই ছাপা-বাঁধাইয়ের লোক বলবো।
অলাত এহ্সান: অনুবাদগ্রন্থে একটা বিশেষ দিক চোখে পড়ছে, প্রবাসী অনেকে অনুবাদ করছেন। এটা দারুণ! কিন্তু যে আলাপটা নানাভাবে সামনে আসছে— প্রকাশকরা তাদের বই প্রকাশে খুশি হচ্ছেন দুই কারণে— ১. অনুবাদ বইয়ের বিক্রি ও ২. অনুবাদকের সম্মানী এড়ানোর সুযোগ। আপনি কী বলবেন?
মুম রহমান: আপনার কথার সঙ্গে আমি এটুকু যোগ করবো, ভাষা জ্ঞান আর সাহিত্য জ্ঞান এক না। শিক্ষিত হলেই সাহিত্যিক হওয়া যায় না। আবার দুটো ভাষা জানলেই এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনুবাদ করা যায় না। অনুবাদ আসলে কেবল শব্দার্থ ধরে এগিয়ে যাওয়া নয়, বরং এটা আরো অনেক বেশি গভীরতর সাংস্কৃতিক, শৈল্পিক কর্মকাণ্ড। আপনি পোলান্ডে থাকলেন, সেখানে বিয়ে করলেন, সংসার পাতলেন, বাচ্চা-কাচ্চা হলো এবং আপনি ও আপনার শিশুরা অনুবাদ শুরু করে দিলেন, পোলিশ থেকে বাংলায় বা বাংলা থেকে পোলিশে— সেক্ষেত্রেও কিন্তু গ্যারান্টি দেয়া যায় না যে আপনি ও আপনার পরের প্রজন্ম ভালো অনুবাদক হবে।
একটা জায়গায় বা সংস্কৃতি বলয়ে থাকলে হয়তো কিছু সুবিধা হয়, কিন্তু সবার আগে তো নিজের মাতৃভাষা; মা, মাটিকে চিনতে হয়। শেকড় মজবুত হতে হবে, নইলে গাছ টিকবে না। এরপর অনুবাদক হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট লেখক এবং সেই লেখকের প্রতি একান্ত আনুগত্য, প্রেম থাকা জরুরি। বইয়ের বিক্রি আর সম্মানী এড়ানোর ফায়দাটা তো প্রকাশক দেখেনই, সেটা শুধু অনুবাদ নয়, মৌলিক বইয়ের ক্ষেত্রেও। বাংলাবাজারে কারো কারো মুখে শুনেছি প্রবাসী লেখক ধরার জন্য নাকি এক শ্রেণীর প্রকাশক আছে যাদেরকে বলা হয় ‘মুরগি ধরা লেখক’। মানে এই লেখকদের অগল্প, অকিবতা, অপন্যাস বা অপঅনুবাদ প্রকাশকরা ছাপছেন লেখকদের কাছ থেকে ডলার নিয়ে কিংবা লেখকের আমন্ত্রণে বিদেশ ভ্রমণ করে। কিন্তু এগুলো খুবই খণ্ডচিত্র। এসব কখনো মূলধারা প্রকাশকরা করেন না। আপনি খাদ্য, ওষুধ, দরকারি পণ্য ব্যবসাতেও তো অসততা দেখেন, প্রকাশনায় কি থাকবে না? তারা আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুর লোক নন। উপরন্তু প্রবাসেও আমাদের অনেক বড় বড় লেখক আছেন। কাজেই ঢালাওভাবে সব কিছুকে খারাপ বলা যায় না।
অলাত এহ্সান: প্রকাশনা ও লেখালেখির ক্ষেত্রে একটা বিরাট ঝুঁকি হয়ে গেছে বই পাইরেসি। এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো তৎপরতা দেখি না।
মুম রহমান: আপনার ধারণা নেই, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কী পরিমাণ শ্রম দিতে হয়। একটা বিশৃঙ্খলতার মধ্যে আমরা আছি। খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, চুরিসহ নিত্যনতুন উপায়ে অপরাধ হচ্ছে দেশে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তো স্বভাবতই বড় বড় অপরাধ আর অন্যায় রোধেই ব্যস্ত থাকবে। বইয়ের পাইরেসি, সিনেমার পাইরেসি নিয়ে কাজ করতে গেলে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিসর আরো বড় করতে হবে। এ বিষয়ে আরো বিশেষজ্ঞ লোক নিয়োগ দিতে হবে। আগে তো ভাত, ডাল খাবো, পরে না হয় সালাদের কথা ভাববো। দেশে নানা ক্ষেত্রেই আগে নিরাপত্ত আসা জরুরি, তারপর না হয় বইয়ের কথা আসবে।
তারা//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর বইম ল বই ম ম রহম ন বইয় র প বই ছ প অন দ ত আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
আইনের হাত বনাম নিজের হাত
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বিশেষত বাংলাদেশে গত ২৬ জুলাই-পরবর্তী আট মাসের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী। গণপিটুনি, স্থানীয়ভাবে বিচারকাজ পরিচালনা, মিথ্যা অভিযোগের মাধ্যমে ব্যক্তিগত প্রতিশোধ গ্রহণ এসব অনিয়ন্ত্রিত প্রবণতা সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে এবং আইনশৃঙ্খলার ভিত্তি দুর্বল করে দিচ্ছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকারিতা ও বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ব্যাহত হলে জনমনে অবিশ্বাস দানা বাঁধে, যা দীর্ঘ মেয়াদে রাষ্ট্রকে ভয়াবহ সংকটের দিকে ঠেলে দিতে পারে। জনগণ যখন ন্যায়বিচার পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে না, তখন তারা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে উদ্বুদ্ধ হয়। এর ফলে সামাজিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয় এবং অপরাধপ্রবণতা বাড়ে।
এ সমস্যা নিরসনে যথাযথ আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করা, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে তার কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং মিথ্যা অভিযোগ ও গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। একই সঙ্গে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। কার্যকর ও দায়িত্বশীল পদক্ষেপের মাধ্যমে একটি সুস্থ, ন্যায়ভিত্তিক ও স্থিতিশীল সমাজ গঠন সম্ভব।
অনেক সময় অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে ভুক্তভোগীদের দীর্ঘ সময় এবং অর্থ ব্যয় করতে হয়। অতীতে বহু অপরাধের বিচার হয়নি; প্রকৃত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে এবং অপরাধীরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব ব্যবহার করে অথবা আইন ও পুলিশি ব্যবস্থার দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে বিচার কার্যক্রম প্রভাবিত বা অসম্পূর্ণ করে তোলে। অনেক সময় পুলিশের গাফিলতি ও প্রশাসনিক দুর্নীতির কারণে অনেক অপরাধী বিচারের আওতার বাইরে থেকে যায়, যা জনগণের আইনের প্রতি আস্থা হ্রাস করে। অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত অভিযোগকারীরা ন্যায়বিচার পান না। বরং মিথ্যা অভিযোগকারীরা রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে সক্ষম হয়। আমরা দেখেছি, পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনিয়ে নিয়ে জনগণ গণপিটুনির মাধ্যমে বিচার সম্পন্ন করছে। এটি মূলত সমাজে ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া ও প্রশাসনের প্রতি মানুষের ক্ষোভের ইঙ্গিত দেয়।
সাধারণ মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। তারা মনে করে, প্রশাসন বা পুলিশ তাদের কাজ সঠিকভাবে করছে না। ফলে তারা নিজেদের উদ্যোগে শাস্তি দিয়ে প্রশাসনকে শেখাতে চায়– কীভাবে ন্যায়বিচার করতে হয়। প্রশাসনকে বিচার শেখানোর উদ্দেশ্যে এটি করা হলেও যদি বারবার তা ঘটতে থাকে, তা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য শুভ লক্ষণ নয়। এভাবে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা কোনোভাবেই আইনি বা ন্যায্য পদ্ধতির অংশ নয়।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকারিতা ও বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ব্যাহত হলে জনমনে অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়, যা দীর্ঘ মেয়াদে রাষ্ট্রকে ভয়াবহ সংকটের দিকে ঠেলে দিতে পারে। যখন জনগণ ন্যায়বিচার পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে না, তখন তারা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে উদ্বুদ্ধ হয়। ফলে সামাজিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত হয় এবং অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
একটি সুস্থ সমাজ গঠনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন অপরিহার্য। জনগণের মধ্যে আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা রোধ এবং মিথ্যা অভিযোগকারীদের শাস্তির আওতায় আনা হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সহজ হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা এবং আইন সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে পারলে দেশ আরও নিরাপদ ও ন্যায়ভিত্তিক হবে। আইনের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানো এবং বিচার প্রক্রিয়া কার্যকর করার মধ্য দিয়েই একটি আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
উছমান গনি: শিক্ষক
usmgoni@gmail.com