ভাষা সংরক্ষণ ও শিক্ষার নতুন দিগন্ত উন্মোচনে প্রযুক্তি হোক শক্তি
Published: 21st, February 2025 GMT
ভাষা আন্দোলনের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাওয়ার ২৫ বছর পূর্তি আজ। মায়ের ভাষার অধিকার রক্ষায় আমরা সংগ্রাম করেছিলাম। মাতৃভাষার গুরুত্ব শুধু যোগাযোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি আমাদের সংস্কৃতি, পরিচয় ও মানবিক বন্ধনের অংশ। রজতজয়ন্তীর এই বছর আমাদের আবারও মনে করিয়ে দেয়, ভাষাগত বৈচিত্র্য ও বহুভাষা চর্চা জাতীয় মর্যাদা, শান্তি ও পারস্পরিক বোঝাপড়া গড়ে তোলার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে সরকারি স্বীকৃতি পাওয়া ৫০টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী প্রায় ৪১টি ভাষায় কথা বলে। এই ভাষাগুলো চারটি আলাদা ভাষা পরিবারের অন্তর্গত। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ১৫টি ভাষা বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে, এর মধ্যে রেংমিটচ্য ভাষাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে মাত্র সাতজন এই ভাষায় কথা বলে। একটি ভাষার মৃত্যু মানে একটি সংস্কৃতির হারিয়ে যাওয়া। তাই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এসব ভাষা রক্ষা করা ও সংরক্ষণে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা যখন তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করে, তখন তারা দ্রুত শিখতে পারে এবং তাদের যোগাযোগ দক্ষতা ভালো হয়। ১৮৬২ সালে চট্টগ্রাম পার্বত্য জেলায় চাকমা ও মারমা ভাষায় শিক্ষা চালু করা হয়, তবে পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ভাষাশিক্ষা পুনরুজ্জীবিত করার জন্য নানা সময়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও, কোনো উদ্যোগই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তিতে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা হয়। ২০১২ সালে জাতীয় শিক্ষানীতির আওতায় সরকার আদিবাসী ভাষায় শিক্ষা চালুর উদ্যোগ নেয়। ২০১৭ সাল থেকে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদ্রি ভাষায় প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাসামগ্রী প্রবর্তিত হলেও কার্যক্রমটি নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে। দক্ষ শিক্ষক সংকট, শিক্ষাসামগ্রীর পর্যাপ্ত মূল্যায়নের অভাব, বাজেট সীমাবদ্ধতা, ভাষাভিত্তিক শিক্ষকদের ঘাটতি এবং ছোট জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষা বাস্তবায়ন কমিটির নিষ্ক্রিয়তার ফলে এ উদ্যোগ প্রত্যাশিত অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি।
এমন প্রেক্ষাপটে আদিবাসী ভাষার পুনরুজ্জীবন, উন্নয়ন ও সংরক্ষণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে আদিবাসী ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়ন, জাতীয় ভাষানীতি প্রণয়ন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক বিভাগ বা ইনস্টিটিউট চালু করা, তরুণদের মাঝে মাতৃভাষার চর্চা উৎসাহিত করা, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ভাষার বিকাশ সাধন এবং বাংলা একাডেমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানে আদিবাসী ভাষা সেল প্রতিষ্ঠা করা।
২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিপাদ্য হলো– ‘প্রযুক্তির মাধ্যমে ভাষা সংরক্ষণ ও শিক্ষা’। এটি ভাষা সংরক্ষণ ও শিক্ষা ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তি ব্যবহারের নতুন পথ খুলে দিতে পারে। ভাষাশিক্ষার জন্য কম খরচে সবার কাছে সহজে পৌঁছে যাওয়ার একটি উপায় হতে পারে ইন্টারনেটভিত্তিক ভাষা মডিউল, যা ইতোমধ্যে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্ল্যাটফর্মে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা চলছে, যা শিক্ষক সংকটের মতো বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যবহার করা যেতে পারে। উন্নত প্রযুক্তিগত সমাধানের অংশ হিসেবে আদিবাসী ভাষায় কনটেন্ট তৈরি করার কথাও ভাবা হচ্ছে। তবে এসব ভাষায় পর্যাপ্ত ডিজিটাল কনটেন্টের অভাব থাকায় এখনও এ ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন সহজ নয়।
ভাষা সংরক্ষণ ও নথিভুক্তির অসংখ্য সুযোগও এনে দিতে পারে প্রযুক্তি। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি আদিবাসী ভাষা বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে, তাই এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এ লক্ষ্যে আদিবাসী ভাষাগুলোর রেকর্ড সংগ্রহ, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলে লেখ্যরূপ উন্নয়ন এবং ডিজিটাল ট্রান্সক্রিপশন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
ভাষা আমাদের পরিচয় ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সামাজিক ও মানসিকভাবে ভালো থাকার সঙ্গেও গভীরভাবে ভাষা জড়িত। বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলো সংরক্ষণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। কারণ একটি ভাষা হারিয়ে গেলে তার সঙ্গে হারিয়ে যায় পরিবেশ, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অমূল্য ভান্ডার।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রজতজয়ন্তী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ২০৩০ সালের মধ্যে ভাষাগত বৈচিত্র্য ও বহু ভাষাবাদের প্রসারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। এটি ইউনেস্কোর উদ্যোগে ঘোষিত ২০২২-৩২ সালের ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষার দশক’ বাস্তবায়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তাই সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের সব ভাষার পুনরুজ্জীবন, উন্নয়ন ও সংরক্ষণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা: জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক এবং ২০২১ সালে জাতীয়ভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পুরস্কারপ্রাপ্ত
ড.
সুসান ভাইজ: ইউনেস্কো বাংলাদেশ প্রধান
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন য ক ক র যকর আম দ র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
চট্টগ্রামে থানা ঘিরে পাল্টাপাল্টি অবস্থান বৈষম্যবিরোধী ও ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের
চট্টগ্রামে হামলার ঘটনায় অভিযোগ দেওয়াকে কেন্দ্র করে থানা ঘিরে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছেন ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে নগরের আকবর শাহ থানার ভেতরে ও বাইরে অবস্থান করছে দুই পক্ষ। এ ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন কর্মী গুরুতর আহত হয়েছেন। সংগঠনটির অভিযোগ, ছাত্রদলের হামলায় তিনি আহত হয়েছেন। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
মূলত আজ দুপুরে নগরের উত্তর কাট্টলী আলহাজ মোস্তফা হাকিম ডিগ্রি কলেজে এক নারী শিক্ষককে কলেজে আসতে নিষেধ করার প্রতিবাদ করলে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রদলের হামলার অভিযোগ ওঠে। শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, ছাত্রদলের কর্মীরা কলেজের ভেতরে ঢুকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছেন। একই ঘটনায় কলেজে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও এনসিপির প্রতিনিধিরা গেলে তাঁদের ওপরও হামলার অভিযোগ ওঠে।
নেতা-কর্মীরা জানান, সন্ধ্যায় এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা আকবর শাহ থানায় যান হামলার বিষয়ে অভিযোগ জানাতে। এ সময় সেখানে আগে থেকে অবস্থান করছিলেন ছাত্রদলের কর্মীরা। পরে সেখানে ছাত্রদলের কর্মীরা তাঁদের ওপর চড়াও হন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক কর্মীকে তাঁরা মারধর করে আহত করেন। এ ছাড়া এনসিপির তিনজন আহত হয়েছেন।
গুরুতর আহত ব্যক্তির নাম মারুফ বলে জানা গেছে। তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আজ রাত ১০টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী ইনচার্জ সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, আহত অবস্থায় দুই-তিনজনকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
যা ঘটেছিল কলেজ ক্যাম্পাসে
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি কলেজের পরিচালনা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি এক নারী শিক্ষককে কলেজ আসতে নিষেধ করেন। সেটির প্রতিবাদ জানিয়ে আজ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেন। সেখানে সিরাজ উদ্দিনের অনুসারী ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা হামলা করেন।
কলেজের শিক্ষার্থী ইকরাম হোসেন বলেন, ‘আমাদের কলেজে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ। কিন্তু ছাত্রদল এখানে আধিপত্য বিস্তার করতে চাচ্ছে। কয়েকজন নারী শিক্ষক এটির প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এরপর স্বেচ্ছাসেবক দলের সিরাজ উদ্দিন তাঁকে (শিক্ষককে) কলেজে আসতে নিষেধ করেন।’
ছাত্রদলের আকবর শাহ থানা শাখার সদস্য ফাহিম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, পরিচালনা কমিটির ভেতরের বিষয় নিয়ে ওই নারী শিক্ষক সমন্বয়কদের ডেকে আনেন। ছাত্রদল সেখানে ফুল দিতে গিয়েছিল। শিক্ষার্থীরা তাঁদের ওপর পানি নিক্ষেপ করেন। হামলার কোনো ঘটনা হয়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি ও এনসিপি বলছে, তাঁরা বিষয়টি শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে গেলে তাঁদের কয়েকজনের ওপর চড়াও হন ছাত্রদলের কর্মীরা। একপর্যায়ে তাঁদের ওপর হামলা করেন। এ বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলমগীরের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
কলেজের পরিচালনা কমিটির সদস্য মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এগুলো সব বানোয়াট কথা। আমার তো কাউকে বের করে দেওয়ার এখতিয়ার নেই। এখানে বৈষম্যবিরোধীর ব্যানারে কিছু মানুষ বিশৃঙ্খলা করছে। যারা একসময় ছাত্রলীগ-শিবির করত।’
চার ঘণ্টা থানা ঘিরে অবস্থান
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যা ছয়টার পর আকবর শাহ থানায় জড়ো হন। তাঁরা থানায় ঢুকলে ছাত্রদল ও বিএনপির লোকজন দলীয় স্লোগান দেওয়া শুরু করেন। বৈষম্যবিরোধীদের কেন থানায় ঢুকতে দেওয়া হলো, এ নিয়ে তাঁরা হট্টগোল শুরু করেন। পরে বৈষম্যবিরোধী ও এনসিপির নেতা-কর্মীদের থানার ভেতরে নিয়ে যায় পুলিশ। এ সময় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা থানার বাইরে অবস্থান করছিলেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক ভিডিওতে দেখা যায়, থানার সামনে অবস্থান করছে একদল লোক। তাঁদের ছাত্রদলের নেতা-কর্মী বলে দাবি করা হয়। এ ছাড়া থানার ভেতরে অবস্থান করতে দেখা গেছে বৈষম্যবিরোধী ও এনসিপির নেতা-কর্মীদের। এ সময় আহত একজনকে গাড়িতে তুলতে দেখা গেছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে নগর পুলিশের উপকমিশনার (পশ্চিম) হোসাইন মোহাম্মদ কবির ভূঁইয়া এবং আকবর শাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা ফোন ধরেননি। রাত সোয়া আটটায় আকবর শাহ থানার কর্তব্যরত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক জুয়েল ত্রিপুরা বলেন, ‘ছাত্ররা থানার বাইরে অবস্থান করছেন। সেখানে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আছেন।’
রাত ১০টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের (চট্টগ্রাম নগর) মুখপাত্র ফাতেমা খানম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখনো থানার ভেতরে আছি। আমাদের কয়েকজন আহত হয়েছে। বর্তমানে আর্মি (সেনাবাহিনী) ও পুলিশ ব্রিফিং করছেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে আগামীকাল শুক্রবার আমাদের বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি আছে।’