চলন্ত বাসে ডাকাতি-শ্লীলতাহানি, ২ থানা ঘুরে মামলা
Published: 21st, February 2025 GMT
চলন্ত বাসে ডাকাতি ও নারী যাত্রীদের জিম্মি করে শ্লীলতাহানির ঘটনায় নাটোরের বড়াইগ্রাম ও টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানা ঘুরে অবশেষে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সকালে বাসের যাত্রী নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার চশবড়াইগ্রামের মোজাহার আলীর ছেলে ওমর আলী বাদী হয়ে মির্জাপুর থানায় অজ্ঞাতনামা ৮ থেকে ৯ জন ডাকাতদলের সদস্যের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেন।
বাসটিতে দুজন নারী যাত্রীকে শ্লীলতাহানী ও সকল যাত্রীর কাছ থেকে টাকা ও মালামাল লুটের অভিযোগ আনা হয়েছে। মির্জাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশারফ হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, যাত্রীবাহী বাসটি গত সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ১১টার দিকে ইউনিক রোড রয়েলস্ পরিবহনের একটি বাস (ময়মনসিংহ-ব-১১-০০৬১) ঢাকার গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে নাটোরের বড়াইগ্রাম যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
এসময় বাসটিতে ৩০ থেকে ৩৫ জন যাত্রী ছিল। পরে রাত ১২টার দিকে হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে এবং হেমায়েতপুর থেকে আরও ১০ থেকে ১২জন যাত্রী নিয়ে বাসটি পুনরায় রওনা দেয়।
বাসটি গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানাধীন চন্দ্রা বাইপাসে পৌঁছালে চা-বিরতির জন্য থামে। সেখানে ১০ থেকে ১৫ মিনিট চা বিরতির সময় চন্দ্রা বাইপাস থেকে আরও তিন থেকে চার জন নতুন যাত্রী নিয়ে রওনা করে বাসটি। বাসটি রাত দেড়টার দিকে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানাধীন হাইটেক সিটি পার্ক সংলগ্ন খাড়াজোড়া ফ্লাইওভার ব্রিজ অতিক্রম করার ৫ থেকে ৬ মিনিট পর হঠাৎ বাসে যাত্রীবেশে থাকা ৮ থেকে ৯ জন ডাকাত একসঙ্গে দাঁড়িয়ে যায়। তারা ধারালো চাকু ও চাপাতি দিয়ে প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে সবাইকে চুপ থাকতে বলে।
এসময় তাদের মধ্যে তিনজন ডাকাত গাড়ি চালকের গলায় ধারালো চাকু ধরে টেনে হিঁচড়ে এবং কিলঘুষি মেরে তাকে উঠিয়ে নিয়ে পেছনে নিয়ে যায়। ডাকাতদের মধ্যে থেকে একজন চালকের আসনে বসে বাসটি নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং বাস চালিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে রওনা হয়।
পরে মির্জাপুর উপজেলার সোহাগপাড়া এলাকার ফুটওভার ব্রিজের প্রায় ১০০ গজ পশ্চিম পাশে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের উপর পৌঁছালে ডাকাতদলের ৬ থেকে ৭ জন সদস্য গাড়িতে থাকা অন্যান্য যাত্রীদের ধারালো চাকু ও চাপাতি দিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। এসময় সকল যাত্রীদেরকে বলে, ‘‘তোদের সাথে টাকা পয়সাসহ যার যা কিছু আছে সব দিয়ে দে।” যাত্রীদের কাছে থাকা টাকা, মোবাইল ফোন, স্বর্ণালংকার ও রূপাসহ সকল মালামাল ছিনিয়ে নেয় তারা।
পরে ডাকাতদলের সদস্যরা মির্জাপুরের নাটিয়াপাড়া নাছির গ্লাসের সামনে থেকে ইউটার্ন নিয়ে আবার ঢাকার দিকে রওনা দেয়। তারা দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা গাজীপুরের কালিয়াকৈর, কোনাবাড়ীসহ গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় গাড়ি নিয়ে ঘুরতে থাকে। এসময় দুজন নারী যাত্রীকে শ্লীলতাহানী করে ডাকাতরা।
এজাহারে আরও বলা হয়েছে, যাত্রীদের টাকাসহ অন্যান্য মালামাল লুট করে রাত ৪টার দিকে ঢাকার আশুলিয়া থানাধীন বাড়ইপাড়া এলাকার নন্দন পার্কের সামনে গাড়িটি টাঙ্গাইল অভিমুখি থামিয়ে চালককে ভয় দেখিয়ে বলে, ‘‘১০ কিলোমিটারের মধ্যে গাড়িটি কোথাও থামালে তোকে জানে মেরে ফেলব। আমরা তোদের গাড়ির পিছনেই আছি।’’ এই বলে ডাকাতদলের সদস্যরা লুণ্ঠিত মালামাল নিয়ে গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে চলে যায়।
পরবর্তীতে চালক গাড়ি নিয়ে চন্দ্রা মোড়ে গেলে গাড়িতে থাকা যাত্রীরা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে ঘটনাটি পুলিশকে জানায়। কিছুক্ষণের মধ্যে টহল পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়। তখন গাড়িতে থাকা যাত্রীরা ডাকাতির বিষয়ে বিস্তারিত জানালে কালিয়াকৈর থানাধীন চন্দ্রা এলাকার টহলরত পুলিশ মির্জাপুর থানায় যাওয়ার পরামর্শ দেয়। এ কথা শুনে চালক গাড়ি নিয়ে মির্জাপুর বাসস্ট্যান্ডে যান।
সেসময় কয়েকজন যাত্রী ও গাড়ির সুপারভাইজার মির্জাপুর থানায় গিয়ে ডিউটি অফিসারকে বিষয়টি মৌখিকভাবে জানায়। সেখানে থাকার ওসি বেলা ৯টার আগে থানায় পৌঁছাবে না জেনে যাত্রীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। পরে তারা পুনরায় নাটোরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
গাড়ি নাটোরের বড়াইগ্রাম থানা মোড়ে পৌঁছলে গাড়ি থেকে তিন থেকে চারজন যাত্রী স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় গাড়ির চালক, হেলপার ও সুপারভাইজার ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে জড়িত আছে সন্দেহে গাড়িটি আটক করে।
এসময় বড়াইগ্রাম থানা পুলিশকে জানানো হয়। পরে খবর পেয়ে বড়াইগ্রাম থানা পুলিশ সেখানে গিয়ে গাড়ির চালক, হেলপার ও সুপারভাইজারকে পুলিশি হেফাজতে নেয়।
বড়াইগ্রাম থানা-পুলিশ গাড়ির চালক, হেলপার ও সুপারভাইজারকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় আদালতে প্রেরণ করেন।
মামলার বাদী ওমর আলী বলেন, ‘‘মামলার এজহারে আমি স্বাক্ষর করেছি। এ মামলায় ৮-৯ জন অজ্ঞাতনামা ডাকাতদলের সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। বাসে থাকা সকল যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা, মোবাইল ফোন ও মালামাল লুট করে। বাসটিতে ৭ থেকে ৮জন নারী যাত্রী ছিল। এদের মধ্যে দুজনকে শ্লীলতাহানী করা হয়।”
এ বিষয়ে মির্জাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশারফ হোসেন বলেন, ‘‘এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।’’
এদিকে, ডাকাতির ঘটনায় বাসের চালক বাবলু ইসলাম (৩৫), চালকের সহকারী সুমন ইসলাম (৩৫) ও সুপারভাইজার মাহবুব আলমকে (৩৮) আটক করে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত শুনানি শেষে জামিনের আদেশ দেন।
বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় জামিন পেলেও বিষয়টি বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে আদালত সূত্রে বিষয়টি জানা যায়।
আদালত পুলিশের পরিদর্শক মোস্তফা কামাল বলেন, “মামলাটি ফৌজদারি কার্যবিধি ৫৪ ধারার হওয়ায় এবং আসামিদের বিরুদ্ধে কোনো ধর্তব্য অপরাধের অভিযোগ সুনির্দিষ্ট না থাকায় আদালত তাদের জামিনের আদেশ দেন।”
তবে ডাকাতির সময় দুই নারী যাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা চলছে। ভুক্তভোগী যাত্রীরা বলছেন, “ডাকাতি হওয়া বাসটি নাটোরের বড়াইগ্রাম থানায় পৌঁছানোর পর দুই নারী যাত্রী পুলিশের কাছে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেছেন।”
বড়াইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম বলেন, “নারী যাত্রীদের নির্যাতন বা ধর্ষণের ঘটনার কথা কেউ বলেননি। এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি।”
বাসযাত্রী ওমর আলী বলেন, ‘‘দুই নারী যাত্রী তাদের কাছে একাধিকবার বলেছেন যে, ডাকাতেরা তাদের শ্লীলতাহানি ঘটিয়েছে। তারা ঘটনাটি বড়াইগ্রাম থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই শরিফুল ইসলামের কাছেও বলেছেন।”
এ বিষয়ে বড়াইগ্রাম থানার এসআই শরিফুল ইসলাম বলেন, “ডাকাতরা দুজন নারী যাত্রীর গায়ে হাত দিয়ে গয়নাপত্র খুলে নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। যেভাবে খুলে নেওয়া হয়েছে, তাতে তাদের শ্লীলতাহানি ঘটেছে বলে বলেছেন।”
যাত্রীরা জানান, সেদিন রাতে ডাকাতির পর বাসটি প্রথমেই মির্জাপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পুলিশ তাদের কোনো কথাই শুনতে চায়নি। তারা বলেছেন ওসি না আসলে তারা কিছুই বলতে পারবেন না। ওসি সকাল ৯ টার আগে আসবেন না। এই অবস্থায় নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা না পেয়ে তারা বড়াইগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
বড়াইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম বলেন, “বাসের যাত্রীরা মৌখিকভাবে পুলিশকে ডাকাতি হওয়ার কথা বলেছেন। অনেক যাত্রীই রাস্তায় নেমে গেছেন। দুজন নারী যাত্রী এসেছিলেন। তাদের একজনের বাড়ি নাটোরের লালপুরে, আরেকজনের বাড়ি রাজশাহীর পুঠিয়ার দিকে। তারা নির্যাতনের ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি। তারা চলে গেছেন। তাদের মোবাইল নম্বরও রেখে যায়নি।”
এ ঘটনায় মির্জাপুর থানার এসআই জুয়েল মিয়া ভুক্তভোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাতে নাটোরের বড়াইগ্রাম থানায় অবস্থান করছিলেন। রাত ১০টার দিকে তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত কোনো মামলা রেকর্ড হয়নি। মামলার জন্য অনেক কিছু প্রয়োজন।”
ঢাকা/কাওছার/আরিফুল/এস
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর দ জন ন র জন য ত র ল ইসল ম বল ছ ন র ঘটন ঘটন য় ব ষয়ট
এছাড়াও পড়ুন:
ভাই আজকে আপনার অফিস নেই, কারাবন্দিরা পলককে
প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো মামলায় আদালতে হাজির করা হয় সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে। তবে যেদিন তারা আদালতে আসা লাগে না সেদিন কারাগারে সামনে সামান্য হাঁটার সুযোগ পান। তখন তাকে দেখে কারাবন্দিরা মজা করে বলেন, “ভাই আজকে আপনার অফিস নেই।”
বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এম এ আজহারুল ইসলামের আদালতে হত্যা মামলায় হাজির করা হয় পলককে। এসময় আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এসব কথা বলেন তিনি। তবে তখনও বিচারক এজলাসে ওঠেননি।
আজ সকাল ১০টা ৫৮ মিনিটে সিএমএম আদালতের হাজতখানা থেকে পলককে বের করা হয়। এসময় তাকে হেলমেট, হাতকড়া ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পড়ানো হয়। হেঁটে আদালতে যাওয়ার পথে তিনি বলেন, “মিথ্যা দিয়ে সত্যকে সাময়িকভাবে আড়াল করা গেলেও সত্যের জয় অনিবার্য, ইনশাআল্লাহ।”
পরে তাকে আদালতের কাঠগড়ায় তোলা হয়। এসময় তিনি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেন, “আমাকে তো নিয়মিত আদালতে আসা লাগে। তবে যেদিন আসা লাগেনা, সেইদিন কারাগারে হাঁটতে বের হলে জেলের বন্দিরা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ভাই আজকে আপনার অফিস নেই। আদালতে হাজিরা নিয়ে তারা মজা করে। আদালতকে তারা আমার অফিস ভাবে।”
পলক বলেন, “জেল জীবন মারাত্মক। জীবনে শিক্ষার জন্য সাত দিন হলেও কারাগারে থাকা উচিত। আমি যদি কখনো কারাগার থেকে বের হতে পারি তখনও এই কথা বলবো।”
এ সময় তার আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে পলক বলেন, “তোমরা কথা বললেই তো রিমান্ডের পরিমাণ বেড়ে যায়৷ তারা তো (রাষ্ট্রপক্ষ) বলেছে, রিমান্ড তো শুরু৷ তাই কথা বলার দরকার নেই। আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী। এটা কোনোভাবে পরিবর্তন করা যাবে না।”
পরে তিনি কাঠগড়ায় সামনে গিয়ে দাঁড়ান। তখন ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকীকে উদ্দেশ্য করে একাধিকবার সালাম দেন। তবে প্রথমে সাড়া না দিলেও পরবর্তীতে পিপি হাসতে হাসতে তার সালামের উত্তর দেন। এরপর পলক বলেন, “যাক এইবার পিপি স্যারের মন নরম হয়েছে।”
তখনও বিচারক এজলাসে ছিলেন না। পরে ১১টা ১০ মিনিটে এজলাসে উঠেন বিচারক। পরে রিয়াজ হত্যা মামলায় পলককে গ্রেপ্তার দেখানোর শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষে আদালত তাকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে পুলিশ প্রহরায় তাকে আদালত থেকে হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
মামলার সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ৪ আগস্ট রাজধানীর ধানমন্ডির সায়েন্সল্যাব এলাকা থেকে জিগাতলা এলাকায় যাওয়ার পথে আসামিদের ছোঁড়া গুলিতে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন মো. রিয়াজ (২৩)। দুই সপ্তাহ চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৭ আগস্ট বিকেলে মারা যান। এ ঘটনায় নিহতের মা মোসা. শাফিয়া বেগম ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার ধানমন্ডি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
ঢাকা/মামুন/ইভা