ভাষা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ, ভাব তৈরি ও আদান-প্রদানের ব্যবস্থা। এই ভাষার জন্মের পেছনে রয়েছে অপার রহস্য। ভাষা সবসময় চলমান, সজীব ও পরিবর্তনশীল। বলা যেতে পারে সতত বহতা নদীর মতোই প্রবহমান।
পৃথিবীর জীবিত-মৃত সব ভাষার আদি উৎস আফ্রিকা। প্রায় ৩ লাখ বছর আগে মানুষের প্রথম অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় আফ্রিকা মহাদেশে। তবে ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় প্রায় ১ লাখ বছর আগে। ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ বছরের মধ্যে আফ্রিকার এই মানুষ জীবিকা, বেঁচে থাকা বা অন্য বিশেষ কিছু কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম দিকে আফ্রিকার মানুষ যোগাযোগ ও ভাব আদান-প্রদানের জন্য একই ধরনের ভাষা ব্যবহার করত। মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে এক সময় মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কালের বিবর্তনে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে বিভিন্ন ধরনের ভাষার উদ্ভব হয়।
জৈবিক দিক বিবেচনায় সব ভাষাই কাছাকাছি। জৈব প্রজাতির মতো ভাষারও জন্ম, বেড়ে ওঠা, বুড়ো হওয়া এবং মৃত্যু আছে। ভাষাবিদরা পৃথিবীতে ৪২ হাজারের বেশি ভাষার সন্ধান পেয়েছে, এর মধ্যে বর্তমানে জীবিত রয়েছে প্রায় ছয় হাজার। বাংলা ভাষার পেছনেও রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস ও বিবর্তনের ধারা। এই অঞ্চলে আদিকালে যারা বাস করত তারা এখনকার বাংলা ভাষায় কথা বলত না। বাংলা ভাষার প্রথম দিককার রচনা চর্যাপদ বা চর্যাগীতি (ড.
মানুষের দৈনন্দিন জীবন, ভাষা, সংস্কৃতি, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব ব্যাপক। বর্তমানে আমরা নতুন নতুন শব্দ ব্যবহার করছি। এখন থেকে ১০০ বছর তো দূরের কথা, ২০-৩০ বছর আগের মানুষের পক্ষেও এ সবের অর্থ বুঝতে পারা অনেক কষ্টের হয়ে যাবে। বিশ্বায়নের প্রভাবে অনেকের ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বিপন্ন। প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে কোন না কোন ভাষা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক সময়ের কেন্দ্র খোদ কলকাতায়ও দিনদিন কমে যাচ্ছে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা।
এমনও পূর্বাভাস আছে, বিশ্বায়ন ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এমন স্থানে পৌঁছাবে আগামী ২০০ বছরের মধ্যে অনেক সীমানা উঠে যাবে, পৃথিবীর সব মানুষ একই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবে, একই ভাবে সবকিছু চিন্তা করবে। যেভাবে চলছে তাতে করে অদূর ভবিষ্যতে এই মহামারি থেকে বাংলা নিজেকে রক্ষা করতে পারবে কিনা বিবেচনার বিষয়।
যেভাবে এল বাংলা ভাষা
ভাষার পরিবার, বংশ, গোষ্ঠী আছে। পৃথিবীর সব জীবিত ও মৃত ভাষার প্রায় শতাধিক ভাষাগোষ্ঠী আছে। এদের প্রধান ১২টি। সবচেয়ে বেশি ভাষার জন্ম হয়েছে বা ছয়টি মহাদেশের অধিকাংশ ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী (প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বছর আগে) থেকে এসেছে। এই ভাষাগোষ্ঠীর দুইটি ধারা ছিল। কেন্তম-যে ধারায় ইউরোপের লোকজন কথা বলত ও শতম-যে ধারায় ভারতীয়, মিশরীয়, ইরানি ও আরবিয়রা কথা বলত। শতমের ইরানী শাখা ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীতে রূপ নেয় এবং এই শাখার লোকেরা পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। এদের আর্য জাতি বলা হয় এবং ভাষা ছিল আর্য। ঐ সময় স্থানীয় ভারতীয় ও অনার্যদেরও ভাষা ছিল। আর্যরা (১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে) ভারতে আসা শুরু করলে ভারতীয় ভাষার সাথে মিশে নতুন ভাষার, ভারতীয় আর্য ভাষা উদ্ভব হয়। এই ভারতীয় আর্য ভাষার দুটি রূপ ছিল; প্রাকৃত ভাষা (জনগণের কথ্য ও বোধ্য ভাষা) ও সংস্কৃত (লিখিত ভাষা)।
আঞ্চলিক ও উচ্চারণের ভিন্নতার কারণে ভারতে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃত ভাষা দেখা যায়। যেমন গৌড়ীয় প্রাকৃত, মাগধী প্রাকৃত, মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত, শৌরসেনী প্রাকৃত, পৈশাচী প্রাকৃত ইত্যাদি। এমন অবস্থায় আর্যরা তাদের ভাষা রক্ষার জন্য সংস্কার করে এবং এই সংস্কারজাত ভাষাই সংস্কৃত। প্রাকৃত ভাষাগুলোর মধ্যে গৌড় এলাকার লোক গৌড়ীয় প্রাকৃত ভাষায় কথা বলত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, এই গৌড়ীয় প্রাকৃত (৭ম শতকে) থেকে বাংলা ভাষা এসেছে। অন্যদিকে, মগধ এলাকার লোকেরা মাগধী প্রাকৃত ভাষায় কথা বলত। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, দশম শতাব্দীতে এ মাগধী প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে। যাইহোক, এই দুটি ভাষারই বিকৃত ঘটে যথাক্রমে গৌড়ী অপভ্রংশ ও মাগধী অপভ্রংশ হয়ে যায়। আবার এই দুই বিকৃত রূপ বা অপভ্রংশ মিলে নতুন ভাষা তৈরি হয়, যাকে বলা হয় বঙ্গকামরূপী এবং এই বঙ্গকামরূপী থেকে এসেছে বাংলা, অসমিয়া ও উড়িয়া ভাষা।
বাংলা আমাদেরই ভাষা
বাংলা ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত ভাষার মত বাংলার স্বতন্ত্র ও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। বাংলা অঞ্চলের ভৌগলিক পরিবেশ, জলবায়ু, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, ধর্ম, রাজনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন অবস্থা এই ভাষার ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছে। ব্রিটিশ আমলে অনেক কিছু ঔপনিবেশিক ও পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ল্যাটিন ভাষা থেকে ইতালীয়, স্প্যানিশ ও ফরাসি ভাষার উদ্ভব। এই ব্যাখ্যার আলোকে সাধারণীকরণ করা হয় সংস্কৃত থেকে বাংলা, হিন্দি, উর্দু ও উপমহাদেশের অন্যান্য ভাষা এসেছে। তবে আধুনিক গবেষণায় এটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলার উদ্ভব হয়নি। এটা বলা যেতে পারে সংস্কৃত শব্দ ও সাহিত্য দ্বারা বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে।
ভাষা গবেষকদের মতে, বাংলা ভাষার উৎপত্তি বা সূচনাকালে এদেশে আর্য ও বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রভাব লক্ষণীয়। যে কারণে বাংলা ভাষায় অনেক সংস্কৃত শব্দ এসেছে। অন্যদিকে, বাংলা ভাষার সুগঠিত রূপ বা বিকাশ শুরু হয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের দিকে এবং এই সময় শুরু হয় মুসলিম শাসন। মিশতে থাকে ফার্সি-আরবি শব্দ। রীতিমত পারস্যকরণ বলা যেতে পারে। ১৯৬৬ সালে শেখ গোলাম মাকসুদ হিলালি ফার্সি উৎসের ৯ হাজারের বেশি বাংলা শব্দ ও অভিব্যক্তির একটি অভিধান প্রকাশ করেন। এদেশে এসেছে পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, ইংরেজসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী এবং তাদের ভাষার অসংখ্য শব্দ মিশেছে বাংলা ভাষায়।
মূলকথা, বাংলার নিভৃত পল্লীতে আমাদের যে পূর্ব-পুরুষরা বাস করত, তাদের নিজেদের শব্দগুলোর সাথে সাথে অন্যদের থেকে কিছু কিছু নিয়ে বাংলা ভাষা তৈরির কাজ শুরু করেছিল। বলা যেতে পারে বাংলা একক কোনো ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর ভাষা নয়। বাংলায় স্থানীয় অনার্য জনগোষ্ঠী বা আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রথমে কেউ হিন্দু বা মুসলমান ছিল না। এক সময় তাদের কেউ হিন্দু হয়, কেউ মুসলমান।
এটা ইতিহাস স্বীকৃত যে, বাংলায় শাসন কার্য, ব্যবসা ও ধর্ম প্রচারের জন্য বহিরাগতরা এসেছে। তবে বাংলা এতই দুর্গম ও সুযোগসুবিধা এতই কম ছিল যে অনেকে চাকরি ও ব্যবসা শেষে নিজেদের দেশে ফিরে যেত। এমনটা জানা যায়, মোঘল আমলে যারা রাষ্ট্রীয়কাজে বাংলায় এসেছিল তাদের বেশ কষ্টেই দিন কাটাতো। ইংরেজদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত ছিল ‘টু রেইন্স’ (two rains) অর্থাৎ রোগ বালাই আর প্রতিকূল পরিবেশের কারণে এক বর্ষাকাল পার করে দ্বিতীয় বর্ষাকাল দেখার সৌভাগ্য অনেকের হতো না।
আর বহিরাগতরা যারা বাংলায় থেকে গিয়েছিল তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে কিন্তু পরিবর্তন করতে পারেনি। এক সময় নিজেরাই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যায়। উত্তর ভারত থেকে যেসব ব্রাহ্মণ বাংলায় এসেছিলেন তারা কেউ বউ বা স্ত্রী সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন এমন শোনা যায় না। তেমনই ইরান, মধ্য এশিয়া, আরব ও উত্তর ভারত থেকে যেসব মুসলিমরা বাংলায় এসেছিলেন তারাও সবাই বউ বা স্ত্রী সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন এমন তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না। স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করে এখানেই ঘর সংসার শুরু করতেন। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, বাংলায় যারা মা হয়েছে তারা সবাই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ছিল। আর ভাষা ও সংস্কৃতিতে মায়েদের প্রভাব থেকেই যায়। আমরা মাতৃভাষা বলি, পিতৃভাষা বলি না।
যুগে যুগে বাংলা যখন অবহেলার শিকার
জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাভাষা চরম অবহেলা ও ষড়যন্ত্রের শিকার। বাংলা কোন সময় রাজা-বাদশা বা উচ্চশ্রেণির লোকের ভাষা ছিল না। ছিল সাধারণ মানুষের ভাষা, পথের ভাষা, মাঠের ভাষা, কৃষকের ভাষা, শ্রমিকের ভাষা। ফার্সি ভাষা প্রায় ৬০০ বছর ও ইংরেজি প্রায় ২০০ বছর এ দেশের রাজ ভাষা ছিল। তারপরও বাংলা ভাষা বহাল তবিয়তে টিকে ছিল। কেননা উপরের দিকে পরিবর্তন হলেও নিচের দিকে তেমন প্রভাব পড়েনি।
প্রথমদিকে ব্রাহ্মণরা এ দেশের স্থানীয়দের অশালীন বা সভ্য নয় এমন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখত। বঙ্গ দেশে আসলে তাদের মাথা কামিয়ে বা মাথায় ঘোল ঢেলে পবিত্র হতে হতো। উপহাসের সাথে বলত বঙ্গদেশের মানুষেরা পাখির মত কিচিরমিচির করে কথা বলে। যে কারণে ব্রাহ্মণরা বাংলা ভাষায় তাদের ধর্মাচার ও ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা অনুপযুক্ত বলে মনে করত। তবে এই ব্যাখ্যা থেকে তারা এক সময় সরে আসে। বিশেষ করে শ্রী চৈতন্যদেবের (১৪৮৬–১৫৩৩ খ্রি.) বৈষ্ণব আন্দোলনের সময় বাংলার দাবি জোরালো হতে থাকে।
আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবস্থা আরো খারাপ। সেই অনেক পূর্ব থেকে অনেকের ভাবখানা এমন, ঐ যে গানে আছে ‘ইরান-তুরান (মধ্য এশিয়া) পার হয়ে এসেছি’। বাজারে প্রচলিত গৎবাঁধা ব্যাখ্যাগুলোর একটি বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান হয়েছে অভিবাসনের কারণে। তবে, সম্প্রতিকালে হাড়গোড় ও অন্যান্য আধুনিক নৃতাত্ত্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি বাঙালি মুসলিমদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য তাদের প্রতিবেশী হিন্দু ও বাংলার স্থানীয় অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সাথে সিংহভাগ মিল। ইরান, তুরান (মধ্য এশিয়া) ও আরবের জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের খুব কমই মিল রয়েছে। যে কারণে এক সময় অনেক মুসলিমের ধারণা ছিল মুসলমানের ভাষা হল আরবি-ফার্সি-উর্দু। অনেকে স্বপ্ন দেখেছিল, বাংলার পরিবর্তে ফার্সি অথবা উর্দু প্রচলনের; এমনকি উর্দুর মত আরবি হরফে বাংলা লেখার। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন কোন দিন বাস্তবে রূপ নেয়নি। বাংলা ভাষার অবস্থা যখন প্রকট ও শোচনীয় তখন এক সময় কবি আবদুল হাকিমকে লিখতে হয়েছিল ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’।
শিক্ষা-ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৮২ সালে হান্টার কমিশন গঠন করে। এই কমিশনে একটা সুপারিশ জমা পড়েছিল যার অর্থটা ছিল এমন ‘বঙ্গের মুসলমানেরা উর্দু ভাষায় কথা বলে আর পূর্ব বঙ্গের চাষা ও নিম্নশ্রেণির লোকেরা বাংলা নামের একটি ভাষায় কথা বলে’। এবং পূর্ব বঙ্গের মুসলিমদের উর্দু ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার দাবি জানানো হয়। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ সাহেব এমনিতেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দেয়নি, এর পেছনে ছিল এদেশের কিছু মানুষ। যারা রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করেছিলেন।
তবে কিছু লোকের এই ধর্মীয় অপব্যাখ্যা টেকেনি। কেননা বর্তমানে বাংলা ভাষায় যারা কথা বলে, তাদের অধিকাংশ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। ইসলাম একটি বিশ্বজনীন ধর্ম এবং এই ধর্মে মানুষের মাতৃভাষাকে মর্যাদার চোখে দেখা হয়েছে। পবিত্র কোরআনেও ভাষাগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, “আর তাঁর [আল্লাহর] নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।“ [সুরা রুম : আয়াত ২২]
আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে সম্পদ পাচার হওয়ার সংস্কৃতি
নিজে কী, নিজের পরিচয় কী হওয়া উচিত— এমন চিন্তা এ দেশের মানুষ খুব কমই করেছে। এ মাটিতে জন্মগ্রহণ করেও এ মাটি ও তাদের নিজেদের ভাষাকে নিজের মনে করতে সবসময় দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ও হীনমন্যতায় ভুগেছে। আত্মপরিচিতির এই সঙ্কট নতুন কিছু নয়। এক সময় হিন্দু সমাজব্যবস্থায় লক্ষণীয় ছিল, যারা উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণ অর্থাৎ যারা কনৌজ-মিথিলা বা উত্তর ভারত থেকে এসেছে, তারাই সমাজে বেশি সম্মানিত। আর মুসলিমরা ব্যস্ত ছিল নিজেদের কে ইরান-তুরান (মধ্য এশিয়া) ও আরবের বংশধর প্রমাণে। তবে, সম্প্রতিকালে হাড়গোড় ও অন্যান্য আধুনিক নৃতাত্ত্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, এদেশের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর। বাইরের জনগোষ্ঠীর তাদের খুব কমই মিল রয়েছে।
আশা করা হয়েছিল ১৯৭১ সালের পর অন্য কিছু ভাবার প্রবণতা শেষ হবে, কিন্তু সেটা হয়নি। বিশেষ করে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের চরিত্রে পরিবর্তন আসেনি। তাদের এখন ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’ দেখা দিয়েছে। পাঁচ বছরের শিশুর মুখ থেকে ২/১ লাইন ভুলভাল ইংরেজি বা অন্য ভাষা শোনাকে বিশাল কাজ মনে করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ডসহ পশ্চিমা দেশে বা অন্য কোনও দেশে বসবাস, ব্যবসা করা বা আসা-যাওয়া অনেক সম্মানের ও আভিজাত্যের ব্যাপার।
আত্মপরিচয়ের এই সংকট তৈরি হয়েছে দেশের সম্পদ পাচার হওয়ার সংস্কৃতি। দুর্নীতি করে হোক আর সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে হোক বিদেশে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। বিদেশে গড়ে উঠেছে বেগমপাড়ার মত অভিজাত এলাকা। যে সব এলাকায় এ দেশের সন্তানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ইংরেজরা এক সময় জাহাজ ভর্তি করে এদেশ থেকে ধনসম্পদ নিয়ে যেত। আর এখন আমরা নিজেরাই বহন করে তাদের দিয়ে আসছি, যাকে বলা হয় ‘Self colonization’ অর্থাৎ নিজেরাই দাসে পরিণত হওয়া।
টবের অথবা শিকড়বিহীন গাছ
শিশুদের বুনিয়াদি শিক্ষা কোন ভাষায় দিতে হবে এই বিতর্ক অনেক পুরানো। শত বছর আগে রবি ঠাকুর বলেছিলেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শিক্ষার পত্তন’। ভাষা ছাড়া চিন্তা হয় না। চিন্তা প্রকাশ হয় ভাষায়। আর মাতৃভাষা ছাড়া কেউ কিছু চিন্তা করতে পারে না। ইংরেজি বা অন্য কোন বিদেশী ভাষা তথ্য দিতে পারে কিন্তু চিন্তা করাতে পারে না। বিষয়টি উপলব্ধি করে মাইকেল মধুসুধন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়রা মাতৃভাষায় ফিরে এসেছিলেন। একটা কথা প্রচলিত আছে, যে জাতি কবি সৃষ্টি করতে পারে না, সে জাতি কোনো দিন উন্নতি করতে পারে না।
এ দেশে ফার্সি, উর্দু, সংস্কৃতি, আরবি, ইংরেজি কম চর্চা হয়নি। তবে শোনা যায়নি ঐসব ভাষায় এ দেশের কেউ সেই অর্থে লেখক বা পণ্ডিত য়েছে। প্রায় ২০০ বছর ইংরেজি রাজভাষা ছিল, কিন্তু শতকরা একজন মানুষও ইংরেজিতে সাক্ষরজ্ঞান লাভ করার কথা শোনা যায়নি। আমরা অনেকে ইংরেজিতে লিখি, তবে দুঃখের বিষয়, ইংরেজদের কাছে সেটা গার্বেজ মনে হয়।
আমরা অর্থ না বুঝে আরবি মুখস্থ করি বা শিখি, এক্ষেত্রে আমাদের বড় ব্যর্থতা আরবি না বোঝার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল শ্রমবাজারে আমরা সুবিধা নিতে পারছি না। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আগামী ২০-৩০ বছরের মধ্যে দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লোকের প্রথম ভাষা হবে ইংরেজি, যাদের কাছে বাংলা হবে দ্বিতীয় ভাষা। অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের সাহেব বানানোর বাসনায় গুচ্ছের টাকা খরচ করছেন। বিদেশি ভাষায় কথা বলতে পারলেই উৎকর্ষের মাত্রা পূর্ণ হয়ে যায় বলে মনে করে। এই দলে কে নেই? এর ফল যা হবার, তা-ই হচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে একটা প্রজন্ম গড়ে উঠছে, যারা না পারে বাংলা, না পারে ইংরেজি। ফলে তারা টবের গাছ অথবা শিকড়বিহীন গাছে পরিণত হচ্ছে।
ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা এবং এই ভাষার প্রয়োজন অপরিহার্য। তবে এই নয়, শিশুদের ওপর চাপিয়ে দিতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনকি ইউরোপেও মাতৃভাষার মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হয়। মাতৃভাষা আয়ত্ত করার পর অন্য ভাষার শিক্ষা দেওয়া শুরু হয়। কেননা যারা মাতৃভাষায় দক্ষ তারা সহজে অন্য ভাষা আয়ত্ত করতে পারে। ইংরেজি প্রচ্ছায়ার বাইরের জাপান, চীন, কোরিয়ার ছাত্র/গবেষকরা ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে আন্তর্জাতিক স্তরে গবেষণা ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দিব্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তারা আমাদের থেকে এগিয়ে।
বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলা
১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতিস্বরূপ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেয় এবং ২০০০ সালে থেকে বিশ্বের ১৯৩টি দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা এবং জনসংখ্যার বিচারে সপ্তম অবস্থানে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, আসাম, বিহার, ত্রিপুরা,ঝাড়খণ্ড, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জসহ আরও কয়েকটি অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক বাংলাভাষী মানুষ বাস করে। নেপাল, মিয়ানমার ও পাকিস্তানের করাচীর বেশ কিছু এলাকায় বাংলার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
উপমহাদেশের বাইরে মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, মালয়েশিয়া এবং ইউরোপের প্রায় সব দেশে অসংখ্য বাংলাভাষী মাতৃভাষার দীপ জ্বালিয়ে রেখেছে। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ও কানাডা থেকে বাংলা ভাষায় বর্তমানে অনেক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। টেলিভিশন-বেতার চ্যানেলে বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। প্রবাসীরা নিজেদের উদ্যোগে বাংলা ভাষার চর্চা, গবেষণা ও প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ইউরোপ ও আফ্রিকার অনেক দেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করছে। তাদের কারণে নানাভাবে বাংলা ভাষা সে সব দেশে চর্চা হচ্ছে। আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওন কিছুদিন আগে বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাভাষীদের হয়রানি
ভাষা নির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক ও ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় বাংলাভাষী মানুষ বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। অনেক সময় জীবীকার তাগিদে তাদের বিভিন্ন অঞ্চলে যেতে হয়। কিন্তু বিষয়টি লক্ষণীয় যে, বিভিন্ন সময়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলাভাষী মানুষ দেখলে তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়, এমনকি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে দেখার অপচেষ্টা চালানো হয়। এনআরসি, ডিটেকশন ক্যাম্প, পুশব্যাক ও জেল-জরিমানার মত ঘটনার শিকার হতে হয়।
মোদের গরব মোদের আশা
আত্মপরিচিতির সঙ্কট থাকলেও এই ভাষাভাষী মানুষ কোন সময় তাদের পূর্বপুরুষের ভাষার ওপর আঘাত মেনে নেয়নি। ১৯৫২ সালে ছাত্রজনতার প্রাণ উৎসর্গ ও আত্মত্যাগ বিশ্বে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ১৯৬১ সালে আসামের বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার আন্দোলনে ১১ জন শহীদ হয়। পঞ্চাশ এর দশকে ভারতের বিহার রাজ্যের মানভূম জেলায়ও বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন। এ ছাড়া উড়িষ্যা ও ঝাড়খণ্ডে বাংলা ভাষার জন্য আত্মত্যাগের ইতিহাস আছে। আশার কথা, বাংলা খণ্ড খণ্ড হয়ে গেলেও বাংলা ভাষা দুই ভাগ হয়ে যায়নি। যেমনটা হয়েছে উর্দু আর হিন্দির ক্ষেত্রে। দুটি ভাষাই সংস্কৃতির অপভ্রংশ খাড়িবুলি থেকে উৎপন্ন। শব্দ, অর্থ, ভাষার উৎস ও ধরন একই। উর্দু লেখা হয়ে আরবি লিপিতে আর হিন্দি লেখা দেবনাগরী লিপিতে।
বিষয়টি এমন হয়ে গেছে, আমাদের বাংলা আবেগ একুশে ফেব্রুয়ারিতেই শুরু ও শেষ হয়ে যায়। এখনও আদালত, আমলা থেকে বড় ব্যবসায়ী, বিভিন্ন পেশাজীবীর লোক, সরকারের শীর্ষে থাকা ব্যক্তি ও সাধারণ মানুষের বাংলা ভাষা চর্চা ও জ্ঞান নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেক দোকানপাট ও প্রতিষ্ঠানের নাম-ফলকে ও বিজ্ঞাপনী প্রচারলিপিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার না করা খুবই দুঃখজনক। অনেকে ইচ্ছামত বাংলা বানানরীতি অনুসরণ করছে। যথাযথ, নির্ভুল, সঠিক বানান ও শব্দের ব্যবহার খুবই প্রয়োজন।
যে ভাষাকে মূলমন্ত্র করে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে এই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হল, সেই ভূমিতে বাংলা যেন মর্যাদাশীল থাকে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। আর আগামীর সংকট মোকাবিলায় আমাদের অনুপ্রেরণা মহাকবি মাইকেল মধুসূদনের উপলব্ধি ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’। আমরা মনে করি বাংলা কখনও ভেঙে পড়ার নয়, প্রতিনিয়ত গড়ে ওঠার।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
তারা//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র ব যবহ র জনগ ষ ঠ র এস ছ ল ন অন য ন য ভ ষ র জন ম সলম ন এক সময় এই ভ ষ র জন ম র অন য পর ব শ আম দ র র পর ব র জন য অন ক স অবস থ ক সময় ধরন র প রথম ব যবস ইউর প বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
‘নিশি ট্রেনের ভূত’ উপন্যাসে যা বলে গেল ভূত
ঘটাং ঘট, রাতের ট্রেন। ছুটে চলছে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম। কেবিন–যাত্রী শিশির মোড়ল, সহযাত্রী সে কি ভূত! মধ্যরাতে আঁধার কেবিনে সহযাত্রীর হঠাৎ প্রশ্ন, ‘আপনি কখনো ভূত দেখেছেন?’ আচমকা প্রশ্নে বিরক্ত শিশির মোড়ল।
অনেক ভূতের গল্প শুনেছি দাদি, নানি, নানার মুখে। দারোগাভূত, গেছোভূত, বাঁশভূত, ব্যাঙভূত, চ্যাংভূত আরও কত নামের ভূত! ছড়া কেটেছি বন্ধুরা তালে তালে, ‘তেঁতুলগাছের তলা/ রাত্রিদুপুর বেলা/ ভূতে মারে ঠেলা।’ কিন্তু ‘নিশি ট্রেনের ভূত’ উপন্যাসের লেখক কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক আমাদের, মানে পাঠকদের জন্য নিয়ে এসেছেন এক প্রাপ্তবয়স্ক ভূতের জীবনভিত্তিক এক তরজমা। লেখকের এই ভূত বাংলা নিয়ে লেখাপড়া করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। জীবনটা শুরু হয়েছিল তার স্বপ্ন বুনে। বিয়ে করে ব্যবসায় থিতু হয়েছিল গল্পপটু এই ভূত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আনুকূল্যে গল্পবন্ধুও জুটে গিয়েছিল মেসেঞ্জারে। তা-ও আবার এই নারীবন্ধুর স্বামী থাকে প্রবাসে। বেশ সময় কাটত মেসেঞ্জারে গল্প বলে অবসরে। বউয়ের সন্দেহের তালিকায়ও নাম উঠেছিল। রাতের ট্রেনের আঁধার কেবিনে বসে এই ভূতপ্রেম, নীতিনৈতিকতা, সন্তানবাৎসল্য, শিশুমনের স্বপ্ন, লড়াকু জীবন আর নেতা নামের নির্মম লেবাসের আড়ালের ক্রূরতার গল্প বলে যায়। নিষ্ঠুরতার আগুন কী করে নিমেষে সব স্বপ্নের যবনিকাপাত ঘটিয়ে দেয়, তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা কাঁদিয়ে দেয় সামাজিক বিবেককে। ভূতটি যখন মানুষ ছিল, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিল ব্যবসার কাজে। সেই সঙ্গে আকাঙ্ক্ষাও ছিল মেসেঞ্জার-প্রেমিকার সঙ্গে মধুর সময় কাটানোর। শিশির মোড়ল গল্পের মধ্যে এতটাই লীন হয়ে গিয়েছিলেন যে তাঁর তাড়া ছিল গল্পের যবনিকায় পৌঁছানোর, কিন্তু ভূত নামের আত্মাটি সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে বলে যেতে থাকে পরতের পর পরত তার দেখা মানুষজীবনের গল্প। শিশির মোড়লের তাগাদার পরিপ্রেক্ষিতে ভূতটি ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায় ছাপা হওয়া এক রসাত্মক ধারাবাহিক উপন্যাসের কিয়দংশের অবতারণা করে। ওই অংশ ছিল এমন: ‘নায়ক ও নায়িকা ঘরে ঢুকল। তারা দরজা বন্ধ করল। রাতের বেলা। তারা বাতি বন্ধ করল। বিছানায় গিয়ে বসল দুজন পাশাপাশি।’ তারপর লেখা: ‘বাকি অংশ পরের লেখায়।’ পরের সংখ্যায় লেখা শুরু হলো, ‘নায়িকা গোসল সেরে এসেছে। তার চুল বেয়ে পানি ঝরছে। সে একটি গামছা দিয়ে চুলে বেণি বানাচ্ছে।’ এরপর পাঠকদের কাছ থেকে প্রচুর চিঠি আসতে লাগল, ‘দুই সংখ্যার মধ্যবর্তী সময়ে কী হলো?’ উপায়ান্তর না দেখে সম্পাদক নোট দিলেন, ‘এই দুই সংখ্যার মধ্যবর্তী সময়ে কী ঘটিয়াছে, তাহার জন্য সম্পাদক দায়ী নহেন।’ ভূতের জবানিতে গুরুগম্ভীর একটি লেখা লিখতে গিয়ে পাঠকদের এমন একটি রসাত্মক অনুষঙ্গ উপহার দেওয়া কি সব লেখকের পক্ষে সম্ভব!
আসলে ট্রেনে আগুন কারা দেয়? কে তাদের নির্দেশ দেয়? কী লাভ তাদের? যাঁরা আমাদের এই সমাজকে চালান; স্কুলে বা কোনো অনুষ্ঠানে যাঁরা শিশুদের সুন্দর সুন্দর উপদেশ দেন; তারাই যদি রাতের আঁধারে ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী কিংবা দলীয় স্বার্থে অগ্নিসন্ত্রাস চালান বিপথগামী কিছু তরুণকে সামান্য কিছু টাকার লোভ দেখিয়ে, তাহলে দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র কে চালায়? মানুষ, নাকি ভূত?যে শিশুর স্বপ্ন ছিল পাইলট কিংবা অ্যাস্ট্রোনট হবে, হিংসার আগুন তাকে মুহূর্তে বোকা বানিয়ে দেয়। যে শিশুটি ট্রেনের দুলুনির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছবি এঁকে চলে, নিমেষে সে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, ভেবেছিল কি শিশুটি, কিংবা তার মা-বাবা-স্বজন! কষ্ট মোচড় দিয়ে ওঠে যখন দেখা যায়, শিশুটি মারা গেলেও তার স্কুলব্যাগটি অক্ষত রয়েছে। হয়তো সে পুড়ে মরার আগে ব্যাগটি ছুড়ে ফেলেছিল দূরে।
আসলে ট্রেনে আগুন কারা দেয়? কে তাদের নির্দেশ দেয়? কী লাভ তাদের? যাঁরা আমাদের এই সমাজকে চালান; স্কুলে বা কোনো অনুষ্ঠানে যাঁরা শিশুদের সুন্দর সুন্দর উপদেশ দেন; তাঁরাই যদি রাতের আঁধারে ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী কিংবা দলীয় স্বার্থে অগ্নিসন্ত্রাস চালান বিপথগামী কিছু তরুণকে সামান্য কিছু টাকার লোভ দেখিয়ে, তাহলে দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র কে চালায়? মানুষ, নাকি ভূত? কে দেবে এর জবাব? এই প্রশ্নটা দেহ থেকে আত্মা আলাদা হয়ে যাওয়ার আগের ভূতের, নাকি আপনার, আমার—সবার?
আনিসুল হক