হজরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) রাসুল (সা.)–কে মুমূর্ষু অবস্থায় রেখে তাঁর ঘর থেকে বের হয়ে এলে লোকজন জানতে চান, ‘হে হাসানের পিতা, নবীজি (সা.)–এর কী অবস্থা?’ তিনি বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, তিনি এখন সুস্থ।’
আব্বাস (রা.) তখন আলী (রা.)-এর হাত ধরে বলেন, ‘খোদার শপথ, তিন দিন পর তোমার অনুগত হয়ে থাকতে হবে। তাঁর অবস্থা যা দেখেছি, তিনি এই অসুস্থ অবস্থাতেই ইন্তেকাল করবেন। মৃত্যুর সময় আবদুল মুত্তালিবের সন্তানদের চেহারা কেমন হয়, তা আমি জানি। চলো, আমরা গিয়ে নবীজি (সা.
আলী (রা.) বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, যদি আমরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করি আর তিনি আমাদের না করে দেন, তবে তাঁর মৃত্যুর পরে মানুষ আমাদের তা আর দেবে না। আর আমি এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করব না।’ (বুখারি, হাদিস: ৪৪৪৭)
আরও পড়ুননবীজি (সা.)-এর মুজিজা২৫ এপ্রিল ২০২৩ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘নবীজি (সা.)-এর মৃত্যু ঘনিয়ে এল। তাঁর ঘর লোকে লোকারণ্য। আছেন ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.)। নবীজি (সা.) সবাইকে বললেন, “এসো, তোমাদের উপদেশনামা লিখিয়ে দিই যেন আমার পরে তোমরা পথহারা না হও।”
ওমর (রা.) বললেন, “রাসুল (সা.) এখন বেদনায় অস্থির। আমাদের কাছে পবিত্র কোরআন আছে, তা-ই যথেষ্ট।”ঘরে উপস্থিত লোকদের মধ্যে ভিন্নমত দেখা দিল। কেউ বলল, “তোমরা আসো, নবীজি (সা.) অসিয়তনামা লিখে দেবেন। তোমরা আর গোমরাহ হবে না।” কেউ কেউ ওমরের (রা.) মতো কথা বলল।
মতানৈক্য ও কোলাহল বেড়ে গেলে নবীজি (সা.) বললেন, “তোমরা চলে যাও।”’ (বুখারি, হাদিস: ৫৬৬৯; মুসলিম, হাদিস: ১৬৩৭)
আরও পড়ুনদুনিয়ার নারীদের সরদার হজরত ফাতিমা (রা.)১৭ মে ২০২৩অন্য বর্ণনায় আছে, রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি যে অবস্থায় আছি, (সে অবস্থাতেই) আমাকে ছেড়ে দাও, তোমরা যার প্রতি আমাকে ডাকছ, (এটা) তার চেয়ে উত্তম।’ এরপর তিনি তাঁদের তিনটি বিষয়ে অসিয়ত করে বললেন, ‘আরব উপদ্বীপ থেকে মুশরিকদের বের করে দেবে; প্রতিনিধিদলের কাছ থেকে সেই পরিমাণ করই নেবে, যতটুকু আমি নিতাম। তৃতীয় বিষয়টি বর্ণনাকারী ভুলে গেছেন।’ (বুখারি, হাদিস: ৪৪৩১; মুসলিম, হাদিস: ১৬৩৭)
এই হাদিস থেকে স্পষ্ট খেলাফত বা কোনো বিষয়েই অসিয়তনামা লেখা হয়নি। রাসুল (সা.) একটি অসিয়তনামা লিখতে চেয়েছিলেন সত্য। পরে তিনি স্বেচ্ছায় সে ইচ্ছা ত্যাগ করেন।
আরও পড়ুনহজরত আলী (রা.)–র সাহসে এসে মিশেছে পাণ্ডিত্ব০৭ মে ২০২৩উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
অলৌকিক উট
নবী নুহ (আ.)-এর ছেলে ছিলেন সাম। হজরত সালেহ (আ.) ছিলেন সামের বংশধর। তিনি সামুদ জাতির নবী। হিজাজ ও সিরিয়ার মধ্যস্থলে অবস্থিত ওয়াদিউল কুরা প্রান্তরে ছিল তাঁদের বসতি, বর্তমানে লোকে যাকে চেনে ‘ফাজ্জুহ নাকাহ’ বা ‘মাদায়েনে সালেহ’ নামে। ঐতিহাসিক মাসউদি বলেন, ‘সিরিয়া থেকে হিজাজে যাওয়ার পথে সামুদ সম্প্রদায়ের ধ্বংসপ্রাপ্ত বসতিগুলোর ভগ্নাবশেষ এবং তার প্রাচীন চিহ্নগুলো দেখা যায়।’ (কাসাসুল কোরআন, মুহাম্মদ হিফজুর রহমান, অনুবাদ: আবদুস সাত্তার আইনী, ১/ ১২৮)
বেশ সচ্ছল ও অবস্থাপন্ন ছিল সামুদ জাতি। শক্তিতে বলীয়ান ছিল, সুখ-শান্তির কমতি ছিল না। পাথর খোদাই ও স্থাপত্যবিদ্যায় তাদের ছিল বিশেষ পারদর্শিতা। বড় বড় প্রাসাদ ও পাহাড় কেটে ঘর বানাত তারা। তাদের ছিল সবুজ-শ্যামল উদ্যান। সোনা-রুপার প্রাচুর্যে মোড়ানো জীবন। কিন্তু তারা আল্লাহকে মানত না। আল্লাহর সঙ্গে অংশীদারি করত। সালেহ (আ.) ছিলেন তাদের গোত্রের একজন। তিনি ছিলেন বিচক্ষণ, সুবক্তা ও পণ্ডিত ব্যক্তি।
আরও পড়ুনআল্লাহর কাছে যে দোয়া করেছিলেন নবী সোলায়মান (আ.) ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫একদিন তিনি আল্লাহর নবী হয়ে তাদের কাছে গেলেন। তাদের একাত্মবাদের পথে আহ্বান করলেন। বললেন, ‘আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো উপাসক নেই, তিনি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর তাতেই তোমাদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন, কাজেই তাঁর কাছে তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা করো, আর তাঁর দিকেই ফিরে এসো, আমার প্রতিপালক তো অতি কাছে, আর তিনি ডাকে সাড়া দানকারী।’ (সুরা হুদ, আয়াত: ৬১)
গুটিকয়েকজন ছাড়া কেউ তাঁর ডাকা সাড়া দিল না। সতর্কবার্তাও এড়িয়ে গেল। তারা প্রাসাদ, অর্থবৈভব ও বিলাসসামগ্রী নিয়ে গর্ব-অহংকার করল। বলল, ‘আমাদের মধ্য থেকে কি তার ওপরই অহি নাজিল হলো?’ (সুরা সাদ, আয়াত: ৮)
তারা সালেহ (আ.)-এর কাছে নবী হওয়ার প্রমাণ চাইল, আপনি যদি আল্লাহর রাসুল হন, তাহলে আমাদের কাতেবা নামের পাথরময় পাহাড়ের ভেতর থেকে একটি ১০ মাসের গর্ভবতী, সবল ও স্বাস্থ্যবতী উট বের করে দেখান। সালেহ (আ.) তাদের থেকে ইমান আনার প্রতিশ্রুতি নিলেন। তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন। গর্ভবতী ও দুগ্ধবতী উট বেরিয়ে এলো পাথুরে পাহাড় থেকে। কোরআনে এটিকে ‘আল্লাহর উট’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ বিস্ময় দেখে কিছু লোক তৎক্ষণাৎ ইমান আনল। অন্যরা ইমান আনতে চাইলে পুরোহিতরা বাধা দিল।
আরও পড়ুনইয়া জাল জালালি ওয়াল ইকরামের ফজিলত১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫সালেহ (আ.) তাদের উটের ব্যাপারে সতর্ক করলেন, ‘আল্লাহর এই উটটি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন। অতএব তাকে আল্লাহর জমিনে বিচরণ করতে দাও এবং তাকে মন্দভাবে স্পর্শও করো না। নতুবা অতিসত্বর তোমাদের আজাব পাকড়াও করবে।’ (সুরা হুদ, আয়াত: ৬৪)
একই কূপ থেকে উট ও অন্য জন্তুদের পানি পান করাত তারা। উট পানি পান করলে পানি শেষ হয়ে যেত। সালেহ (আ.) উটের জন্য একদিন ও তাদের জন্য একদিন নির্ধারণ করে দিলেন। অনেকেই সালেহ (আ.)-এর কথা মেনে নিল। এভাবে কিছুদিন চলল। তারা উট ও তার বাচ্চাদের থেকে উপকৃত হলো। এর মধ্যে তারা পানি নিয়ে উটের দিনটাকে ঝামেলা মনে করল। একপর্যায়ে সামুদ জাতির ‘মিসদা’ ও ‘কাসার’ নামের দুই যুবক বিভিন্ন প্রলোভনের নেশায় মত্ত হয়ে এই উটকে হত্যা করল। (কাসাসুল কোরআন, মুহাম্মদ হিফজুর রহমান, অনুবাদ: আবদুস সাত্তার আইনী, ১/১৪৪-১৪৫)
আল্লাহ বললেন, ‘তারা উটকে হত্যা করে স্বীয় প্রতিপালকের আদেশ অমান্য করল। তারা বলল, হে সালেহ, নিয়ে এসো যা দিয়ে আমাদের ভয় দেখাতে, তুমি যদি রাসুল হয়ে থাকো।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৭৭)
সালেহ (আ.) লোকদের কাছে গিয়ে আজাবের দিনক্ষণ জানিয়ে দিলেন, ‘তোমরা নিজেদের ঘরে আরও তিন দিন বাস করে নাও; এটি ওয়াদা, যাতে বিন্দুমাত্র মিথ্যা নেই।’ (সুরা হুদ, আয়াত: ৬৫)
প্রথম দিন তাদের সবার মুখমণ্ডল হলদে ফ্যাকাসে, দ্বিতীয় দিন লাল এবং তৃতীয় দিন ঘোর কালো হয়ে গেল। এক শনিবার ভোরে গগনবিদারী গর্জন, মুহুর্মুহু বিজলির চমক আর ভয়াবহ ভূমিকম্পে তাদের মৃত্যু হলো। তারা নিজ নিজ ঘরে মুখ থুবড়ে পড়ে রইল। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর পাকড়াও করল তাদেরকে ভূমিকম্প। ফলে সকালবেলায় নিজ নিজ ঘরে উপুড় হয়ে পড়ে রইল।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৭৮)
লেখক: আলেম
আরও পড়ুনরানি বিলকিস ও হজরত সোলায়মানের (আ.) ঘটনা১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫