‘রাজকুমারী দেবীর ইন্টারভিউটা আপনি করেন।’
বস যে এ রকম কিছু বলবে মিতু আগেই ধারণা করেছিল। সব ব্র্যান্ডিং মাল এরে–ওরে দিয়ে বাকি যে অগা-মগা থাকে, তার দায়িত্ব পড়বে মিতুর ওপর। এই তো স্টার ফ্যাশন প্রোগ্রামে পল্লব পেল জয়ার দায়িত্ব, তানিয়াকে শাকিবের পিছে পিছে দৌড়ানোর সুযোগ দেওয়া হলো, আর মিতুকে বলা হলো... থাক আর ভাবতেই চায় না সে। ‘বস, আমি এবার জয়া আপার ওপর কাজটা করতে চাইছিলাম।’ সিগারেটে ভাব ধরানো দুইটা টান দিয়ে বস বলে, আপনারে যেটা দিছি, ওটাই করেন। মিতুর খুব রাগ হয়েছিল। ক্যানটিনে চা খেতে গিয়ে দ্যাখে পল্লব আর তানিয়া হাসি–তামাশার দোকান খুলে বসেছে। পল্লব কী জানি বলছে আর তাানিয়া হাসতে হাসতে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। নিশ্চয় ওকে নিয়েই কোনো খুনসুটি হচ্ছে। কড়া এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে বসে বসে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল মিতু। চায়ের কাপটা ওদের মাথায় ঢেলে দেবে কি না ভাবছিল।
‘আপনি পটেনশিয়াল আছেন। সাহারা বেগমকে নিয়ে আপনার ফিচারটা অনেকেই পছন্দ করছে। মেইনস্ট্রিমের ভূত মাথা থিকা নামান।’
বসের কথায় মিতুর মন খানিকটা নরম হলো। আসলেই সাহারা বেগমের ওপর করা ফিচারটা জোশ হয়েছিল। ফেসবুকে হাজারের ওপর শেয়ার হয়েছে। এককালের যাত্রার হট প্রিন্সেস সাহারা। আজ থেকে ৫০–৬০ বছর আগে যে যাত্রার মঞ্চে ‘মিলতেহি আঁখে দিল হুয়া দিওয়ানা’ গেয়ে গেয়ে নাচত। পাতলা শাড়ির চিপায় সাহারার আধফোটা নাভি দেখতে এলাকার যুবকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ত। ‘শোনো গো মা, পেটের মইধ্যে একখান ফুটা, সেইটা নিয়া মাইনষের ঘুম নাই, বুকের ভিতরে যে মহব্বতের দিল, তার খোঁজ কেউ রাখে না।’ নেটিজেনরা পিক করেছিল সাহারার এ কথা।
‘রাজকুমারী দেবীর কাজটা মন লাগিয়ে করেন মিতু। শি ইজ আ লিজেন্ড!’
২.
শ্রীমঙ্গলে মিতুর এটা ফার্স্ট ট্যুর। অনেক শুনেছে, কিন্তু কেন জানি আসা হয়ে ওঠে নাই। শীত বেশি পড়ে। এটা একটা কারণ। শীত মিতুর একদম অপছন্দ। ফাল্গুনের শুরু। ঢাকায় তো শীত অলরেডি সাইবেরিয়া রওনা দিয়েছে। এখানে নাকি এখনো সকালে কুয়াশা পড়ে! ট্রেন জার্নি ওর অবশ্য খারাপ লাগে না। জানালা দিয়ে তাকালে মন কেমন যেন করে। দিলরুবা খানের ‘রেললাইন বহে সমান্তরাল’ গানটা মনে পড়ে। ট্রেনের নাম পারাবত এক্সপ্রেস। পারাবত মানে কী? অ্যাটেনডেন্সকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, এটা একটা ইন্টারসিটি ট্রেন। মিতু বিরক্ত মুখে বলল, আচ্ছা। গুগলে সার্চ করতে হবে। নেট ঠিকঠাক কাজ করছে না। ট্রেন জার্নির একটাই সমস্যা, খুব লেংথি মনে হয়। মনে হয় কোনো উদ্দেশ্য নাই। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। রাজকুমারী দেবীর দু–তিনটে গান পাঠিয়েছিল বস। শোনা যেতে পারে। ব্যাগে খুঁজে দেখে এয়ারফোন নাই। ক্যামেরা বের করে নিল। রানিংয়ে ল্যান্ডস্কেপ তোলার চেষ্টা করা যেতে পারে।
‘আপা সাবধান। ক্যামেরাটা সাবধানে রাখেন।’
চা–ওয়ালা বলে গেল। পাশে বসা এক মুরব্বি জিজ্ঞেস করেন, ‘কই যাইবা তুমি?’ বয়সের অপার ক্ষমতা। যারে–তারে তুই-তুমি বলা যায়। মিতু খানিকটা বিরক্ত হয়ে ক্যামেরার লেন্স নাড়াচাড়া করে।
শ্রীমঙ্গল?
জানলেন ক্যামনে!
ছবি তোলার জন্য বেশির ভাগ লোক যায়।
আমি যাব মণিপুরি পাড়া। মাধবপুর।
কমলগঞ্জ?
জি।
তাইলে তুমি ভানুগাছ নামতে পারবা। শ্রীমঙ্গলের পরের স্টেশন।
তাই?
অফিসের কেউ এই ইনফরমেশন দিল না! মিতুর ইচ্ছে করল লোকটার একটা ছুবি তুলে রাখে। না থাক।
আঙ্কেল, ওখানে শীত কেমন?
আগের শীত আর নাই।
এবার রাসমেলা হয়েছে?
কেন হবে না? আমার ছেলেমেয়েরা গেছিল।
আপনি কই নামবেন?
শায়েস্তাগঞ্জ।
মিতু একবার ভাবছিল রাজকুমারী দেবীর কথা জিজ্ঞেস করবে কি না। রাসের কথা যখন জানেন, রাজকুমারীর কথাও লোকটা জেনে থাকতে পারেন। রাজকুমারী হচ্ছেন রাসের লিজেন্ড। বস বলে, দুই শর বেশি রাসলীলা পরিচালনা করেছেন ওই মহিলা। সারা রাত ধরে হওয়া একটা পারফরম্যান্স। প্রতিবার নতুন নতুন শিল্পী ট্রেনআপ করতে হয়। দুই শ বার! খাইছে!
৩.
ভানুগাছ স্টেশনে নেমে চায়ের খুব তেষ্টা পেল মিতুর। এই এলাকা হলো চায়ের রাজধানী। ‘চায়ের রাজধানীতে রাজকুমারী দেবী’। বাহ্! ইন্টারেস্টিং হবে। বস আবার একটু বেশি অফ ট্র্যাক। এ রকম সোজাসাপটা টাইটেল পছন্দ করে না। বলবে, এই রকম না মিতু, ট্রেন্ডি হয়েন না। বি চুজি! বি ইউনিক!
ওয়েদারটা খারাপ না। যেমনটা মনে করেছিল তার ধারেকাছেও নেই। দুপুর বারোটা ছুঁই ছুই মাত্র, তার মধ্যেই চড়া রোদ। জ্যাকেটটা খুলে ফেলাই ভালো। ভানুগাছ স্টেশনের পাশেই ছোট্ট টংদোকানের বেঞ্চিতে বসে এক কাপ চা খেতে খেতে ক্যামেরার লেন্স–ফোকাস সব ঠিক করে নিল মিতু। বস বলে দিয়েছে, একটা ছেলে আসবে ওকে পিক করতে। মণিপুরি ছেলে। নাম মিলন। মণিপুরি ছেলের এমন বাংলাটাইপ নাম পছন্দ হলো না মিতুর। তবে নামটা স্পিরিচুয়াল। রাজকুমারীর সঙ্গে মিতুর মিলন ঘটানোর সে হলো একটা মিডিয়াম। সে-ই তাকে নিয়ে যাবে রাজকুমারী দেবীর কাছে। ট্রেন নাকি আজ আধা ঘণ্টার মতো লেট করেছে। তা–ও মিলনের দেখা নেই। শান্তিপূর্ণ এলাকা কমলগঞ্জ। সারা দেশে যখন কারফিউ চলে, এখানকার লোকজন বিয়ার দাওয়াত খেতে যায়। শান্তির এলাকায় এক্ষণে অশান্তির বিষয় মিলন। কই সে!
গুড মর্নিং, দিদি!
এখন তো দুপুর।
চেইন পড়ে গেছিল।
মোটরসাইকেলের অবস্থা দেখে মিতুর বিশ্বাস হলো।
দুই বছর আগে কামাল ভাই রাসে আসছিলেন। তখন আমার লগে পরিচয়। রাসের আগর দিন উনারে নিয়া পুরা এরিয়া চক্কর দিছি।
হুমম। বস বলছে তোমার কথা। এখন আমারে রাজকুমারী দেবীর কাছে পৌঁছায়া দেও ভাই।
চায়ের বিলটা আগ বাড়িয়ে মিলনই দিল। খুব স্মার্ট ছেলে মনে হলো। কিন্তু স্মার্ট ছেলের এভাবে চেইন পড়ে যায় কেন!
৪.
মিলনের বাড়িতে ফ্রেশট্রেশ হয়ে জম্পেশ একটা নাশতা করার পর মিতুর হঠাৎ কী জানি মনে উদয় হলো, বলল, আসার পথে একটা নদী পেলাম। কী নাম?
ধলাই।
পানি তো নাই।
পানি নাই? বর্ষার সময় আইলে দেখবেন!
বন্যা হয়?
হয় মানে? গত বছর, এই রকম ফকফকা রইদ, আচমকা নদী পাড়ে-পাড়। ভাসাইলো কয়েকটা গ্রাম।
কী বলো!
হ, উজানের পানি। ইন্ডিয়ার।
আমি একটু ধলাইর পাড়ে গিয়ে বসব।
রাজকুমারীর মাসির কাছে যাবেন না?
একটু পরে যাব।
ধলাইয়ের পানি হাঁটুসমান। বড় বড় চর পড়ে আছে। মিতু পাড়ের একটা ছোট্ট কাঠের গুঁড়িতে বসল। ‘তোমার এয়ারফোনটা একটু দিবা?’ মিলন তার কানে লাগানো এয়ারফোনটা খুলে দিল।
ট্রেনে শোনা হয়নি। বসের পাঠানো গানগুলো শুনে নেওয়া ভালো। এমনিতে মিতু তার প্রফেশনাল কাজে সিরিয়াস। সারা রাত রাজকুমারী দেবীকে নিয়ে স্টাডি করেছে। যত ডেটা, ইমেজ, ফুটেজ সব। গানগুলোই শোনা হয় নাই। একটু–আধটু হিম বাতাস বইছে। ‘ফুটিল মাধবী ফুল গগনে উড়িল, এ বসন্তে প্রাণনাথ কোথা চলি গেল...’
আহ্, কী মিহি গলা! সুরটা যেন উঁচা-নিচা পথ ধরে আগাচ্ছে। শীতের শেষ প্রায়। বসন্তের আগমনী রং চোখ তুলতে শুরু করেছে, ধলাইয়ের উদোম বুকে কী এক শূন্যতা, এর মধ্যে রাজকুমারী দেবীর গান কৃষ্ণের বিরহে পোড়া রাধার বেদনাকে মনে জাগিয়ে তুলল। এমনিতে পাগলা টাইপের মেয়ে হলেও মিতুর চোখে হুটহাট পানি আসে। মিলন খানিকটা অবাক হয়ে তাকে দেখে। স্টেশনে আউলা-ঝাউলা চুলে টংদোকানে বসে থাকা মিতুর সঙ্গে এই মিতুর মিল নাই।
৫.
রাজকুমারীর রাজপ্রাসাদ এক–আধভাঙা মাটির দেয়াল। জায়গায় জায়গায় মাটি খসে পড়েছে। নিচে উঁইপোকার বড় বড় ঢিবি। বারান্দার একদিকটায় বাঁশের আচ্ছাদন। তা–ও ভাঙাচোরা। দক্ষিণ দিকটায় টিনের ছাউনির আধেক অংশ ভেঙে গেছে। উঠানের কোণে একটা বড়সড় বরইগাছ।
বরইগাছটার দিকে তাকাতেই মিতু চমকে ওঠে, ওখানে কোনো বাদুড় নয়, কাঠবিড়ালি নয়, আস্ত একটা মানুষের বাচ্চা। তাকে দেখে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
‘মাও, দাংগো কই?’ (মামণি, দিদিমা কই?)
মেয়েটা কিছু বলে না। হঠাৎ ভেতর থেকে এক মহিলা মেয়েটার মা-ই হবে ‘হৈমা’ বলে তেড়ে আসে বরইগাছের দিকে। একটা চিকন বাঁশ দিয়ে গুঁতো দেওয়ার ছলে মেয়েটিকে ভয় দেখায়। মেয়ে কান ধরে। মিতু খুব মজা পায়।
রাজকুমারীর নাতনি। খুব দুষ্টু!
মিতু ক্যামেরা নিয়ে ঝটপট কয়েকটা ছবি তুলে ফেলে। হঠাৎ মহিলা মিতুকে দেখতে পেয়ে লজ্জা পায়। দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। তার গায়ে কোনো ব্লাউজ ছিল না। পরনের নিচের অংশটা বুক পর্যন্ত উঠিয়ে ঢেকে নেওয়া।
ওটা কী পোশাক?
লাহিং। ফানেকও বলে।
বাহ্!
মেয়েটা কতগুলো বরই ছুড়ে মারে মিলনের দিকে। মিলন কয়েকটা লুফে নেয়, কয়েকটা মাটিতে পড়ে যায়। মেয়েটা হি হি করে হাসতে থাকে। পা নাচিয়ে বসে থাকে বরইগাছে। খানিক দূরে ঢোলের মতো এক বাদ্য বাজছে। মিলন জানায় ওটা মৃদঙ্গ। আজ এক মৃতের কৃত্য হচ্ছে। মানুষ মারা গেলেও এখানে গানবাজনা হয়!
মিলন বারান্দা থেকে দুটো টুল নিয়ে আসে। তারপর ভেতরে চলে যায়। মিতু মেয়েটার সঙ্গে খুনসুটি করে। সে মিতুর দিকে তাকিয়ে চোখের টিপ্পনী কাটে, হাসে আর বরই ছুড়ে মারার ভয় দেখায়।
তুমি তো ভারি দুষ্টু!
হি হি হি।
তোমার দিদিমা যে কত বড় শিল্পী তুমি জানো? তার কাছ থেকে গান শেখো তুমি?
শিখি।
একটু শোনাও তো!
মেয়েটা শোনায়—তুমি কোন শহরের মাইয়া গো, লাগে উরাধুরা...
হাসতে হাসতে মিতুর পেটে খিল ধরে যায়।
শুভ্রকেশী দীর্ঘদেহী ফরসা গাত্রের রাজকুমারী দেখতে রাজকুমারীই বটে। আশি বছরেও সুগঠিত শরীর, চামড়াও এতটা শিথিল নয়। কিন্তু মিলন তাকে যখন আগলে ধরে নিয়ে আসে, তখন তিনি খানিকটা কাঁপছিলেন। শীতেও হতে পারে।
মেয়েটা কতগুলো বরই ছুড়ে মারে মিলনের দিকে। মিলন কয়েকটা লুফে নেয়, কয়েকটা মাটিতে পড়ে যায়। মেয়েটা হি হি করে হাসতে থাকে। পা নাচিয়ে বসে থাকে বরইগাছে। খানিক দূরে ঢোলের মতো এক বাদ্য বাজছে। মিলন জানায় ওটা মৃদঙ্গ।মিতু তার পা ছুঁয়ে সালাম করে। রাজকুমারী একটা টুলে বসেন। মিতুর দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে থাকেন। গড়নে বদনে এমন দাপুটে একটা মহিলার অবনত মুখ দেখতে ভালো লাগে না। তবে মিতু জানে কীভাবে তাকে সহজ করে তোলা যাবে। সাহারা বেগমও এমনই আড়ষ্ট ছিল, পরে তো মিতুর সঙ্গে পারলে মুজরানাচ নাচে। কাল রাতে মিতু বসের দেওয়া ভিডিওটা গভীরভাবে দেখেছে। বছর তিনেক আগে দেখা সেই রাসলীলার ভিডিও। সেখানে বারকয়েক রাজকুমারী দেবীকে দেখা যায়। উদাত্ত গলায় গান করে চলেছেন। সঙ্গে তাঁর কয়েকজন সহশিল্পী, যাদের বলা হয় সূত্রধারী। খোঁপায় ফুল গোঁজা, গলায় সোনার মালা পরা সেই রাজকুমারীর সঙ্গে এই রাজকুমারীর মিল খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। রাজকুমারীর রাজ্যলোপাট হয়েছে কালের হাতছানিতে। তবু নিশ্চয় তার সেই মনে-তোলপাড়-তোলা গানের সুর এখনো আছে? কাঁপা কাঁপা কারুকাজের সেই মিষ্টি কণ্ঠ? রাজকুমারীর পুত্রবধূ এক গ্লাস দুধ নিয়ে আসে। রাজকুমারী মিতুকে ইশারায় দুধ খেতে বলেন। মিতু তাকাচ্ছিল তার হাতের দিকে। ভিডিওতে দেখেছে রাজকুমারী রাসের সময় অনবরত তার হাত দুটো দিয়ে নানান মুদ্রা করে শিল্পীদের ইশারায় পরিচালনা করে যাচ্ছেন। হাত দুটো আজ নিথর। মিতু তার হাতের ক্লোজ কয়েকটা ছবি তোলে। রাজকুমারী অবাক চোখে তাকালে সে মৃদু হাসে। ছবি তুলতে থাকে।
সাত-আট ঘণ্টার রাসলীলা, কত বড় একটা পারফরম্যান্স, সেই রাস দুই শটার বেশি আপনি পরিচালনা করেছেন! অ্যামেজিং! বিশ্বাস হয় না!
রাজকুমারী স্মিত হাসেন। কিন্তু চোখে–মুখে তাঁর ক্লান্তি। মিতু ছবি তুলতে থাকে। মিলন তাকে সাহায্য করে। রাজকুমারীর পুত্রবধূ বারান্দার খুঁটি ধরে তাকিয়ে থাকে। কথায় কথায় মিতু জেনেছে রাজকুমারীর ছেলে একটা গ্যারেজে কাজ করে। কদিন ধরে তার চিকেনপক্স হওয়ায় আর বাড়ি ফেরেনি। গ্যারেজের একটা রুমে পড়ে আছে।
অনেকগুলো ছবি তোলা হয়ে গেলে মিতু থিতু হয়ে বসে। দুধে চুমুক দিতে দিতে বলে, মাসি, আমরা আলাপে পরে যাব, তার আগে আপনার গলায় একটা গান শুনতে চাই।
রাজকুমারী মাথা ঘুরিয়ে পেছনে বারান্দায় দাঁড়ানো পুত্রবধূর দিকে তাকায়। বিষণ্ন মুখ। নিষ্প্রভ চোখ।
এ বসন্তে প্রাণনাথ কোথা চলি গেল... আহা কী গান! এটা কি রাসের গান?
মিলন আগবাড়িয়ে বলে, না না, এটা হোলির গান।
শোনান না মাসি! একটা ফিল আসুক। তারপর কথা বলি। প্লিজ মাসি! প্লিজ!
মিতুর প্রবল অনুরোধে রাজকুমারী গাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মুখ থেকে কথা বেরোয় না। অনেক কষ্টে আধো আধো বোল বের হয়। অস্ফুট। বিকৃত। মিতু হকচকিত। মিলনের দিকে তাকায়। মিলনও খানিকটা অবাক। রাজকুমারীর গলা থেকে গানটার সুর শুধু শোনা যায়। তা–ও ভাঙা ভাঙা। মিতু লক্ষ করে রাজকুমারীর মুখটা একদিকে বেশ বাঁকা। খানিক বিকৃত। জিহ্বা অসাড়। বারান্দায় দাঁড়ানো তার পুত্রবধূর দিকে তাকায় মিতু। তার চোখে জল। রাজকুমারী অনেক কষ্ট করেও গানের কোনো লাইন বলতে পারেন না। একটা অবরুদ্ধ বেদনায় তার মুখ ছেয়ে যায়। মিতু ক্যামেরাটা ভিডিও মুডে অন করে রেখেছিল। সে হতবাক। মিলন বলে, শুনেছিলাম মাসি ছোটখাটো একটা স্ট্রোক করেছে, কিন্তু এ রকম অবস্থা জানতে পারি নাই দিদি!
রাজকুমারী গাইবার চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু পারেন না। হঠাৎ অন্য কোথাও থেকে কচি কণ্ঠে ভেসে আসে গানটা! মিতু চমকে তাকায়। বরইগাছের ডালে বসা রাজকুমারীর দুষ্টু নাতনিটি গাইছে। ওর মুখ ভরা হাসি। গলায় সেই গান। মিতুর অবাক ক্যামেরা অজান্তেই যেন ঘুরে যায় তার দিকে।
ছোট্ট রাজকুমারী গাইছে—ফুটিল মাধবী ফুল গগনে উড়িল, এ বসন্তে প্রাণনাথ কোথা চলি গেল...
বরইয়ের ডালে ডালে যেন মাধবী ফুটে উঠছে আজ!
শুভাশিস সিনহা: কবি; কথাসাহিত্যিক।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ত রবধ র ওপর বসন ত র একট
এছাড়াও পড়ুন:
ফুটিল মাধবী ফুল
‘রাজকুমারী দেবীর ইন্টারভিউটা আপনি করেন।’
বস যে এ রকম কিছু বলবে মিতু আগেই ধারণা করেছিল। সব ব্র্যান্ডিং মাল এরে–ওরে দিয়ে বাকি যে অগা-মগা থাকে, তার দায়িত্ব পড়বে মিতুর ওপর। এই তো স্টার ফ্যাশন প্রোগ্রামে পল্লব পেল জয়ার দায়িত্ব, তানিয়াকে শাকিবের পিছে পিছে দৌড়ানোর সুযোগ দেওয়া হলো, আর মিতুকে বলা হলো... থাক আর ভাবতেই চায় না সে। ‘বস, আমি এবার জয়া আপার ওপর কাজটা করতে চাইছিলাম।’ সিগারেটে ভাব ধরানো দুইটা টান দিয়ে বস বলে, আপনারে যেটা দিছি, ওটাই করেন। মিতুর খুব রাগ হয়েছিল। ক্যানটিনে চা খেতে গিয়ে দ্যাখে পল্লব আর তানিয়া হাসি–তামাশার দোকান খুলে বসেছে। পল্লব কী জানি বলছে আর তাানিয়া হাসতে হাসতে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। নিশ্চয় ওকে নিয়েই কোনো খুনসুটি হচ্ছে। কড়া এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে বসে বসে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল মিতু। চায়ের কাপটা ওদের মাথায় ঢেলে দেবে কি না ভাবছিল।
‘আপনি পটেনশিয়াল আছেন। সাহারা বেগমকে নিয়ে আপনার ফিচারটা অনেকেই পছন্দ করছে। মেইনস্ট্রিমের ভূত মাথা থিকা নামান।’
বসের কথায় মিতুর মন খানিকটা নরম হলো। আসলেই সাহারা বেগমের ওপর করা ফিচারটা জোশ হয়েছিল। ফেসবুকে হাজারের ওপর শেয়ার হয়েছে। এককালের যাত্রার হট প্রিন্সেস সাহারা। আজ থেকে ৫০–৬০ বছর আগে যে যাত্রার মঞ্চে ‘মিলতেহি আঁখে দিল হুয়া দিওয়ানা’ গেয়ে গেয়ে নাচত। পাতলা শাড়ির চিপায় সাহারার আধফোটা নাভি দেখতে এলাকার যুবকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ত। ‘শোনো গো মা, পেটের মইধ্যে একখান ফুটা, সেইটা নিয়া মাইনষের ঘুম নাই, বুকের ভিতরে যে মহব্বতের দিল, তার খোঁজ কেউ রাখে না।’ নেটিজেনরা পিক করেছিল সাহারার এ কথা।
‘রাজকুমারী দেবীর কাজটা মন লাগিয়ে করেন মিতু। শি ইজ আ লিজেন্ড!’
২.
শ্রীমঙ্গলে মিতুর এটা ফার্স্ট ট্যুর। অনেক শুনেছে, কিন্তু কেন জানি আসা হয়ে ওঠে নাই। শীত বেশি পড়ে। এটা একটা কারণ। শীত মিতুর একদম অপছন্দ। ফাল্গুনের শুরু। ঢাকায় তো শীত অলরেডি সাইবেরিয়া রওনা দিয়েছে। এখানে নাকি এখনো সকালে কুয়াশা পড়ে! ট্রেন জার্নি ওর অবশ্য খারাপ লাগে না। জানালা দিয়ে তাকালে মন কেমন যেন করে। দিলরুবা খানের ‘রেললাইন বহে সমান্তরাল’ গানটা মনে পড়ে। ট্রেনের নাম পারাবত এক্সপ্রেস। পারাবত মানে কী? অ্যাটেনডেন্সকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, এটা একটা ইন্টারসিটি ট্রেন। মিতু বিরক্ত মুখে বলল, আচ্ছা। গুগলে সার্চ করতে হবে। নেট ঠিকঠাক কাজ করছে না। ট্রেন জার্নির একটাই সমস্যা, খুব লেংথি মনে হয়। মনে হয় কোনো উদ্দেশ্য নাই। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। রাজকুমারী দেবীর দু–তিনটে গান পাঠিয়েছিল বস। শোনা যেতে পারে। ব্যাগে খুঁজে দেখে এয়ারফোন নাই। ক্যামেরা বের করে নিল। রানিংয়ে ল্যান্ডস্কেপ তোলার চেষ্টা করা যেতে পারে।
‘আপা সাবধান। ক্যামেরাটা সাবধানে রাখেন।’
চা–ওয়ালা বলে গেল। পাশে বসা এক মুরব্বি জিজ্ঞেস করেন, ‘কই যাইবা তুমি?’ বয়সের অপার ক্ষমতা। যারে–তারে তুই-তুমি বলা যায়। মিতু খানিকটা বিরক্ত হয়ে ক্যামেরার লেন্স নাড়াচাড়া করে।
শ্রীমঙ্গল?
জানলেন ক্যামনে!
ছবি তোলার জন্য বেশির ভাগ লোক যায়।
আমি যাব মণিপুরি পাড়া। মাধবপুর।
কমলগঞ্জ?
জি।
তাইলে তুমি ভানুগাছ নামতে পারবা। শ্রীমঙ্গলের পরের স্টেশন।
তাই?
অফিসের কেউ এই ইনফরমেশন দিল না! মিতুর ইচ্ছে করল লোকটার একটা ছুবি তুলে রাখে। না থাক।
আঙ্কেল, ওখানে শীত কেমন?
আগের শীত আর নাই।
এবার রাসমেলা হয়েছে?
কেন হবে না? আমার ছেলেমেয়েরা গেছিল।
আপনি কই নামবেন?
শায়েস্তাগঞ্জ।
মিতু একবার ভাবছিল রাজকুমারী দেবীর কথা জিজ্ঞেস করবে কি না। রাসের কথা যখন জানেন, রাজকুমারীর কথাও লোকটা জেনে থাকতে পারেন। রাজকুমারী হচ্ছেন রাসের লিজেন্ড। বস বলে, দুই শর বেশি রাসলীলা পরিচালনা করেছেন ওই মহিলা। সারা রাত ধরে হওয়া একটা পারফরম্যান্স। প্রতিবার নতুন নতুন শিল্পী ট্রেনআপ করতে হয়। দুই শ বার! খাইছে!
৩.
ভানুগাছ স্টেশনে নেমে চায়ের খুব তেষ্টা পেল মিতুর। এই এলাকা হলো চায়ের রাজধানী। ‘চায়ের রাজধানীতে রাজকুমারী দেবী’। বাহ্! ইন্টারেস্টিং হবে। বস আবার একটু বেশি অফ ট্র্যাক। এ রকম সোজাসাপটা টাইটেল পছন্দ করে না। বলবে, এই রকম না মিতু, ট্রেন্ডি হয়েন না। বি চুজি! বি ইউনিক!
ওয়েদারটা খারাপ না। যেমনটা মনে করেছিল তার ধারেকাছেও নেই। দুপুর বারোটা ছুঁই ছুই মাত্র, তার মধ্যেই চড়া রোদ। জ্যাকেটটা খুলে ফেলাই ভালো। ভানুগাছ স্টেশনের পাশেই ছোট্ট টংদোকানের বেঞ্চিতে বসে এক কাপ চা খেতে খেতে ক্যামেরার লেন্স–ফোকাস সব ঠিক করে নিল মিতু। বস বলে দিয়েছে, একটা ছেলে আসবে ওকে পিক করতে। মণিপুরি ছেলে। নাম মিলন। মণিপুরি ছেলের এমন বাংলাটাইপ নাম পছন্দ হলো না মিতুর। তবে নামটা স্পিরিচুয়াল। রাজকুমারীর সঙ্গে মিতুর মিলন ঘটানোর সে হলো একটা মিডিয়াম। সে-ই তাকে নিয়ে যাবে রাজকুমারী দেবীর কাছে। ট্রেন নাকি আজ আধা ঘণ্টার মতো লেট করেছে। তা–ও মিলনের দেখা নেই। শান্তিপূর্ণ এলাকা কমলগঞ্জ। সারা দেশে যখন কারফিউ চলে, এখানকার লোকজন বিয়ার দাওয়াত খেতে যায়। শান্তির এলাকায় এক্ষণে অশান্তির বিষয় মিলন। কই সে!
গুড মর্নিং, দিদি!
এখন তো দুপুর।
চেইন পড়ে গেছিল।
মোটরসাইকেলের অবস্থা দেখে মিতুর বিশ্বাস হলো।
দুই বছর আগে কামাল ভাই রাসে আসছিলেন। তখন আমার লগে পরিচয়। রাসের আগর দিন উনারে নিয়া পুরা এরিয়া চক্কর দিছি।
হুমম। বস বলছে তোমার কথা। এখন আমারে রাজকুমারী দেবীর কাছে পৌঁছায়া দেও ভাই।
চায়ের বিলটা আগ বাড়িয়ে মিলনই দিল। খুব স্মার্ট ছেলে মনে হলো। কিন্তু স্মার্ট ছেলের এভাবে চেইন পড়ে যায় কেন!
৪.
মিলনের বাড়িতে ফ্রেশট্রেশ হয়ে জম্পেশ একটা নাশতা করার পর মিতুর হঠাৎ কী জানি মনে উদয় হলো, বলল, আসার পথে একটা নদী পেলাম। কী নাম?
ধলাই।
পানি তো নাই।
পানি নাই? বর্ষার সময় আইলে দেখবেন!
বন্যা হয়?
হয় মানে? গত বছর, এই রকম ফকফকা রইদ, আচমকা নদী পাড়ে-পাড়। ভাসাইলো কয়েকটা গ্রাম।
কী বলো!
হ, উজানের পানি। ইন্ডিয়ার।
আমি একটু ধলাইর পাড়ে গিয়ে বসব।
রাজকুমারীর মাসির কাছে যাবেন না?
একটু পরে যাব।
ধলাইয়ের পানি হাঁটুসমান। বড় বড় চর পড়ে আছে। মিতু পাড়ের একটা ছোট্ট কাঠের গুঁড়িতে বসল। ‘তোমার এয়ারফোনটা একটু দিবা?’ মিলন তার কানে লাগানো এয়ারফোনটা খুলে দিল।
ট্রেনে শোনা হয়নি। বসের পাঠানো গানগুলো শুনে নেওয়া ভালো। এমনিতে মিতু তার প্রফেশনাল কাজে সিরিয়াস। সারা রাত রাজকুমারী দেবীকে নিয়ে স্টাডি করেছে। যত ডেটা, ইমেজ, ফুটেজ সব। গানগুলোই শোনা হয় নাই। একটু–আধটু হিম বাতাস বইছে। ‘ফুটিল মাধবী ফুল গগনে উড়িল, এ বসন্তে প্রাণনাথ কোথা চলি গেল...’
আহ্, কী মিহি গলা! সুরটা যেন উঁচা-নিচা পথ ধরে আগাচ্ছে। শীতের শেষ প্রায়। বসন্তের আগমনী রং চোখ তুলতে শুরু করেছে, ধলাইয়ের উদোম বুকে কী এক শূন্যতা, এর মধ্যে রাজকুমারী দেবীর গান কৃষ্ণের বিরহে পোড়া রাধার বেদনাকে মনে জাগিয়ে তুলল। এমনিতে পাগলা টাইপের মেয়ে হলেও মিতুর চোখে হুটহাট পানি আসে। মিলন খানিকটা অবাক হয়ে তাকে দেখে। স্টেশনে আউলা-ঝাউলা চুলে টংদোকানে বসে থাকা মিতুর সঙ্গে এই মিতুর মিল নাই।
৫.
রাজকুমারীর রাজপ্রাসাদ এক–আধভাঙা মাটির দেয়াল। জায়গায় জায়গায় মাটি খসে পড়েছে। নিচে উঁইপোকার বড় বড় ঢিবি। বারান্দার একদিকটায় বাঁশের আচ্ছাদন। তা–ও ভাঙাচোরা। দক্ষিণ দিকটায় টিনের ছাউনির আধেক অংশ ভেঙে গেছে। উঠানের কোণে একটা বড়সড় বরইগাছ।
বরইগাছটার দিকে তাকাতেই মিতু চমকে ওঠে, ওখানে কোনো বাদুড় নয়, কাঠবিড়ালি নয়, আস্ত একটা মানুষের বাচ্চা। তাকে দেখে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
‘মাও, দাংগো কই?’ (মামণি, দিদিমা কই?)
মেয়েটা কিছু বলে না। হঠাৎ ভেতর থেকে এক মহিলা মেয়েটার মা-ই হবে ‘হৈমা’ বলে তেড়ে আসে বরইগাছের দিকে। একটা চিকন বাঁশ দিয়ে গুঁতো দেওয়ার ছলে মেয়েটিকে ভয় দেখায়। মেয়ে কান ধরে। মিতু খুব মজা পায়।
রাজকুমারীর নাতনি। খুব দুষ্টু!
মিতু ক্যামেরা নিয়ে ঝটপট কয়েকটা ছবি তুলে ফেলে। হঠাৎ মহিলা মিতুকে দেখতে পেয়ে লজ্জা পায়। দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। তার গায়ে কোনো ব্লাউজ ছিল না। পরনের নিচের অংশটা বুক পর্যন্ত উঠিয়ে ঢেকে নেওয়া।
ওটা কী পোশাক?
লাহিং। ফানেকও বলে।
বাহ্!
মেয়েটা কতগুলো বরই ছুড়ে মারে মিলনের দিকে। মিলন কয়েকটা লুফে নেয়, কয়েকটা মাটিতে পড়ে যায়। মেয়েটা হি হি করে হাসতে থাকে। পা নাচিয়ে বসে থাকে বরইগাছে। খানিক দূরে ঢোলের মতো এক বাদ্য বাজছে। মিলন জানায় ওটা মৃদঙ্গ। আজ এক মৃতের কৃত্য হচ্ছে। মানুষ মারা গেলেও এখানে গানবাজনা হয়!
মিলন বারান্দা থেকে দুটো টুল নিয়ে আসে। তারপর ভেতরে চলে যায়। মিতু মেয়েটার সঙ্গে খুনসুটি করে। সে মিতুর দিকে তাকিয়ে চোখের টিপ্পনী কাটে, হাসে আর বরই ছুড়ে মারার ভয় দেখায়।
তুমি তো ভারি দুষ্টু!
হি হি হি।
তোমার দিদিমা যে কত বড় শিল্পী তুমি জানো? তার কাছ থেকে গান শেখো তুমি?
শিখি।
একটু শোনাও তো!
মেয়েটা শোনায়—তুমি কোন শহরের মাইয়া গো, লাগে উরাধুরা...
হাসতে হাসতে মিতুর পেটে খিল ধরে যায়।
শুভ্রকেশী দীর্ঘদেহী ফরসা গাত্রের রাজকুমারী দেখতে রাজকুমারীই বটে। আশি বছরেও সুগঠিত শরীর, চামড়াও এতটা শিথিল নয়। কিন্তু মিলন তাকে যখন আগলে ধরে নিয়ে আসে, তখন তিনি খানিকটা কাঁপছিলেন। শীতেও হতে পারে।
মেয়েটা কতগুলো বরই ছুড়ে মারে মিলনের দিকে। মিলন কয়েকটা লুফে নেয়, কয়েকটা মাটিতে পড়ে যায়। মেয়েটা হি হি করে হাসতে থাকে। পা নাচিয়ে বসে থাকে বরইগাছে। খানিক দূরে ঢোলের মতো এক বাদ্য বাজছে। মিলন জানায় ওটা মৃদঙ্গ।মিতু তার পা ছুঁয়ে সালাম করে। রাজকুমারী একটা টুলে বসেন। মিতুর দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে থাকেন। গড়নে বদনে এমন দাপুটে একটা মহিলার অবনত মুখ দেখতে ভালো লাগে না। তবে মিতু জানে কীভাবে তাকে সহজ করে তোলা যাবে। সাহারা বেগমও এমনই আড়ষ্ট ছিল, পরে তো মিতুর সঙ্গে পারলে মুজরানাচ নাচে। কাল রাতে মিতু বসের দেওয়া ভিডিওটা গভীরভাবে দেখেছে। বছর তিনেক আগে দেখা সেই রাসলীলার ভিডিও। সেখানে বারকয়েক রাজকুমারী দেবীকে দেখা যায়। উদাত্ত গলায় গান করে চলেছেন। সঙ্গে তাঁর কয়েকজন সহশিল্পী, যাদের বলা হয় সূত্রধারী। খোঁপায় ফুল গোঁজা, গলায় সোনার মালা পরা সেই রাজকুমারীর সঙ্গে এই রাজকুমারীর মিল খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। রাজকুমারীর রাজ্যলোপাট হয়েছে কালের হাতছানিতে। তবু নিশ্চয় তার সেই মনে-তোলপাড়-তোলা গানের সুর এখনো আছে? কাঁপা কাঁপা কারুকাজের সেই মিষ্টি কণ্ঠ? রাজকুমারীর পুত্রবধূ এক গ্লাস দুধ নিয়ে আসে। রাজকুমারী মিতুকে ইশারায় দুধ খেতে বলেন। মিতু তাকাচ্ছিল তার হাতের দিকে। ভিডিওতে দেখেছে রাজকুমারী রাসের সময় অনবরত তার হাত দুটো দিয়ে নানান মুদ্রা করে শিল্পীদের ইশারায় পরিচালনা করে যাচ্ছেন। হাত দুটো আজ নিথর। মিতু তার হাতের ক্লোজ কয়েকটা ছবি তোলে। রাজকুমারী অবাক চোখে তাকালে সে মৃদু হাসে। ছবি তুলতে থাকে।
সাত-আট ঘণ্টার রাসলীলা, কত বড় একটা পারফরম্যান্স, সেই রাস দুই শটার বেশি আপনি পরিচালনা করেছেন! অ্যামেজিং! বিশ্বাস হয় না!
রাজকুমারী স্মিত হাসেন। কিন্তু চোখে–মুখে তাঁর ক্লান্তি। মিতু ছবি তুলতে থাকে। মিলন তাকে সাহায্য করে। রাজকুমারীর পুত্রবধূ বারান্দার খুঁটি ধরে তাকিয়ে থাকে। কথায় কথায় মিতু জেনেছে রাজকুমারীর ছেলে একটা গ্যারেজে কাজ করে। কদিন ধরে তার চিকেনপক্স হওয়ায় আর বাড়ি ফেরেনি। গ্যারেজের একটা রুমে পড়ে আছে।
অনেকগুলো ছবি তোলা হয়ে গেলে মিতু থিতু হয়ে বসে। দুধে চুমুক দিতে দিতে বলে, মাসি, আমরা আলাপে পরে যাব, তার আগে আপনার গলায় একটা গান শুনতে চাই।
রাজকুমারী মাথা ঘুরিয়ে পেছনে বারান্দায় দাঁড়ানো পুত্রবধূর দিকে তাকায়। বিষণ্ন মুখ। নিষ্প্রভ চোখ।
এ বসন্তে প্রাণনাথ কোথা চলি গেল... আহা কী গান! এটা কি রাসের গান?
মিলন আগবাড়িয়ে বলে, না না, এটা হোলির গান।
শোনান না মাসি! একটা ফিল আসুক। তারপর কথা বলি। প্লিজ মাসি! প্লিজ!
মিতুর প্রবল অনুরোধে রাজকুমারী গাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মুখ থেকে কথা বেরোয় না। অনেক কষ্টে আধো আধো বোল বের হয়। অস্ফুট। বিকৃত। মিতু হকচকিত। মিলনের দিকে তাকায়। মিলনও খানিকটা অবাক। রাজকুমারীর গলা থেকে গানটার সুর শুধু শোনা যায়। তা–ও ভাঙা ভাঙা। মিতু লক্ষ করে রাজকুমারীর মুখটা একদিকে বেশ বাঁকা। খানিক বিকৃত। জিহ্বা অসাড়। বারান্দায় দাঁড়ানো তার পুত্রবধূর দিকে তাকায় মিতু। তার চোখে জল। রাজকুমারী অনেক কষ্ট করেও গানের কোনো লাইন বলতে পারেন না। একটা অবরুদ্ধ বেদনায় তার মুখ ছেয়ে যায়। মিতু ক্যামেরাটা ভিডিও মুডে অন করে রেখেছিল। সে হতবাক। মিলন বলে, শুনেছিলাম মাসি ছোটখাটো একটা স্ট্রোক করেছে, কিন্তু এ রকম অবস্থা জানতে পারি নাই দিদি!
রাজকুমারী গাইবার চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু পারেন না। হঠাৎ অন্য কোথাও থেকে কচি কণ্ঠে ভেসে আসে গানটা! মিতু চমকে তাকায়। বরইগাছের ডালে বসা রাজকুমারীর দুষ্টু নাতনিটি গাইছে। ওর মুখ ভরা হাসি। গলায় সেই গান। মিতুর অবাক ক্যামেরা অজান্তেই যেন ঘুরে যায় তার দিকে।
ছোট্ট রাজকুমারী গাইছে—ফুটিল মাধবী ফুল গগনে উড়িল, এ বসন্তে প্রাণনাথ কোথা চলি গেল...
বরইয়ের ডালে ডালে যেন মাধবী ফুটে উঠছে আজ!
শুভাশিস সিনহা: কবি; কথাসাহিত্যিক।