ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন বিচারকাঠামো
Published: 21st, February 2025 GMT
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসচর্চা গত পাঁচ দশকে বদরুদ্দীন উমর থেকে বেশি দূর এগোয়নি। বদরুদ্দীন উমরের কালজয়ী গবেষণাগ্রন্থ পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি-এর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে, তৃতীয় ও সর্বশেষ খণ্ড ১৯৮৪ সালে। ১৯৯০ সালে বদরুদ্দীন উমরের কাঠামোকে অনুসরণ করেই সামাজিক গবেষণার আদলে ইউপিএল থেকে বের হয় ভাষা আন্দোলনের আর্থ-সামাজিক পটভূমি। আর্কাইভমূলক কিছু কাজের বাইরে এর পরের তিন দশকের ইতিহাসকারেরা তাঁদের শ্রম খরচ করেছেন প্রধানত স্বাধীনতার পরে রাজনীতিতে ক্রিয়াশীল বিবিধ পক্ষের (আওয়ামী [মুসলিম]) লীগ ও তার অঙ্গসংগঠন, তমুদ্দন মজলিসসহ ‘ডানপন্থী’ গ্রুপ এবং কমিউনিস্ট পার্টিসহ ‘বামপন্থী’দের ভূমিকা মূল্যায়নে। যার চূড়ান্ত পরিণতি দাঁড়িয়েছিল দেড় দশকজুড়ে ক্ষমতার চূড়ান্ত এককেন্দ্রীকরণের সমান্তরালে মুক্তিযুদ্ধের মতো ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকেও চরম একদেশদর্শী বয়ানে এঁটে ফেলার মধ্য দিয়ে।
ইতিহাসের সত্য যে কেবল তথ্যে নিহিত থাকে না, নানা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পটভূমির পাটাতনে এর যে নানা প্রকরণ তৈরি হয় এবং সমকালীন ইতিহাসচর্চা যে তথ্যের প্রথাগত সাংবাদ–প্রতিবেদনমূলক টালিকরণ থেকে বহুদূর এগিয়ে দর্শন-সমাজবিজ্ঞানের সীমানা ভেদ করেছে, সেই বোধ আমাদের মূলধারার ইতিহাসচর্চায় এখনো অস্ফুট রয়ে গেছে। ফলে উমরের পর ভাষা আন্দোলনের যে ইতিহাস রচিত হয়েছে, তা প্রধানত একরৈখিক এবং আমাদের চিন্তার ইতিহাসে তা নতুন কোনো মাত্রা যোগ করতে পারেনি। যেমন সাত দশক পরেও ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তানের বিচারব্যবস্থার কী ভূমিকা ছিল কিংবা কী রকম বিচারব্যবস্থার সহায়তায় পাকিস্তানের সামরিক-আমলাতান্ত্রিক অভিজাতরা জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে রুদ্ধ করে জবরদস্তিমূলক শাসনব্যবস্থা জারি করতে পেরেছিল, এসব নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। এমনকি উমরের পদ্ধতিগতভাবে প্রায়-স্বয়ম্ভু গ্রন্থেও তৎকালীন বিচারব্যবস্থাকে অ্যাড্রেস করা হয়নি।
‘যখন আমার চক্ষের মানিক, আমাদের রাষ্ট্রের ভাবী নেতা, ছয়জন ছাত্র রক্তশয্যায় শায়িত, তখন আমরা পাখার নিচে বসে হাওয়া খাব, এ আমি বরদাশত করতে পারব না। আমি জালিমের এ জুলুমের প্রতিবাদে পরিষদগৃহ পরিত্যাগ করছি এবং মানবতার দোহাই দিয়ে…সকল মেম্বারের কাছে পরিষদগৃহ ত্যাগের আবেদন জানাচ্ছি।’ এ কথা বলে তিনি পরিষদ ত্যাগ করেন।২.
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের প্রধান ভূমিকা হলো আইনসভা কোনো গণবিরোধী আইন করলে কিংবা সেই আইনের ব্যবহার/অপব্যবহার করে নির্বাহী বিভাগ কোনো নিপীড়নমূলক সিদ্ধান্ত নিলে তার অযথার্থতা-অন্যায্যতা চিহ্নিত করে নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সমুন্নত করা। আদালত তার ভূমিকা পালন করতে সক্ষম কি না, তা মূল্যায়নের জন্য আদালতের গঠন এবং আইনি কাঠামো যার মধ্য থেকে আদালত বিচারকাজ সম্পন্ন করে, তা বিবেচনা করা দরকার। আবার আইন-আদালতের কাঠামো বৃহত্তর রাষ্ট্রকাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন করে বোঝা দুষ্কর।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্ম হয় ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রকাঠামোর প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকার নিয়ে। প্রথাগত ইতিহাসে ভারতে ব্রিটিশ বিচারব্যবস্থাকে ঔপনিবেশিক শাসনের ‘শাপেবর’ বা অকল্যাণের কল্যাণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু আদতে ‘ব্রিটিশ ন্যায়বিচার’ বা ‘আইনের শাসন’ ইত্যাদি ধারণাকে ঔপনিবেশিক শাসককুল ব্যবহার করেছেন তাদের দখলদারত্ব, কথিত ‘প্রাচ্যের স্বৈরতন্ত্রে’র বিপরীতে ‘সিভিলাইজিং মিশনে’র নামে তার অনন্ত শাসন-শোষণের বৈধতা নিরূপণের প্রধান মতাদর্শিক ও প্রায়োগিক অস্ত্র হিসেবে। আইন একদিকে স্থানীয় বিদ্রোহ আর প্রাত্যহিক শাসনের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাহায্য করেছে, শোষণ-নিষ্পেষণ ও সম্পদ-নিষ্কাশনের কাঠামো সরবরাহ করেছে, অন্যদিকে উপনিবেশিত প্রজাদের একটি ন্যায্য ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মাধ্যমে ব্রিটিশ ক্ষমতার প্রয়োগকে বৈধতা দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আইনি সাংবিধানিক কাঠামো ছিল বৈষম্যমূলক, বর্ণবাদী, নিপীড়নমূলক ও কর্তৃত্ববাদী, যার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো শাসন ও ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করা।
স্বভাবতই এটা ছিল গুটিকয়েক শাসন, ক্ষমতার ভরকেন্দ্র ছিল ওপরে ক্রাউনের প্রতিনিধিরূপে সার্বভৌম গভর্নর জেনারেল/গভর্নর (ও তার কাউন্সিল), নিচে একই সঙ্গে আইনি-নির্বাহী-বিচারিক ক্ষমতার অধিকারী স্বয়ম্ভূ প্রতিনিধি জেলা প্রশাসক। কখনো ‘উদারনীতিবাদ’ বা ‘উপযোগবাদ’, কখনো ‘পরোক্ষ শাসন’, ‘প্রতিনিধিত্বশীল সরকার’ কিংবা ‘স্ব-শাসন’ (সেলফ রুল/অটোনমি) ইত্যাকার নানা তত্ত্বকাঠামোতে সওয়ার হয়ে উনিশ শতকের ত্রিশের দশক থেকে শুরু করে পরবর্তী এক শতকজুড়ে নানা সংস্কার আনা হয় শাসনকাঠামোতে, কিন্তু কর্তৃত্ববাদী কাঠামো অটুট থাকে।
আমলাদের বানানো হয় নেটিভ মন্ত্রীদের প্রহরী, যাঁরা মন্ত্রীদের ডিঙিয়ে গভর্নরের কাছে রিপোর্ট করতেন। এমনকি ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রথম নির্বাচিত প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠিত হলেও আমলাতন্ত্রই ছিল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। বিচার বিভাগেরও নিয়ন্ত্রণ ছিল পরাক্রমশালী নির্বাহী বিভাগের কাছে।
ন্যায়বিচার ও সমতার কথা বলা হলেও বিচারিক কাঠামো নিজেই ছিল অবিচার ও অসমতার কারখানা। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্টের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি হওয়ার পর কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট এবং মফস্সলে নানা স্তরের দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা আবশ্যিকভাবে ব্রিটিশ এবং অধস্তনও আদালতে উচ্চ বিচারিক ক্ষমতাসম্পন্ন সব পদে বিচারিক কাজে অভিজ্ঞতাহীন ব্রিটিশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্য, কেবল নিম্ন দেওয়ানি পদগুলোতে স্থানীয়রা। ম্যাজিস্ট্রেসি বা ফৌজদারি বিচারের (প্রাথমিক তদন্ত, গ্রেপ্তার, জামিন কিংবা সুপ্রিম কোর্টে বিচারযোগ্য কোনো মামলা দায়েরের ক্ষমতা) ক্ষমতা কেবল ব্রিটিশদের হাতে, ১৮৪৩ নাগাদ স্থানীয়দের মধ্যে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের খবর পাওয়া যায়। কিন্তু আমূল বর্ণবাদী বিচারব্যবস্থায় ভারতীয় ম্যাজিস্ট্রেটদের ব্রিটিশদের এমনকি বহুকাল পর্যন্ত অব্রিটিশ ইউরোপীয়দেরও বিচার করার ক্ষমতা ছিল না, সাম্রাজ্যের অস্তকাল পর্যন্ত এ বিধান অক্ষুণ্ন থাকে। ভারতে বসবাসরত ইংরেজদের প্রবল বিরোধিতার কারণে ১৮৭৩ সালে ইলবার্ট বিলের যে পরিবর্তিত সংস্করণ পাস হয়, তাতে স্থানীয় বিচারকদের ইংরেজদের বিচারের ক্ষমতা দেওয়া হয় কেবল বিচারকাজে অর্ধেক ব্রিটিশ জুরি রাখার শর্তে। ফলে দারোগা বা ইংরেজ নীলকর জমিদারদের শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকারের জন্য স্থানীয় প্রজাদের যেতে হতো সুদূর কলকাতার সুপ্রিম কোর্টে, সেই সুপ্রিম কোর্টের দায়রা (ফৌজদারি) বেঞ্চ আবার বসত বছরে মাত্র চারবার। ১৮৬১ সালে সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে কলকাতা হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হলেও বিচারিক বৈষম্য অটুট থাকে।
১৮৫৮ সালে রানির ঘোষণায় প্রজার মধ্যে সমতার কথা পুনর্ব্যক্ত করা হলেও ১৮৭৭ সাল নাগাদ দেখা যায় ভারতে কমপক্ষে তিনটি আলাদা ফৌজদারি কোড বিদ্যমান: ‘মফস্সল আদালতের জন্য ফৌজদারি কার্যবিধি, দ্য হাইকোর্টস’ ক্রিমিনাল প্রসিডিউর অ্যাক্ট এবং প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট অ্যাক্ট।
উনিশ শতকের শেষ নাগাদ রাজনৈতিক দল, সভা-সমিতি আর সংবাদপত্রের উত্থানের ফলে মতপ্রকাশ-সংক্রান্ত অপরাধগুলো আবিষ্কৃত হতে থাকে। আদি দণ্ডবিধিতে না থাকলেও ১৮৭০ সালে ‘সেডিশন’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ যোগ করা হয়। ১৮৭৮ সালে সংবাদপত্র দমনের আইন হয় এবং ১৮৮৩ নাগাদ সংবাদপত্রে লেখার জন্য প্রথম গ্রেপ্তার (সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী)। প্রথমে স্বদেশি/সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন (১৯০৬-০৭) পরে খেলাফত-অসহযোগকে (১৯১৯-২০) কেন্দ্র করে মতপ্রকাশের ওপর দমন-পীড়নের আরও বিস্তৃততর হয়। বেয়াড়া নাগরিক প্রজাদের ঠেকানোর জন্য ‘অবৈধ সমাবেশ’ বা ১৪৪ ধারার মতো অস্ত্র আবিষ্কৃত হয় (১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি)। ক্রিমিনাল ল সংশোধন করে পুলিশি ক্ষমতা বাড়ানো হয়। খাজনা তোলার বিরুদ্ধে প্রজা-বিদ্রোহকে ডাকাতি’ নাম দিয়ে তা ঠেকানোর জন্য পুলিশের উদ্ভব হয়েছিল, তারা এবার তরুণ স্বদেশিদের প্রতিরোধে স্কুল-কলেজ-হোস্টেল বা নাগরিক সভা-সমিতিতে উত্থিত হন, হরেদরে গ্রেপ্তার-গুলির অধিকার পান। সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রধান প্রতিভূ হিসেবে আবির্ভূত হয়ে পুলিশ, বিচারিক দায়মুক্তিসহ। যুদ্ধকালে সংহতির নামে ‘জরুরি অবস্থা’ আবিষ্কৃত হয় যেখানে প্রজাদের সভা-সমাবেশ সবকিছুর অধিকার এককালীনভাবে কেড়ে নেওয়া যায়, নিবর্তনমূলকভাবে আটক করা যায় কিংবা সেনাবাহিনী নামিয়ে নির্বিচার গুলি। যুদ্ধকালে কিংবা জরুরি অবস্থায় বিচার বিভাগের ক্ষমতা স্থগিত/সীমিত থাকে, অন্য সময় বিচারকের সম্মতি পেতে সরকারকে কেবল বলতে হয় যে, সরকার বা গভর্নর এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে ধৃত ব্যক্তি ‘আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ’। বিচারক নিয়োগের ক্ষমতা ছিল নির্বাহী প্রধান/বিভাগের হাতে। ১৯৩৫ সালের সংস্কারে হাইকোর্টের বিষয়াবলি প্রাদেশিক সরকারের অধীনে আনা হলেও নির্বাহী-কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ন রাখা হয়। হাইকোর্টের ব্যয় বরাদ্দের ওপর প্রাদেশিক পরিষদে ভোট প্রদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
৩.
এই ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রকাঠামো নিয়েই পাকিস্তানের জন্ম হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রকাঠামোতে যে কর্তৃত্ববাদী একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্থিত হয়, তা-ই রাজনৈতিক বাঁকবদল পেরিয়েও অটুট থাকে। কেন্দ্রে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী গভর্নর জেনারেল এবং সামরিক-আমলাতান্ত্রিক কোটারি গোষ্ঠী; প্রদেশে গভর্নরের (প্রকারান্তরে মুখ্য সচিবের) একচ্ছত্র ক্ষমতা এবং একদলীয় প্রাদেশিক আইনসভা, যা ছিল সরকারি দল মুসলিম লীগের সংসদীয় কমিটির বর্ধিত অংশ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলা হলেও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার বদলে নিবর্তন-নিপীড়নমূলক আইনই নতুন রাষ্ট্রের ভাষা হয়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক আমলের বিস্তৃত নিপীড়নমূলক আইনি কাঠামোও তার জন্য যথার্থ প্রতিভাত হয় না। একের পর এক নিবর্তনমূক আইন প্রণীত হতে থাকে। দেশের সংবিধান প্রণয়নে ৯ বছর লাগলেও এক দশকে আমরা কমপক্ষে ১০টি নিপীড়নমূলক আইন প্রণীত হতে দেখি, যার অধিকাংশই প্রণীত হয় সংসদকে এড়িয়ে, নির্বাহী আদেশে। রাজনৈতিক ভিন্নমত ও নাগরিক অধিকার দলনের জন্য রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রায় সব রকম ধরনই ব্যবহৃত হতে থাকে। ঔপনিবেশিক আমলের দমনের যাবতীয় কলাকৌশল প্রস্তুত ছিল, পাকিস্তানি শাসকেরা কেবল তার নবরূপায়ণ করেছেন।
১৯৪৮ সালের ২৮ আগস্ট বরিশালের ব্রজমোহন কলেজের বিএসসি চতুর্থ বর্ষের ছাত্র নির্মল সেনকে (পরে বিখ্যাত সাংবাদিক) গ্রেপ্তার করা হয় সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করছে এমন গুপ্ত সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে। আরও ২০ জন রাজবন্দীর সঙ্গে এই আটকাদেশ হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়। বিচারপতি এলিস ও বিচারপতি ফজলে আকবরের বেঞ্চের সামনে শুনানিতে নির্মলের আইনজীবী আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, তার দল (রেভল্যুশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি অব পাকিস্তান—আরএসপি) আইনত নিষিদ্ধ নয় এবং দলের অধিকাংশ কর্মী জেলের বাইরে থেকে প্রকাশ্য কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
১৯৫০ সালের ২৮ আগস্টের রায়ে নাগরিক অধিকার নয়, আইনের অক্ষরের প্রতি অবিচল নিষ্ঠাবান বিচারপতি এলিস সিদ্ধান্ত জানান, বিচারক হিসেবে তাঁরা ‘আটককৃতের গ্রেপ্তার হওয়ার কোনো ভিত্তি ছিল কি ছিল না তা নিয়ে মোটেই চিন্তিত নয়।’ কেবল দেখতে হবে সরকারপ্রদত্ত আটকাদেশ বৈধ কি না এবং বৈধতার ভিত্তি হলো সরকারের ‘সদুদ্দেশ্য-প্রণোদিত’ সিদ্ধান্ত এবং ‘সাবজেক্টিভ স্যাটিসফ্যাকশন’ (নির্মল কুমার সেন বনাম ক্রাউন ৫৫ সিডব্লিউএন ২৫)। আমরা জানি এবং বিচারপতি নিজেও তাঁর মনোভাব গোপন করেননি যে এখানে তিনি রাষ্ট্রের ভাষায় কথা বলছেন, যে রাষ্ট্র ইতিমধ্যে ‘কমিউনিজম’কে নতুন ‘অপরাধ’ এবং ‘কমিউনিস্ট’দের ‘অপরাধী গোষ্ঠী’ হিসেবে আবিষ্কার করেছে।
ফলে দেখা যাচ্ছে, আইনের ফাঁকফোকরের কারণে বিনা বিচারে আটকাদেশের বৈধতা নির্ধারণ নির্ভর করত সংশ্লিষ্ট বিচারপতির নিজস্ব অবস্থানের ওপর। তাই সরকারের হাতে এই আইনের অপব্যবহারের ব্যাপক সুযোগ থেকে যায়।
৪.
১৯৪৭ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন ১৯৫২ সাল নাগাদ বৃহত্তর আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে গণবিস্ফোরণে পরিণত হয়েছিল। নির্বাহী বিভাগ নজিরবিহীন বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তা দমন করেছিল। কিন্তু বিচার বিভাগ কি সেই রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণ-সংক্রান্ত দুটি বিচারিক কার্যক্রম পর্যালোচনার মাধ্যমে আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করব।
ক. ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিলে গুলি: সংশ্লিষ্ট পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক দায়মুক্তি
২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের পূর্বনির্ধারিত হরতাল-সমাবেশের আগের দিন ১৪৪ ধারা জারি করে তা নিষিদ্ধ করা হয়। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল-সমাবেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পুলিশও ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে হাজির হয় তা প্রতিরোধে। সশস্ত্র-নিরস্ত্র-গ্যাস স্কোয়াড নিয়েডের কনস্টেবলদের প্রত্যক্ষ ফোর্স মোতায়েন করা হয় সকাল থেকে। ইন্সপেক্টর, সার্জেন্ট, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, এসপি, ডিএসপি, অ্যাডিশনাল এসপি, ডিআইজি এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হাজির ছিলেন। পুলিশি বাধার মুখে ছাত্রদের ইটপাটকেলের বিপরীতে পুলিশ লাঠিপেটা করে, কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। একপর্যায়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও ডিআইজির পরামর্শে এবং এসপির নির্দেশে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। সরকারি ভাষ্যমতে, কমপক্ষে ৩০ জন পুলিশ সদস্য ২৭টি গুলি করেন। কেবল রাস্তায় নয়, মেডিকেল হোস্টেলের ভেতরেও গুলি করা হয়। হোস্টেলের ভেতরেই গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যায় কেউ, একজনের মাথায় গুলি লেগে মগজ বেরিয়ে যায় বলে বিবরণ পাওয়া যায়। ‘প্রচুর রক্তে বারান্দার শেডের প্রশস্ত অংশ রঞ্জিত হইয়া ওঠে।…কয়েকটি বুলেট ১২ নম্বর শেডের দেওয়াল ভেদ করিয়া কামরার মধ্যে প্রবেশ করে…।’ ৩–৪ জন নিহত এবং ১৭ জন আহত হন। বহুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। (আজাদ, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)
২২ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার মিছিলে আবার গুলি করে পুলিশ। এবার পুলিশের সঙ্গে যুক্ত হয় ইপিআর ও সেনাবাহিনী। এতে চারজন নিহত ও শতাধিক আহত হন। জারি করা হয় কারফিউ।
১৯৪৯–৫৩ সাল পর্যন্ত ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিনউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক ব যবস থ র ন র জন য কর ত ত ব র জন ত ক ব চ রপত ব যবহ র ক ষমত র র ক ষমত য গ কর ত র জন আইন র উমর র সরক র র ওপর ক আইন ক আমল প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
অস্ট্রেলিয়ার কাছে রেকর্ড রানও নিরাপদ নয়!
ওয়ানডে ক্রিকেটে তারা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। কেন তারা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন তারই আরেকটি প্রমাণ মিলল চ্যাম্পিয়নস ট্রফির মঞ্চে। ইংল্যান্ডকে স্রেফ নাকানিচুবানি খাইয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির যাত্রা শুরু করেছে অস্ট্রেলিয়া।
লাহোরে দুই দলই ইতিহাসের পাতায় নিজেদের জড়িয়ে নিয়েছে। ইংল্যান্ড আগে ব্যাটিং করে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ইতিহাসে সর্বোচ্চ দলীয় রান ৩৫১ জমা করে। এই রানও অস্ট্রেলিয়ার কাছে নিরাপদ নয়। পাল্টা জবাব দিয়ে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ জিতেছে ৫ উইকেটে, ১৫ বল হাতে রেখে।
ইংলিশ ওপেনার বেন ডাকেট চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান করেছিলেন প্রথম ইনিংসে। ১৬৫ রানের ইনিংস খেলেন। তার দেড়শ’র জবাব সেঞ্চুরিতে দিয়েছেন জশ ইংলিস। তাতেই অস্ট্রেলিয়ার বিজয়ের রূপকথা লিখা হয়ে যায়।
আরো পড়ুন:
সাকিবসহ ১০৪ ক্রিকেটারের দলবদল সম্পন্ন, আগামীকাল করবেন তামিম
পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের কোনো উত্তাপ টের পাচ্ছে না ভারত!
অজি দলে নিয়মিত একাধিক ক্রিকেটার নেই। কামিন্স, স্টার্ক, মার্শ, হ্যাজেলউড, স্টয়নিসকে ছাড়া অস্ট্রেলিয়া দলটি কেমন হবে তা নিয়ে চিন্তায় ছিল সমর্থকরা। কিন্তু স্কোয়াডের গভীরতা যে এতোটা বেশি তা কেউ ভাবতে পেরেছিল?
তার ওপরে ট্র্যাভিস হেড (৬), অধিনায়ক স্মিথ (৫) ও মার্নাস লাবুসানে (৪৭) ফেরার পর সাড়ে তিনশর বেশি রান তাড়া করা যাবে এমন ভাবনার লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল। কিন্তু পাঁচে নামা জশ ইংলিস সব হিসেব পাল্টে দিলেন। তাকে যোগ্য সঙ্গ দিলেন অ্যালেক্স ক্যারি। দুজন মিলে পঞ্চম উইকেটে ১১৬ বলে ১৪৬ রানের জুটি গড়েন।
ক্যারি ফিফটি ছুঁয়ে ৬৯ রানে ফিরে গেলে ইংলিস তুলে নেন ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রথম সেঞ্চুরি। তাতে লিখা হয়ে অনবদ্য এক বিজয়ের গল্প। ৮৬ বলে ৮ চার ও ৬ ছক্কায় ইংলিস তার ইনিংসটি সাজান। এছাড়া ম্যাক্সওয়েল ১৫ বলে ৩২ রান করেন ৪ চার ও ২ ছক্কায়।
এর আগে বেন ডাকেটের একক ব্যাটিং প্রদর্শনীতে রানের পাহাড়ে চড়ে ইংল্যান্ড। ওপেনিংয়ে নেমে ৪৮তম ওভার পর্যন্ত ক্রিজে ছিলেন। প্রায় পৌনে চার ঘণ্টার ইনিংসে ১৭ চার ও ৩ ছক্কা হাঁকিয়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১৬৫ রানের ইনিংস খেলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে তাকে যোগ্য সঙ্গ দেন জো রুট। ১৫৫ বলে ১৫৮ রান যোগ করেন দুজন। রুট ৭৮ বলে ৬৮ রান করে ফিরে গেলেও ডাকেট তুলে নেন ওয়ানডে ক্রিকেটের তৃতীয় সেঞ্চুরি।
এই দুই ব্যাটসম্যান বাদে বিশের ঘর পেরিয়েছেন কেবল জস বাটলার ও জোফরা আর্চার। বাটলার ২১ বলে ২৩ ও আর্চার ১০ বলে ২১ রান করেন। শেষ দিকে আর্চারের অতি গুরুত্বপূর্ণ রানের সুবাদে ইংল্যান্ডের রান সাড়ে তিনশ পেরিয়ে যায়।
ইনিংসের শুরুতে অ্যালেক্স ক্যারি দুর্দান্ত ক্যাচ নিয়ে আলো কেড়ে নেন। বেন ডোয়ার্শুইসের বলে মিড অনে ক্যাচ দিয়েছিলেন। সেখানে ক্যারি ডানদিকে ঝাঁপিয়ে এক হাতে অসাধারণ দক্ষতায় বল তালুবন্দি করেন।
অস্ট্রেলিয়ার বোলিংয়ে তেমন ঝাঁজ ছিল না। ডোয়ার্শুইস ৬৬ রানে ৩ উইকেট নেন। এছাড়া ২টি করে উইকেট নেন অ্যাডাম জাম্পা ও মার্নাস লাবুসানে।
প্রথমে রেকর্ড রান গড়া। সেই রান তাড়া করে জয়। দুই ইনিংসে দুটি অনবদ্য সেঞ্চুরি। সব মিলিয়ে বলা যায় ওয়ানডে ক্রিকেট দারুণ একটি দিন কাটাল। আর ক্রিকেটপ্রেমীরাও সেটা মনভরে উপভোগ করলো।
ঢাকা/ইয়াসিন/আমিনুল