বাংলাদেশের ৪১টি ভাষার মধ্যে বিপদাপন্ন মাত্র ৩টি ভাষা সংরক্ষণের কাজ শুরু করতে পেরেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। যদিও কাজটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিপন্নপ্রায় এই তিন ভাষা হচ্ছে রেংমিটচ্য, কন্দ ও পাত্র (লালেংথার)। এর কোনো একটি ভাষায় মাত্র দুজন কথা বলেন, কোনো ভাষায় ছয়জন। এই ভাষাগুলো যে বিপন্ন, তা জানা গিয়েছিল ২০১৬ সালে ভাষা সমীক্ষা শেষে। অথচ তা নিয়ে কাজ শুরু করার প্রস্তুতি নিতেই চলে গেছে সাত বছর। এর মধ্যে ভাষাগুলো আরও বিপন্ন হয়েছে। কমে গেছে সে ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যাও।

১৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই তিন বিপন্ন ভাষার শব্দ সংরক্ষণ করা হয়েছে। এবার ডিজিটাইজেশনের কাজ শুরু হবে। দেশের বিপন্ন অন্যান্য ভাষার মধ্যে আছে খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুন্ডারি, খুমি, পাংখোয়ার মতো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আরও ১৪টি ভাষা। ভাষাগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না গেলে চিরতরে মুছে যাবে। এসব ভাষার লিপি উদ্ধার, লিপি না থাকলে নতুন লিপি প্রণয়ন এবং সংরক্ষণের দায়িত্ব মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের। এ ভাষা ব্যবহারকারীরা যাতে ভাষাটি ব্যবহার করতে পারেন, সে ব্যবস্থাও তাদের করার কথা।

দেশের বিপন্ন অন্যান্য ভাষার মধ্যে আছে খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুন্ডারি, খুমি, পাংখোয়ার মতো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আরও ১৪টি ভাষা। ভাষাগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না গেলে চিরতরে মুছে যাবে।

ভাষা নিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের দেশব্যাপী ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজ শেষ হওয়ার পর গত আট বছরে তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে মাত্র একটি। তা–ও তা জনসাধারণের হাতের নাগালে পৌঁছায়নি। বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজ নিয়ে প্রকাশের কথা ছিল মোট ২০টি খণ্ড। সে গবেষণায় জানা গিয়েছিল বাংলাদেশের ৪১টি ভাষার মধ্যে ১৬টির নিজস্ব লিপি রয়েছে। বাকি ২৫টি ভাষা লিপিহীন।

মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের আরেক দায়িত্ব লিপিহীন ভাষাগুলোর জন্য লিপি প্রবর্তন করা। এ ব্যাপারে এখনো কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। দেশের বিপন্ন ভাষা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে কাজে গতি না থাকলেও শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি ছয়টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় ভাষান্তর করে গত বছর প্রকাশ করেছে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট।

এ বছরের অমর একুশে বইমেলায় এ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বসাহিত্যের সেরা গল্প সংকলনের বই। এতে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার জনপ্রিয় ১৪টি উল্লেখযোগ্য গল্প বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। এই অনুবাদের কাজটি করেছেন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন শাখার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এর মধ্যে মাত্র একজনের অনুবাদের অভিজ্ঞতা আছে বলে জানা যায়।

ভাষা নিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের দেশব্যাপী ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজ শেষ হওয়ার পর গত আট বছরে তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে মাত্র একটি। তা–ও তা জনসাধারণের হাতের নাগালে পৌঁছায়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আধুনিক ভাষা নিয়ে কাজ করা একজন শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের কাজ বাংলাকে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এ জন্য ভাষা নিয়ে কাজ করে, এমন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। যৌথভাবে কাজ করতে হবে। সে দেশের ভাষায় বাংলা সাহিত্য অনূদিত হতে হবে। তা না করে উল্টো অদক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে বাংলা অনুবাদে বই প্রকাশ হচ্ছে দ্রুত সময়ে কাজ দেখানোর চেষ্টা। তিনি আরও বলেন, নামের সঙ্গে ‘আন্তর্জাতিক’ শব্দটি থাকলেও আদতে বিশ্ব পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির সংযোগ দুর্বল। সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠানটির উল্লেখযোগ্য কোনো অর্জন নেই।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ বাঙালির অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। এর ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন পাস হয়। এক বছর আগে, ২০১১ সালের মাঝামাঝি শুরু হয় জনবল নিয়োগ ও ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় অবস্থিত সুরম্য এই প্রতিষ্ঠানটি ইউনেসকোর দ্বিতীয় গ্রেডের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

নামের সঙ্গে ‘আন্তর্জাতিক’ শব্দটি থাকলেও আদতে বিশ্ব পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির সংযোগ দুর্বল। সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠানটির উল্লেখযোগ্য কোনো অর্জন নেই।নাম প্রকাশ না করার শর্তে আধুনিক ভাষা নিয়ে কাজ করা একজন শিক্ষকগবেষণায়ও নেই, বরাদ্দেও নেই

মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের দুর্বলতার তালিকায় আছে গবেষণা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রসঙ্গও। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন-২০১০ অনুযায়ী, এই ইনস্টিটিউটের ২৩টি দায়িত্ব পালন করার কথা। এর মধ্যে প্রথম দায়িত্ব ‘দেশে ও দেশের বাইরে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ।’ প্রতিষ্ঠানের আইন অনুসারে দ্বিতীয় দায়িত্ব ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও ক্ষুদ্র জাতিসমূহের ভাষা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, এ–সংক্রান্ত গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা’।

গত এক বছরে এই প্রতিষ্ঠান থেকে বিশ্বসাহিত্যের সেরা গল্প ছাড়া প্রকাশিত হয়েছে বার্ষিক প্রতিবেদন, ১২ পৃষ্ঠার ত্রৈমাসিক পত্রিকা মাতৃভাষা-বার্তা, আর দুটি ভাষা তথ্য সংগ্রহ প্রতিবেদন। এদিকে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রতিবেদন বলছে, গবেষণা অনুদান খাতে একটি টাকাও খরচ করতে পারেনি এই প্রতিষ্ঠান। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান হলেও গবেষণা খাতে বরাদ্দ উৎসব অনুষ্ঠানের বরাদ্দের তিন ভাগের এক ভাগ।

মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের উপপরিচালক (অর্থ, প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা) শেখ শামীম ইসলামের দেওয়া তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২০২৫) প্রতিষ্ঠানের মোট বাজেট ৮ কোটি ১ লাখ ৮১ হাজার টাকা। এর মধ্যে অনুষ্ঠান ও উৎসবাদি খাতে বরাদ্দ দেড় কোটি টাকা, বেতন–ভাতা ১ কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা আর গবেষণার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ লাখ টাকা।

প্রতিষ্ঠানটি ভাষাবিষয়ক গবেষণার জন্য বৃত্তি চালু করেছে। এর আওতায় ১৩ জন গবেষক ভাষা নথিভুক্তকরণ, ভাষার হারিয়ে যাওয়া উপাদান সংরক্ষণ এবং অভিধান তৈরি নিয়ে কাজ করছেন। পোস্ট ডক, পিএইচডি, এমফিল, ফেলোশিপ ও প্রফেশনাল—এই পাঁচ ভাগে কাজ চলছে। তবে এই কাজ চলমান থাকার কথা গত বছরেও শোনা গেছে। এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণাপত্র উপহার দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।

গত এক বছরে এই প্রতিষ্ঠান থেকে বিশ্বসাহিত্যের সেরা গল্প ছাড়া প্রকাশিত হয়েছে বার্ষিক প্রতিবেদন, ১২ পৃষ্ঠার ত্রৈমাসিক পত্রিকা মাতৃভাষা-বার্তা, আর দুটি ভাষা তথ্য সংগ্রহ প্রতিবেদন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটেও অবশ্য প্রমাণ পাওয়া গেল জনগণের অর্থে পরিচালিত ভাষা সংরক্ষণের, প্রচার-প্রসারের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এ প্রতিষ্ঠানে একজন গবেষকেরও নিয়োগ হয়নি। গবেষকের কোনো পদই নেই। কর্মকর্তাদের তালিকায় ১৫ জনের মধ্যে ১১ জনই বিসিএস কর্মকর্তা।

এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে গত নভেম্বরে ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া অধ্যাপক মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অবকাঠামো নির্মাণেই অনেক সময় গেছে। প্রতিষ্ঠানে গত দুই বছরে সবচেয়ে বেশি কাজ হয়েছে। এখানে যে পরিমাণ জনবলসংকট, তা নিয়ে কীভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে প্রতিষ্ঠান? এরপরও যদি গত দুই বছরের দিকে তাকাই, আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সম্পূর্ণ জনবল পেলে অনেক কাজ করতে পারবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভাষা নিয়ে গবেষণা সব সময় সব দেশেই ধীরগতির কাজ। না বুঝেই মানুষ এ বিষয়ে মন্তব্য করেন।’

তবে এ বক্তব্যের বিপরীতে ভাষাবিদেরা সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেসের (সিআইআইএল) কর্মপদ্ধতি ও দ্রুত সময়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের উদাহরণ দিয়ে থাকেন। প্রতিষ্ঠানটি দেশটির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে ভাষাসংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ এবং সহায়তা দেয়। অপ্রধান ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষাগুলোকে সুরক্ষা দিতে এবং নথিভুক্ত করতে কাজ করে। বিষয়বস্তু তৈরির মাধ্যমে ভারতীয় ভাষার উন্নয়নে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে দেখা যায়, আগামী এপ্রিল মাসেই তারা ভাষা নিয়ে আয়োজন করছে কয়েক ধাপের আলোচনা অনুষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান যেসব ভাষা নিয়ে কাজ করে, সেসব ভাষার জন্য বিভিন্ন কোর্সের বইও প্রকাশ করে থাকে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটেও অবশ্য প্রমাণ পাওয়া গেল জনগণের অর্থে পরিচালিত ভাষা সংরক্ষণের, প্রচার-প্রসারের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এ প্রতিষ্ঠানে একজন গবেষকেরও নিয়োগ হয়নি। গবেষকের কোনো পদই নেই। কর্মকর্তাদের তালিকায় ১৫ জনের মধ্যে ১১ জনই বিসিএস কর্মকর্তা।বাংলার জন্য নেই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড

বিপন্ন ভাষা সংরক্ষণে বিশ্বব্যাপী উদ্যোগ (ইএলপি) বা ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম সংস্থার মতো আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত অংশীদারদের সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের। ভাষা ও প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে কাজ করেন, এমন শিক্ষকেরা বলছেন, বিশ্বের অন্তত ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে পড়ানো হয়। এদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার কথা কখনো ভাবেনি এই প্রতিষ্ঠান। অথচ ভাষার উৎকর্ষ সাধনের জন্যই তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট।

ব্রিটিশ কাউন্সিল যেমন ইংরেজি ভাষা শেখার জন্য, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ ফরাসি ভাষার জন্য বিগিনার, লার্নার, প্রি-ইন্টারমিডিয়েট বা স্কোরের একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে, এমন পদ্ধতি বাংলা ভাষার জন্য আজও নির্ধারণ করতে পারেনি মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাষার ইতিহাস, উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে তথ্যসংবলিত মাতৃভাষা পিডিয়া ১০ খণ্ডে প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫ খণ্ড প্রকাশ করতে পেরেছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও ক্ষুদ্র জাতিসমূহের ভাষা সংগ্রহ, সংরক্ষণসহ প্রয়োজনীয় গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পন্ন করা এবং বাংলাসহ অন্যান্য ভাষা আন্দোলনের তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণা এবং ইউনেসকোর সদস্য দেশসমূহের মধ্যে এ-সংক্রান্ত তথ্যাবলি পৌঁছে দেওয়া।’

অবকাঠামো নির্মাণেই অনেক সময় গেছে। প্রতিষ্ঠানে গত দুই বছরে সবচেয়ে বেশি কাজ হয়েছে। এখানে যে পরিমাণ জনবলসংকট, তা নিয়ে কীভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে প্রতিষ্ঠান? এরপরও যদি গত দুই বছরের দিকে তাকাই, আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সম্পূর্ণ জনবল পেলে অনেক কাজ করতে পারবে।অধ্যাপক মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান, ইনস্টিটিউটের পরিচালক

তবে ভাষা নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিতে হলে শুধু জনবল নিয়োগ করলে হবে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনের প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখানে বেশি প্রয়োজন ভাষাবিদ, গবেষক, যোগাযোগে দক্ষ ব্যক্তি। গত সরকারের আমলে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরে পরিণত হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।

ভাষা ও প্রযুক্তিবিশেষজ্ঞ মামুন অর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভৌত অবকাঠামো দারুণ কিন্তু সেই তুলনায় বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান এখনো উল্লেখযোগ্য নয়। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে ইউনেসকোর সাইনবোর্ডটি কাজে লাগাতে পারত।

এই গবেষকের মতে, প্রতিষ্ঠানটির নীতি প্রণয়নেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। প্রশাসন, গবেষণা ও আন্তর্জাতিক নীতিকৌশলের কাজকে আলাদা বিবেচনা করতে হবে এবং উপযুক্ত বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে এগুলো না করলে প্রতিষ্ঠানটি তার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে না।

মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভৌত অবকাঠামো দারুণ কিন্তু সেই তুলনায় বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান এখনো উল্লেখযোগ্য নয়। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে ইউনেসকোর সাইনবোর্ডটি কাজে লাগাতে পারত।ভাষা ও প্রযুক্তিবিশেষজ্ঞ মামুন অর রশীদ.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গত দ ই বছর ভ ষ র জন অবক ঠ ম ণ জনবল বর দ দ ক জ কর অন ব দ পর চ ল র জন য বছর র প রথম র একট

এছাড়াও পড়ুন:

বিলুপ্তপ্রায় ভাষা রেংমিটচ্য যেভাবে বেঁচে আছে

বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার সদর ইউনিয়নের তৈনখাল ঘেঁষে পাড়াটির অবস্থান। নাম ক্রাংসিপাড়া। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা এই জনপদে যাতায়াতের একমাত্র উপায় যন্ত্রচালিত নৌকা ও পায়ে হাঁটা পথ। বাঁশের ছোট ছোট মাচাং ঘরে থাকেন পাড়ার বাসিন্দারা। সবাই কথা বলেন ম্রো ভাষায়। তবে ব্যতিক্রম এই পাড়ার চার ব্যক্তি।

তাঁরা নিজেরা এক হলে ভিন্ন এক ভাষায় কথা বলেন। সেই ভাষা বোঝেন না তাঁদের পরিবারের অন্য সদস্যরা। না বোঝার কারণও আছে। ওই চারজনের মুখের ভাষা ম্রো ভাষার কোনো উপভাষা নয়। দেশি ও বিদেশি গবেষকেরা এই ভাষাকে একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। যার নাম ‘রেংমিটচ্য’।

ক্রাংসিপাড়ার চারজন ছাড়াও আরও তিনজন এই ভাষা জানেন। তাঁদের একজন থাকেন এই পাড়া থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে মেনসিংপাড়ায়। অন্যদের একজন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ওয়াইবতপাড়ার, আরেকজন কাইংওয়াইপাড়ার বাসিন্দা। সব মিলিয়ে দুই উপজেলার চারটি পাড়ার সাতজনের মধ্যেই টিকে আছে রেংমিটচ্য ভাষা। যাঁদের বয়স ৫৮ থেকে ৭৯ বছর। পারিবারিকভাবে চর্চা না হওয়ায় এই সাতজনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ভাষাটি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গবেষকেরা।

সিংরা জানান, একসময় পাড়ার ২৮টি পরিবারের মধ্যে রেংমিটচ্য ভাষার প্রচলন ছিল। এখন একটি পরিবারেও নেই। কেবল তাঁরা চারজন ভাষাটা জানেন। এ ছাড়া মেনসিংপাড়ার থোয়াইংলক ম্রো (৬১), নাইক্ষ্যংছড়ির ওয়াইবতপাড়ার মাংপুন ম্রো (৭৫) ও কাইংওয়াইপাড়ার মাংওয়ই ম্রো (৬৫) রেংমিটচ্য জানেন।

কেমন আছেন রেংমিটচ্য ভাষাভাষী মানুষজন, জানতে এই প্রতিবেদক গত বুধবার যান আলীকদমের তৈনখাল এলাকার ক্রাংসিপাড়ায়। এই পাড়ার সিংরা ম্রো (৫৮), মাংপুন ম্রো (৭৯) এবং একই নামের দুই নারী কুনরাও ম্রো (৭৪) ও কুনরাও ম্রো (৬৭) রেংমিটচ্য ভাষা জানেন। এই পাড়ার সবাই জুমচাষি। কাজ শেষে সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে এলে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে বাংলা ভালো বলতে পারেন সিংরা ম্রো। তিনি সেনাবাহিনীর করে দেওয়া একটি ছোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের রেংমিটচ্য ভাষা শেখান।

সিংরা জানান, একসময় পাড়ার ২৮টি পরিবারের মধ্যে রেংমিটচ্য ভাষার প্রচলন ছিল। এখন একটি পরিবারেও নেই। কেবল তাঁরা চারজন ভাষাটা জানেন। এ ছাড়া মেনসিংপাড়ার থোয়াইংলক ম্রো (৬১), নাইক্ষ্যংছড়ির ওয়াইবতপাড়ার মাংপুন ম্রো (৭৫) ও কাইংওয়াইপাড়ার মাংওয়ই ম্রো (৬৫) রেংমিটচ্য জানেন।

যেভাবে বিলুপ্তির পথে রেংমিটচ্য

ক্রাংসিপাড়ার কুনরাও ম্রো এবং মেনসিংপাড়ার থোয়াইংলক ম্রো জানান, কলেরা ও গুটিবসন্তের প্রাদুর্ভাবে ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে রেংমিটচ্য গোত্রের পাড়াগুলো জনবসতিশূন্য হয়ে পড়ে। অনেকে মারা যান, অনেক পরিবার পার্শ্ববর্তী ম্রো পাড়ায় গিয়ে বসবাস শুরু করে। সত্তরের দশকে ক্রাংসিপাড়াসহ কয়েকটি পাড়া গড়ে তোলে রেংমিটচ্য গোত্রের লোকজন। কিন্তু আশির দশকে পার্বত্য এলাকায় অশান্ত পরিস্থিতিতে এসব পাড়ার বাসিন্দারা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। বড় অংশ প্রতিবেশী জনগোষ্ঠী ম্রোদের সঙ্গে মিশে যায়; এরপর ধীরে ধীরে রেংমিটচ্য ভাষা ম্রো ভাষার আড়ালে চাপা পড়ে। এখন রেংমিটচ্য জানা মানুষ সাতজন থাকলেও এই ভাষায় কথা বলা কোনো পরিবার নেই। সাতজন আলাদা পরিবারে থাকেন। তাঁরা নিজেরা একত্র হলে রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বললেও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা ম্রো ভাষায় কথা বলেন।

তবে সরকারি উদ্যোগ না থাকলেও কয়েকজন ভাষাটি নিয়ে গবেষণা ও সংরক্ষণের কাজ করছেন। ডেভিড পিটারসন দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক ধ্বনিতত্ত্বে বর্ণমালা (ইন্টারন্যাশনাল ফোনেটিক অ্যালফাবেট) বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে ব্যাকরণ প্রণয়নের কাজ করছেন বলে তাঁর সহযোগী লেলুং খুমি জানিয়েছেন। এক দশক ধরে ভাষার শব্দভান্ডার সংগ্রহ করে ডিজিটাল আর্কাইভে সংরক্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন ডেভিড।আফসানা ফেরদৌস নামে বাংলাদেশি একজন গবেষকও রেংমিটচ্য ভাষার বিপন্নতা বিষয়ে গবেষণা করছেন।

উন্নয়নের চেয়ে সংরক্ষণের প্রচেষ্টা বেশি

যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ কলেজের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক ডেভিড পিটারসন ২০১৫ সালে বান্দরবান প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে রেংমিটচ্য ভাষাটি বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কার কথা জানান। এর পর থেকে গণমাধ্যমে লেখালেখি হচ্ছে। তবে ভাষাটি বিলুপ্তি থেকে রক্ষার জন্য এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। রেংমিটচ্য ভাষার ওয়ার্ডবুক লেখক ইয়াংঙান ম্রো বলেছেন, ভাষাটি উন্নয়ন ও প্রসারে সেনাবাহিনী একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। সেখানে সীমিত পরিসরে শিশুদের রেংমিটচ্য ভাষা শেখানো হচ্ছে।

তবে সরকারি উদ্যোগ না থাকলেও কয়েকজন ভাষাটি নিয়ে গবেষণা ও সংরক্ষণের কাজ করছেন। ডেভিড পিটারসন দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক ধ্বনিতত্ত্বে বর্ণমালা (ইন্টারন্যাশনাল ফোনেটিক অ্যালফাবেট) বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে ব্যাকরণ প্রণয়নের কাজ করছেন বলে তাঁর সহযোগী লেলুং খুমি জানিয়েছেন। এক দশক ধরে ভাষার শব্দভান্ডার সংগ্রহ করে ডিজিটাল আর্কাইভে সংরক্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন ডেভিড। আফসানা ফেরদৌস নামে বাংলাদেশি একজন গবেষকও রেংমিটচ্য ভাষার বিপন্নতা বিষয়ে গবেষণা করছেন।

এক সিংরা ম্রোর প্রচেষ্টা

রেংমিটচ্য নিয়ে পাঁচ বছর ধরে কাজ করছেন সিংরা ম্রো। ছেলেমেয়েদের ভাষাটি শেখাচ্ছেন, নিজের জনগোষ্ঠীর লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করছেন। তাঁর লক্ষ্য রেংমিটচ্য ভাষা জানা মানুষের সংখ্যা বাড়ানো ও একটি প্রজন্ম তৈরি করা।

সিংরা ম্রোর সঙ্গে গত বুধবার কথা হয় প্রথম আলোর। মাতৃভাষা বাঁচিয়ে তোলার কাজ কতটা এগিয়েছে, জানতে চাইলে তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘এখন আমি জুমচাষের কাজে আছি। নিজের বেঁচে থাকা ও ভাষা বাঁচানোর সংগ্রাম একসঙ্গে চলছে। পাড়ার ৪২ জন স্কুলগামী ছেলেমেয়ের মধ্যে অনেকে রেংমিটচ্য কিছু কিছু জানে। ভাঙা ভাঙা বলতেও পারে। তবে পরিবারে চর্চার সুযোগ এখনো গড়ে ওঠেনি।’

দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র খামলাই ম্রো রেংমিটচ্য ভাষা শিখছে। তার মা ও বাবা দুজনেই রেংমিটচ্য গোত্রের, কিন্তু তাঁরা কেউ এই ভাষা জানেন না। পরিবারে সবাই ম্রো ভাষায় কথা বলে। খামলাই ম্রো বলে, সে রেংমিটচ্য ভাষায় এক থেকে বিশ পর্যন্ত গণনা করতে পারে। ভাত, তরকারি ও মাছের নামও জানে। আরও শিখতে চায়।

রেংমিটচ্য ভাষা শেখার ও বাঁচিয়ে রাখার আগ্রহ দেখে সেনাবাহিনী বান্দরবান রিজিয়ন ও ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের উদ্যোগে ২০২৩ সালে ক্রাংসিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় করে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয়ে সিংরা ম্রোকে রেংমিটচ্য ভাষার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকদের সব খরচ সেনাবাহিনী চালায়।

রেংমিটচ্য গবেষক আফসানা ফেরদৌস আশার মতে, পারিবারিক ভাষায় উন্নীত করা গেলেই রেংমিটচ্য ভাষা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। কারণ, মানুষ ভাষা শেখে পরিবার থেকে। তারপর বর্ণমালা উদ্ভাবন ও ব্যাকরণ প্রণয়ন করা গেলে আরও বেশি সুরক্ষিত হবে। খুব স্বল্প মাত্রায় শিশুদের ভাষা শেখানোর সেই কাজ সিংরা ম্রো করছেন।

খামলাই ম্রো বলে, সে রেংমিটচ্য ভাষায় এক থেকে বিশ পর্যন্ত গণনা করতে পারে। ভাত, তরকারি ও মাছের নামও জানে। আরও শিখতে চায়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাকিস্তান এবার আরও দু্র্বল, বলছেন মাঞ্জরেকার
  • রাজধানীতে এক রাতে ছয় ডাকাতি
  • পদ্মাপাড়ে মুখে স্কচ টেপ প্যাঁচানো লাশটি ব্যবসায়ী বাসারের
  • বগুড়ায় ট্রাক-অটোরিকশা সংঘর্ষ: নিহত বেড়ে ৫
  • ঝিনাইদহে ৩ জনের গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার, দায় স্বীকার করে বার্তা
  • শিরোনামহীনের ‘প্রিয়তমা’ প্রশংসা কুড়াচ্ছে
  • ‘অভিযুক্ত’ চালক-সুপারভাইজারকে আসামি না করায় প্রশ্ন বাদীর
  • ভুল বানানে ভরা ভাষা দিবসের প্ল্যাকার্ড, ফেসবুকে সমালোচনা
  • দিনাজপুরে ৮ সহস্রাধিক ডাকটিকিট নিয়ে প্রদর্শনী, দর্শনার্থীদের ভিড়
  • বিলুপ্তপ্রায় ভাষা রেংমিটচ্য যেভাবে বেঁচে আছে